গল্পঃ হাসি হাসি রাশি রাশিঃ সুমন ঘোষ





লোকটা দেখি হেসেই যাচ্ছে। হাসছে তো হাসছেই। সামনে পিছনে তেমন কেউ নেই। আমি একটু আড়ালেই গেলাম। লোকটা কিন্তু হেসে যাচ্ছে। হাসির কিসিমটাও আলাদা। একটু জোরে, আরও জোরে আবার মাঝেমাঝে মৃদু, আবার মিচকিও। 

হলটা কী? চারিদিকে সব স্বাভাবিক। হাওয়া দিচ্ছে, হালকা রোদ, না গরম না ঠান্ডা পরিবেশ। তাতে মন ভাল থাকে কিন্তু হাসি কোনওমতেই আসে না। অথচ লোকটা হেসেই যাচ্ছে। থামেই না। কেন জানি না ওই লোকটাকে দেখে এবার আমারই বেশ হাসি এল।

আমাকে দেখে ঠিক তখনই হঠাৎ একটা লোক যাকে আমি কোনওদিন কোথাও দেখিনি একটু রূঢ় ভাসায় আমার মুখের কাছে এসে বলল, “দাদা হাসছেন কেন?” 

আমি একটু হাঁ করে তাকে দেখলাম। 

লোকটা আমাকে আবার বলল, “হাসছেন কেন?”

মহা মুশকিল। আমি হাসছি কেন সে তো আমি বুঝব। তাই, তাকে আমি অনেক কিছুই বলতে পারতাম। বলিনি। তখনও সেই লোকটা হেসেই চলেছে। অবিরাম। আমার কাছের লোকটাকে আমি কোনও উত্তর দিলাম না। বরং গুরুগম্ভীর ভাবে তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী নাম? কোথায় থাকা হয়?”

লোকটা বোধহয় একটু থতমত খেল আর তারপর সেই লোকটাও হাসতে শুরু করল। 

সে এক বিদঘুটে হাসি। যা মলো! আজ হলটা কী! প্রায় ঘাড়ের কাছে একটা লোক হাসছে, আর কয়েক পা দূরে আরেকটা লোক হাসছে। হাসছে তো হাসছেই। বেড়ে মজা তো! এবার আমারও আবার হাসি পেল। 

হঠাৎ দ্বিতীয় লোকটার হাসির বহরে একটু বদল এল আর হাসতে হাসতেই কিছু একটা বলতে চাইল।

আমি একটু থমকে গেলাম। তার কথায় মন দিতে চাইলাম।

লোকটার হাসিটা পরিষ্কার কিন্তু কথাগুলো তেমন পরিষ্কার নয়। আমি একটু কান খাড়া করলাম। বুঝলাম লোকটা বলছে, “কী হল থামলে কেন। হাসো হাসো। শুধু হেসে যাও। আর কত কাঁদবে?”

এবার সত্যি সত্যি আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না।

লোকটা তারপর বলল, “আপনি আমার নাম জানতে চাইছিলেন না?”

“আমার নাম......” বলতে না বলতেই একটু দূরে দাঁড়ানো প্রথম লোকটার থেকে উত্তর এল “ওর নাম বেইমান।”

বলেই সেই লোকটা আরও জোরে হাসতে লাগল। তা শুনে দ্বিতীয় লোকটি তেমন একটা রাগ করল না। বরং হাসিটাতে একটা মখমলে ভাব আনল। সেটা ব্যঙ্গ না তাচ্ছিল্য বোঝা মুশকিল। তবে প্রথম লোকটি ওই বেইমান বলেই থামেনি। সে হাসতে হাসতেই বলতে থাকল “আর বেইমান থাকে কোথায়? থাকে এখানে সেখানে, যেখানে ভাত না মিললেও দু’দণ্ড প্রাণ খুলে হাসা যায়।”

আমি আমার মুখে একটা সিরিয়াস ভাব আনলাম। আসলে ভাব আনলাম বলা ভুল, একটু সিরিয়াসই হয়ে গেলাম বোধহয়। 

তা দেখে আবার দ্বিতীয় লোকটি আমাকে বলে উঠল, “তোর কী দরকার, এত কথা জেনে। এখানে এসেছিস, মন খুলে প্রাণ খুলে হাসতে পারলে হাসবি নতুবা চলে যাবি। এত ঠিকানা খুঁজে লাভ নেই। আর শোন, জগতে কার ঠিকানার কে টের পেয়েছে রে। ওরকম সবাই ভাবে যে যেখানে ঘর বেঁধেছে ওটাই তার ঠিকানা। ঠিকানা বাঁধা কী এত সোজা রে। ও রকম মনে হয়।”

