স্কুল থেকে বেরিয়ে দু চার পা এগোতেই ডানপায়ের কোলাপুরি স্যান্ডেলের স্ট্রিপটা হঠাৎ খুলে গেল। পায়ের দিকে চেয়ে একটা বিরক্তিসূচক অভিব্যক্তি বেরিয়ে এলো স্মিতার। উফ, আজকেই এটা হতে হল! দিদি কল করেছিল। ফেরার পথে একবার ওর বাড়িতে যেতে হবে। ফোনের মধ্য দিয়ে ওর ভেসে আসা গলায় বেশ উদ্বিগ্নতার ছোঁয়া ছিল। ও বলছিল, সামনাসামনি না হলে নাকি এর কারণ বলতে পারবে না ও। দিদির এই স্বভাবটা এক্কেবারে মায়ের মতো, লোককে টেনশনের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখতে ভালোবাসে। ভাবতে ভাবতে ডান পাটাকে জুতো সমেত ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে পাশের আমগাছটার তলায় এগিয়ে গেল স্মিতা। ছাতাটা বন্ধ করে কাঁধের ব্যাগে আলগোছে ওটা গুঁজে দিল। তারপর কিছুটা নিচু হয়ে ডানপায়ের জুতোটা খুলে হাতে নিতে গিয়েই অপর এক জোড়া পা চোখে পড়ল। তাতে বেশ একটু চমকেই উঠল স্মিতা।
“ওহ্, আপনি?” তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হতবিহ্বল প্রশ্ন স্মিতার।
“অন্য কাউকে আশা করেছিলেন নাকি?” গোঁফের আড়ালে মৃদু হেসে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সুমন্ত।
“আপাতত একটা মুচিকে ধারেকাছে আশা করছি।” জুতো জোড়া সামলে একরাশ বিরক্তি নিয়ে গম্ভীর গলায় উত্তর দিল স্মিতা।
“তাকে সামনের বটতলার মোড়ে পেয়ে যাবেন। অতটা পথ যেতে খুব অসুবিধা হলে, আমি কিছু সাহায্য করতে পারি।” কথাবার্তা বাড়ানোর অজুহাত ধরল বছর চল্লিশের সুমন্ত।
উফ, কোন কুক্ষণে যে স্মিতা রুবিকে ওর জীবন ইতিহাস বলতে গিয়েছিল সেদিন, কে জানে! আসলে মায়ের মৃত্যুর পরের হঠাৎ শূন্যতাটা ওকে বিরহের চেয়েও বেশি অজ্ঞাত অপরাধবোধে পিষছিল। কতকটা যন্ত্রণাবোধ থেকেই সেদিন কথাগুলো বেরিয়ে এসেছিল রুবির সামনে। তার জন্য আজ এগারো মাস ধরে মাশুল দিতে হচ্ছে ওকে। পেটপাতলা রুবির এমনিতেই ঘটকালি করার সখ। তাই বিলম্ব না করে ও সুমন্তের কানে ঢেলে দিয়েছিল স্মিতার একাকীত্বের ইতিহাসটাকে। সেদিন থেকে বিপত্নীক সুমন্ত খুব আগ্রহ সহকারে নিরলস চেষ্টা করে চলেছে। স্মিতা ওদের কোনোভাবেই বোঝাতে পারে নি যে, ও মাঙ্গলিক মানেই যেকোনো মাঙ্গলিক পুরুষ ওর জীবনে এন্ট্রি নিতে পারে.. এ ভাবনাটা সম্পূর্ণ ভুল।
“খুব কষ্ট হচ্ছে কি?” সুমন্তর খেজুরে আলাপ অব্যাহত। রোজ রোজ এরকম বাহানা পাওয়া যায় না। কপালজোরে আজ স্মিতার জুতোর স্ট্রিপ ছিঁড়েছে। আপ্রাণ সাহায্য করার তাগিদ তাই সুমন্তকে বিড়ালের শিকে ছেঁড়ার লক্ষ্যে অবিচল করে তুলেছে। বড্ড বিরক্তি লাগল স্মিতার। মনে মনে ভাবল, বটতলায় জুতো সেলাই করানো মানে, আরও মিনিট পনেরো এই মাঝবয়সী সঙ্গী অনুসন্ধানকারী পুরুষটির সঙ্গ নিতে হবে। তার চেয়ে রিক্সা ধরে আপাতত সোজা দিদির বাড়ি চলে যাওয়াটাই ভালো। পরে দিদির কোনও জুতো পরে ম্যানেজ করে নেবে ব্যাপারটা।
“খুব কষ্ট হচ্ছে কি?” স্মিতার মুখের বিরক্তিসূচক ভাঁজগুলো দেখে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটাল সুমন্ত।
“রিক্সা ... এই রিক্সা ...” উঁচু গলায় ডাক পাড়ল স্মিতা।
কতকটা হকচকিয়ে হতাশার সুরে বলে উঠল সুমন্ত “মুচি?”
