যখন বৃষ্টি এল
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
“পা চালিয়ে চল মা, দেখছিস না আকাশের মুখ কেমন গোমড়া হয়ে আছে!”, অধৈর্য হয়ে কাঁধের বোঝাটা সামলাতে সামলাতে জোরে জোরে পা চালায় বুড়ো ওয়াং শু।
“দাদু তুমি বুড়ো হয়ে গেছ, কিন্তু শরীরে এত জোর পাও কী করে বল তো? আর আকাশের মুখ গোমড়া হয় নাকি কখনও? শরীরটা তোমার এখনও মজবুত, কিন্তু মাথাটা গিয়েছে খারাপ হয়ে”, হাসতে হাসতে দৌড়াতে থাকে ইউ ইয়ান, সদ্য সে কলেজে উঠেছে।
“আকাশ যখন মুখ ভার করে থাকে, তখন বুঝবি বৃষ্টি হবে। আর বৃষ্টি হয়ে গেলে কী হবে বল দেখি? যত খাবার ওই পিতৃপুরুষের জন্য নিয়ে চলেছি, সব ভিজে জুবজুবে হয়ে যাবে, তেনাদের মুখে রুচবে না”, বকবক করতে করতে চুং-ই-থং কবরখানার দিকে পা চালাতে থাকে বুড়ো ওয়াং। নাতনিটি তার যুবতী হয়ে ওঠার সন্ধিক্ষণে হলে কী হয়, মনটা যেন এখনও দশ বছর পিছিয়ে।
বলতে না বলতে চড়বড় করে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা ঝরতে থাকে। ওয়াং খুঁজে-পেতে একটা বাড়ির রোয়াকে উঠে পড়ে নাতনি ইয়ান-কে নিয়ে। ট্যাংরা বস্তি অঞ্চলে মাথা বাঁচানোর উপযুক্ত এমন বাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যিস এই বাড়িটার রোয়াকের উপর বড়সড় একটা সানশেড আছে! নইলে আজ সব খাবার দাবার বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়ে যেত। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে দিতে কাঁধের বোঝাটা রোয়াকে নামিয়ে রাখে বুড়ো ওয়াং শু।
নিউ চায়না টাউন গড়ে উঠেছে ট্যাংরা অঞ্চলে সে অনেক বছর হয়ে গেল। ওয়াং শু কোনওদিন চীন যায়নি। কবে যে তার পিতৃপুরুষ এদেশে বসবাস করতে শুরু করেছিল, হিসেব মিলিয়ে সে বলতে পারবে না। আজ এই বাদলা দিনে কুইংমিং উৎসবে দাদু নাতনিতে মিলে চলেছে শহরের চীনে কবরখানা–চুং-ই-থং-এ। ওয়াং এর বাবা-মায়ের কবরে রাখা হবে ফুল, ঠাণ্ডা খাবার দাবার। তবেই না স্বর্গ থেকে দুহাত তুলে তারা আশীর্বাদ করবে ওয়াং-কে!
