১
সেদিন ভোর রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। এদিক ওদিক ভালোই জল জমে রয়েছে। বাড়ির সামনে কাদাও হয়েছে। পড়ন্ত বিকেলের ওই বৃষ্টি মাখা আবহাওয়ার সঙ্গে অস্ত যাওয়া সূর্যের আলোতে চারদিকটা যেন একেবারে চকচক করছিল। একটা মায়াময় লাল আভা আর বিষণ্ণতা, হাল্কা কিন্তু ভীষণ স্পষ্ট। সারাদিন এইরকম এক নাগাড়ে বৃষ্টি হলে বিকেলটা বেশ মায়াময় হয়ে ওঠে। তবে, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণাও যেন লেগে থাকে তার সঙ্গে। চাপা কষ্টটা কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও, সেটা সবসময় সম্ভব হয় না। ওই মুহূর্তে গলার কাছে কী যেন একটা আটকে যায়, বুকের ভেতরটা ফেটে গেলেও, তা প্রকাশ করা যায় না।
এদিকে, বাড়ির সামনে ছোট মাঠটায় ঘাসগুলো ভিজে রয়েছে। পাশের বাড়ির ছাদের ছোট ছোট গাছের টবের ফুলগুলো চুপসে গেছে। ঘোষ কাকুদের বাড়ির বড় বড় গাছগুলোর ডাল ধরে পাড়ার বাচ্চাগুলো আনন্দে জল ঝরাচ্ছে, ভিজছে। নিজেদের মধ্যে হেসে কুটোকুটি হচ্ছে। বড় বড় নারকেল গাছের পাতা থেকে টপটপ করে ঠাণ্ডা জল গায়ে পড়ছে পথচারীদের। বাচ্চাদের হাতে বানানো কাগজের নৌকাগুলো এখানে ওখানে ভেসে বেরাচ্ছে, যার মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে ভিজে মাটির গন্ধ। দুপুরে প্রবল ঝড়ের পর, ঝরে পড়া গাছের পাতাতে আমাদের বাড়ির গলিটা একেবারে ভরে গিয়েছিল। যেমন আমার অন্তরটাও আজ ভরে উঠেছে, হাজার ক্ষততে। ভালোবাসা যেন প্রকৃতির নিয়মে আমায় বিদায় জানাচ্ছে। হঠাৎ সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, পল্লবীর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। সূর্যাস্তের শেষ প্রহরটা আমি না চাইতেও, আমাকে আবারও মনে করিয়ে দিয়ে গেল যে আজ ওর বিয়ে। হ্যাঁ! এই গোধূলি লগ্নে।
এতক্ষণে হয়ত বিয়ের পিড়িতে পল্লবী বসে পড়েছে। লাল পাড়ের যে কোনও শাড়িতেই ওকে ভারি সুন্দর লাগে দেখতে। হয়ত আজকেও পল্লবী লাল রঙের বেনারসি পড়েছে। পল্লবীর সঙ্গে শেষবার কথা বলার সময় জানতে পেরেছিলাম, তন্ময় অর্থাৎ ওর জন্য দেখা পাত্রটি দিল্লিতে মস্ত বড় একটা চাকরি করে। দেখাশোনা করে বিয়ে হলেও, এই কদিনে ছেলেটা ওকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু পল্লবী? ও কি পেরেছে তন্ময়কে ভালোবাসতে?
