প্রবন্ধঃ মূল্যবোধ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনেঃ কৃষ্ণেন্দু দেব

মূল্যবোধ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে


কৃষ্ণেন্দু দেব

      

  

প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, ইনটারনেটে বা পথেঘাটে নিত্যদিন আমরা হাজারো বিজ্ঞাপনের মুখোমুখি হই। কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিবিশেষ নিজের প্রোডাক্ট বা পরিষেবা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই দিয়ে থাকে ঐ বিজ্ঞাপনগুলো। এতে দোষের কিছু নেই। ব্যবসার খাতিরে এমনটা কেউ করতেই পারে। কিন্তু বিজ্ঞাপনে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে মানুষকে আকৃষ্ট করতে চাইলে তা প্রতারণারই নামান্তর। সেটা কিছুতেই মেনে নেওয়া উচিত নয়। তাই বিশেষত মানবস্বাস্থ্য নিয়ে এই লোক-ঠকানোর প্রবণতা রোধ করার উদ্দেশ্যেই ১৯৫৪ সালে তৈরি হয়েছিল ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইজিং) অ্যাক্ট।        

আইনটা তৈরি হয়েছিল বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঐ আইনের প্রয়োগ বিশেষ একটা হয়নি। তাই অমুক শ্যাম্পু চুলের পুষ্টি জুগিয়ে চুল পড়া বন্ধ করে বা তমুক ক্রিম ব্যবহার করলে তিন সপ্তাহের মধ্যে গায়ের রং ফর্সা হয়ে যায়, কিংবা অমুক হেলথ ড্রিঙ্ক খেলে বাচ্চার মেধার দ্রুত বিকাশ ঘটে-এমন অনেক বিজ্ঞাপনে মানুষ ঠকে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে। এমনিতেই ছাপার অক্ষরে কিছু পড়লে, বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে কিছু দেখলে বেশিরভাগ লোকই তা ধ্রুব সত্য বলে মনে করে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো এই প্রবণতা আরও বেশি। তাই ‘বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে’---এই মিথ্যা ভাষণ দিয়ে শ্যাম্পু, ফেয়ারনেস ক্রিম বা হেলথ ড্রিঙ্কের ঐসব বিজ্ঞাপন দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে বোকা বানিয়ে এসেছে।

আসলে কোনও তথ্য কেউ বিশ্বাস করবে কী করবে না, তা নির্ভর করে যে লোকের সামনে তথ্যটা পেশ করা হচ্ছে সে কতটা যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক, তার ওপর। চুল আমাদের দেহত্বক থেকে উৎপন্ন হলেও তা আদতে জড় পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয় (তাই চুল কাটলে রক্ত পড়ে না, ব্যথাও লাগে না) এবং সেই কারণে বাইরে থেকে প্রোটিন বা ভিটামিন সমৃদ্ধ তেল বা শ্যাম্পু প্রয়োগ করে চুলের পুষ্টি সাধন বা বৃদ্ধি ঘটানো আদৌ সম্ভব নয়। এমনটা যদি বাস্তবে ঘটত, তাহলে কাঠের একটা টুকরোর গায়ে প্রতিদিন সার দিলে সেটাও ধীরে ধীরে লম্বা হয়ে যেত। এই সরল সত্যিটা বোঝার মতো বিচারবুদ্ধি, বলতে বাধা নেই, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে আমাদের দেশের বহু মানুষেরই নেই। থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তারা সেটা প্রয়োগ করে না। তাই করোনা রুখতে কেউ গোমূত্র সেবন করে, আবার কেউ করে যজ্ঞের আয়োজন! সেই কারণে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ বিজ্ঞাপনের যেকোনও আজগুবি দাবিও যে বিশ্বাস করবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!

এই সমস্ত ব্যাপার মাথায় রেখেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি (২০২০) কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ১৯৫৪ সালের ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইজিং) আইনটিকে আরও কঠোর করে একটি খসড়া বিলের প্রস্তাব করেছে। তাতে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করার চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ লাখ টাকা জরিমানা আর সর্বাধিক পাঁচ বছর কারাবাসের বিধান আছে। প্রস্তাবিত এই বিলে সময় ও প্রযুক্তির পরিবর্তনকে মাথায় রেখে বদলানো হয়েছে বিজ্ঞাপনের সংজ্ঞাও। আগে এইডস, ছানি পড়া, হার্নিয়া সহ ৫১টি অসুস্থতা নিরাময়ের অবৈজ্ঞানিক দাবি করা ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ ছিল। এই সংশোধনীতে ঐসব রোগ-ব্যাধির সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭৮।

অতঃপর ওষুধের গুণে সেরে যাবে ক্যানসার, মধুমেহ, তোতলামো বা পারকিনসন ডিসিজ, হেয়ার অয়েল বা শ্যাম্পুর ছোঁয়ায় চুল পড়া বন্ধ হবে কিংবা নারী-পুরুষের যৌন অঙ্গ হবে বিবর্ধিত, ক্রিমের জাদুতে কালো মেয়ে মাত্র তিন সপ্তাহে হয়ে উঠবে ধবধবে ফরসা (কালো ছেলের কিন্তু সেটায় আবার কাজ হবে না, তার জন্য অন্য ফেয়ারনেস ক্রিম)---বিজ্ঞাপনে এমন সব অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক দাবি আর করা যাবে না। বিলটি যদি ভবিষ্যতে সত্যিই আইনসভায় পাশ এবং কঠোরভাবে কার্যকরী হয়, তাহলে দেশের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার হাত থেকে কিছুটা হলেও যে রক্ষা পাবেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আইনটা কঠোরভাবে কার্যকরী না হলে কিন্তু মানুষ সেই আগের মতো প্রতারিত হতেই থাকবে।

তবে শুধু স্বাস্থ্য নয়, ইদানীংকালে এমন অনেক বিজ্ঞাপন নিয়মিত প্রচারিত হয় যেগুলো আমাদের শিক্ষাজগতেও যথেষ্ট কুপ্রভাব ফেলছে। ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্রসমাজ। সমস্যাটা তুলে ধরতে গেলে পুরোনো কিছু স্মৃতি রোমন্থন আবশ্যক। মনে পড়ে ছেলেবেলায় মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের ফলপ্রকাশের পরদিন খবরের কাগজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তাম। যারা মেধাতালিকায় একেবারে ওপরে, তাদের নাম, পরিচয়, ছবি আর বিভিন্ন বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর ছাপা হত কাগজে। কেউ অঙ্কে একশোয় একশো পেয়েছে তো কেউ ইংরাজিতে একানব্বই।

ঐ ছেলে-মেয়েগুলোকে তখন মনে হত কোনও অন্য গ্রহের জীব বুঝি। বাড়িতে বাবা-কাকা আর স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা---সবাই ওদের প্রসঙ্গ তুলে বলতেন, ওরা শুধু মেধাবি নয় দারুণ পরিশ্রমীও বটে। ওরা একটা বিষয়ের অনেকগুলো বই পড়ে, সিলেবাসের বাইরেও অনেক কিছু অধ্যয়ন করে, সারা বছর কঠোর অনুশীলনের মধ্যে থাকে। তবেই না আসে এমন সাফল্য। বলতে বাধা নেই, মফস্সল এলাকায় থাকতাম বলেই হয়তো, কলকাতার কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত কাগজে ছবি ওঠা অমন কোনও নক্ষত্রকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়নি আমার। প্রথম যাঁর সাথে আলাপ হয়েছিল তিনি পেশায় অধ্যাপক, আশির দশকের প্রথমভাগে মাধ্যমিকে তৃতীয় এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তখন তো আর স্কুলে পড়া নবীন কিশোরটি নই, রীতিমতো কলেজের ক্লাস বাঙ্ক করে কফিহাউসে আড্ডা জমানো তরুণ আমি---তাও সেদিন ভদ্রলোককে চোখের সামনে দেখে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শিহরন খেলে গিয়েছিল। এলিয়েন দেখার অনুভূতি যেন!

কিন্তু একুশ শতকে পা দিতেই সব কিছু বদলে যেতে শুরু করল অতি দ্রুত। আমরা আগে লেখকের নাম দেখে পাঠ্যপুস্তক কিনতাম। দেখলাম ধীরে ধীরে লেখককে ছাপিয়ে উঠে এল কয়েকটা প্রকাশনা সংস্থার নাম। তারপর বোর্ড বা কাউন্সিলের পরীক্ষায় র‍্যাংকধারীদের প্রায় সকলকেই নির্দিষ্ট কিছু প্রকাশনা সংস্থা বা কোচিং সেন্টারের প্রোডাক্ট বলে ভ্রম হতে লাগল। ইদানীংকালে তো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর থেকে বছরভর খবরের কাগজের পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় কেবল ঐ কৃতী প্রোডাক্টদের মুখই চোখে পড়ে। একেক দল কৃতী একেকটা সংস্থার বই হাতে টানা বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছেন, ঐ বই পড়েই তাঁরা নাকি পেয়েছেন অমন আকাশ ছোঁয়া সাফল্য এবং স্কুলে ভর্তি হওয়া ইস্তক তাঁরা শুধুমাত্র ঐ প্রকাশনার বইপত্রই পড়ে আসছেন!

এই বিজ্ঞাপন দেখে মনে প্রশ্ন জাগে---তাহলে কি এখন আর জীবনের এই বড়ো পরীক্ষাগুলোতে সেরা হওয়ার জন্য আগের মত মেধা, পরিশ্রম বা অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হয় না? মাত্র একটা সংস্থার প্রকাশিত বই পড়েই এত সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় সাফল্যের চূড়ায়? এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব অবশ্য আমাদের সকলেরই জানা। আমাদের কৃতীরা বিজ্ঞাপনে যা-ই বলুন, বাস্তবে তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করেই অর্জন করেছেন ঐ সাফল্য, তাঁদের পূর্বসূরীদের মতোই। আর এই কারণেই, কোনও প্রকাশনার বই হাতে নিয়ে সেরা ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া ঐ বিজ্ঞাপনগুলোকে টাক-মাথায় চুল গজানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া লোক ঠকানো বিজ্ঞাপনের থেকে আর যেন আলাদা করা যায় না।

কেউ অবশ্য এক্ষেত্রে যুক্তি সাজাতেই পারেন, বিরাট কোহলি বা সৌমিত্র চ্যাটার্জির মত বিখ্যাত মানুষরাও তো সিমেন্ট বা সরষের তেলের বিজ্ঞাপন করেন। ওঁরা নিশ্চয়ই ঐ সিমেন্ট বা ভোজ্যতেলের গুণমান যাচাই করে তারপর বিজ্ঞাপনগুলো করেননি। অমিতাভ বচ্চন কোনও ডিটারজেনণ্ট বা মাথা ঠান্ডা করার তেলের বিজ্ঞাপন করার আগে নিশ্চয়ই সেগুলোর কার্যকারিতা ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পরীক্ষা করেননি। তাহলে এই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের কৃতীরা কোনও বিশেষ পাঠ্যপুস্তকের গুণগান করলে অত আপত্তির কী আছে? তাতে কী মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? 

আপত্তির কারণ, দু’রকম বিজ্ঞাপনের মধ্যে নীতিগত ফারাক। বিরাট কোহলি, সৌমিত্র চ্যাটার্জি বা অমিতাভ বচ্চনরা যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, নামি রেস্তোরাঁর শেফ বা কোনও প্রখ্যাত বায়োকেমিস্ট নন, সেকথা সবাই জানে। কেবল ওঁদের বিপুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে লোকের কাছে ঐ প্রোডাক্টগুলোকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্যই যে বিজ্ঞাপনগুলো বানানো হয়েছে, সেটা বুঝতে তাই কারো অসুবিধা হয় না। অর্থাৎ নৈতিকতার প্রশ্নে ওগুলোকে কখনোই লোক ঠকানো বিজ্ঞাপন বলা যায় না। তবে হ্যাঁ, আজ যদি বিরাট কোহলি, সৌমিত্র চ্যাটার্জি বা অমিতাভ বচ্চন কোনও বিজ্ঞাপনে বলতেন যে অমুক ক্রিকেট কোচিং অ্যাকাডেমিতে খেলা শিখে কিংবা তমুক ড্রামা ইনস্টিটিউট বা ফিল্ম সেন্টারে অভিনয় শিখে ওঁরা ঐ আকাশ-ছোঁয়া সাফল্য পেয়েছেন, তবে সেটাকে অবশ্যই অনৈতিক, মূল্যবোধহীন কাজ বলা যেত।

আমাদের আজকের কৃতী ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক বা কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন দিয়ে সেই অনৈতিক কাজটাই করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আগামীদিনে যে সমস্ত ছেলেমেয়ে বোর্ড বা কাউন্সিলের পরীক্ষায় বসবে, তাদের অনেকেই এমন বিজ্ঞাপন দেখে নিশ্চয়ই বিভ্রান্ত হচ্ছে। তারা অনেকেই নিশ্চয়ই ভাবছে কোনও বিষয়ের পাঁচটা বই ঘেঁটে পড়াশোনা করার দরকারটা কী? স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ যেভাবে নিয়মিত অনুশীলনের কথা বলেন, সেসবেরও প্রয়োজন নেই। সহজে সাফল্যলাভের চাবিকাঠি তো আমাদের দাদা-দিদিরা দেখিয়েই দিয়েছে। শুধু অমুক কোম্পানির বই পড়ো আর তমুক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে যাও। তাহলেই সাফল্য চলে আসবে হাতের মুঠোয়।

তাই আমার মনে হয়, তাই এই ধরনের বিজ্ঞাপন রোধেও প্রবল জনসচেতনতা গড়ে ওঠা উচিত। আর কেন্দ্রেরও উচিত ঐসব বিজ্ঞাপন আটকাতে কঠোর আইন প্রণয়ন করা। নাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষালাভ করতে এসেও বিজ্ঞাপনী মিথ্যাচারে প্রতারিত হতেই থাকবে। আর তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন তলিয়ে যাবে বিজ্ঞাপনের চোরাবালিতে।  


……………………

                                                                                                                                                                                               

 

No comments:

Post a Comment