“পরে দেখছি। আজ একটু তাড়া আছে।” বলে গটগটিয়ে রিক্সার দিকে পা বাড়াল স্মিতা।
২
ঘর্মাক্ত কাঁধ, গলা শাড়ির আঁচল দিয়ে শুষ্ক করতে করতে কলিংবেল প্রেস করল স্মিতা।
“আয়” দরজা খুলে গম্ভীরমুখে বোনকে সম্বোধন করল ঈশিতা।
“তোর একটা চপ্পল দিস তো, পরে বেরোব। জুতোটা স্কুল থেকে বের হতেই হঠাৎ করে ছিঁড়ে গেল। মুচির কাছে আর যাইনি। সুমন্তবাবুর বকবকানি শুনতে হচ্ছিল। উফ, বিরক্তিকর। লোকে সঙ্গী খুঁজতে এমন বেপরোয়াভাবে সচেষ্ট হয়, জানতাম না।”
“সবার জীবনে তো আর, তোর মতো ভীষ্মের পণ থাকে না।”
দিদির কথায় অভিমানের সঙ্গে আজকাল যেন একটা অভিযোগের সুর শুনতে পায় স্মিতা। কী জানি হয়তো মায়ের অসুস্থতার কারণ হিসেবে মনে মনে বোনকেই দায়ী করে ও। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকল স্মিতা। অতঃপর হাতমুখ ধুয়ে নিয়ে দু'কাপ চা নিয়ে এসে বসল দুই বোন।
“বল, কী কথা বলবি! ফোনে তোকে বেশ টেন্সড লাগছিল।” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দিদির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল স্মিতা।
“আজ সকালে সন্দীপদার কাছে গিয়েছিলাম।” দিদির কথার শুরুতেই, এবার ওর ডাকার কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারল স্মিতা। আর যথারীতি ওর সন্দেহ প্রমাণিত হল ইশিতার পরবর্তী কথাগুলোতে।
“রূপের সাথে মৌবনীর কোষ্ঠী মেলানোর জন্য। সন্দীপদা বলল, রূপ মাঙ্গলিক। মৌবনীর সাথে বিয়ে হলে মৌবনীর জীবন সংশয় হতে পারে। আমাদের যে একটাই মেয়ে রে ...” শেষ কথাগুলো বলার সময় গলা বুজে আসছিল ঈশিতার।
চায়ের কাপটা হাত থেকে বিছানার উপর নামিয়ে রাখল স্মিতা। এই ‘মাঙ্গলিক’ শব্দটাকে ঘিরে ছারখার হয়ে গেছে ওর জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম স্বপ্ন, প্রথম শিহরণগুচ্ছের স্মৃতিগুলো। আজ আবার সেই শব্দ এসে থাবা বসাল ওর প্রিয় মৌবনীর জীবনে!
বোনকে চুপ থাকতে দেখে ঈশিতা কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করল “মৌবনীকে তুই জানিস। ও এসব বিশ্বাস করে না। বড্ড একগুঁয়ে জেদি..কতকটা ...” বলে নিজেকে সামলে নিল ঈশিতা।
স্মিতা দিদির ইঙ্গিত বুঝে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল “আমায় কেন ডেকেছিস?”
“আমার চেয়েও ও তোকে আপন মনে করে। বন্ধুর চোখে দেখে। ওর মানি ওকে কিছু বললে, ও ফেলতে পারেনা। তাই ...”
“তাই, আমি ওকে রূপের থেকে দূরে সরে আসতে বলব? এক জোড়া একুশ বছরের স্বপ্নে ঘেরা চোখে আমি কোষ্ঠীগত বিচারের বিষ মিশিয়ে দেব? তাই বলতে চাইছিস?”
দিদিকে থামিয়ে দিয়ে বেশ উত্তেজনার সঙ্গে কথাগুলো বলে উঠল স্মিতা।
“বিকাশের মৃত্যুর পরও তুই ....”