উত্তরটা হয়ত এই সময় দাঁড়িয়ে 'না'-ই হবে। তবে, এটাও ঠিক যে বিয়ের পর একসঙ্গে থাকতে থাকতে নিজের স্বামীকে পল্লবী নিশ্চয়ই ওর অন্তরে একদিন জায়গা করে দেবে।
সবকিছু কেমন যেন জীবন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে লাগল। এমনিতে আমি ড্রিংক করি না, পরশু হয়ত আর থাকতে না পেরে অফিসের ইনটারভিউ দিয়ে ফেরার সময় দু-পেগ খেয়েই ফিরেছিলাম। সে নিয়ে বাড়িতে কী অশান্তি! কারণ এর আগে আমি যে কোনোদিনও ড্রিংক করিনি। কিন্তু একবার মন যখন তলিয়ে যায়, তখন এইসব ব্যাপারে আর খেয়াল থাকে না।
শেষবার যখন পল্লবী আমাকে ফোন করেছিল, তখন ওর মুখে শুধু একটাই কথা লেগেছিল,
“তোর ভালো চাই বলেই, বলছি। আমাকে তোর মন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবারও নিজের জীবনটা গড়ে তোল, সাগ্নিক। প্লিজ, মুভ অন।”
সত্যি! বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, ভরসা এই প্রত্যেকটা শব্দ আজ বোঝার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে থেকে যত তাড়াতাড়ি নামানো যাবে, ততই ভালো। কিন্তু পরক্ষণেই অন্তর থেকে কে যেন বলে ওঠে, এতটাই কি সহজ? না! কারণ এই সমাজে এখনও আমার মতো এমন বেশ কিছু মানুষ রয়েছে, যাদের ক্ষেত্রে আবেগ আর অনুভূতি দূরে সরিয়ে রেখে এত তাড়াতাড়ি মুভ অন করা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রিয়জনের বিদায় ও রোজকার নানা কোন্দল, সবকিছু সঙ্গে নিয়েই জীবন নামক এই যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়।
২
দেখতে দেখতে প্রায় সাতাশটা বছর কেটে গেল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে, জীবন এখন অনেকটাই বদলে গেছে। অবশ্য আমার জীবনে এই বদল ঘটিয়েছে আমার একমাত্র মেয়ে, শ্রদ্ধ্যা। সেবার পল্লবীর বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই বাড়ি থেকে সবাই প্রায় জোর করেই দেবশ্রীর সঙ্গে আমাকে সংসার নামক খাঁচাটায় পুরে দিল। প্রথম প্রথম দেবশ্রীর সঙ্গে আমি একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম। সেও আমাকে আমার মতো থাকতে দিয়েছে, কখনও আমার বৃত্তে ঢুকে পড়ার সে চেষ্টাও করেনি। ওর এই স্বভাবটাই আমাকে ধীরে ধীরে নিজেকে পাল্টাতে সাহায্য করেছে আর মেয়ে হওয়ার পর জীবনের ওই ফেলে আসা অধ্যায়টা আমি একেবারে কাটিয়ে না উঠতে পারলেও, অনেকটাই পিছনে ফেলে আসতে পেরেছিলাম।
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধ্যাকে নিজের মনে গুনগুন করে গান গাইতে দেখে, আমিও ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। তবে, পিছন থেকে আমার পায়ের শব্দ শুনে, ও গান থামিয়ে দিয়ে আমাকে অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল,
“বাপি, তুমি?”
“হ্যাঁ, তোকে খুঁজতেই এখানে এলাম। কিন্তু আমার পায়ের শব্দ শুনে গান থামালি কেন? বেশ তো হচ্ছিল। গানটা কেন যে তখন ছাড়লি, পড়াশোনার সঙ্গে গানটাও চালিয়ে যেতে পারতিস?”
(মেয়ে আমার একটু লজ্জা পেয়ে বলল) “কী যে বলো না, বাপি। আমার গলায় একমাত্র তুমিই সুর খুঁজে পাও।”
“সত্যি, কি তাই?”
“হ্যাঁ! হ্যাঁ! তাই। আচ্ছা! বাপি, তুমি যে অত সুন্দর আবৃতি করতে, কই এখন আর একটাও কবিতা আবৃতি করে শোনাও না তো! আমি যদি তোমার বয়সী হতাম, তাহলে কবেই তোমার কবিতা শুনে প্রেমে পড়ে যেতাম।”
“ওরে, মেয়ে। বাবার সঙ্গে ঠাট্টা করা হচ্ছে?”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মেয়ের সঙ্গে দিব্বি হাসি গল্পে মেতে উঠেছিলাম। সন্ধ্যার এই সময়টায়, দক্ষিণদিক থেকে আমাদের ব্যালকনিতে ভারি মিষ্টি বাতাস বয়। আর সেই মিষ্টি বাতাসে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে, ক্রমাগত দুলতে থাকা ব্যালকনির একপাশে রাখা ওই বোগেনভিলা ফুলের গাছটাও বোধহয় আমাদের আড্ডায় তখন সামিল হতে চাইছিল। আমাদের কথোপকথনের মাঝেই হঠাৎ পকেটে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখি মঞ্জুদির নম্বর থেকে দুটো মিস কল। সেই মিস কল দেখা মাত্রই আমি তাকে ফোন করলাম এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলার পর যখন ফোনটা রাখলাম, তখন শ্রদ্ধ্যার প্রশ্ন,
“বাপি, এতক্ষণ ধরে মঞ্জুপিসি কি বলছিল?”
