গল্পঃ মোম জোছনায়ঃ সাগরিকা রায়

                                                       



মিষ্টি হাসল মহিলাটি। ঘন রঙের লং কামিজের গোলাপ প্রিন্ট থেকে গোলাপগুলো তীব্র সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। এই ঘরে ঢুকেই গন্ধটা নাকে ঢুকে গিয়েছে জবরদস্ত। অম্লানের ভালো লাগছে। সুবাসিত ঘর! গন্ধের উৎসটা পেয়ে স্বস্তি হল। গোলাপগুলো কি তাজা? নইলে এমন সুগন্ধ কোনও পোশাকের প্রিন্ট দিতে পারে বলে শোনেনি অম্লান। অবশ্য পৃথিবী এখন যেভাবে দৌড়চ্ছে, তাতে কী হতে পারে আর কী হতে পারে না, দেবা ন জানন্তি। মানুষ হয়তো জেনে ফেলেছে! ছবির খাবার থেকে হুবহু সেই খাবারেরই গন্ধ পাওয়া যায় বলে কারা রটিয়ে ছিল। আইডিয়াটা ভালো। তো সেই আইডিয়া আত্মস্থ করে যদি পোশাকের ফুল ছাপ থেকে ফুলের গন্ধ বের হয়, তাতে ক্ষতি কী? তবে গন্ধটা প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগে। পরে দম আটকে আসতে থাকে যেন। বন্ধ ঘরে এমন তীব্র সুবাসে শ্বাসকষ্ট হয়। 

“আসুন। ইনটিরিয়র ডেকোরেশনের পরামর্শ চাই? বসুন। আপনার অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে আছে আপনি ইনটিরিয়র ডেকোরেশনের পরামর্শ চান। বেশ, বলুন, কী জানতে চান?”

“না, মানে, আমি আসলে সেটা বলতে চাইনি। টাইপ মিসটেক হয়েছে মনে হচ্ছে। আমি ইনটিরিয়র ডেকোরেশন সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি। অ্যাকচুয়ালি ওটা আমার প্রফেসন। আমি সবসময় মানে একটু ডিপ্রেসড আছি। ইনসমনিয়া আছে আমার। সবসময় বিমর্ষ থাকি। তো, আমার অফিস কলিগ সঙ্গীতা বলল এখানে আসতে…!”

“আচ্ছা! আমাকে প্রথমে জানতে হবে ডিপ্রেশনের কারণ। কেন আপনার মধ্যে মন খারাপের রোগ বাসা বেঁধেছে? বন্ধু মনে করে বলুন। কথাবার্তা আমার আর আপনার মধ্যে থাকবে। এটা আমার বিজনেস। এই রুম থেকে বাইরে বের হলেই আমি আপনাকে চিনব না।” মহিলা চমৎকার গোলাপি ঠোঁটের নড়াচড়ায় শব্দগুলো নিয়ে খেলছেন। দুধসাদা দাঁতের ঝিলিক কুন্দফুলের মত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মাঝে মাঝেই। চোখের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বপূর্ন আন্তরিকতা।  

“আসলে, আমার কিছুই ভালো লাগে না। না ভালো লাগে খেতে, না বই পড়তে, না বেড়াতে! আসলে ব্রেক আপের পর থেকেই…!” অম্লান দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিজেকে মেলে ধরতে সঙ্কোচ হচ্ছিল।  

“আপনি অ্যারোমাথেরাপির ঘরোয়া উপায় ফলো করতে পারেন।” মহিলা নেইল কাটারটা হাতে তুলে নিলেন। চকচকে নেইল কাটার। ভারী সুন্দর। 

“মানে?”

“ঘরে পা রেখে মৃদু সুগন্ধ যখন আপনাকে আপ্যায়িত করবে, তখন মুগ্ধ হবেন নিশ্চয়? শুনুন, দারুণ করে ঘর সাজিয়ে কোথাও একটা অভাব অনুভব করছেন। ঘর বিমর্ষ হয়ে আছে। মনে রাখবেন, তাঁরও সুবাসিত হতে ইচ্ছে করে। ঘর খুশ মানেই আপনি খুশ। একাকিত্ববোধটা কেটে যাবে। নিজেকে নতুন করে ভালবাসতে ইচ্ছে করবে। আমরা চাই, কেবল আপনি নন, আপনার পারিপার্শ্বিকও সুস্থ হয়ে উঠুক।” 

মহিলার নামটা মনে ছিল না। সঙ্গীতা বলেছিল। চেম্বার থেকে বেরিয়ে নেমপ্লেটটা দেখে নিল অম্লান। আকিরা। ফ্র্যান্ড আকিরা। ইনটিরিয়র ডেকোরেটর অ্যান্ড কাউন্সিলার। নামটা দেখেই কুরোসাওয়া আর কুরোসাওয়া মনে হতেই সেভেন সামুরাই কেন মনে হল, জানে না অম্লান। আসলে সবই চেইনে বাঁধা। নাগরদোলার বাক্সের মত। একটার পর একটা দুলে দুলে আসে। কুরোসাওয়ার মধ্যে শেষ জীবনে মৃত্যুচিন্তা আসছিল। কোন ছবিটিতে যেন মৃত্যুচিন্তার ছাপ পড়েছিল? মনে করতে পারল না অম্লান। সঙ্গীতার কে এসেছিল এখানে? নামটা জেনে রাখা উচিত ছিল। তবু বলে দেখবে নাকি?

“নামটা চেনা নয়। আপনি পেশেন্টের নাম বললে রেজিস্টার খাতা খুলে দেখে বলতে পারতুম। কে পাঠিয়েছে, সেটা আমার জানার কথা নয়।” মহিলার কথায় মিষ্টি থাকলেও একটা দৃঢ়তা ছিল। অম্লান আর বেশি কিছু বলার সাহস করল না। 

কাফে ডি ক্যাফের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কফির গন্ধ নাকে ঠেকল না। আসলে বাইরে গন্ধ বেরিয়ে যাওয়া মানে অপচয়। এক পয়সার অপচয় হতে দেবে না এরা। কাচের সুদৃশ্য ঘরের আধুনিক সোফায় শরীর এলিয়ে দিলেই চকচকে কাচের সেন্টার টেবিলের ওপর বিদেশি ম্যাগাজিনে চোখ আটকে যাবেই। আর তখনই মেনু কার্ড দেখে কোল্ড না হট, মাফিন না কোকো স্ট্রবেরি বেছে নিতে পারবে কাস্টমার। তখন গন্ধটা আসবে। বিনে পয়সায় গন্ধটুকুও ছাড়বে না এরা। 

আরেকটু হেঁটে বাঁদিকের সরু গলিতে খানিকটা যেতেই চোখে পরল নামটা। বিউটি কুইন। এটা কি পার্লার? এখানেই কি আকিরার প্রেসক্রাইব করা অ্যারোমাথেরাপির জিনিসগুলো পাওয়া যাবে? 

ভ্রু নাচিয়ে মেকআপে জর্জর মেয়েটি শ্রাগ করল, “না। এখানে নেই।”

“তাহলে কোথায় পাব বলতে পারবেন?”

“ফ্রেন্ড আকিরায় চলে যান। সামনে গিয়ে বাঁদিকে যাবেন। ডানদিকে সিঁড়ি…ব্লা ব্লা ব্লা।”

বিরক্ত লাগল অম্লানের। আকিরা নামের মহিলাটি আগেই বলে দিতে পারত যে, মশাই, এসব আমার থেকেই নিতে হবে। বাইরে কিচ্ছুটি পাবেন না গোঁসাই। তা না করে বেকার ছোটাল। আসলে নিজেকে ক্লিন দেখাতে চায়। অম্লান ঘুরে ফিরে দেখে নিক। নইলে ভাববে আকিরা প্রোডাক্ট বেচার জন্য কনভিন্স করছে। 

ফের দরজা ঠেলে আকিরার রুমে ঢোকার আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হল। দশ মিনিট বসে থেকে দেওয়ালের থাঙ্কা, জাপানিজ চিত্রকলা দেখল অম্লান। যখন বিরক্ত হবে ভাবছে, তখনই ঠিক দশ মিনিটের মাথায় ডাক পড়ল।

সেই মিষ্টি গন্ধ! মন আবিষ্ট হয়ে যায়। গোলাপি লম্বা ঝুলের পোশাক জুড়ে বড় বড় লাল গোলাপ ফুটে রয়েছে। আহ! কী সুগন্ধ! নাক টেনে শ্বাস নিল অম্লান। মহিলা এরই মধ্যে পোশাক পালটে নিলেও গোলাপের ব্যাপারটা রয়েছে কিন্তু। ভাবল অম্লান। 

“বলুন।” 

“আপনি অ্যারোমাথেরাপির জন্য যা যা নিতে বলেছিলেন, সেসব বাইরে কোথাও পেলাম না। শুনলাম, এখানেই পাওয়া যাবে। তাই…!”