বাহাত তুলে দুচোখের পাতা বলপূর্বক বন্ধ করে দিদিকে থামার ইঙ্গিত দিল স্মিতা।
“প্লিজ দিদি, আমি চাই না কেউ আমার পনের বছর আগের ভাঙাচোরা স্মৃতিগুলোকে নিয়ে আবার নতুন করে কাটাছেঁড়া করুক। আর তাছাড়া আমি কারও বিশ্বাসকে আঘাত করতে চাইনা। নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। তোরা যেমন বিশ্বাস করিস, তেমন করেই মৌবনীকে বোঝা। আমায় এসবের মধ্যে টানিস না। নিজের স্বপ্নভাঙ্গার ব্যথা এত বছর পরেও মাঝেমধ্যে আমার মনে এসে উঁকি দেয়। এই অবস্থায় মৌবনীর কষ্ট দেখার মতো মানসিক সাহস বা সামর্থ আমার নেই।”
“তোর কী মনে হয়? মেয়ের মন ভাঙলে আমার কষ্ট হবে না? তোর বেলাতে মায়ের কষ্ট হয়নি? সেই কষ্টতেই তো মা সারাটা জীবন গুমরে থেকে ...” থেমে গেল ঈশিতা।
“সব বুঝি দিদি। তোদের সবার কষ্টটা আমি বুঝি। কেবল তোদেরকেই আমার কষ্টটা বোঝাতে পারিনি আমি। এ আমার অক্ষমতা। আমার ...” বুজে আসা গলায় কথাটাকে অসম্পূর্ণ রেখেই বেরিয়ে যায় স্মিতা। ঈশিতার বাড়ি থেকে ওর ভাড়া বাড়ি পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। ছেঁড়া জুতোটাকেই পায়ে গলিয়ে নিয়ে সেই পথ ধরে স্মিতা। পুরোটা পথে পায়ের দুই আঙুলের চাপে নিজের জুতোটাকে জবরদস্তি পায়ের সাথে সেঁটে রাখতে চায় ও। আর চোখদুটোকে কড়া গ্রীষ্মের আকাশের মতো খটখটে শুকনো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। পাছে মাঝরাস্তার কোলাহল ওর প্রতি করুণার দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে।
৩
চাবি দিয়ে তালা খুলে বারান্দাতে পা দিতেই স্মিতার চোখের পাতায় অবাধ্য বর্ষা নেমে এল। বারংবার ওর মনে হয়, ও সব ভুলে থাকতে চাইলেও নিয়তি ওর চরম শত্রু হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। বর্তমান মুহূর্তগুলোর ধাক্কাধাক্কিতে যখন-তখন রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ওর সময়ের ধূলায় ঢেকে যাওয়া অতীত। তখন স্মৃতির অ্যালবাম বিনা অনুমতিতেই ওর মন ও চোখের সামনে পাতা উলটাতে শুরু করে। অতঃপর যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্তগুলো ফ্ল্যাশব্যাকের মতো এক এক করে ফুটে উঠতে থাকল ওর মানসপটে। ক্লান্ত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানার চাদরের একাংশ খামচে ধরে মেঝের উপর বসে পড়ল স্মিতা। মাথাটাকে হেলিয়ে দিল বিছানার দিকে। পনের বছর আগের দিনগুলো আজ হঠাৎই যেন জবরদস্তি ঘিরে ধরল ওর অস্তিত্বকে।
তখন ওর বাবা চাকুরী সূত্রে বেনারসে ছিলেন। ওরা স্কুল কলেজের ছুটিতে মায়ের সাথে ওখানে যেত। এই যাতায়াত করতে করতেই বাবার অবাঙালি বন্ধু ভরত কাকুর ছেলে বিকাশের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল স্মিতার। ঈশিতার তখন কলকাতায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মৌবনী খুব ছোটো ছিল। স্মিতার চেয়ে প্রায় এগার বছরের বড় ছিল ঈশিতা।
বিকাশের সঙ্গের আলাপটা দু তিন বছরের মধ্যেই আপনি আজ্ঞে'র বেড়া ডিঙ্গিয়ে তুমি'র গভীর অনুভবে ডুব দিয়েছিল। স্মিতার জীবনের প্রথম প্রেমের উত্তাপ, প্রথম ভালোবাসার স্পর্শ, প্রথম কোনও পুরুষের হৃদয়ে নিজের প্রতিমূর্তি দেখার আনন্দ ... সবটাই হয়েছিল বিকাশকে ঘিরে। সেসময় কলকাতা থেকে বছরে দুবার বেনারসে যওয়ার টানটা যেন ওকে সারাটা বছর তারিখ গুনে রাত জাগিয়ে রাখত।