“কিন্তু কী জানিস মা, অনেক আগে এই কুইংমিং উৎসবের সময় কিন্তু বৃষ্টি হত না। সে হাজার হাজার বছর আগে... তখন রোদ ঝলমল দিনে বাতাসে গা ভাসিয়ে লোকে উৎসবে যোগ দিত। এখন প্রতিবার বৃষ্টি হয়, তা এই কলকাতা শহরেই হোক, কিংবা চীনে।”
“কেন দাদু? বৃষ্টি হত না কেন?”, অশান্ত গলায় প্রশ্ন করে ইয়ান।
“তাহলে তো একটা মস্ত গল্প ফাঁদতে হয় দিদি! তবে বৃষ্টি যা জোরে এসেছে, মনে হয় না খুব শিগগির থামবে। তাহলে বলি। সে বহুদিন আগের কথা, তখন আমরা এই দেশে থাকতাম না। আমাদের দেশ চীনে ছিল...”, কাপড় দিয়ে রোয়াক ঝেড়ে আরাম করে বসে গল্প শোনায় ওয়াং।
--হাজার বছর, বা তার চাইতেও পুরোনো সেই গল্প, যা বাপ ঠাকুরদার মুখ থেকে বহুবার শোনা। কুইংমিং উৎসবের সময় বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টিকে বলে কুইংমিং বৃষ্টি। এক বড় রহস্য আছে এই বৃষ্টি আসার ব্যাপারে। কাহিনিটা একটু করুণও বটে।
চীনের ফুয়াং শহর দিয়ে যে ফুচুন নদী বয়ে চলেছে, তার তীরে হাজার বছর আগে বাস করত এক মেয়ে, তার নাম ছিল- লিং কেলিয়ান। ফুয়াং তখনও শহর হয়ে গড়ে ওঠেনি। সেখানে ছিল এক গ্রাম- শাংশিয়াশান। লিং ছিল এক অপূর্ব সুন্দরী যুবতী। তাকে দেখে মনে হত যেন, স্বর্গের উদ্যান থেকে হঠাৎ পথ ভুল করে চলে আসা কোনও পরি। তার চলার ছন্দ দেখে মনে হত, যেন কোনও রাজ হংসী। কিন্তু রূপ নিয়ে তার কোনও অহমিকা ছিল না। বরং নিজের সৌন্দর্য নিয়ে সে ছিল খানিকটা উদাসীন। তাতেই লিং-এর রূপ আরও হয়ে উঠেছিল বিকশিত। শাংশিয়াশান গাঁয়ের অন্য কোনও মেয়ে রূপে তার ধারেকাছে আসার যোগ্য ছিল না।
লিং-এর মা খুব ছোটবেলায় মারা যাওয়ায়, বাবা-ই বল, বা মা— তার গোটা দুনিয়াটা ছিল বাবাকে ঘিরে। বাবার জন্য সে খাবার বানাত, জল তুলে নিয়ে আসত নদী থেকে, জামাকাপড় কেচে দিত। কিন্তু লিং-এর বাবা ছিল খুব গরিব। একচিলতে চাষের জমি পর্যন্ত তার ছিল না এই পৃথিবীতে। তবে সে ছিল খুব ভাল এক চাষি। অন্যের খেতে চাষবাস করে কায়ক্লেশে বাবা-মেয়ের দিন চলত কোনওমতে।
একদিন লিং কেলিয়ান নদীতে যখন জল ভরতে গেছে, তখন নদীতে নৌকায় জলবিহার করছিল বড়লোক এক ব্যবসায়িক। শাংশিয়াশান গাঁয়ের ঠিক উলটোদিকে, নদীর অপর পাড়ে ছিল তার বিশাল প্রাসাদ। সে লিং-এর বাবার চাইতে অন্তত বছর দশেকের বড় বই, ছোট হবে না। লিং কেলিয়ান-কে দেখে বুড়োর বিয়ের লালসা জাগল। নৌকা তীরে ভিড়িয়ে সে সোজা গেল লিং-এর বাবার কাছে। গিয়েই প্রস্তাব দিল লিং-কে বিয়ে করার। লিং-এর বাবা নিজের মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজে বার করার কোনও চেষ্টাই কোনওদিন করেনি, কারণ তার টাকাপয়সা কিছুই ছিল না। বুড়োর প্রস্তাবে সে তো আহ্লাদে আটখানা! এত বড়লোকের সাথে বিয়ে হলে মেয়ের একটা হিল্লেই শুধু হবে না, তার নিজের বরাতও খুলে যেতে পারে। তাই এক কথায় সে বুড়োর প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল।
শুভ দিন দেখে লিং-এর সাথে বুড়ো ব্যবসায়িকের বিয়ে হল। সুন্দরী লিং তার মনের দুঃখ কাউকে প্রকাশ করতে পারল না। নীরবে এক একা চোখের জল ফেলল। কিন্তু বাবাকে দুঃখ পাবে ভেবে, মুখ ফুটে তাকেও জানাতে পারল না যে এই বিয়ে তার কাছে এক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
গাঁয়ের লোককে পেট ভরে খাইয়ে খুশি করে, নববিবাহিতার পিতাকে অনেক উৎকোচ দিয়ে, বুড়ো ব্যবসায়িক নৌকায় সুন্দরী স্ত্রীকে যত্ন করে বসিয়ে, পাড়ি দিল ফুচুন নদী। লিং তার বাবাকে জড়িয়ে অনেক কাঁদল। নিজের ভাগ্যকে অভিশাপ দিতে দিতে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সে চলল শ্বশুরবাড়ি।
লিং-এর দুঃখে সেদিন নদীও মন খারাপ করেছিল। নইলে সেদিন না ছিল ঝড়, না ছিল আকাশে মেঘ, তবু ফুঁসে উঠেছিল ফুচুন। যেন নৌকা উলটে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল লিং-এর বুড়ো বরকে। নৌকার হালুই থেকে পর্দা সরিয়ে জলের দিকে উঁকি দিয়ে লিং-এর মনে হয়েছিল ‘এ জীবন রেখে আর কী লাভ?’ আর যেমন ভাবা, তেমনি কাজ! এক লহমায় সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফুচুন নদীর বুকে। তারপর অপেক্ষায় ছিল, নদীর গভীরে কখন তার যৌবন ডুবে মরে।
জলের উপর নৌকা উলটেছিল কিনা, সে দিকে লক্ষ্যই ছিল না লিং-এর। কিন্তু মনে হয়েছিল, সে নিজে ডুবে যাচ্ছে না, বরং ভেসে আছে। কে যেন তাকে ভাসিয়ে রেখেছে জলের উপর। ভাসতে ভাসতে একসময় নদীর তীর দেখতে পেল লিং। চমক ভাঙল, যখন তার অবচেতন মন বুঝতে পারল দুই সবল পুরুষালি বাহু তাকে সযত্নে জলের উপর ভাসিয়ে রেখেছে। কিন্তু লিং তাকে দেখতে পারছে না। তারপর লিং-এর পলকা শরীর শূন্যে ভাসল। লিং-এর নজরে এল – এক অপূর্ব রূপবান যুবক তাকে দুই হাতের শক্তিশালী ভরসায় নদীর তীরে, বালির চরে শুইয়ে দিয়েছে।
“আমি জিন মিংলঙ্গ। আমাকে দেখে ভয় পাবার কারণ নেই। এখান থেকে বিশ মাইল দূরে নদীর ধারে আমার বাড়ি। সেখানে আমি একাই থাকি, কেননা তিন কুলে আমার আপন বলতে কেউ নেই” বজ্রের মত কঠিন, অথচ বাঁশির মত সুরেলা গলায় নিজের পরিচয় দেয় সুপুরুষ যুবক।
লিং কেলিয়ান তার পাপড়ির মত দুচোখ মেলে যুবকের সৌন্দর্যকে মনে মনে তারিফ করতে করতে বলে, “আমার বাবা আমাকে এক বুড়ো থুত্থুড়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে। আমি তো মরে যেতেই চেয়েছিলাম...তুমি কেন আমাকে বাঁচালে? এ জীবন এখন আমার কাছে দুর্বহ বোঝা বই আর কিছুই নয়। আমাকে বরং নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দাও, যেমন নিয়ে এসেছিলে।”
লিং-এর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে মিংলঙ্গ তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, “ও কথা মুখেও এনো না। এই পৃথিবীতে আমারও কেউ নেই। আর তুমি ফিরে গেলে তোমার কপালে অশেষ যন্ত্রণা লেখা আছে। তাই আমার কথা শোন, মনে জোর আনো। আত্মহত্যার চাইতে বড় পাপ কিছু নেই। প্রাণ অতি মূল্যবান। যদি রাজি থাক, আমার সাথে জীবন কাটাতে পার সচ্ছন্দে।”
মিংলঙ্গ-এর কথায় মনে সাহস আসে লিং-এর। তার কুমারী মন নতুন জীবন ফিরে পেয়ে সতেজ হয়ে ওঠে। মিংলঙ্গ-এর অকপট স্বীকারোক্তিতে সে ভরসা পায়। আর যাই হোক, ইচ্ছে করলেই সে লিং-এর উপর বলপ্রয়োগ করতে পারত। তা না করে সে যখন ঘর বাঁধার প্রস্তাব দিয়েছে, তাকে প্রত্যাখ্যান করার কোনও ইচ্ছেই হয় না তার। দুই বাহু দিয়ে সে মিংলঙ্গ-কে আলিঙ্গন করে বাহুপাশে বেঁধে ফেলে। জীবনে প্রথম পুরুষ স্পর্শে থরথর করে কাঁপতে থাকে লিং-এর শরীর।
ফুচুন নদীর বালুকাবেলায় মাসের পর মাস, কোথা দিয়ে আদরে সোহাগে কেটে গেল, লিং আর মিংলঙ্গ দুজনেই বুঝতে পারেনি। একদিন ভোরবেলায় হঠাৎ লিং কেলিয়ান দেখল, মিংলঙ্গ-এর কোমরে সবুজ ডোরা কাটা দাগ। চমকে উঠল লিং। সে জানত, এমন দাগ থাকে শুধু ড্রাগনের শরীরেই। তবে কি মিংলঙ্গ মানুষরূপী ড্রাগন? যদি ড্রাগন হয়ও, তবু তো সে লিং-কে নিজের প্রাণের চাইতেও বেশি ভালবাসে। লিং-কে কাছে পাবার জন্যই কি সে সব কথা লুকিয়ে রেখেছে? যখন মিংলঙ্গ-এর নতুন রূপ আবিষ্কার করে কিছুটা ভয় মিশ্রিত বিস্ময়ে সে তার শরীরের দিকে তাকিয়ে আছে, তখুনই ঘুম ভেঙে যায় মিংলঙ্গ-এর। লিং কেলিয়ানের মনের কথা পড়ে নেয় সে এক লহমায়।
“অনেকবার তোমাকে বলতে চেয়েছি যে, আমি আসলে এক ড্রাগন। কিন্তু কী জান প্রিয়তমা, প্রতিবার নিজেকে সংযত করেছি এই ভেবে, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে যাও? আমাকে এক সুন্দর জীবন দিয়েছ তুমি। আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছ যে, আসলে এক ড্রাগন বাস করে আমার শরীরে। এখন কি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”
মিংলঙ্গ-এর দুই হতাশ, দুঃখ ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে লিং-এর মন অন্য কথা বলে। সে মিংলঙ্গ-এর হাতে হাত রেখে বলে, “মানুষের চাইতেও তুমি সুন্দর, সুন্দর তোমার মন। আমার জীবনকে ভালাবাসায়, মমতার বাঁধনে বেঁধে, যে নতুন জীবন তুমি আমাকে দিয়েছ, তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।”
এমনি ভাবেই সুখে দিন কাটতে থাকে লিং আর মিংলঙ্গ-এর। একদিন ফুচুন নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছে মিংলঙ্গ, আর ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত লিং। হঠাৎ নদীতে জামাকাপড় ধুতে গিয়ে লিং দেখে একজন অচেনা মানুষ কাঁধে বিরাট এক ঘড়া নিয়ে জল ভরে ফিরছে। লিং নিজেকে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে লোকটাকে দেখতে থাকে অলক্ষ্যে। আরে, কী আশ্চর্য! এ যে তার মামাবাড়ির গাঁয়ের লোক! মিংলঙ্গ ছাড়া কোনও মানুষের সংস্পর্শে আসেনি লিং কেলিয়ান এই কয়েক মাসে। তাই চেনা মানুষের দেখা পেয়ে সে দৌড়ে ছুটে যায় তার কাছে। মানুষটি থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ লিং-কে দেখে। তারপর চিনতে পেরে বলে, “তুমি লিং কেলিয়ান! জো এর মেয়ে! এখানে কেমন করে? আর কী সুন্দরই না তোমাকে দেখতে হয়েছে! আগে যখন ছোটটি ছিলে, তখন দেখেছি। তারপর তোমার মামারা তোমাকে তোমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিল...”
“সব মনে আছে খুড়ো। কিন্তু আমার মামাবাড়ি, সে এখান থেকে কতদূর... জানা নেই...”
“অনেক দূরে। সেখানে বড় জলের কষ্ট। তিনবছর এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। খেতখামার সব শুকিয়ে গেছে। খাল বিল শুকনো ফুটিফাটা। ফুচুন নদী ছাড়া আমাদের আর কোনও গতি নেই। কিন্তু এতদূর থেকে জল ভরে নিয়ে যাওয়া বড় কষ্টের...”
মামাবাড়ির গাঁয়ের লোকটিকে ঘরে এনে, খাইয়ে দাইয়ে, লিং তাকে বিদায় দেয় মিংলঙ্গ ফিরে আসার আগেই। কে জানে, হয়ত অচেনা লোক দেখলে ড্রাগন রাগ করবে!
মিংলঙ্গ ফিরে আসতেই লিং কেলিয়ান বায়না ধরে, “জানো, আমার মামাবাড়ির গাঁয়ে বৃষ্টি হয়নি তিন তিনটে বছর। গাঁ শুকিয়ে গেছে, খেতে ফসল ফলছে না, জল ভরতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হচ্ছে। আমি জানি ড্রাগনরা বৃষ্টি আনতে পারে। তোমার কাছে আজ অবধি কিচ্ছু চাইনি। তুমি সেখানে বৃষ্টি নিয়ে এস, লক্ষ্মীটি।”
লিং-এর কথা শুনে মিংলঙ্গ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ভাবে। আসলে ড্রাগন হঠাৎ বৃষ্টিপাত ঘটানোর ক্ষমতা রাখে ঠিকই, কিন্তু অকারণে নিজের ইচ্ছেমত সেই কাজটা করলে স্বর্গের দেবতা জেড প্রচণ্ড রেগে যেতে পারে। স্বর্গের নিয়ম বড় কঠিন। সেক্ষেত্রে মিংলঙ্গ-এর কঠোর শাস্তি হতে পারে। কিন্তু লিং-এর দুঃখে মিংলঙ্গ বিচলিত হয়ে পড়ে। মনের মানুষটিকে আনন্দ দিতে মিংলঙ্গ স্থির করে, ব্যতিক্রম ঘটিয়ে দেখাই যাক না, কী হয়!
তারপর মিংলঙ্গ নিজের শরীরটা প্রকাণ্ড করে তুলল। মানুষের রূপ থেকে বেরিয়ে এসে তার আসল ড্রাগন রূপ ফুটে উঠল। বড় হতে হতে তার মাথা আকাশ ফুঁড়ে আরও উঁচুতে উঠে গেল। ড্রাগনের লেজ আছড়ে পড়ল ফুচুন নদীর জলে। লেজের ঝাপটায় নদীর জল দুকূল ভাসিয়ে দিল। লিং কেলিয়ান ভয়ে চোখ বন্ধ করল। মিংলঙ্গ উড়ে গেল লিং কেলিয়ানের মামাবাড়ির গাঁয়ে। তার নিঃশ্বাসের টানে যত মেঘের দল কালো হয়ে আকাশে ধেয়ে এল। তারপর বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। একটানা চলল সেই বৃষ্টি। গাঁয়ের সব মানুষ ঘর ছেড়ে বাইরে এসে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল। বহু প্রতিক্ষিত বৃষ্টিতে তাদের আনন্দ রাখার জায়গা নেই সেদিন। করজোড়ে মিংলঙ্গ-কে তারা ধন্যবাদ জানাল বৃষ্টি এনে দেবার জন্য। লিং কেলিয়ানের জন্য তারা জানাল প্রাণ ভরা স্নেহ।
স্বর্গের দেবতা জেডের কানে গেল মিংলঙ্গ-এর অসময়ে বৃষ্টি নামানোর সংবাদ। তিনি বেজায় চটে গিয়ে স্বর্গের কোতোয়ালদের ডেকে, মিংলঙ্গ-কে পাঠালেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। মিংলঙ্গ-কে স্বর্গে ধরে নিয়ে গেল কালো পোশাকের দেবদূতেরা। লিং কেলিয়ানের অনেক মিনতিও তাদের এতটুকু বিচলিত করতে পারল না। লিং-এর কাছে চোখের জলে বিদায় নিয়ে মিংলঙ্গ তাকে আশ্বাস দিল, “রাজা জেড নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে শাস্তি দেবেন না। মানুষের কষ্টের কথা শুনলে তিনি অবশ্যই ব্যথা পাবেন। নিজেকে যত্নে রেখ। আমি ঠিক ফিরে আসব।”
মিংলঙ্গ-এর জন্য সারারাত কেঁদে ভাসাল লিং কেলিয়ান, কিন্তু মিংলঙ্গ ফিরে এল না। স্বর্গের রাজা জেড মিংলঙ্গ-কে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তার শরীর টুকরো টুকরো করে ক্ষুধার্ত কুকুরদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হল। এদিকে লিং কেলিয়ানের প্রসব বেদনা উঠল। তার জঠরে পালিত হচ্ছিল মিংলঙ্গ-এর সন্তান। জন্ম নিল মিংলঙ্গ এর পুত্র, লিং তার নাম রাখল জিও জিন মিংলঙ্গ।
মায়ের যত্নে বড় হতে লাগল মিংলঙ্গ-এর ছেলে জিও। বাপের মতই সে সুপুরুষ হবে, ছোটবেলা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু স্বামীহারা লিং, কায়ক্লেশে ছেলেকে মানুষ করতে লাগল। অপূর্ব সুন্দরী লিং কেলিয়ান যেন যৌবনেই মেনে নিল বার্ধক্য। মলিন হল তার পোশাক, স্বামী জিন মিংলঙ্গ-এর শোকে তার রঙ হতে লাগল বিবর্ণ। তবে মা-ছেলের কষ্টের কথা বেশিদিন চাপা থাকল না। একদিন ফুচুন নদীতে ভিড়ল এক সাধারণ নৌকা। তার থেকে নামল লিং কেলিয়ানের বাবা। মেয়েকে দেখে তার বুক দুঃখে মুচড়ে উঠল। লিং বাবাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদল। নাতি জিওকে দেখে লিং-এর বাবা খুব খুশি। সে তখুনি দুজনকে নৌকায় বসিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেল নিজের গাঁয়ে।
গাঁয়ে লিং-এর জন্য যে বিপদ ওত পেতে বসে আছে, কে জানত! গরীব বাবা মেয়ের দুঃখের খবর জানতে পেরে ছুটে গিয়েছিল যে আশায়, সেই আশা ভেঙে টুকরো হয়ে গেল একমুহূর্তে।
বুড়ো জো, যে ধনী ব্যবসায়িকের সাথে লিং কেলিয়ানের বিয়ে হয়েছিল, লিং বেঁচে আছে জানতে পেরে সাথে সাথে ছুটে এসে সে দাবি জানাল, “তোমার এই নাতি অবৈধ সন্তান। ওর মায়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিলে, আর সে কিনা অন্য পুরুষের সাথে ঘর করেছে আমার চোখে ধুলো দিয়ে! এর শাস্তি তাকে পেতেই হবে।”
লিং-এর অসহায় বাবা করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে বলল, “আমার মেয়ে স্বামী হারা। এই শিশু সন্তানের কোনও দোষ নেই। আমি আজ আছি, কাল থাকব না। তখন এই শিশুকে মানুষ করবার জন্য কে থাকবে বল? ক্ষমা করে দাও, বয়সের দোষ বলে ছেড়ে দাও ওকে। তোমারও তো তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে!”
লিং-এর বাবার কথায় বুড়ো ব্যবসায়িক আরও রেগে গেল। সে চিৎকার করে উঠে বলল, “একটা উপায় আছে তোমার মেয়েকে বাঁচানোর। যত ধনসম্পত্তি তোমাকে আমি বিয়ের সময় দিয়েছিলাম, সব তুমি সুদে আসলে ফেরত দাও। নইলে লিং-এর মৃত্যু অবধারিত।”
লিং কেলিয়ানের বাবা সব সম্পত্তি এতদিনে নিজের পেট চালাতেই ব্যয় করে ফেলেছিল। গরিব লোকটা আর কোথা থেকে সম্পত্তি ফেরত দেবে! অনেক অনুনয়-বিনয়ে চিঁড়ে ভিজল না। বুড়ো ব্যবসায়িকের পোষা গুণ্ডারা লিং-কে বাঁশের তৈরি খাঁচায় বন্দী করল। তারপর তাকে ফুচুন নদীর জলে ডুবিয়ে দিল। হাহাকার করে উঠল লিং-এর বাবা। নদীর ধারে ছুটে গেল লিং-এর ছেলে জিও মিংলঙ্গ। কাঁদতে কাঁদতে সে তার মাকে ছেড়ে দেবার জন্য গুণ্ডাদের কাছে বারবার মিনতি করতে লাগল। কিন্তু প্রভুর আদেশ তাদের কাছে অনেক বড় ছিল, তাদের হৃদয় ছিল পাষাণ দিয়ে তৈরি। জিও -কে লাথি মেরে তারা তাড়িয়ে দিল। গাঁয়ের লোকে তামাশা দেখতে লাগল। কারো কারো অবশ্য লিং কেলিয়ানের মর্মান্তিক পরিণতি দেখে মন খারাপ হতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ এক দৃশ্য ফুচুন নদীর তীরে দাঁড়ানো মানুষকে শিহরিত করে দিল।
সভয়ে সবাই দেখল জিও মিংলঙ্গ-এর শরীর আস্তে আস্তে বড় হতে থাকছে, গায়ে তার ফুটে উঠছে চাকা চাকা দাগ, সবুজ হয়ে উঠছে তার গোটা শরীর। রাগে তার শরীর গজরাচ্ছে। বড় হতে হতে একসময়ে তার শরীর আকাশ ছুঁয়ে গেল। ড্রাগনের লেজের ঝাপটে সব গুন্ডা নদীতে সলিল সমাধি পেল। ড্রাগন জিওর মুখ থেকে লেলিহান শিখা ছুটে গিয়ে বুড়ো ব্যবসায়িককে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। গাঁয়ের সব মানুষ ভয় পেয়ে যে যার ঘরে গিয়ে খিল তুলে দিল।
ড্রাগন রূপী জিও, ব্যবসায়িক আর তার পোষা গুণ্ডাদের শাস্তি দিয়ে ফুচুন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে লিং কেলিয়ান-কে তুলে আনল বাঁশের খাঁচা সমেত। কিন্তু খাঁচা খুলে দেখা গেল, সব শেষ— লিং-এর প্রাণহীন দেহ খাঁচার এক কোণায় পড়ে। তার সন্তান জিও রাগে দুঃখে চিৎকার করে উঠল। আকাশ থেকে বজ্রপাত হতে লাগল। ড্রাগনের মাথা আবার আকাশ ফুঁড়ে উপরে উঠে গেল। তার কান্না ঝরে পড়ল বৃষ্টি হয়ে। নদীতে তুফান উঠল। তিনদিন একটানা বৃষ্টিতে ফুচুনের দুকূল ছাপিয়ে গেল। প্রবল প্লাবনে ভেসে গেল গাঁ। সেই থেকে প্রতিবছর কুইংমিং উৎসবের সময় পৃথিবীর মাটিতে বৃষ্টি হয়।
বৃষ্টি থেমে যেতে বুড়ো ওয়াং শু বকবক থামিয়ে নাতনি ইউ ইয়ান-কে তাড়া দিল, “চল দিদি, বৃষ্টি থেমে গেছে। এবার পা চালিয়ে না গেলে বড় দেরি হয়ে যাবে। ওই দ্যাখ, শান্ত হয়ে গেছে জিও জিন মিংলঙ্গ।”
ইউ ইয়ান দাদুর পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে জিজ্ঞেস করল, “প্রতিবছর কেন বৃষ্টি হয় দাদু, সেটা তো বললে না?”
“ওই যে প্রতি বছর জিও তার মায়ের কবরে এসে কাঁদে। তখন বৃষ্টি হয়। কিন্তু তাকে দেখা যায় না। এটা তো ওদের মা-ছেলের ব্যাপার, বুঝলি না? এবার চল, তেনারা না খেয়ে বসে আছেন পথ চেয়ে... আমার স্বর্গগত বাবা-মা।”
(চীনের লোককথা অবলম্বনে)
………………
বাহ
ReplyDelete