একে তো চেনা নেই, জানা নেই তার উপর ঐ বিদঘুটে হাসি, তুইতোকারি, আর সঙ্গে ঐ সব দার্শনিক দার্শনিক কথায় এবার আমি একটু ভ্যাবলে গেলাম। আমার চকচকে শার্ট প্যান্ট জুতোর দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে একটু মেপে নিলাম। সেটা আবার প্রথম লোকটা খেয়াল করল কী না কে জানে। সে আবার দেখি ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল আর তার হাসির ধরণটা একটু বদলে আমাকে বলল, “ওর কথায় ঘাবড়ে যাবেন না। ও হাসতে হাসতে কখন কী যে বলে ও বোধহয় নিজেও জানেনা।” 

বলেই আমাকে একটা তীব্র খিকখিক উপহার দিল। আবার আমার হাসি পেল। তবে সেটা তেমন বুঝতে দিইনি। কিন্তু ওই দার্শনিক গোছের লোকটা সেটা কি টের পেল!

নিশ্চয়ই পেল।

নয়তো আমাকে বলল কেন এবং তাও আবার হাসির মোড়ক ভাসিয়ে “শোন, বেইমান আমার নাম নয়, ওটা আমার বদনাম। আসলে আমার নাম জগত। বাপ মরার আগে মা'কে আমার বাপটা ওই নাম বলে দিয়েই চলে গিয়েছিল। আর আমার মা যখন মরতে যাওয়া বাপটাকে মুখে জল দিতে গিয়েছিল তখন বাপটা নাকি হেসে উঠেছিল। মা তখন থেকেই ভেবে নিয়েছিল ওটাই আসলে বাপের আমাকে নিয়ে শেষ ইচ্ছে। মা তাই বলত ‘যতদিন বাঁচবি, হেসে হেসে বাঁচবি। জগতে তোর নাম হবে’।” বলেই আর একটা অদ্ভুত হাসি।

আমি তখন একটু গম্ভীর। লোকটা ওই হাসির ঝলকে আরও জোর এনে বলল, “কী রে থামলি কেন, হাস হাস। যত হাসবি, তত বাঁচবি। ঠিক আমার মত। হাসলে কেউ মরেনা।”

তবুও আমার আর হাসি আসেনি। লোকটা কিন্তু হেসেই চলেছে। বিশ্বের হাসি ওর ঠোঁটে অথচ আমি নিশ্চুপ।

প্রথম লোকটা তখনও হেসেই চলছে। চলছে বলি কেন, বরং তার হাসিতে নানা রকমফের হচ্ছে। দু চার রকম হাসির ধরণ তো সবার মতো আমারও জানা। কিন্তু তার এত রকমফের আমার জানা ছিল না। আর থাকবেই বা কোথা থেকে। মেয়েটার বিয়ে নিয়ে আমি এমন ঝামেলায় ফেঁসে আছি, ছেলেটা সব চাকরির বাজারে ডাহা ফেল, এত হাসির গবেষণা করব কখন! বুকে যা আছে সবই তো কান্না। আর এদের গল্প আর পরিবেশের ছাঁচে হাসি না কান্না কোনটা ঠিক ভাবলেই তো কেমন কেমন লাগে। আমার মনটাই তো তখন নিজের মনকে চিনতে পারছে না। তার আবার হাসি, তার আবার কান্না। বোঝো ঠ্যালা। লোকদুটোর সঙ্গে দেখাই বা হল কেন আর ওরাই বা জগতের সব হাসি আমার সামনে হাসল কেন, তাই ভেবেই তো আমি অস্থির। আর আমার অস্থিরতার তোয়াক্কা কেই বা কবে করল। ওরাই বা হঠাৎ করবে কেন? 

এরমধ্যেই প্রথম লোকটা আমার আর একটু কাছে এসে গিয়েছিল।

দূরে দু চার জনকে দেখলাম আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরাও বেশ হাসছে। তাতে খুব একটা আওয়াজ নেই কিন্তু হাসছে তা বোঝা যায়। এবার ওরাও যদি আমার দিকে এগিয়ে আসে, তাহলে যে কী হবে ভেবে আমি আরও একটু অস্থির হলাম। যাক, এত ভেবে কী হবে! হাসির তো আজ এত অভাব। এসব দেখে তো আমার ভাল লাগারই কথা। না, তেমন কেউ আর কাছে এল না। ওরা হাসছে ওদের মতো। ভাবলাম বাঁচা গেল!

এর মধ্যেই কাছে আসা প্রথম লোকটা বলে উঠল দ্বিতীয় লোকটাকে, “ওসব তো হল, বল তুই বেইমান কেন?”

হাসতে হাসতে বেশ ধমকের সুরেই কথাটা বলল। দ্বিতীয় লোকটা প্যান্টের ছেঁড়া বেল্টটা গোটাতে গোটাতে, প্রথম লোকটাকে দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে বলি শোন।...ওর বউটা বড় মিষ্টি ছিল রে। খালি হাসত। এই আমার মত।” বলেই এবার যে হাসিটা হাসল সে একটা গোঙানি ছিল। অথচ সেটিও হাসি।

কান পাতলে বোঝা যায়। আমি বুঝেছি কারণ আমি তো বিস্ময়ে কান পেতেই আছি। 

আমি জোর করে মুখে একটা মুচকি এনে বললাম, “তারপর?”

সে বলল, “তারপর আর কী! ওর বউটাকে দেখে, থেকে থেকেই আমার বাপের ইচ্ছে আর মার কথাটা খুব মনে পড়ত। বাঁচবি তো বাঁচবি, হেসে হেসে বাঁচবি। তাই ভাবলাম বাপ মা তো হাসতে হাসতে বাঁচতে পারেনি, সারা জীবন কাঁদতে কাঁদতেই বেঁচেছে। তা, আমি যদি ওর বউটাকে ভাগাতে পারি, তবে ওই হাসিটাকে ঘরে বেঁধে রাখতে পারব। আমার বাচ্চাকাচ্চারাও ওদের মায়ের মত হাসতে শিখবে। আমার মা বাপ যা পারেনি। ব্যাস, ভাবামাত্র ওর বউটাকে হেসে হেসে ফাঁদে ফেললাম। আর হাসিতে কে না ভোলে, বল! আর ওর বরটা তো হাসতেই শেখেনি। আমার ওই জগত ভোলানো হাসিতে ভুলে ওর বউটা ওই গোমড়াটাকে ছেড়ে আমার কাছে চলে এল। তারপর দিন কয়েক সে কী হাসিরে, সে কী হাসি। কিন্তু সে আর সইলো কইরে! ধম্মে সইল না।” বলে যেন কথাটা একটু থামাল। কিন্ত লোকটার হাসি থামেনি। কিন্তু সে হাসিতে মলিনতার আভাস ছিল।

প্রথম লোকটা দেখি এবার কেমন মিচকি হাসছে। তাতে আওয়াজ নেই কিন্তু মন পাতলে তার আওয়াজ শোনা যায়। ঠোঁটের কোনে ওই হাসিটা একটু তির্যক করে ঝুলিয়েই বলল, “থামলি কেন বল।” 

দ্বিতীয় লোকটা আবার গলা ছাড়ল। এবার একটা নতুন হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল, “তারপর আমার বউয়ের পেটে আমার বাচ্চা এল। কিন্তু হল কী জানিস, বাচ্চাটা হওয়ার সময় কাঁদল না। ডাক্তারটা বলল বাচ্চা না কাঁদলে নাকি বাঁচে না। বাচ্চাটা সত্যিই সত্যিই বাঁচল না। জন্মাতে জন্মাতেই চলে গেল। সেটি যখন টের পেল আমার ওই হাসি-বউটা, তখন সেও আর রইল না। ডাক্তার বাবু কে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার বাচ্চা কাঁদেনি যখন তখন নিশ্চয়ই এক গাল হেসেছিল। আমি তো তাই চেয়েছিলাম ডাক্তার বাবু! ‘ডাক্তার জবাব দিয়েছিল, হয়তো হেসেছিল। আমরা বুঝতে পারি নি’। তারপর থেকেই আমার আর হাসি থামেনা। বুঝলি, আমার মুখের হাসি আসলে আমার ছেলের হাসি রে, আমার ছেলের হাসি। ছেলের হাসি হাসলে কেউ বেইমান হয়? তুই বল। তুইই এর বিচার কর।”

বলেই আরও জোরে হাসতে হাসতে ওই লোকটা প্রথম লোকটাকে দেখিয়ে বলে, “আমার ছেলে বউ মরে যাওয়ার পর ‘ও’ আমার পিছন পিছন হেসে বেড়ায়। ও বোধহয় খুশিতে হাসে।”

দুটি মানুষের হাসিতে তখন যেন একটা হট্টগোল। সে হাসি কিন্তু আমাকে কাঁদিয়ে দিল। আমি যখন চোখের জল মুছছি, হঠাৎ আমার একটা হাত হালকা করে এসে ধরল প্রথম লোকটা। তখন আর তার মুখে আর হাসি নেই। তার চোখে কি তাহলে একটু জল এলো! দ্বিতীয় লোকটিও কাছে এসে আমার আর একটা হাত ধরে বলল, “অনেক হেসেছি রে, এবার আমাকে একটু কাঁদতে দে। আমার ছেলের মা'টা তো শেষে কেঁদে কেঁদেই চলে গেল।” বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।

আমি আর ওখানে দাঁড়াই নি। তারপর যতবার আমি ওই জায়গায় গেছি, ততবারই হাসি আর কান্নার আওয়াজ একসাথে শুনেছি।

হয়তো, এ আওয়াজ আমার না শোনাই ভাল ছিল।


…………..

অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


 

No comments:

Post a Comment