অতঃপর বাবার রিটায়ারমেন্টের সময় বিকাশের বাড়ি থেকেই প্রথম ওদের সম্পর্কের স্বীকৃতি দানের প্রসঙ্গটা উঠেছিল। শুরু থেকেই স্মিতার মায়ের তীব্র আপত্তি ছিল এই ব্যাপারে। তাঁর মতে অবাঙালি ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। ওদের রীতিনীতি আদবকায়দা আলাদা, খাওয়াদাওয়া ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন ... এসব বিবিধ ভিন্নতার অজুহাতে তিনি তাঁর ভিন্নমতের জোরালো দাবী জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্মিতার বাবার আপত্তি ছিল না। বাবার মত পেয়ে যখন স্মিতা সবে নিজের স্বপ্নকে বেনারসি মুড়ে সাজতে দেখছিল, সেসময় নিয়তি ঘটাল এক অঘটন। হঠাৎ পরপর দুটো কিডনি খারাপ হয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন স্মিতার বাবা। কেটে গেল একটা বছর। এই সময়ে বিকাশের কলকাতায় যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। ঠিক সেসময়ই স্মিতার মা ঘরে জানিয়েছিলেন যে, বিকাশের সঙ্গে স্মিতার কোষ্ঠী মিল হয়নি। স্মিতা নাকি মাঙ্গলিক। তাই মাঙ্গলিক ছেলে ছাড়া অন্যকারও সঙ্গে স্মিতার বিয়ে দিলে নাকি কয়েক বছরের মধ্যে ওর বৈধব্যদশা নিশ্চিত। বিকাশ ও স্মিতা যে উভয়ই এসবে অবিশ্বাসী, সে কথাও ওরা জানিয়েছিল স্মিতার মাকে। কিন্তু স্মিতার মায়ের একটাই বক্তব্য ছিল, তার ছোটো মেয়ের জীবনে এমন কিছু হোক, তা ও চায় না।
একবার বিকাশ কলকাতায় এলে ওর সঙ্গে রীতিমতো খারাপ ব্যবহার করেছিলেন স্মিতার মা। সেসময় বিকাশ কলকাতা ছাড়ার আগে, দুজনের হৃদয়ে সম্পর্কটাকে আরও বিশ্বস্ত ও শক্তপোক্ত করার তাগিদে একটা ছোটো অচেনা মন্দিরে গিয়ে উঠেছিল। চুপিসারে সিঁদুর আর মাল্যদানের মধ্য দিয়ে একে অপরের জীবনে প্রেমের স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। এরপরের কিছুদিন ছিল স্মিতার জীবনের স্বর্ণালি সময়। বিকাশ বেনারসে আর ও কলকাতায় থাকলেও, মনে হত এইতো একটা নীল সাদা আকাশ ... ভালোবাসার আচ্ছাদনের মতো ছেয়ে রয়েছে দুজনের মাথার উপর। এই বিশ্বাস ওদের মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি জোগাত। মনে হত, পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর দামী সুখটা তখন একমাত্র বিকাশ আর স্মিতার মধ্যে একটা অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে আটকে গেছে। সেই সুতোটা যে নিয়তির ইশারার কাছে কতটা কমজোর ছিল, সেটা তখন প্রেমে ডুবে থাকা দুটো মন কোনওভাবে টেরও পায় নি।
৪
কলেজ থেকে ফিরে মায়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি করে গোমড়ামুখে বসেছিল মৌবনী। ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, যে ওর মা রূপকে এত পছন্দ করা সত্ত্বেও আজ তার থেকে ওকে দূরে সরে থাকতে বলছে। মুহূর্তে মৌবনীর মনে হচ্ছিল, ওর মা গ্রামের লোকেদের মতো অযৌক্তিক সব তথ্যকে নির্ভর করে এঁড়ে তর্ক জুড়তে চাইছিল ওর সঙ্গে। তবে ও কাঁদেনি। ওর বিশ্বাস ... ওর আর রূপের সম্পর্কটা কোনভাবেই নষ্ট হতে পারে না। আর কেউ ওর পাশে না থাকলেও, ওর মানি ওকে এ বিষয়ে সাপোর্ট করবেই।
ভাবতেই মৌবনীর মনে পড়ল মায়ের একটা কথা ... ‘আরেকটা জীবন এই মাঙ্গলিক শব্দের হাঁড়ি কাঠে বলী হোক, আমি চাই না। আমি চাই না আমার একমাত্র মেয়েটার জীবন বিকাশের মতো ...’ বলে থেমে গিয়েছিল। কথাটা মনে করতেই, বিকাশ নামটা কেমন যেন শোনা শোনা মনে হল মৌবনীর। কার মুখে যেন এই নামটা শুনেছিল ও ... ভাবতেই মনে পড়ল, একদিন দিদুন মানিকে বলছিল ‘বিকাশ তো আর নেই, তুই কার অপেক্ষায় নিজেকে এভাবে তিলেতিল করে শেষ করছিস?’