(আমি বললাম) “জানিস, মঞ্জুদি তোর জন্য একটা ভালো পাত্রের সন্ধান দিয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপ করেছে ছবিটা, দেখবি নাকি একবার?”
(কথাটা শোনা পর শ্রদ্ধ্যার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, সে বলল) “এত তাড়াতাড়ি যখন বিদায় করতে চাও, তখন আমাকে ছবি দেখিয়ে কী লাভ, বাপি? তোমাদের যা ভালো মনে হয়, তাই করো।”
কথা শেষ করেই শ্রদ্ধ্যা একরাশ অভিমান নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেল। আর আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম ব্যালকনিতে, পাশে বলতে শুধু বোগেনভিলা ফুলের গাছের সামনে রাখা টেবিলটার উপর রয়ে যাওয়া চায়ের কাপ দুটো। অর্ধেক ভর্তি না খালি, সেটা বোঝার অবকাশ ছিল না।
৩
গত সন্ধ্যার সেই বাপ-মেয়ের মান-অভিমানের পালা এভাবেই পরদিন সকালে চায়ের টেবিল অবধি গড়াল। দেবশ্রী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমার উদ্দেশ্যে বলল,
“মেয়ের বিয়েটা কি এখন দেওয়া খুব প্রয়োজন? সবে তো চব্বিশে পা দিল।”
“তুমিও দেখছি মেয়ের মতোই আমাকে ভুল বুঝছ। পাত্র দেখতে শুরু করা মানে এই নয় যে এখনই বিয়ে দিয়ে দেব।”
“জানি না। কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমাদের এই বাপ-মেয়ের সম্পর্কটা আমার কিছুতেই মাথায় ঢোকে না।”
“দেবশ্রী, আমি চাই না আমার মেয়ের জীবনটাও আমাদের কাটানো প্রথম কিছু বছরের মতো হোক।”
“হুঁ। প্রথম কিছু বছর। মেয়ের কারণেই শুধু একে-অপরের কাছে আসা। আর বাকি সময়টুকু আলাদা।”
(দেবশ্রীর কাছাকাছি গিয়ে বললাম) “জানি, আমার ভুল ছিল। আমি এটাও মানি যে আমাদের সংসারটা সেবার ভেঙে যায়নি, একমাত্র তোমার কারণেই।”
“কথাটা 'আমাদের' বলো না, সাগ্নিক। তখনকার সংসারটা ছিল কেবলমাত্র আমার একার। প্রাণহীন একটা সংসার।”
“পুরোনো কথা আর তুলো না। সেই অধ্যায়টা শ্রদ্ধ্যার বেড়ে ওঠার সঙ্গেই আমরা নিজেদের জীবন থেকে মুছে ফেলার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম। সেটা আশা করি তোমার মনে আছে?”