মিষ্টি হাসলেন মহিলা। লম্বা লম্বা আঙুলের সরু সরু নখে হলুদ নেইলপলিশের ওপরে গ্লিমার সেট করা। চোখের রঙ ঘন বাদামী। কন্ট্যাক্ট লেন্স। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক। চোখে ঘন ল্যাশ। ঘাড় কাত করে তাকালেন মহিলা, “কী ইচ্ছে করছে?”

“মানে?” চমকে উঠেছে অম্লান। মহিলা কি টেলিপ্যাথি জানেন? 

“যার জন্য ডিপ্রেশন, তাকে আঘাত দিতে ইচ্ছে করছে?”

“না, না, তা কেন?”

“করছে। মনের অগোচরে প্রতিশোধের স্পৃহা রয়েছে। কিন্তু অন্যমন তাকে চাপা দিয়ে রেখেছে। মন অতি বিষম বস্তু, বুঝলেন?” নখের গ্লিটার চমকে উঠল। 

অম্লান মহিলাকে বুঝতে চেষ্টা করছিল। কী বলতে চান মহিলা?

“মোম জ্বালাতে ভালো লাগে?”

“মোম? আমার এলাকায় লোডশেডিং হয় না…!”

“সেই জন্য বলিনি। সেন্টেড ক্যান্ডেলের কথাই বলছি। আপনি সাধারণ মোম ইউজ করবেন। রোজ এসেন্সিয়াল অয়েল ড্রপারে করে দুফোঁটা ঢেলে দিন মোমের ওপরে। ঘর গোলাপের গন্ধে ভরে উঠবে।”

“গোলাপ?”

ফিসফিস করে হাসলেন মহিলা, “সে বুঝি গোলাপ ভালোবাসে?”

“সে? ও ফুল ভালোবাসে। যে কোনও। জুঁই, গোলাপ…!”

“একটা কথা বলুন। তার কথা আপনার মনকে আবিষ্ট করে রাখছে। নিজে উপস্থিত না থেকেও সে কিন্তু উপস্থিত। আপনার মন সে অধিকার করে রেখেছে। আপনার চিন্তাধারা হারিয়ে যাচ্ছে গোলকধাঁধায়। সব সে ক্যাপচার করে রেখেছে। এটা কিন্তু তার অপরাধ নয়। কোথাও না কোথাও তার মনের ভেতরে আপনিই আছেন,” মহিলা মেকআপ চর্চিত মুখটি অম্লানের মুখের সামনে এগিয়ে আনেন, “আপনি বুঝতে পারছেন? যদি আপনাকে ছেড়ে উনি চলেই গেলেন, অন্য একজনকে ভালবাসলেন, তাহলে কেন আপনাকে আটকে রেখেছেন মনের খাঁচায়? এটা অপরাধ নয়?” মহিলার হাসিতে গোলাপের গন্ধ। সুবাসে মন ভুর ভুর করছে অম্লানের। মনে হচ্ছে আকিরা ওর বন্ধু। ওর কাছে সব বলা যায়। আকিরার সব কথাই সত্যিকথা।

“অপরাধ? ভীষণ রকমের অপরাধ।”

অম্লান মনের দরজা খুলে দিল, “ওর জন্য কী করিনি বলুন? ঝড় বৃষ্টির রাতে মন্দিরে দেখা করতে বলেছিল। বাড়িতে লুকিয়ে ভিজে একশা হয়ে গিয়ে দেখিও আসেনি। ফোন করছি। রিঙ হচ্ছে। রিসিভ করছে না। আমি ভয় পেলাম এই ভেবে যে, ও একা একা আমার আগেই মন্দিরে আসেনি তো? কিছু হয়ে গেল না তো? আজকাল জানেন, মেয়েরা নিরাপদ নয় মোটেই। পাগলের মত ছুটোছুটি করে মরছি, তখন সে ফোন রিসিভ করল, “অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তুমি আসছ না বলে চলে এলাম।” অথচ মন্দিরের পুরোহিত বললেন, সন্ধের পর থেকে উনি ছাড়া মন্দিরে কেউ আসেনি। ঝড় বৃষ্টিতে কে আসবে? আমি যাওয়াতে উনি নাকি অবাক হয়েছিলেন। এমন ভিজে টিজে গিয়েছি বলে। আর, আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম, ও যখন ফোনে কথাগুলো বলছিল, পাশ থেকে কেউ ওকে সংলাপ শিখিয়ে দিচ্ছিল। পুরুষকন্ঠ। এরপরেও ক্ষমা করে দিয়েছি। ভেবেছি, এসেছিল। পুরোহিত মশাই হয়তো খেয়াল করেননি। কিন্তু এই ধরণের প্রতারণা বারবার হল। বারবারই আমি নিজেকে স্তোক দিয়ে চললাম। নিজের থেকে ওকে বিশ্বাস করলাম। একদিন ও ধরা পড়ে গেল। ও রেজেস্ট্রি ম্যারেজ পর্যন্ত করে ফেলেছে তখন। আমাকে জানাল সারপ্রাইজ পার্টির দিন। কী অসম্ভব বোকা আমি! ওর ডাকে গিয়েছি। ঘন ইন্ডিগো কালারের জমকালো লেহেঙ্গার জরির ফুলকে চমকে দিয়ে ও বরের হাত ধরে এগিয়ে এল, “আমরা বিয়ে করেছি।” ভাবুন। দৃশ্যটা জাস্ট ভাবুন।”

“ওহ্! তারপর?”

“কী ভাবে বাড়িতে ফিরেছিলাম, মনে নেই। জ্বলতে জ্বলতে শরীর মন সব জ্বলে পুড়ে ছাই। এখন নিজেকে জ্যান্ত লাশ বলে মনে হয়।”

“জ্যান্ত লাশ? আপনার প্রাণ ভোমরা কার কাছে লুকিয়ে আছে, সেটা বুঝেছেন তো?”

অম্লান মহিলার কথার জবাব দিল না। মহিলা মানে আকিরা উঠে দাঁড়াল। লীলায়িত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াতেই ওর পোশাকের ফুলের কুঁড়িগুলো এক এক করে ফুটে উঠছিল। আর কী চমৎকার সুবাস এই ফুলের ফুটে ওঠার পর। নাক টেনে টেনে সুবাস বুকের ভেতরে নেয় অম্লান। আকিরার পায়ের পাতা অবধি নেমে আসা পোশাক মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছিল। অম্লান স্পষ্ট দেখল, পোশাকের লাল টকটকে গোলাপগুলো ইচ্ছেমতো গড়িয়ে গড়িয়ে মেঝেতে নেমে আসছে। মেঝে ভর্তি লাল গোলাপ দৌড়োদৌড়ি করছে। ঘরময় কী সুবাস, কী সুবাস! এগুলোকেই কি বসরাই গোলাপ বলে। অম্লানের খুব আনন্দ হল। মনে হল খুব জোরে হেসে উঠতে হবে ওর। হা হা হা হা। আবার খুব খুব কাঁদবে ও। আহা, কী আনন্দ! খুব আনন্দ হচ্ছে। কাজেই কী কী করবে কে জানে। হাততালি দিয়ে নাচবে ঘুরে ঘুরে, “এই ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই...।”

“আসুন। আসুন অম্লান। আমার সঙ্গে আসুন।” কেমন মোহময় সুরে ডাকে আকিরা! যেন বেদেনী সাপ ধরার জন্য বাঁশি বাজাচ্ছে। 

এই ঘরের পাশে বুঝি আরেকটি ঘর আছে? অম্লান আগে খেয়ালই করেনি। আকিরা বলার পরে তাকিয়ে দেখে লতাপাতা আঁকা চমৎকার কাচের দরজা। অম্লানের মনে হচ্ছে লতাপাতাগুলো যেন তাজা। ওগুলো আঁকা নয়?

“আঁকা কী আঁকা নয়, সব আপনার ইচ্ছের ওপরে। যদি মনে করেন ওগুলো জ্যান্ত হলে, লিভিং থিং হলে আপনার ভালো লাগবে, তাহলে ওগুলো তা-ই। যেমনটি আপনি চান।” মহিলার হলদে নখের গ্লিটার ঝা গ্লিচ ম্লিচ ঝুকুমুকু করে নড়ছে অম্লানের চোখের সামনে। অম্লানের মনে হচ্ছে কাচের দরজায় গায়ে আঁকা লতাপাতাগুলো আসলে সব শাঁখামুটি সাপ। শাঁখামুটি সাপ কবে দেখেছে অম্লান জানে না। এখন মনে হচ্ছে এই সাপ ওর চেনা। এগুলোকে শাঁখামুটি বলে। কাচের দরজা পেরিয়ে ওপাশের ঘরে যাবে কী করে অম্লান? সাপ ছোবল দেবে না?

“সাপ? আসুন, ও আপনাকে চেনে। কিচ্ছু বলবে না। আসুন। আসুন না!” কী মায়াময়, মোহময় ডাক! যেন সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে এক অনন্যা। তার শুভ্র নিটোল বাহু বাড়ায়ে ডাকছে “এস অম্লান, আমার কাছে এস। আমি তোমার জন্য মন্দিরে দাঁড়িয়েছিলাম। সত্যি!” অম্লান কাচের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কেন যেন কিছু ভাবতে পারছে না ও। কেউ চালিত করছে, ও তার হুকুম পালন করছে সুতো বাঁধা পুতুলের মত।  

কাচের সুদৃশ্য দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল মহিলা। আকিরা। সম্মোহিতের মত পেছনে গেল অম্লান। ঘরের ভেতরে পা রেখে চমকে উঠল ও। আকিরা কোথায়? ওর ঠিক আগেই ঢুকেছে এই ঘরে।তাহলে গেল কোথায় ওকে না বলে? ঘরে চারপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখল অম্লান। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট এর ওপরে কুশন ছড়ানো। একটা স্বপ্ন স্বপ্ন আলো ছড়িয়ে আছে ঘরে। ভালো করে সব দেখাও যাচ্ছে না। ঝাপসা ঝাপসা আলোর মধ্যে আসবাবগুলোকে মনে হয় জীবিত কিছু। বন্ধ জানালার গায়ে ঝুলে থাকা লম্বা লম্বা পর্দাগুলো যেন উড়ে উড়ে আসছে ওকে ডাকতে। ঘরের এক কোনে একটি বড় টব। টবের মধ্যে লম্বা লম্বা শুকনো ডাল। ডাল থেকে দুদিকে সরু সরু শাখার সঙ্গে ছোট ছোট মাথার খুলি। খুব ভয় পেয়েছে। এটা কোথায় এসেছে অম্লান? ও ছুটে ঘরের অন্য কোণে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানে টব রয়েছে। টবে ক্যাকটাস জাতীয় কিছু উদ্ভিদ রয়েছে। এগুলো কি উদ্ভিদ? এগুলো মরা মানুষের আ…..আঙ্গুল নিশ্চয়। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা কিছু মরা মানুষের আঙুল। কোনদিকে পালাবে ঠিক করতে পারছিল না অম্লান। সেই গোলাপ আকিরা নেই এখানে? ভাবতে ভাবতেই ঘর পালটে যাচ্ছিল ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট, ওয়াল টু ওয়াল পর্দায় এত এত গোলাপি রঙ! এত গোলাপ কখন ফুটেছে? সদ্য সদ্য ফুটে ওঠা গোলাপের সুবাসে সুবাসিত ঘর। রাশি রাশি গোলাপ থেকে আলগা হয়ে এল আকিরা। মুখে মৃদু হাসি, “খুঁজছিলেন?”

“হ্যাঁ, ওখানে মাথার খুলির ডাল ছিল টবে, আর, মরা মানুষের আঙুল...।” 

“আচ্ছা, আচ্ছা। আপনি মাথার খুলি দেখেছেন টবে? ভয়ের ব্যাপার। উফ! আসলে স্ন্যাপড্রাগন বীজ দেখেছেন। ওটা আমার ওষুধ বানাতে কাজে দেয়। আর মরা মানুষের আঙ্গুল! ভালো বলেছেন। ওগুলোকে দেখতে মরা মানুষের আঙ্গুলের মত লাগে। ওগুলো ফাঙ্গাস। স্যাপব্রিক ফাঙ্গাস। নাম আছে ওর। জাইলেরিয়া পলিফরমা। ওটাও আমার কাজে লাগে। ওরা আপনাকে ভয় দেখায়নি তো? খুব দুষ্টু জানেন তো! ভয় পেয়েছেন?” 

“না, না।”

“আচ্ছা, বেশ ভাল। একটু কফি খান? অল্প খান। ভাল লাগবে। স্নায়ু উইক হয়েছে। কফি তাজা করবে।” কোথা থেকে কফি আনল আকিরা, অম্লান ধরতে পারল না। ছোট্ট একটা গোলাপের মত দেখতে কাপে কফি খেল অম্লান। কী স্বাদ! অমৃত বুঝি এরকমই হয়? আহহ! অদ্ভুত আনন্দে প্রাণ ভরে যাচ্ছে! চোখ বুজে এল আরামে।

“আসুন, এখানে শুয়ে পড়ুন।” একটা কোচের দিকে আঙ্গুল তুলল আকিরা। অম্লান আদেশমাত্র শুয়ে পড়ল। জুতো খোলার কথা মাথায় ছিল না। আকিরা সে সম্পর্কে কিছু বলল না। কিন্তু অম্লান কিছুতেই ভাল করে শুতে পারছে না দেখে আকিরা কাছে এগিয়ে এল, “অসুবিধে?”

“হ্যাঁ, মানে ...জুতো। জুতো না খুলে শোব কী করে?” অম্লান অভ্যস্ত জুতো খুলে শোওয়ায়। ঘোরের মধ্যেও খিচখিচ করছিল মনটা।

“কিচ্ছু হবে না। একটু সময় লাগবে। আজ আনন্দের সময়। জুতোর কথা মাথা থেকে বের করে দিলেই ভাল। আনন্দ। আনন্দ! আর কিস্যু না কিস্যু না কিস্যু না...! হিস হিস করে জিভ নাড়াচ্ছিল আকিরা। একদম শাঁখামুটি সাপের মত। 

অম্লান শুয়ে পড়ল টানটান হয়ে। জুতো পায়েই থাকল। একটু সময়। থাক জুতো? অ্যাঁ?

অম্লানের পিঠের নীচে গোলাপের পাঁপড়ি। নরম নরম পাঁপড়ি। ওরা নড়েচড়ে কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছেল। ঘাড়ে ফুঁ দিচ্ছিল। উহু হু, কী আরাম রে ভাই! 

আকিরা কয়েকটা সুন্দর কাজ করা ডিফিউজার সেরামিক পট অম্লানের চারপাশে সাজিয়ে রাখা আছে। ওর ভেতরে টি লাইট ক্যান্ডল রাখা। ডিফিউজার পটগুলোর ভেতর দিয়ে অল্প অল্পআলো ছিকমিক ছিকমিক করছে ঘরের ভেতরে। অপূর্ব সুবাসিত ঘরে আলোছায়ার খেলা দেখছে অম্লান। 

“চোখ বুজে থাকুন।” আকিরা অম্লানের সামনে এসে দাঁড়াল, “বলুন, কেমন লাগছে? মনে করুন আপনার প্রেমিকা আপনার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে করুন সেই আনন্দের দিন গুলো...ওর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন...! ভাবুন ওর হাতে জুঁই আর গোলাপ...!”

“আমি জুঁই ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। জুঁই ফুল।” অম্লান ফিসফিস করে। 

“আসবে। সে আসবে আপনার কাছে। এতদিন যেভাবে আপনাকে তার কাছে আটকে রেখেছে, এবারে আপনি সেটা করবেন। করবেন তো? আপনাকে সে নিজের কোনও অভিপ্রায় মিটিয়ে নেওয়ার জন্য ইউজ করেছে। অভিপ্রায় মিটে গেলে ছুঁড়ে ফেলেছে আপনাকে। হয়তো দেখবেন, ওর প্রেমিককে কাছে টানার জন্য ঈর্ষার উদ্রেক ঘটাতে আপনার সঙ্গে মিশেছে প্রেমিকার মত। এখন আপনি ওর সঙ্গে তেমনটি করবেন। মনে রাখুন...মনে রাখুন... মনে রা...খু...ন!” 

অম্লানের ঘুম পাচ্ছিল। আকিরার কথায় শান্তি পাচ্ছিল বলে শরীর ছেড়ে দিল ডিভানে। আকিরা একটা প্যাকেটে কী কী গুছিয়ে দিচ্ছিল। রঙবেরঙি চকচকে মোড়কে প্যাকেটটা মুড়ে দিচ্ছিল যখন, অম্লান খুচ খাচ কুচ কাচ শব্দ পেল। আকিরা কি গিফট দিচ্ছে ওকে?

এইটুকুই মনে ছিল অম্লানের। ঘুমিয়ে পড়েছিল ডিভানে। ঘুম যখন ভাঙল, আকিরা সামনেই দাঁড়িয়ে। ওকে চোখ মেলতে দেখে সুন্দর হাসল, “এবারে বাড়িতে যান।” অম্লান অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে বেরিয়ে এল আকিরার ওখান থেকে। যেদিক দিয়ে ঢুকেছিল, এটা কি সেই রাস্তা? না। অন্য রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে ও। ঢোকার রাস্তাটা কোথায়? কেন যেন মনে হচ্ছে ঢোকার রাস্তা হারিয়ে গেলে অম্লান আর আকিরার কাছে আসতে পারবে না। নিশ্চয় পেছনের দিকেই মূল দরজাটা থাকবে। অম্লান বুঝতে পেরেও দাঁড়িয়ে রইল। ইচ্ছে করছে না। হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। এখানে একটু বসে থাকুক ও? নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করছে। আস্তে আস্তে বসে পড়ল মাটিতে। রাস্তার ধারে। তখন দেখল, যে দরজা দিয়ে এইমাত্র ও বেরিয়ে এল, সেই দরজা ফের খুলেছে। একটি একটি করে মোট চারজন বেরিয়ে এল টলমল পায়ে। ঘোরে পড়া মানুষ সব। অম্লানের মতই। অম্লান আবছা বুঝল, এরাও পেশেন্ট। আকিরার পেশেন্ট। 

উঠে পড়ে কখন নিজের ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছেছে, মনেই নেই। মন আবিষ্ট হয়ে আছে গোলাপের সুগন্ধে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারপর নিখাদ ঘুমে ডুবে গেছে। ঘুম ভাঙল ভোরে। ঘুম ভেঙে দেখে বৃষ্টি পড়ছে। ও ফ্ল্যাটের দরজা খুলে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। জলের ছাঁট দরজা ভিজিয়ে দিয়েছে। অম্লান বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল রাস্তায় জল জমে গিয়েছে। নর্দমা উপচে পাঁক-জলে ভাসছে রাস্তা। নিকাশি ব্যবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবতে ভাল লাগছে না অম্লানের। মন উচাটন হয়ে আছে। জানালার কাছে ধারাস্নান চলছিল। ঘরে ঢুকে টিভি অন করে অম্লান। সেখানেও বৃষ্টির খবর, “সবচেয়ে বেশি জল জমেছে উল্টোডাঙায়। দত্তবাগান, গার্ডেনরিচ, সাদার্ন অ্যাভিনিউ জলে ভেসে যাচ্ছে।” অম্লান উত্তেজিত হচ্ছিল। আর্মহাস্ট স্ট্রিটেও কি জল জমেছে? সুবর্ণা ওখানেই আছে। ও বৃষ্টি ভালবাসে। হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে জল দেখছে। ওর নীল কাফতানে আকশের মেঘের ছায়া পড়েছে।  

আজ কোথাও যাবে না অম্লান। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকবে। সারাক্ষণ সুবর্ণাকে ভাববে। সুবু! সুবুকে ভেবে ভেবে সময় কাটাবে আজ। দুজনে উল্টোডাঙার জমে থাকা জলে লাফিয়ে লাফিয়ে জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে একে অন্যকে ভিজিয়ে দেবে। 

বৃষ্টি সারাদিন ঝরল। সন্ধে নামল যখন, রাস্তার ত্রিফলার আলোতে বৃষ্টির জলকণা রত্নরাজির মত ঝিকমিক করছিল। অম্লান বাতাসে আকিরার গায়ের গন্ধ পাচ্ছিল। পোশাকের গোলাপের গন্ধ পাচ্ছিল। রাত যত বাড়ছে, সুবাস তীব্র হচ্ছে। কী যেন একটা …ভুলে ভুলে যাচ্ছে…কী যেন…ওহ! আকিরা কি ডাকছে অম্লানকে? কিছু বলেছিল কি? 

মনে পড়ল অবশেষে। আকিরা একটা প্যাকেট দিয়েছিল ওকে। কী আছে ওতে? টেবিলের কাছে গেল অম্লান। ফ্ল্যাটের চাবি, মোবাইল, চার্জার, সিগারেট…ইত্যাদির পাশে আকিরার দেওয়া প্যাকেটটা পড়ে আছে। অম্লান হাতে তুলে নিল। আকিরার কাছে যেতে হবে। আকিরা ডাকছে। সুবর্ণাকে নিয়ে আসবে আকিরা। যাচ্ছে, অম্লান যাচ্ছে। এখনই যাবে।

অম্লানকে যে ঘরে আনা হল, সে ঘরের চার কোণে চারটে ডিফিউজার পট। চমৎকার নকশার জালি তাতে। এর ভেতরে টি লাইট ক্যান্ডল রাখার জায়গা আছে। একটা প্যাকেটের ভেতরে ছোট ছোট মোমবাতি আছে। আকিরার নির্দেশমতো অম্লান ডিফিউজারের মধ্যে মোম জ্বালিয়ে দিল। জালি নকশার ভেতর দিয়ে আলোছায়ার খেলা শুরু হল। পটের ওপরে চাকতির মত জায়গাটায় অল্প জল নিয়ে তার ওপরে কয়েক ফোঁটা অ্যারোমা অয়েল ফেলে দিল। এই অয়েলে কী আছে? জুঁই, গোলাপ, ল্যাভেন্ডার, অরেঞ্জ…! ঘরের বাতাস অপার্থিব হয়ে উঠেছে। হাওয়া উঠেছে ঘরের ভেতরে। লম্বা লম্বা মোটা মোটা রঙিন মোমগুলো জ্বালিয়ে দিল এবারে। ঘরের ভেতরে জোছনা ফুটে উঠল। আহা! ডিফিউজারের ভেতর থেকে তারারা উঁকি দিচ্ছে। “এই মোম জোছনায় এসো সুবর্ণা…এসো। আমি তোমায় খুঁজব না। তুমিই আসবে আমার কাছে। এই ঘরে এসো। ঘর সুবাসে ভরে উঠেছে। এবারে চাঁদ উঠল। সোনারঙ চাঁদ।” অম্লান হাসছে। অনেকদিন পরে এমন প্রাণখুলে হাসছে ও। শব্দ হচ্ছে?

অম্লান শব্দ পাচ্ছিল। কেউ আসছে। সুবর্ণা? সুবুর শরীর থেকে ফুলের গন্ধ আসছে। ওর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছিল অম্লান। পা টিপে টিপে আসছে সুবর্ণা। ভুলতে পারেনি অম্লানকে? নাকি অম্লান ওকে টেনে এনেছে নিজের কাছে? একবার এইঘরে ঢুকলে আর বের হতে পারবে না সুবর্ণা। ওই যে! দরজা খুলে গেল। নীল কাফতান মাটিতে লুটিয়ে এলোমেলো চোখে এসে দাঁড়িয়েছে সুবর্ণা। ও ভেতরে ঢুকতেই বাইরে থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের ভেতরে মোম জোছনার আলোয় সুবর্ণার দিকে এগিয়ে গেল অম্লান। সুবর্ণা এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে জোছনায়। মিশে যাচ্ছে। অম্লান ডিভান থেকে উঠে পড়তে চাইলেও পারল না। গভীর স্বপ্নে আটকে আছে ও। হাত বাড়িয়ে জোছনার ভেতর থেকে সুবর্ণাকে টেনে আনতে চাইল। হাত উঠল না। 

আকিরা কাস্টমারের বডিটা গোপন ঘরে ঢুকিয়ে দিল। কিডনি পাচার হবে। এক চা চামচ হিপনোটিজম দরকার। ডিপ্রেসড পেশেন্ট হলে ভালো। কাজে ঝামেলা কম। কথার জাদুতে মাতিয়ে রাখতে হয়। বাকিটা হাতযশ।  

খবরের কাগজে ছোট একটা খবর বেরিয়েছিল। ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে কিডনি পাচার চক্র। স্বাস্থ্যবিভাগ প্রচুর নিয়মকানুন করেছেন। কিডনি কেনা বেচা নিষিদ্ধ। এসব সমস্যার সমাধান আছে। কে আর তার হিসেব রাখে, কিছু গোলাপের পারফিউম ছাড়া! 


……………

অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


No comments:

Post a Comment