তখন দিদুন খুব অসুস্থ ছিল। মৌবনী সকালে বিকালে যেত দেখতে। সেই সময় একদিন ঘরে ঢোকার মুহূর্তে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ও শুনেছিল কথাটা। তবে কি বিকাশই ছিল মানির ভালোবাসা? যার জন্য মানি আর বিয়েই করল না। মাঙ্গলিক শব্দের সঙ্গে বিকাশের সম্পর্কটাই বা কী? মানির সঙ্গে মৌবনীর বয়সের পার্থক্য চোদ্দ বছর হলেও দুজন বান্ধবীর মতো মেশে ওরা। এখনও মৌবনী স্মিতাকে বন্ধুর মতোই ‘তুই’ সম্বোধন করে। রূপের কথাটাও দু'বছর আগে প্রথম ওর মানিকেই জানিয়েছিল ও। এই দু'বছরে মানি, রূপ আর ও কত মুভি দেখতে গিয়েছিল। পুজোর আগে একসঙ্গে শপিং করেছিল। ওদের দুজনের মধ্যের এত খোলামেলা মনের বাতায়নেও মৌবনী কখনও মানিকে এই ‘বিকাশ’ নামক ব্যক্তির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো কোথাও ওর মনে হয়েছিল, মানি সেই স্মৃতির গহ্বরটাকে নিজেই এড়িয়ে চলতে চায়।
একগুচ্ছ অস্থির প্রশ্নকে মাথায় গুঁজে মানির বাড়ির দিকে হাঁটা দিল মৌবনী। পথে হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে দেখল রূপের ফোন।
“বিন মামার হঠাৎ একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আজ রাতে আমি হাসপাতালে থাকতে পারি। ফোন সাইলেন্স থাকবে।” ওপারে রূপের ভেজা গলায় উদ্বিগ্নতার ছাপ।
মৌবনী অনুভব করল রূপের মানসিক অবস্থাটা। ও জানত, রূপ বিন মামাকে কতটা ভালোবাসে। ওর মা স্থানীয় এক এনজিওতে ডাক্তার। সেখানেই দশ বছর আগে বছর চল্লিশের এই ভদ্রলোক এসেছিলেন। নিজের সম্পূর্ণ অতীতকে অজান্তে হারিয়ে ফেলার কারণে তার তখন নতুন নাম হয়েছিল বিন। শুরুর দিকে মানসিকভাবে নাকি অত্যন্ত বিপর্যস্ত ছিলেন মানুষটা। রূপ বলত, তাকে নাকি বিন কার্টুন চরিত্রের মতো দেখতে। মৌবনী অবশ্য দেখেনি কখনও। সবটাই রূপের মুখে শোনা। এরপর রূপের মায়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের ধীরে ধীরে একটা স্নেহের বাঁধন গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে চিকিৎসার মধ্য দিয়ে অনেকটা সুস্থ হওয়ায় পর গত কয়েক মাস ও রূপদের বাড়িতেই থাকতেন। কানে ফোনটা ধরে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উদ্বিগ্নচিত্তে প্রশ্ন করল মৌবনী “সেকি! কীভাবে? কখন?”
৫
অতীত অনুভূতির কবরে নিজেকে মেশাতে গিয়ে কখন যে নোনা জলের বন্যায় দুচোখে নিদ্রা নেমে এসেছিল, টের পায়নি স্মিতা। কলিংবেলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখল, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমেছে। মনের ভেতরের পুঞ্জীভূত অন্ধকারকে দীর্ঘশ্বাসের বাঁধনে দূরে সরিয়ে রেখে দরজার দিকে ধীরে পা বাড়াল স্মিতা। ততক্ষণে কলিংবেলটা আরও দুবার বেজে গেছে। আর তার দ্রুত ছন্দও স্মিতার পরিচিত। ও জানে মৌ এমন করে ঘনঘন বেল প্রেস করে।
“এত দেরি করলি যে দরজা খুলতে” দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই মৌবনীর অস্থির প্রশ্ন। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বিস্ময়কর নিচু গলায় বলে উঠল ও “কী হয়েছে মানি? তোর চোখমুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে? বাইরের শাড়ি পরে ... কোথাও বেরিয়েছিলিস নাকি?”
“নারে, স্কুল থেকে এসে শাড়িটা আর ছাড়া হয়ে ওঠেনি।” ধীর গলায় উত্তর দিল স্মিতা।
“এতক্ষণ কী করছিলিস?” মৌবনীর বিস্ময় তুঙ্গে।
“তেমন কিছুই না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চা খাবি? চা বসাই। আমিও খেয়ে একটু চাঙ্গা হব।” প্রসঙ্গ বদলাতে কথাটা বলল স্মিতা।
“তোর কি জ্বর টর এল নাকি?” কপালে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল মৌবনী।
“নারে, আজ কেন জানি মনটা ভালো লাগছিল না। পুরানো দিনের কথা মনে পড়ছিল। বাবার কথা, মায়ের কথা আর ...” অন্যমনষ্ক হয়ে থেমে গেল স্মিতা।
“আর কী মানি?”
“তুই বস। আমি চা করে নিয়ে আসছি।” বলে পেছন ঘুরতে গেলেই স্মিতার দুহাত ধরে মৌবনী ওকে বেডরুমের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর বলপূর্বক বিছানায় বসিয়ে বলে “বাকি কথাটা বল আমায়। অনেকদিন ভেবেছিলাম, তোকে কিছু প্রশ্ন করব। কিন্তু করতে পারিনি। আজ মায়ের মুখে একজনের নাম শুনে আবার প্রশ্নগুলো আমার মনে দানা বেঁধেছে।”
“কার নাম শুনেছিস?” সন্দিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করল স্মিতা।
“মানি তুই তো আমার বন্ধুর মতো। দেখ, আমি তোকে আমার সব মনের কথা বলি। তাহলে, তুই কেন এমন একা একা গুমড়াচ্ছিস? কেন একাকীত্বটাকে এত জাপটে ধরে থাকিস তুই?” মৌবনী ওর প্রিয় মানির হাতদুটোর উপর ভালোবাসার আদর বুলিয়ে বলল।
“তুই বললি না..কার নাম বলেছে তোকে দিদি” স্মিতার নিচুস্বরে প্রশ্ন।
“বিকাশ। ও কে মানি? একদিন দিদুনের মুখেও এই নামটা শুনেছিলাম আমি। তোর একাকীত্ব, বিকাশ, মাঙ্গলিক এসব শব্দের মধ্যের যোগসূত্রটা কী?”
“মাঙ্গলিক শব্দটা তো দিদি আশা করি বুঝিয়ে দিয়েছে তোকে।”
“হুঁ। সে তো মা অনেকভাবেই চেষ্টা করল বোঝাতে। আমার যদিও এ ব্যাপারে কিছু বোঝার আগ্রহ নেই। তবে যেটুকু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুঝেছি, তা হল কাপলদের মধ্যে যেকোনো একজনের এই মাঙ্গলিক নামক কোষ্ঠীগত রোগ থাকলে অপরজনের জীবনসংশয় হতে পারে। যত সব বোগাস যুক্তি। আরে আমরা কবে জন্মাব, কতদিন বাঁচব, কী করব ... এসব ভগবানের সৃষ্টি। তবে হ্যাঁ, আমাদের কর্ম দ্বারা অবশ্যই সে সৃষ্টির গতিবিধি নির্ধারিত হয়। তাতে অন্য মানুষের প্রভাবের প্রসঙ্গ অবান্তর।”
“তুই নিশ্চিত?” স্মিতার ফ্যাকাসে চোখে প্রশ্ন।
“১০০%। আমি যা পড়ব, যা লিখব, তাই দেখে আমায় স্যার নম্বর দেবেন। আমার পাশের বেঞ্চের স্টুডেন্ট পরীক্ষা হলে টুকলি করলে বা ভুলভাল লিখে ফেল করলে তাতে, আমার নম্বর কম বেশি হবে কেন?”
মৌবনীর ব্যাখ্যা শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইল স্মিতা। কত সহজ সরল যুক্তি ওর। কোথাও একটুকুও নড়বড়ে ফাঁকফোকর নেই। টানটান বাস্তব অভিজ্ঞতা নির্ভর। তবে কেন অদেখা অপ্রমাণিত ঘটনার ব্যাখ্যার ধোঁয়াশায় হাবুডুবু খায় মানুষ? মনে মনে ভাবল স্মিতা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মৌবনীর কাছে স্মিতা পনের বছর আগের ওর সেই স্বপ্নভাঙার কাহিনি বলতে শুরু করল।
৬
ক্যাবের জানলা দিয়ে হু হু করে বাতাস কেটে বের হয়ে যাচ্ছিল। স্মিতার দুচোখের হাল্কা দৃষ্টি মুহূর্তে ছুঁয়ে যাচ্ছিল রাতের স্নিগ্ধ কলকাতাকে। পাশাপাশি ওর মনের দ্বন্দ্বগুলো নীরবে মাথা কুটছিল মৌবনীর প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদে।
“তোর কাছে তো বিকাশ আঙ্কেলের বার্থ টাইম ছিল। তুই কোনওদিন কোনও জ্যোতিষীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলি, যে বিকাশ আঙ্কেলের নিজের কোষ্ঠীগত আয়ু কত ছিল? হয়তো দেখতিস তখন, সেই জ্যোতিষী বলতেন ... তার নিজেরই স্বল্পায়ু ছিল। কেন নিজেকে নিজের ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুর কারণ ভেবে সারাটা জীবন এমন করে কষ্ট পেলি? একবার ভাবত, দাদুও তো সেসময় মারা গিয়েছিলেন। তাই বলে কি কেউ দিদার কোষ্ঠী ঘেঁটে তখন তার কারণ খুঁজেছিল? এভাবে সারা পৃথিবী জুড়ে নিরন্তর জন্ম-মৃত্যুর চক্র ঘুরতে থাকে। আসল কথা কী জানিস তো, আমরা ততক্ষণ একটা ভাঙাচোরা আঁধারঘেরা বাড়িকে সেভাবে ভয় পাই না, যতক্ষণ না তার সম্বন্ধে প্রচারিত ভৌতিক রটনাটা আমাদের কানে আসে। তার মানেই কিন্তু সবক্ষেত্রে, ঘটনা আর রটনার মধ্যে যৌক্তিক যোগসূত্রের উপস্থিতি থাকে না।”
মৌবনীর কথাগুলো বহু বছর পর স্মিতাকে যেন নতুন করে ভাবতে, বুঝতে ও বিশ্বাস করাতে শেখাচ্ছিল।
পাশ থেকে ফোনে বলা মৌবনীর কথোপকথন ভেসে আসছিল স্মিতার কানে।
“সেকী রে! এসব কথা আগে বলিসনি তো আমায়! এমনও হয়? একজনের স্মৃতি এতবছর আগের একটা অ্যাক্সিডেন্টে চলে যাওয়ার পর আবার নতুন করে ফিরে আসতে পারে? সে তার নিজের অস্তিত্বকে নতুন করে চিনতে পারে? ভাবতেই কেমন একটা শিহরণ হচ্ছে আমার। আচ্ছা তুই রাখ এখন, আমরা আসছি। হ্যাঁ, এত রাতে একা আসব না বলেই তো মানি আসছে আমার সঙ্গে। যদিও বাড়িতে শুধু এটুকুই বলেছি যে, আজ মানির বাড়িতেই থেকে যাব।”
মৌবনী ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। গাড়িটা ট্রাফিক সিগনালে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাইপাসের দিকে মোড় ঘুরল। মৌবনী নিস্তব্ধতা ভেঙে মানির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল “আচ্ছা মানি, বিকাশ আঙ্কেলের অ্যাক্সিডেন্টের খবর তোকে কে দিয়েছিল? তোরা তো তখন কলকাতায় ছিলি?”
“ওর কাকা। ওই অ্যাক্সিডেন্টে বিকাশের বাবাও মারা গিয়েছিলেন সেদিন। দিল্লীতে এসে ওরা দুজনে বাসে করে জম্মুতে বেড়াতে যাচ্ছিল। তখনই পথে ...” বলে দুচোখ বন্ধ করে থেমে গেল স্মিতা। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে শুরু করল “আরও চার পাঁচজন মারা গিয়েছিল সেই অ্যাক্সিডেন্টে। সেসব টিভির নিউজে বলেছিল পরের দিন।”
“জানিস মানি রূপের এই বিন মামারও নাকি মারাত্মক এক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বহু বছর আগে। আর তার পর থেকেই ওর স্মৃতি চলে গিয়েছিল। সম্ভবত তার থেকেই একটা আতঙ্ক ওর মনের মধ্যে গেঁড়ে বসেছিল। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব আচরণ করতেন তিনি। এতগুলো বছর মানুষটা নিজের পরিচয় সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। আজ আবার অ্যাক্সিডেন্ট হল। মাথায় ভালোই চোট লেগেছে। ব্লিড হয়েছে প্রচুর। রূপের ভাগ্যিস একই ব্লাড গ্রুপ। তাই ওকে সঙ্গে সঙ্গে ব্লাড সাপোর্ট দেওয়া গেছে। তবে ডাক্তার বলছেন, ওর নাকি পুরানো মেমরি ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। আধো জ্ঞান আসার পর হিন্দিতে অস্পষ্টভাবে কীসব বলছেও। তবে এখনও সবটা পরিষ্কার নয় ডাক্তারের কাছে। সম্পূর্ণ সজ্ঞান অবস্থায় ফিরলেই নাকি বোঝা যাবে ব্যাপারটা।”
“রূপের বিন মামা নন-বেঙ্গলি?” স্মিতার সাবলীল প্রশ্ন।
উত্তর দেওয়ার আগেই মৌবনীর ফোনটা আবার বেজে উঠল। রূপের ফোন ধরে উত্তেজনায় বলতে থাকল মৌবনী “তাহলে সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এসেছে? কী বলছিস, কোন জায়গা ... বন্দীপুর ... বারানসী?”
মুহূর্তে একটা অবাধ্য আশার ঝিলিক অকারণে স্মিতার মনকে চঞ্চল করে তুলল। ম্যালেরিয়া জ্বরের কাঁপুনির মতো শিহরণসহ কেঁপে উঠল ওর সর্বাঙ্গ। অস্ফুট ঠোঁট দুটোর নড়াচড়ার মধ্য দিয়ে শুধু বেরিয়ে এল দুটো শব্দ
“বন্দীপুর ... বারানসী!”
৭
হাসপাতালে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে স্মিতার হৃদস্পন্দনের বেগ আরও দ্রুত হারে বাড়তে লাগল। চরম এক অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে ওর দুচোখ আনমনে অপরিচিত আহত মানুষটিকে খুঁজতে উদ্যোগী হয়ে উঠল। মৌবনীকে অতিক্রম করে তার দ্রুত পদচারণা প্রতি মুহূর্তে প্রকাশ করতে থাকল তার সেই অধৈর্য্য কৌতুহলকে।
রূপ দোতলার লম্বা করিডরের মুখেই দাঁড়িয়েছিল। স্মিতা আর মৌবনীকে দেখে এগিয়ে এসে হাস্যমুখে বলল “মৌ, মামা ওর আসল নামটা বলতে পেরেছে।”
সিড়ির শেষ ধাপটাতে পা দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল স্মিতা। ওর মনে হচ্ছিল যেন মাঙ্গলিক শব্দকে ঘিরে একটা চরম কঠিন পরীক্ষা ওর সামনে দুর্বোধ্য প্রশ্নপত্র খুলে বসেছে। এরপরের কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর নিয়তির অঙ্কে ‘পাশ ফেল’ শব্দদুটো আবার নতুন করে রেজাল্ট তৈরি করবে। এসব চিন্তার ঘোরে স্মিতার বুকের ভেতরের স্পন্দনগুলো যেন সরব হয়ে উঠছিল আরও। নির্বাক চোখে চেয়েছিল ও রূপের মুখের দিকে।
মৌবনী বলল “তাই?”
রূপ বলে চলেছে “বিকাশ। বিকাশ জৈন। মামা বারানসীতে থাকত রে! পনের বছর আগে জম্মু যাওয়ার পথে একটা অ্যাক্সিডেন্টে ... কি হল আন্টি, আন্টি? শরীপ খারাপ করছে তোমার?”
মুহূর্তে স্মিতার সারা শরীর অস্থির করে উঠল। খুব দ্রুততার সঙ্গে দুচোখে ভেসে উঠল কিছু ফ্ল্যাশব্যক ... বারানসীতে জাহ্নবীর তীরে হাত ধরে দুজনের একসঙ্গে থাকার শপথ গ্রহণ, কলকাতার মন্দিরে সিঁদূর দানের সময় একসঙ্গে জীবনপথে হাঁটার সিদ্ধান্ত, হঠাৎ ভেসে আসা অ্যাক্সিডেন্টের খবরে উচ্চারিত একটাই শব্দের অনুরণন ‘মাঙ্গলিক, তুই মাঙ্গলিক’... মায়ের গলা ... দিদির গলা ... অন্ধকার ... খুব প্রগাঢ় এক অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ওর অস্পষ্ট স্মৃতিগুলো। সব শেষ হয়ে গিয়েছিল কি আদৌ?? অবাধ্য বেপরোয়া প্রশ্নের ভিড়ে জ্ঞান হারাল স্মিতা।
মৌবনীর কাঁধে মাথা রেখে স্মিতা এলিয়ে দিল ওর অবশ শরীরটাকে। ঘটনার আকস্মিকতাতেও মৌবনী বুঝতে পারল সবটা। মানির ভেতরের অনুভবগুলোকে সাধ্যমতো ছুঁয়ে রীতিমতো ভয়ার্ত গলায় কেঁদে উঠল ও “মানি? মানি? .... শিগগিরই ডাক্তার ডাক রূপ।”
৮
পরবর্তী কয়েকঘন্টার মধ্যে হঠাৎই যেন দু'জোড়া ভালোবাসাময় ভবিষ্যৎ জীবন যাবতীয় অযৌক্তিকতাকে ধূলিসাৎ করে দিল। মনের গহীনে গড়ে তোলা ভালোবাসার মহীরুহের ছায়ায় চিরকালীন আশ্রয় পেল দুই জোড়া প্রণয় প্রজাপতি। ফিরে পেল বিশ্বাস। ফিরে পেল মনোবল।
ঘটনার ব্যাখ্যায় বোঝা গেল, সেদিনকার দুর্ঘটনায় বিকাশের মৃত্যুই হয়নি। ওর বডিও পাওয়া যায়নি সেদিন। পরে যখন ওকে উদ্ধার করে এনজিও থেকে ওর ছবি বিজ্ঞাপনে দেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো কাকারা কেউ জেনেশুনে সাড়াই দেয়নি। সম্পত্তি বড় বিষম বিষ। এই বিষকে আত্মসাৎ করার তাগিদে মানুষ হয়তো এভাবেই একটা জলজ্যান্ত মানুষের পুনর্জন্ম পাওয়ার সুযোগটাকেও নির্বিকার চেপে যেতে পারে।
পনের বছর পর যখন স্মিতা বিকাশের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন বিকাশ ছিল শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত। আর স্মিতা মানসিকভাবে। দুজনের সেই নির্বাক মিলনের মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে প্রেমের অমৃত সুবাস মনপ্রাণ ভরে নিচ্ছিল আরেক জোড়া নব্য প্রেমের কুঁড়ি ... মৌবনী আর রূপ।
সব শুনে হাসপাতালে ছুটে এসেছিল মৌবনীর মা বাবা। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলছিল অশোক “আজ এতগুলো বছর পর স্মিতার জীবনটা আবার রঙিন হয়ে উঠল তোদের জন্য। রূপদের বাড়িতে বিকাশের থাকা, তোর সঙ্গে পরিচয় হওয়া, আর আজ এভাবে স্মিতার তোর সঙ্গে এখানে আসা ... সবটাই হয়তো ঘটেছিল নিয়তির ইশারায়। আমরা যেকোনও ঘটনার ব্যাখ্যা নিজের মতো করে যাই দিইনা কেন, আসলে সবার উপরে থাকে নিয়তির আধিপত্য। সেই নিয়তিই একসময় মাথা নোয়াতে বাধ্য হয় আমাদের মনের ভেতরের সদিচ্ছা অপ্রতিরোধ্য টানের সামনে। আর তখন, জীবনে শুধু এবং শুধুমাত্র মঙ্গলই হয়।”
……………
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment