অবলোকন কী?
অবলোকন পাত্র ইতিহাস রক্ষী। এই পৃথিবীর ইতিহাস পথ ভুল করতে চাইলে অবলোকন তাকে সঠিক দিশা দেখায়। জিওর্দানো ব্রুনো মৃত্যুদণ্ডের আদেশ শুনে মৃতকল্প। পরের দিন তিনি বেপরোয়া। কেন? অবলোকন জানে। সেই বদলেছে ইতিহাসের গতি। শেক্সপীয়রকে অবলোকন মাস্টার বলে। তিনি যখন ভুল পথে যেতে চান অবলোকন ছোটে ষোড়শ শতকের লন্ডনে। লাঠিয়াল বলরাম হাড়ি মানুষ-সাধন আরম্ভ করেন কোন ম্যাজিকে? অবলোকন জানে। অবলোকন পথ দেখায় রামপ্রসাদকে, প্রাণ বাঁচায় বিবেকানন্দের। ইতিহাসের সঙ্গে ফ্যান্টাসি মিশে সৃষ্টি অবলোকন সিরিজের।
অবলোকনের স্রষ্টা চয়ন সমাদ্দার বলেন, ফ্যান্টাসির ধর্মই সাবভারশন। ইতিহাসের একেকটা মোড়ে আসলে অনন্ত সম্ভাবনা থাকে। একটা বিশেষ দিকে কেন ইতিহাস গেছে তার ব্যাখ্যা ফ্যানটাসি দিয়ে করতে চান তিনি। তাছাড়াও, থ্রিল আনতে এই অতিমানুষী ব্যাপার স্যাপার দিয়ে। নীল রঙের শক্তি বলয় ঘিরে থাকে অবলোকনকে। টাইম, স্পেস আর এনার্জির ওপর তার টোটাল কনট্রোল!
এক ধরণের সুপার হীরো সিরিজ হলেও, অবলোকন কাহিনিতে জানা ইতিহাস সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকে। কেবল তার ফাঁকগুলো ভরাট করে কল্পনা।
ইমান
চয়ন সমাদ্দার
(১)
পুঁড়ার হাট থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে উঠছে আকাশে। লাঠির ওপর ভর দিয়ে সেদিকেই চেয়ে আছে করণ সর্দার। হাট ভাঙচুরের সময় সে হাত লাগায়নি। আরে, গরীবের ওপর জুলুম করে হবেটা কী? লড়লে লড়তে হবে জমিদার আর নীল বাঁদরগুলোর সঙ্গে। ঘেন্নায় মাটিতে পিচিক করে থুতু ফেলল করণ।
যমুনা আর ইছামতীর তট জুড়ে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর মধ্যে বসিরহাটের বালিয়া পরগনার নারকেল-বেড়িয়াতে চাষ-আবাদ হয় ভালো। পরগনা সরফরাজপুর বা সর্পরাজপুরের সবচেয়ে জমজমাট বাজার বসে পুঁড়া আর শরফনগরে। কুড়াগাছা, হঁড়া আর তিঁতুলিয়ায় আছে ছোটো ছোটো নীলকুঠি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তীকালে এই অঞ্চলের মাথা যে বঙ্গজ কায়স্থ গোষ্ঠী, তারই গোষ্ঠীপ্রধান জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। এখন যা হচ্ছে, তার দায়ভার মুখ্যতঃ তাঁরই।
হাটের দিক থেকে এগিয়ে আসছে দিল মহম্মদ। করণকে দেখে হাসল।
-ভালো লাগছে না?
-এ কাজটা কি না করলেই চলত না দিলু ভাই?
-ওরে, না খেতে পাওয়া, মার খাওয়া মানুষের দল যখন ক্ষেপে ওঠে, তখন একটু ইদিক-উদিক হয়ে যায়।
-কিন্তু, এই হাটুরেরা তো আমাদেরই মতো গরীব লোক। আর মন্দিরকে অপবিত্র করলে?
দিল মহম্মদ একটু গম্ভীর হোল।
-করণ, এই হাটকে জমিদারের জাঁক দেখানোর জায়গা ভাব, মন সাফ হয়ে যাবে। তাছাড়া, ইমানের কাছে সব জায়েস।
-ইমান মানে?
-আমাদের মুরশিদের ইমান। হিদায়েতিদের ইমান। আমরা খোদার মকবুল, সেই ইমান।
করণ মনে মনে দশ গুনল। তারপর যখন কথা বলল, তখনও তার গলা একটু কাঁপছে।
-তাহলে আমি এখানে কী করছি দিলু ভাই? কী করছে রামচন্দ্রপুর, রুদ্রপুর, হায়দরপুর, নয়াপাড়া, কীর্তিপুরের জোলা আর চাষিরা? আমরা তো কাছা খুলেও রাখিনে, আর দাড়িও গজাইনে। তাহলে আমরা কেন?
-তোরা এসেছিস মুরশিদের কুদরতে। তাঁর টান কি যে সে টান রে?
হাসতে হাসতে দিল মহম্মদ অন্যদিকে চলে গেল। আর অবিশ্বাসভরা চোখে তার গমনপথের দিকে চেয়ে রইল করণ। তারপর, সিংহের মতো, মাথা ঝাঁকালো সে। এবং দ্রুতপদে হাঁটতে লাগলো উল্টো দিকে। এবার আমাকে সক্রিয় হতে হবে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, করণ যাচ্ছে তার স্বজাতীয়দের কাছে, হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে নষ্ট হতে বসেছে এই ইংরিজি ১৮৩১ এর ৬ই নভেম্বর জন্মানো এক স্বপ্নের সম্ভাবনা। এই স্বপ্ন পরাধীন ভারতকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি যোগাবে। স্বাধীন হওয়ার প্রেরণা দেবে। একে বিফল হতে দেওয়া চলে না।
আমি, পৃথিবী নামের গ্রহের, ইতিহাসের প্রহরী। এই গ্রহের ইতিহাস যাতে পথ ভুল না করে, তা দেখার দায়িত্ব আমার। মরজগতে কালপ্রবাহ ধীর। অণুপল, পল, মুহূর্ত, দিন, মাস, বছর। কিন্তু, আমার চোখ দিয়ে দেখলে, পলকপাতে,শিশু যুবক হয়, যুবক গতাসু হয়। আবার, এক জীবনেই অগণিত সম্ভাবনা। ধরা যাক, এক শিশুর পায়ে কাঁটা বিঁধলো, তারপর বিষিয়ে গেল সে ক্ষত, সে আর বড়োই হলো না। অন্য এক সম্ভাবনায় সে কৃতী হলো, হলো ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনকাল একসঙ্গে দেখি, তাই আমি অবলোকন। আর, রক্ষা করি ইতিহাস নির্দিষ্ট একটি মাত্র সম্ভাবনাকে। যেমন, ওই শিশুটির যেন অকালপ্রয়াণ না ঘটে, মহাকালের নির্দেশে তা দেখার দায়িত্ব আমার। তাই, আমাকে মানবদেহ ধরতে হয় প্রয়োজনে। সক্রিয় হয়ে সহায়তা করতে হয়, পৃথিবীতে মাথা তোলা মানবজাতিকে। হতে হয় ইতিহাস কাহিনির এক পাত্র। তাই, আমি অবলোকন পাত্র।
বটগাছটার তলায় করণ পৌঁছতেই ওর মুখোমুখি হলাম। ও জানে না, আমরা এখন কালস্রোতের বাইরে। বললাম,
-করণ সর্দারের কাছে লড়াইয়ের চেয়ে জাত বড় হলো?
-কে রে?
-আমি অবলোকন পাত্র। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। যুগী আর জোলাদের ছোঁয়া জল সাধারণে স্পর্শ করে না। পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, জমিদারের জুলুমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এই অবস্থায় হেদায়েতিদের মুর্শিদ এককাট্টা হতে ডাকেন। জাতের জন্য যোগ দিয়েছিলেন, না একটা অভয়ের জায়গা থেকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য?
-তুমি কে ঠাকুর? গা থেকে আলো বেরুচ্ছে। আছো কি নেই বুঝছিনি। তুমি দেব্তা না ভূত?
-আমি অবলোকন। আমি ভূত, আমি বর্তমান, আমি ভবিষ্যৎ। ভালো করে ভেবে বলুন। হেদায়েতিদের মুর্শিদের ক্ষমতা বাড়ছে; ছোটোলোকরা তাঁর কথা শুনছে দেখে, তাঁর মুসলমান শিষ্যদের সায়েস্তা করার জন্য, জমিদার কৃষ্ণদেব রায় দাড়ি পিছু আড়াই টাকা কর ধার্য করেন। পুঁড়া গ্রামের দায়েম আর কায়েম প্রথম এই কর দেয়। তারপর, আপনাদের সর্পরাজপুর কর দিতে অস্বীকার করে। আপনি নিরপেক্ষই ছিলেন। এরপর, জমিদার লোক লস্কর নিয়ে সর্পরাজপুর আক্রমণ করেন। বাড়িতে আগুন লাগে। একটা মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখনও আপনি কোনও পক্ষ নেননি। তারপর...
ঘেন্নায় মুখটা বেঁকে গেছে করণের। নীচু গলায় বলল,
-তারপর, জমিদার শালা পালাল। শুনলাম দু’পক্ষই থানায় খবর দিয়েছে। থানার লোক এল।
হাসলাম। বললাম,
-সাতই জুলাই বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমিদারমশাই বললেন, তিনি দাঙ্গার সময় কলকাতা ছিলেন। এবং, বসিরহাট থানার দারোগা রামরাম চক্রবর্তী জানালেন, জমিদারকে ফ্যাসাদে ফেলতে ছোটোলোকরা নিজেরাই মসজিদ পুড়িয়েছিল। গাঁয়ে পুলিশি জুলুম বাড়ল; হেদায়তিরা পালালেন, কারণ সামনে এলেই তাঁরা গ্রেফতার হতেন। কোনও সাক্ষী রইল না। মামলা খারিজ। এই সময় আপনি যোগ দেন এদের সঙ্গে। কেন?
করণ গর্জে উঠল।
-আর কত মার খাব মুখ বুজে? যদি ফিরিয়ে মার দেওয়ার জন্য...
চুপ করে গেল সে। আমি জোরে হেসে উঠলাম।
-তাহলেই দেখুন। আপনি নিজেই জানেন, আপনি এদের সঙ্গে কেন! তাহলে পালাচ্ছেন কেন?
-পালাইনি। ওরা একটা মোচলমানি জিগির তুলছে। অপবিত্র করছে মন্দির। এরকম করলে, একসঙ্গে লড়াই চলে? তাই, ভাই-বেরাদরদের খবর দিতে যাচ্ছিলাম।
আমি আঙুল দিয়ে ওর দুই ভুরুর মাঝখানটা ছুঁলাম। চোখ বুজে গেল তার। খুব আলতো গলায় বললাম,
-মনের ভেতর তাকিয়ে দেখুন। আপনার দেবতা কি বাইরের মন্দিরে আছেন না ভেতরে? কোনও রকম উগ্র অসহিষ্ণুতা তাঁকে ছুঁতে পারে না পারে না? নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভু –আপনার হৃদিস্থিত পরম, পাপ-পুণ্য গ্রাহ্য করেন না করণ সর্দার। কারণ, যা খণ্ডিত, তারই কেবল কোনও উদ্দেশ্য থাকে। অখণ্ড, পূর্ণের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েই আছে। আপনারা একজোট না হলে, ভাবীকাল অসুরক্ষিত হয়ে পড়বে। সেটা হতে দেওয়া যায় না। তাই, আমার নির্দেশ – এই যুদ্ধে আপনাকে অংশ নিতেই হবে।
চোখ মেলল সে। আমায় আর দেখা যাচ্ছে না। সেও মনে করতে পারছে না, কী ঘটে গেল এতক্ষণ। শুধু তার মন-প্রাণ-সত্তা বলছে, তাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকতে হবে, সেই মানুষটির পাশে যাকে তাঁর শিষ্যরা মুর্শিদ বলে।
(২)
সামনে তাকিয়ে করণ দেখল, যাঁর কথা ভাবছিল, তিনি এগিয়ে আসছেন। ঝাড়া চার হাত লম্বা জোয়ান –এক সময় লাঠিয়াল-পালোয়ান ছিলেন-, টকটকে রঙ, মাথার মাঝখানটা কামানো, মুখময় দাড়ি। সামনে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অসম্ভব তীব্র দৃষ্টিতে করণের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। তারপর, অপ্রত্যাশিত কাণ্ড করলেন একটা। ঝুঁকে পড়ে করণের পা ছুঁতে গেলেন। ছিটকে সরে গেল সে।
-কী করছেন সর্দার?
-মাফি মাঙছি রে বাপ। বিশ্বাস কর, আমি হাট লুটের হুকুম দিয়েছিলাম জমিদারের গুমর ভাঙব আর লড়াইয়ের হেতের জোগাড়ের টাকা তুলব বলে। বলেছিলাম, মন্দিরের গায়ে যেন কেউ হাত না ছোঁয়ায়। ওই মুসিরৎ শা ফকিরের ওস্কানিতে হয়েছে এসব। আমি জবান দিচ্ছি, বারদিগর এমনটি আর হবে না।
বেলা গড়িয়েছে। গাছতলায় জড় হয়েছে তাঁর দলবল। খুব নীচু গলায় কথা বলছেন তিনি।
-হেঁদু জানিনে, মোচলমান জানিনে, জানি শুধু যাদের আছে, আর যাদের নেই। আমাদের হেতের দরকার। তাই, ওরাই টাকা দেবে। রাজ্য এখন দীন মহম্মদের। কেল্লা গড়া হয়ে গেছে, ফৌজও তৈয়ার। জমিদারদের কাছে খত পাঠাও। টাকা না পেলে আগুন জ্বলবে। আর, এর মধ্যে, লুট করো নীলকুঠি।
(৩)
হুগলি কুঠির হেনরি ব্লাউড অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। লুটতরাজের সময়ই সে লক্ষ্য করেছিল, ব্যাপকভাবে ধ্বংস করা এই লোকগুলোর উদ্দেশ্য নয়। কারণ, তা হলে তারা খড়ো ঘরে –যেখানে তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকার সম্পত্তি ছিল- আগুন লাগাতে পারত। কিন্তু, তারা তা করেনি। কিছু ভেড়া নিয়েছে, আর সমস্ত দাদনের কাগজ পুড়িয়ে দিয়েছে, যাতে রায়তদের ঋণের কোনও হিসেব না থাকে। হেনরি জানে এই এক জিনিসই ঘটেছে পাইরনের বাংলোতে, বারঘর কুঠিতে। এই মুহূর্তে হেনরি এই র্যাবেলদের লীডারের সামনে দাঁড়ানো। এই অঞ্চলের ভাষা ভালোই জানে সে। খুব শান্তভাবে হেনরি ব্লাউড বলল,
-আপনি অনাবশ্যক ঝুঁকি নিচ্ছেন। সরকারি ফৌজের সামনে দাঁড়াতে পারবেন মনে করেন? ম্যাজিস্ট্রেটও নিশ্চয়ই চুপ করে থাকবেন না।
লীডারও খুব শান্তভাবে হাসলেন।
-ও ভাবনাটা আমায় ভাবতে দিন না! আপনাকে এখানে এনেছি কারণ, নীলকর হলেও, আপনি একটু মানুষের মতো। তাই, কথা দিন, আমার অধীনে নীল চাষ করবেন।
খুব দ্রুত চিন্তা করছে ব্লাউড। এতটা কনফিডেন্স যখন, তখন কিছু একটা ঘটেছে। মে বি দে হ্যাভ ওয়ান আ মাইনর স্কারমিশ। এখন যেটা দরকার সেটা হলো সময়। আই মাস্ট বাই টাইম, ভাবল ব্লাউড। নট বিফোর লং ইউল্ বি লাফিং অন দ্য আদার সাইড অফ ইয়োর ফেস, মাই ফাইন ফ্রেন্ড! বাট হোয়াই অন আর্থ ইজ হি সো কমপোজড্?
ব্লাউড সাহেব না জানলেও, অবলোকন জানে। দু’দিন আগের কথা। ১৫ নভেম্বর, ১৮৩১। বাদুড়িয়া থেকে এসে বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার নারকেলবেড়িয়ায় প্রায় ছশো লোকের এক বাহিনির মুখোমুখি হন। করণ সর্দার আর গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে জোলা, যুগী, তাঁতি, মুসলমান মরণপণ যুদ্ধ করে দশ জন সেপাই, এক জন জমাদার আর তিন জন বরকন্দাজকে হত্যা করে। গোলাম মাসুম তলোয়ার হাতে আলেকজান্ডারের ওপর চড়াও হন, কিন্তু প্রাণে মারেননি। বস্তুত, বন্দিদের কেউই মারা যাননি। একজন ছাড়া। বসিরহাটের দারোগা শ্রীযুক্ত বাবু রামরাম চক্রবর্তী মহাশয়কে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে।
আজ, ১৭ নভেম্বর, নদীয়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেট স্মিথ আর মূলনাথ কুঠির কুঠিয়াল ডেভিড অ্যান্ড্রুজ হাজার দেড়েক লোকের প্রতিরোধের সামনে পড়েন নারকেলবেড়িয়াতেই। বন্দুক, কামান আর তীর, বল্লমের লড়াইতে আগ্নেয়াস্ত্র সুবিধে করতে পারেনি। পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন স্মিথ আর অ্যান্ড্রুজ। এই মুহূর্তে স্মিথ তাঁর কর্তাদের জানাচ্ছেন, এটা দস্তুরমতো বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহীদের মনোবল অসামান্য। সামরিক বাহিনি ছাড়া এদের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয়।
এসবের কিছুই না জেনেও শুধু বিদ্রোহী নেতার মুখের ভাব দেখেই অতি দ্রুত বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিল ব্লাউড। অচঞ্চল স্বরে বলল,
-আমি আপনাকে রুলার অফ দ্য কান্ট্রি বলে মেনে নিচ্ছি, ইওর ম্যাজেস্টি। আমি আপনার অধীনেই নীল চাষ করব।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে খাঁটি ইংরেজের মতো ব্লাউড ভাবল,
-এভরি ডগ হ্যাজ ইটস্ ডে, ইউ আপস্টার্ট!
(৪)
১৮ নভেম্বর, ১৮৩১। বারাকপুর থেকে বাদুড়িয়া হয়ে মেজর স্কট, লেফটেনান্ট ম্যাকডোনাল্ড আর ক্যাপটেন সাদারল্যান্ডের নেতৃত্বে ১১ নং রেজিমেন্টের একাংশ যাত্রা শুরু করে সকালে নারকেলবেড়িয়া এসে পৌঁছেছে। সৈন্যবাহিনির রসদ যোগান দেবার নির্দেশ দিয়েছেন নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট –গোবরডাঙা, চান্দুরিয়া আর রানাঘাটের জমিদারদের। বিদ্রোহী বাহিনির নায়কও জমিদারদের চরমপত্র পাঠিয়েছেন। কেল্লার সামনে কামান সাজানো হচ্ছে। করণ সর্দারের ভালো ঠেকছে না ব্যাপারটা। থাকতে না পেরে সে সোজা নেতার কাছে চলে গেল। চোখ বুজে যেন ধ্যানস্থ তিনি। জোরে গলা খাঁকাড়ি দিল করণ। চোখ খুললেন নায়ক। হাসলেন। বললেন,
-কিছু বলবি?
-সামনা সামনি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হারিয়ে দেওয়া এক, আর কামানের সঙ্গে লড়াই আর এক ব্যাপার। আমাদের জেতার কোনও আশা নেই।
বিচিত্র হাসলেন তিনি।
-জিতব বলে তো লড়ছি না।
-তাহলে?
-ইমানের জন্য।
-ইমান, ইমান! মানে কী কথাটার?
-এর মানে হলো একটা বিশ্বাস, যার জোরে যারা শুধু হুকুমের চাকর ছিল, সেই বোকা জোলারা, তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বোঝা ঝেড়ে ফেলে পিঠ সোজা করে দাঁড়ায়; গরিব গুর্বো একটা স্বপ্নের দেশের সন্ধান পায়, যাতে মনে নিয়ে সে বুক বাঁধতে পারে। সব পেয়েছির এক দেশ, যেখানে সবাই সমান। আমি মোসলমান, তাই আমার স্বপ্নের দেশের নাম দিয়েছি আরব। কিন্তু, সেটা পরীস্তান হলেও বাধা ছিল না। কারণ, মার খাওয়াদের একটা স্বপ্নলোক চাই, যার আদর্শ নিয়ে অত্যাচারীর সঙ্গে লড়া যায়। আমি কোরান, হদিস থেকে আমার ইমানের ভাষা বানিয়েছি। তুই কি ভাবিস জোলা, তাঁতিরা তার কিছু বোঝে? কিচ্ছু বোঝে না। তারা কেবল বোঝে বিশ্বাসের সততাটা। আমি যদি হেঁদু বামুন হতাম আর তোদের শাস্তর ঘেঁটে একই আদর্শের কথা বলতাম, দেখতি একই ফল হতো। এখন মুর্শিদ বলে, তখন গুরু বলত। ওরে, এতদিন ধরে বেঁচে মরে থেকে, যদি যুদ্ধে মরেই এরা, তাহলে বেঁচে যাবে। শুধু, বেঁচেই যাবে না, বেঁচে থাকবে। লোকের মুখে মুখে। ইমান বেঁচে থাকবে, আমরা না থাকলেও।
করণের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। এ কে? সাধক না উন্মাদ? এসব কী বলছে? প্রলাপ? না, তাও তো নয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, একেবারে বুকের ভেতর থেকে কথাগুলো উঠে আসছে। ইনি যা বলছেন, তা এঁর কাছে প্রত্যক্ষ সত্য। করণ তাঁর কথার এক বর্ণ না বুঝলেও কথার ভেতরের তাতটা নিজের চামড়ায় অনুভব করতে পারছে যেন।
১৯ নভেম্বর, ১৮৩১। যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। পদাতিক বাহিনি আর সাদারল্যান্ডের ক্যাভালরি ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুর্গের ওপর। সামনাসামনি লড়াইতে বিদ্রোহীরা ভয় পায় না। করণ একটা গোরাকে বল্লমে গেঁথে ফেলে পাশে তাকালো। নায়ক তলোয়ার হাতে সিংহবিক্রমে লড়ছেন। আজ তাঁর পরনে দীন ফকিরের বেশ। ওই গুলি খেয়ে ঢলে পড়ল গোলাম মাসুম। লড়াই তবু চলছে। ইজ্জতের যুদ্ধ। মাথা উঁচু রাখার সংগ্রাম।
মেজর স্কট ঠিক এতটা রেজিসটেন্স আশা করেননি। নেটিভদের বীরত্ব সম্পর্কে তাঁর কোনওদিনই খুব একটা উঁচু ধারণা নেই। তিনি ভেবেছিলেন, দু’এক ঘা পিঠে পড়লেই, এই দুপেয়েরা কুকুরের মতো লেজ গুটোবে। কিন্তু, এরা সমানে লড়ছে। বেশ কিছু সোলজার মারা গেছে এরই মধ্যে। এই অবস্থা তো চলতে দেওয়া যায় না। গোলন্দাজ বাহিনির অধিনায়ক লেফটেনান্ট ম্যাকডোনাল্ডকে ডাকলেন তিনি।
-দ্য বাগারস্ আর পুটিং আপ আ গুড ফাইট, লেফটেনান্ট।
-দে আর ডুইং সো, সার।
-দ্যাট ওন্ট ডু, হোয়াট ডু ইউ সে?
-ওয়েটিং ফর ইওর অর্ডারস্, সার।
-ইওর ক্যাননস্ আর ইন পোজিশন?
-ইয়েস সার।
-ফায়ার আ ওয়ার্নিং শট। ইফ দে গিভ ইন, নান উইল বি হ্যাপিয়ার দ্যান মি; ফর আই ডিটেস্ট আননেসেসারি ব্লাডশেড। বাট, ইফ দে ডোন্ট, ব্লাস্ট দেম টু স্মিদারিনস্।
প্রথম গোলাটা কেল্লার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। কেউ হতাহত হলো না দেখে, দ্বিগুণ উৎসাহে তীর ছোঁড়া শুরু করলো বিদ্রোহীরা।
-ট্রুপ ডিসপার্স!
সদারল্যান্ডের আদেশ শোনা গেল। অশ্বারোহী আর পদাতিকরা পিছিয়ে যাচ্ছে দেখে কেল্লায় একটা বিরাট উল্লাসধ্বনি জেগে উঠল। সেটা মেলাতে না মেলাতেই, এসে পড়ল প্রথম গোলাটা। আমার নীলাভ শক্তিক্ষেত্রে ঢাকা বলে করণের কিছু হলো না। এখন চারিদিকে আগুন। নায়কের ডান পাটা ঊরুর কাছ থেকে উড়ে গেছে। পরের গোলাটা সব কিছু চুরমার করে দিল। যারা প্রাণে বেঁচেছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে, ইংরেজ মার্কসম্যানদের বন্দুকের গুলিতে মাটি নিচ্ছে।
করণকে নিয়ে বাইরে এলাম। এখান থেকে কেল্লার আগুন দেখা যাচ্ছে, কিন্তু, এই আমবাগানে এখন কেউ আসবে না। বললাম,
-সোজা ওই দিক দিয়ে পালান।
সে উদভ্রান্তের মতো চাইছে এদিক ওদিক।
-আমি কেন? আমি বেঁচে কেন?
-কারণ, আপনাকে জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। শোনাতে হবে ইমানের কাহিনি। এই মহাকালের বিধান। যান বলছি!
আমার আদেশের রেশ মেলানোর আগেই সে ছুটতে শুরু করেছিল। দেখতে দেখতে চোখের আড়াল হয়ে গেল।
দূরে মারখাওয়াদের রোষের প্রতীক হয়ে জ্বলছে বাঁশের কেল্লা।
পুড়ছে বহু মাথা উঁচু রাখতে চাওয়া দেহ।
পুড়ছেন তাদের নেতা।
পুড়ছেন তিতুমীর।
ঋণস্বীকার – গৌতম ভদ্র, বিহারীলাল সরকার।
No comments:
Post a Comment