“হ্যাঁ।” (দেবশ্রীর ছোট্ট একটা জবাব)
(টেবিলের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম) “আমি বেরলাম, অফিস থেকে ফিরতে আজ রাত হবে। খাবার গরম করে খেয়ে নিও।”
দেবশ্রী মৃদু স্বরে বলা 'সাবধানে যেও' কথাটা কানে এল দরজা দিয়ে বেরনোর সময়। ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা হাসি রেখে আমি বেরিয়ে গেলাম। বাস্তব জীবনটা হয়ত এমনই নির্দয়। পুরনো কঠিন সময়টা পেরিয়ে আসার পরও, তার স্মৃতি মানুষের মনে আজীবন কাঁটার মতো বিঁধতে বারবার বর্তমানে ফিরে আসে।
ওই রাতে বাড়ি ফেরার পর দেখি, আমাদের ঘরে মা-মেয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে। অনেক রাত হয়ে গেছে তাই আর দেবশ্রীকে ঘুম থেকে না উঠিয়ে বরং নিজেই ডাইনিং টেবিলে রাখা খাবারটা গরম করে, খেয়ে শ্রদ্ধ্যার ঘরে গিয়ে শুলাম। তবে, ওর বিছানায় শুতেই বালিশের নীচে একটা ছোট্ট চিরকুট আমার চোখ পড়ল। খুলে দেখি তাতে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা 'সরি'।
ওই চিরকুটে লেখা 'সরি'টা আদতে কে কার জন্য লিখেছে, সেটা বুঝে ওঠার আগেই, পাশের টেবিলে চার্জে বসানো শ্রদ্ধ্যার ফোনটা কেঁপে উঠল। একবার ভাবলাম ওর ফোনে ঢোকা মেসেজটা আমার দেখা উচিত হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ওই বিষয় জানার একটা কৌতূহল মনে জন্মালো। সুতরাং মনের মধ্যে ঠিক ভুলের দোলাচল নিয়েই ফোনটা হাতে তুলে নিলাম এবং সেই মেসেজ - 'আই মিস ইউ', ওপরে 'অগ্নি-কলেজ' লেখাটা দেখা মাত্রই আমার মনের ভেতর যেন শত প্রশ্নেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
৪
পরদিন রাতে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার পর দেবশ্রীর সামনেই শ্রদ্ধ্যার কাছে কথাটা পারলাম, যা শুনে ও মাথা নিছু করে থাকলেও, দেবশ্রী একেবারে হতবাক। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শ্রদ্ধ্যা বলল,
“বাপি, আমি আর অগ্নি একই কলেজে পড়তাম। কলেজের সময় থেকেই আমরা একে-অপরকে পছন্দ করি।”
(পছন্দ শব্দটা শুনে আমি বললাম) “তোমার সঙ্গে আমি সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুর মতো মিশে আসছি, কখনো বাবা আর বন্ধুর পার্থক্যটা বুঝতে দিইনি। এমনকি বড় হওয়ার পরও তোমার কোনও কাজে বাঁধা দিইনি। স্বাধীন ভাবে চলতে দিয়েছে। এর বদলে তোমার থেকে কী একটু সততা আশা করা ভুল হয়েছে, শ্রদ্ধ্যা?”
(প্রথমবার বাবার মুখে বাবু ডাকটার বদলে শ্রদ্ধ্যা শুনে ও বলল) “আমার ভুল হয়েছে, বাপি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”
“চাওনি। কিন্তু আজ তো তুমি আমাকে সেই কষ্টটাই দিলে। আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি। একবার ভেবে দেখেছ, তোমার এই সম্পর্কের বিষয়টা লুকিয়ে যাওয়া, আমাদের মনে কতটা আঘাত করতে পারে? তোমার জন্য যে পাত্র দেখা শুরু করেছি, সেটা তুমি জেনেও তোমার এই ভালোবাসার কথাটা আমাদের জানাওনি!”
“আমি ভয় পেয়েছিলাম, বাপি। অগ্নি এখনও লাইফে এস্টাব্লিশ হতে পারেনি। একটা ভালো চাকরি না পেলে আমি কি মুখে তোমার সামনে ওর কথাটা বলতাম, বলতে পারো?”
ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে ঘড়ির দিকে চোখ গেল, দেখি অনেকক্ষণ আগেই ঘড়ির বড় কাঁটাটা এগারোটা ছুঁয়েছে। রাত বাড়ছে দেখে ওর শেষ প্রশ্নের উত্তরটা না দিয়ে বরং মাথা নাড়তে নাড়তে নিজের ঘরে চলে গেলাম।
ওই রাতে ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও, আমার চোখ দুটোতে কিছুতেই ঘুম এল না। আমাদের এই ২বি-এইচ-কে ফ্ল্যাটের দুটো বেডরুমে থাকা বাপ-মেয়ের মাঝে যেন বড্ড বেশি অভিমান জমে গিয়েছিল।
৫
সেই ঘটনার পর আমাদের বাপ-মেয়ের সম্পর্কে খানিক পরিবর্তন ঘটলেও, তা কিছুদিনের মধ্যেই আবার আগের ছন্দ ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে বিগত কিছুদিনে শ্রদ্ধ্যার আচরণে এক আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ফোন নিয়ে সময় কাটানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে মেয়েটা, ঘরের কাজেই এখন ওর বেশি মন। অবশ্য দেবশ্রী আমাকে এই বিষয় অনেকবার বলেছে যে মেয়ের এই বদল নাকি আমারই জন্য। প্রথমদিকে অত গুরুত্ব না দিলেও, পরবর্তী সময় দেবশ্রীর এই কথাটা যে কতটা অর্থ বহন করে, তা বুঝতে পেরেছিলাম ওইদিন যখন ড্রইংরুমে বসে খবরের কাগজটা চোখ বোলাচ্ছিলাম আর এমন সময় হঠাৎ ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর থেকে কল দেখে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম। ফোনের রিসিভারটা কানের পাশে নিয়ে বললাম,
“হ্যালো।”
“নমস্কার, আমি শ্রদ্ধ্যার বন্ধু অগ্নির মা বলছি।”
অপর প্রান্তের মহিলাটির গলার স্বর শুনে চমকে উঠলাম। সেই গলার স্বর যেন আমার কাছে অনেক দিনের চেনা মনে হল। একটু থেমে তাই বললাম,
“হুঁ। নমস্কার, আমি শ্রদ্ধ্যার বাবা।”
(অপর প্রান্তের সেই মহিলা যেন মিনতি করার মতো করে বলল) “দাদা, আপনার সঙ্গে যদি একবার দেখা করা যেত, তাহলে খুব ভালো হত।”
(আমি একটু অবাক হয়েই বললাম) “দেখা? কেন বলুন তো?”
“আসলে অগ্নি আর শ্রদ্ধ্যার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাইছিলাম।”
(গলা ঝেরে বললাম) “ঠিক আছে। পরশু দিন শ্রদ্ধ্যাদের কলেজের রিইউনিয়ন আছে, আমি ওকে আনতে যাব। আপনার ছেলেও নিশ্চয়ই যাবে, তাই পারলে আপনিও চলে আসুন। সেদিন নয় কথা বলা যাবে।”
“আচ্ছা, দাদা। তাহলে ওই কথা রইল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
কথা শেষ করে ফোনটা রাখার সময় কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। কফি মগে শেষ চুমুকটা দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এসি ঘরে বসেও, তখন ঘাম ঝরছে। মনটা আসলে বড়ই অস্থির হয়ে উঠেছিল।
সমস্ত ঘটনাটা দেবশ্রীকে খুলে বললাম এবং পুরোটা শোনার পর ও শ্রদ্ধ্যাকে এই বিষয় জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম যে মেয়ে আমার এতটাই ওর বাপিকে ভালোবাসে যে নিজের প্রিয়তম মানুষটির সঙ্গে এতদিনের সম্পর্কটা ও ভেঙ্গে দিতে দু-বারও ভাবেনি। সেই রাতের পর অগ্নির সঙ্গে আর কোনও ভাবেই যোগাযোগ রাখেনি শ্রদ্ধ্যা। দিনের পর দিন, ওর ফোনে অগ্নির অগুণতি মেসেজ আর মিস কল দেখা সত্ত্বেও, নিজেকে ও দুর্বল হতে দেয়নি। নিজের বাপির প্রতি ভালোবাসার জন্য জীবনের এই স্বার্থত্যাগ দেখে, শ্রদ্ধাকে আমি কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পেলাম না। ফলে, ওই মুহূর্তে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“বাবু, আর তোকে কষ্ট পেতে হবে না। আমি পরশু দিন অগ্নির মায়ের সঙ্গে কথা বলে তোদের চার হাত এক করার ব্যবস্থা করছি।”
“কিন্তু বাপি, অগ্নি এখনও এস্টাব্লিশ নয়। এখনও যে চাকরি পায়নি ও!”
(মেয়ের মুখে আবারও এস্টাব্লিশ আর চাকরি শব্দ দুটো শুনে বললাম) “দূর! বোকা মেয়ে। তোর বাপিকে কি তুই এই চিনিস? আমার কাছে চাকরি আর ভালোবাসা, দুটোরই সমান গুরুত্ব। আর যেই ছেলে আমার মেয়েকে সবকিছু উজাড় করে, আমার মতো ভালোবাসতে পারে, তার হাতেই তো আমি আমার জীবনের এই অমূল্য রত্নটি তুলে দেব নাকি!”
“কিন্তু মঞ্জু পিসি?”
“ওরে, আমার কাছের মঞ্জুদি আগে নাকি তুই? ও নয় আমি কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেব। আমার শুধু একটা ব্যাপারেই খুব আঘাত লেগেছিল রে। আমি তোর সঙ্গে এত বন্ধুর মতো মিশি আর সেই তুই কিনা অগ্নির কথাটা আমার কাছে বেমালুম চেপে গেলি।”
“না! বাপি, আমি আসলে মনে-মনে ভয় পাচ্ছিলাম, যদি তুমি ওকে না মেনে নাও।”
(হাসতে হাসতে দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম) “শোনো গো, মেয়ে আমাদের বড্ড বড় হয়ে গেছে। এবার সত্যি, বিয়েটা দিয়েই ফেলতে হচ্ছে।”
ড্রইংরুমে উপস্থিত আমাদের প্রত্যেকের মুখেই তখন হাসি ফুটে উঠল। নিজের অতীতের না পাওয়াটা যেন আজ মেয়েকে পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ওর মাধ্যমে সেই শান্তির কিছুটা অনুভব করার চেষ্টা করলাম।
৬
সেদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছিলাম, তাই সময়ের অনেক আগেই শ্রদ্ধ্যার কলেজে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্ত পৌঁছেও ভিতরে আর ঢুকলাম না। একই রাস্তা দিয়ে হঠাৎ স্মৃতির অ্যালবাম থেকে বেরিয়ে আসার মতো চোখের সামনে দিয়ে পল্লবীকে হেঁটে যেতে দেখলাম। পরনে নীল রঙের শাড়ি আর ঠিক সাতাশ বছর আগের মতো একই সাজে। এতবছর পর আমাকে দেখতে পেয়ে সেও আর না এগিয়ে, রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল। দু-জনেই দু-জনের দিকে চেয়ে রইলাম অথচ কেউই কথা বলার জন্য এগিয়ে আসছিলাম না। কোনও এক অজানা শক্তি যেন আমাদের আটকে রেখেছিল। অবশেষে রাস্তার ওই দূরত্বটা মুছে ফেলে, আমার ফেলে আসা সেই অতীত, আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
“তুই এই দিকে?”
(আমি বললাম) “হ্যাঁ! একটা কাজে এসেছি। তুই?”
(ম্লান হাসল পল্লবী) “আমিও একটা কাজে। তা কেমন আছিস, কতবছর পর আমাদের দেখা, তাই না?”
“হুঁ। তা সময়ের কী দোষ? আমরা নিজেরাই তো আর যোগাযোগ রাখিনি।”
“এখনও আমার ওপর রাগ আর অভিমান, দুটোই আছে দেখছি।”
“না! একটুও নেই। তোর কথা মতো মুভ অন করেছি বলেই হয়ত আজ দুটোর একটাও নেই।”
চারপাশে এত গাড়ির আওয়াজ যে ওখানে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ কথা বলার অবকাশ নেই দেখে, আমরা দুজনেই সামনের একটা ক্যাফেতে গিয়ে ঢুকলাম। আমাদের বসতে দেখে একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে আমাদের টেবিলে মেনু কার্ডটা দিয়ে গেল। মেনু কার্ডটা দেখে ওয়েটারকে ফের ডেকে বললাম,
“একটা কোল্ড কফি আর একটা ব্ল্যাক কফি দেবেন।”
(ওয়েটার চলে যাওয়ার পর পল্লবী আমার উদ্দেশ্যে বলল) “ব্ল্যাক কফি যে আমার প্রিয়, সেটা এখনও মনে রেখেছিস?”
(হাতে ফোনটা নিয়ে সাময়িক ব্যস্ততা দেখানোর মাঝেই বললাম) “ওইটুকুই।”
ক্যাফের কাচের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘেরা জমাট বাঁধছে। মনের মধ্যে তখন দু-একটা কৌতূহল যেন বৃষ্টি হয়ে নেমে এল,
“তুই না বিয়ের পর দিল্লি চলে গিয়েছিলিস, তাহলে আবার কলকাতা?”
(চশমাটা চোখের সামনে থেকে সরিয়ে টেবিলে রেখে, পল্লবীর উত্তর) “হ্যাঁ! দিল্লিতেই ছিলাম। তারপর বান্টি যখন ক্লাস সিক্সে উঠল, তখন তন্ময় কলকাতায় ট্র্যান্সফার পেয়ে গেল। ব্যাস! আবার কলকাতায় চলে এলাম।”
“বান্টি?” (প্রশ্ন করলাম আমি)
“হ্যাঁ! আমার একমাত্র ছেলে। এখন কলেজ শেষ করে চাকরি খুঁজছে। আমার কথা অনেক জানলি, এবার তোর কথা কিছু বল।”
“আমার কথা? কী শুনবি বল?”
“বিয়ে করেছিস?”
“হুঁ। তোর বিয়ের দু-বছরের মধ্যেই।”
ওয়েটার আমাদের কথার মাঝেই কফি দিয়ে গেল এবং সেই কফির কাপে চুমুক দিয়ে পল্লবী বলল,
“খুব ভালো করেছিস, সাগ্নিক। আমি সবসময় চেয়েছি তুই ভালো থাকিস। তুই হয়ত ভাবিস, তোর সাঙ্গে আমার সম্পর্কটা কেবলমাত্র তোর চাকরি না পাওয়ার কারণেই ভেঙ্গে গিয়েছিল কিন্তু সেই ভাবনাটা তোর একদমই ভুল। ওই সময় বাবার কথা অমান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমাদের সম্পর্কটা বাবা কখনোই মেনে নেয়নি। তাই তাকে আমাদের বিয়ের কথাটা বলার মতো স্পর্ধা দেখাতে পারিনি। আজ যদি তোর মেয়ে থাকত তাহলে বুঝতিস, একটা মেয়ের মনে সেই মুহূর্তে কতটা ঝড় বয়ে যায়। আমি তাই বাধ্য হয়েছি বাবার সুখে নিজের সুখ খুঁজতে।”
পল্লবীর শেষের কথাগুলো শুনে নিজের মনেই হেসে উঠলাম। তবে, আমার মুখের ভঙ্গি দেখে, পল্লবী কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে সেইসব কথা থামিয়ে, আমাকে জিজ্ঞেস করল,
“তুই আমার কথা শুনে হাসছিস যে? ব্যঙ্গ করছিস আমায়?”
(আমি বললাম) “না! না! ব্যঙ্গ কেন করব? এতবছর পরও তোর কথা বলার ধরণ দেখছি একই রয়েছে। আমি তো ভাবলাম মাথার সাদা চুল আর কপালের ভাঁজের সঙ্গে তোর কথা বলার ধরণটাও পাল্টেছে।”
“দূর! সাদা চুল আর কপালের ভাঁজ তো বয়সের স্রেফ একটা চিহ্ন মাত্র। এর সঙ্গে কথা বলার ধরণের কোনও সম্পর্ক নেই।”
“তাই হবে হয়ত। তবে, এবার যে আমাদের উঠতে হবে, পল্লবী। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ, মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে।”
“হুঁ! চল ওঠা যাক।”
ওয়েটারকে ডেকে বিলটা মিটিয়ে যখন ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসছি, তখন পিছন থেকে পল্লবী বলে উঠল,
“আচ্ছা! সাগ্নিক, তুই এখনও আমাকে ভুলতে পারিস নি, তাই না? এখনও আমায় ভালোবাসিস।”
(কথাটা কানে ভেসে আসতেই, ওর দিকে ফিরে বললাম) “জানিস তো, পল্লবী। প্রত্যেকের কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা এক এক রকম। তাই এই নিয়ে আলোচনা না হয় অন্য আরেক দিন হবে।”
কথা শেষে ক্যাফের কাচের দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে এলাম। সেদিন গোধূলির সময়, মেঘলা আকাশে সূর্যের শেষ আলোটুকু যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে কিছু বোঝাতে চাইছিল। তবে, আমি আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা মেয়ের কলেজের দিকে হাঁটা লাগালাম। কিন্তু কলেজের গেটের সামনে যাওয়ার আগেই দূর থেকে দেখি একটা ছেলের সঙ্গে শ্রদ্ধ্যা আমার দিকে এগিয়ে আসছে এবং কাছে আসার পর ছেলেটার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল,
“বাপি, এই হল অগ্নি। তোমার আর আন্টির জন্য আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।”
“কিন্তু তোর আন্টি মানে অগ্নির মা কই?”
(অগ্নি অমনি বলে উঠল) “এই তো আমার মা, আঙ্কেল। আপনার পিছনেই তো আসছে।”
কথাটা শোনা মাত্রই পিছন ফিরে তাকালাম এবং দেখি ততক্ষণে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকা পল্লবীকে 'মা' বলে সম্বোধন করছে অগ্নি। মুখে লেগে থাকা হাসিটা কখন যে মিলিয়ে গেল, তার টের পেলাম না। আমি আর পল্লবী, দুজনেই একে-অপরের এই নতুন পরিচয় জানার পর একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। তখন মনে হচ্ছিল গোটা পৃথিবীটাই যেন ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর, আমরা দু-জনেই ওই সাময়িক ধাক্কাটা সামলে উঠে দ্রুত চারপাশের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে, নিজেদের পুরোনো পরিচয় গোপন রেখেই বর্তমানকে গ্রহণ করার চেষ্টা করলাম। মনকে বোঝালাম, আজ আমি শুধুই শ্রদ্ধ্যার বাবা আর ও অগ্নির মা। তবে, যেটা উল্লেখ না করলেই নয়, সেটা হল- ওইদিন ফিরে আসার আগে অগ্নি আর শ্রদ্ধ্যার আড়ালে পল্লবী আমাকে বলেছিল,
“সাগ্নিক, আমি আশা করি আমাদের অতীত, ওদের সম্পর্কের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না। আমাদের সম্পর্কের পরিণতি যেন এই দুটো বাচ্চার জীবন থেকে ওদের সুখ কেঁড়ে না নেয়।”
(ওর এই কথার উত্তরে বলেছিলাম) “আমি এমন একজন বাবা পল্লবী, যার কাছে নিজের মেয়ের সুখই সবচেয়ে বড়। নিজের সুখ বলতে আমি শ্রদ্ধ্যার সুখটাই বুঝি। তাই বাকি অনেকের মতো না ভেবে, আমি তোকে শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে আমার কাছে চাকরিটাই একমাত্র মাপকাঠি নয়। নিজের মেয়ের সম্প্রদান আমি তার হাতেই করব যে আমার মেয়েকে আমার মতোই ভালোবাসবে এবং প্রতিশ্রুতি দেবে সারাজীবন ভালোবেসে রাখার।”
এই গল্পের সাগ্নিকের মতো বাস্তব জীবনে আমরা এমন অনেক অভিবাবকদের খুঁজে পাই, যাদের কাছে নিজের সুখের চেয়েও তাদের সন্তানের সুখ বেশি দামি। হতে পারে তাদের মধ্যেও এমন বেশ কিছুজন রয়েছে, যারা সাগ্নিকের মতো নিজের ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা বোঝে বলেই, তারা তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দিতে চায় না। আর ঠিক সেইজন্য, আজও আমরা হাজার হাজার শেষ হয়ে যাওয়া ভালোবাসার ভিড়ে, অগ্নি-শ্রদ্ধ্যার মতো ভালোবাসারও শুভ পরিণতি দেখতে পাই।
……………
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment