প্রবাসের পাঁচালি
অরুণদ্যূতি মৈত্র
২০২০ বছরটা কোভিডের চক্করে পরে পুরো মাঠে মারা গেল। এই বছর লন্ডনে হাতে গোনা কয়েকটা দুর্গাপুজো ছাড়া খুব বেশি হল না, এদিকে আমি গত বছরই আগাম পুজোর তারিখ দেখা ইস্তক মনে মনে প্ল্যান করে রেখেছিলাম শত সহস্র, কত যে কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম! নিজের সৌভাগ্য দেখে নিজেরই হিংসা হচ্ছিল এই ভেবে যে, এই বছর আর সপ্তমী, অষ্টমী ছেড়ে সেই দশমী, একাদশীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না; কবে সেই সপ্তাহান্ত আসবে, আর আমরাও মায়ের মুখদর্শন করতে পাব, ঐদিকে ভাগ্য বিধাতা নিজের মনে হেসে বলছিলেন, “হুঁহুঁ বাবা, সেটি হবার নয়, সারা বছর থাকবে বিদেশে, সব সুখভোগ করে, কলকাতার পলিউশনকে গালিগালাজ করে wine-এর গ্লাসে ঝড় তুলবে, এদিকে আশা করবে পুজোয় কলকাতার মতন আনন্দ! তো করোনাসুরের জ্বালাতনে সব এবার মাটি, দেখ এবার পুজো কী দেখবি!”
আচ্ছা, আপনারা হয়ত ভাবতে শুরু করেছেন কী এমন রহস্য আছে এবারের পুজোর ডেট-এ! নয় একটু পিছিয়ে গিয়েছে পুজো, তাতে কী এমন হাতি ঘোড়া এসে যায়! সেক্ষেত্রে আমার পেশাটি সম্পর্কে আপনাদের একটু অবগত করানো দরকার। আমি লন্ডনের একটি সরকারি হাই স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষিকা। আমাদের ছুটির লিস্ট-এ আছে হাফ টার্ম, মানে হচ্ছে প্রত্যেক ৩ মাস অন্তর ১টি সপ্তাহের ছুটি আমাদের প্রাপ্য, আর সেই হিসেবে অক্টোবর হাফ টার্মের ছুটিটা প্রতি বছর পড়ে অক্টবরের শেষের সপ্তাহে, কারণ এদেশে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে।
এক পুজো দিয়ে শুরু করে কত কথা বলে ফেললাম, এরই নাম হল বাঙালি! একবার আড্ডার গন্ধ পেয়েছে কী মজে গেল! ওই যে বলে না! স্বভাব যায় না ম’লে!
প্রথমবার এদেশে যেবার পা রাখলাম, সে ছিল ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের এক মঙ্গলবার, ধূসর সৌন্দর্যে চারিদিক ঘেরা, গাড়ির আরামদায়ক হিটিং-এ বসে বাইরের ওই রুক্ষ, রঙহীন প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে মন্দ লাগছিল না। তারপর দেখতে দেখতে ১১ টা বছর পার হয়ে গেল, প্রতি বছর ওই এক আবর্ত প্রকৃতির, তাও যেন মনে হয়; আহা কী মনোহরা এই রূপ! এখানে গরম কাল থাকে অগস্টের শেষ অবধি, তারপর অক্টোবর থেকে ঠান্ডা পড়তে শুরু করে, আর পশ্চিমের যে বিখ্যাত ঠান্ডা, সেটা পড়ে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ। তবে কলকাতার মতন ঠান্ডায় কষ্ট এখানে হয় না, তার পুরো ক্রেডিট দিতে হয় এদেশের সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম কে, আর দরজা জানলার কাচের ডাবলপ্লেটকে, অনেকটা উড়োজাহাজের জানলার মত মনে হয়।
এই পর্যন্ত ঠিক ই ছিল, কিন্তু কষ্টটা হঠাৎই “বাবা রে! মা রে!” বলে হাউমাউ করে ওঠে, যখন -৫ ডিগ্রিতে বাইরে বেরোতে হয়। তার সবটাই হল পাপী পেটের জন্য (উহু উহু)! এখন বলতেই পারেন কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল ওই সাতসমুদ্র তেরো নদী পার করে থাকতে, মুশকিল হল হাল্লারাজার দেশে কোন ভরসাতে যাই বলুন! না আছে চাকরি-বাকরি, না আছে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতন মৌলিক প্রয়োজনীয় বস্তুগুলি, এদেশে অনেক কিছু বাজের মধ্যেও মানতেই হবে, খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিত্সার মতন ন্যুনতম প্রয়োজনগুলি মেটাতে মানুষকে পায়ের ঘাম মাথায় ফেলতে হয় না। বরং বাস্তবিক ক্ষেত্রে যার যত কম ক্রয়ক্ষমতা সে তত বেশি সুবিধা ভোগ করে থাকে, মানে সরকারের একপ্রকার জামাই হয়েই দিন কাটায়। এর বড় এক কুফল হল, যত দিন যাচ্ছে মানুষ তত বেশি কর্মবিমুখ হয়ে পড়ছে। বাঙালি কর্মবিমুখ হিসেবে ভারতে যতই বদনাম কুড়াক, এদেশে কিন্তু তা না! বরং উলটোটাই। এখানে সবাই ভারতীয়, আর ভারতীয় হিসেবে তত্পরতা এবং দক্ষতার জন্য বেশ সমীহই করে এখানের কর্মজগৎ, আমিও সেটা শেষ পাতের মিষ্টি দই এর মতন চেটে পুটে নিই।
এবার আপনাদের এখানকার দৈনন্দিন জীবন সম্বন্ধে একটু অবগত করানোর চেষ্টা করি। বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন সময় শুনে এসেছি বিদেশে জীবন খুব সহজ, এখানে কাজকর্মের কোনও চাপ নেই, ধুলোবালি হয় না, মেশিন সব কাজ করে দেয়; এর সবটাই কিন্তু সত্যি নয়। যে কাজটা সবচেয়ে কষ্টকর বলে মনে হয় আমার, সেটা হলো ম্যাট্রেসে কাভার আর ডুবে কভার পড়ানো, মানে গোদা বাংলায় বলতে গেলে লেপে কাভার পড়ানো। এই কাজগুলো করার সময় সত্যিই অনুভব করি দেশের লাইফস্টাইল কতটা সহজ, অবশ্য এতে কিছুটা আত্মনির্ভরতার সাথে আপোষ করার প্রশ্ন এসে যায়, এতে অনেকে আমাকে গালিগালাজও করতে পারেন। তবে সেভাবে বিচার করতে গেলে, আমার মনে হয় দুটো দেশেরই ভালো এবং খারাপের সামঞ্জস্য বিদ্যমান, আর লন্ডনের বাঙালিরা সেই দিকটাকে খুব ভালো ভাবে আয়ত্ত করতে পেরেছেন। একদিকে খ্রিস্টোৎসবের পুডিং আর টার্কির রোস্ট আবার তার সাথে সাথে লক্ষীপুজোর আলপনা আর খিচুড়ি-লাবড়া-এরকম সর্বধর্মসমন্বয় বোধহয় বাঙালির পক্ষেই পালন করা সম্ভব। আর এদেশের যে জিনিসটা সবথেকে বেশি আমার পছন্দ, সেটা হলো কর্মব্যস্ততা আর পরচর্চাবিমুখতা।
পুরো সপ্তাহটা আমার কাটে ঘোড়ায় জিন দিয়ে, সকালে ফার্স্ট অ্যালার্ম বাজে ৫টা, তারপর ৫-20, এমনি করে ফাইনাল অ্যালার্মের আওয়াজে যখন সবটুকু আরামের ওম বিছানাতে ফেলে রেখে আমাকে উঠতে হয়, তখন ঘড়ির কাঁটা পৌনে ছয় ছুঁই ছুঁই, এখন যেহেতু অক্টোবর, তাই ডে লাইট সেভিং টাইম চলছে, তাই সকাল পৌনে ছয়ের একটু পরেই আলো ফুটে যায়। ডে লাইট সেভিং প্রথম প্রস্তাবিত করেছিলেন বেঞ্জমিন ফ্র্যাংকলিন, তারপর ১৯১৮ এর ৯ মার্চ প্রথম শুরু হলো ঘড়ির কাঁটা এগনো- পিছনোর এই পন্থা। মোদ্দা কথা হল শীতের বেলা ছোট, তাই এক ঘন্টা ঘড়িকে এগিয়ে দাও, যাতে সকালে সময় মতো কাজ শুরু করতে পারো, যেহেতু সে যুগে ইলেকট্রিসিটির প্রচলন ছিল না, ন্যাচারাল সূর্যের আলো ছিল একমাত্র ভরসা। আবার গরমকালে যেহেতু সকাল তাড়াতাড়ি হয়, তাই ঘড়ির কাটা ১ ঘন্টা এগিয়ে দাও, সোজা কথায় বলতে গেলে, গরম কালের সকাল ৬টা হয়ে দাঁড়ায় আমার শীতকালের সকাল ৭টা।
যাইহোক, চিরকালের অব্যাসবশত আমি সকালে একপ্রস্থ স্নান সেরে নিয়ে টুক করে একটু ঠাকুর প্রণাম করি, তারপর তৈরি হই বেরোবার জন্য । আমার breakfast বলতে, লন্ডনের বিখ্যাত ‘breakfast on go’ যাওয়ার পথে দোকানে থেমে একটা ব্রেকফাস্ট বার আর ১ কাপ mocha, ব্যাস, আমার সকালের খাবার তৈরি, একটু বেলায় একটা কলা, আর লাঞ্চ-এ একটা স্যান্ডউইচ, পুরো দিনের খাবার সর্টেড। কলা ইত্যাদি ফল ব্রেকফাস্টের জন্যই বরাদ্দ, কফিশপ-এ সকালে গেলে কলা ছাড়া অন্য ফল পাবেন না আর কমলালেবু, আপেল এগুলো লাঞ্চ টাইমের জন্য। ব্রিটেনের লাইফ স্টাইলের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরণের ফল। ফল ছাড়া কোনও মিলই সম্পূর্ণ নয়। এখন অনেকেই নাক সিঁটকোবেন, এই তো খাবারের ছিরি! তার আবার এতো বর্ণনা। ইস! কোথায় আমাদের লুচি, সাদা আলুর তরকারি, আর কোথায় ম্যাপেল সিরাপ দেয়া হাজার সিড-এ ভরা ব্রেকফাস্ট বার, তবে কিনা দুটো ক্ষুদেকে সামলে, তাদের সকালে তৈরি করে স্কুলের ব্রেকফাস্ট ক্লাবে পাঠিয়ে, নিজের জন্য যেটুকু সময় বরাদ্দ থাকে, তাতে এর থেকে বেশি সৌভাগ্যের আশা আমি রাখি না।
তবে আমার একটা বড়ো সুবিধা হল, বাড়ি থেকে বেশি দূরে আমাকে কাজে যেতে হয় না, তবে অনেকেই এদেশে যাওয়া আসা মিলিয়ে ৩ ঘন্টার রাস্তা পার করেন, আর সেটা বেশ কষ্টজনক তো বটেই। লন্ডনের বিখ্যাত M25, যা কিনা ট্রাফিক জ্যামের জন্য বিখ্যাত, M অর্থে মোটরওয়ে, মানে যেটাকে আমরা হাইওয়ে বলে চিনি। লন্ডন শহরকে বেষ্টন করে রেখেছে এই motorway M25, যার চলতি নাম লন্ডন অরবিট। যা বলছিলাম আরকি, যে সমস্ত নিত্যযাত্রী এই পথে যাতায়াত করেন তারা জানেন এর যন্ত্রনা। কলকাতার বাইপাসের ট্রাফিক জ্যাম, এর কাছে নেহাতই দুগ্ধপোষ্য শিশু। তারপর দিনের শেষে বাড়ি ফিরে সমস্ত নিত্যদিনের কাজ শেষ করে, বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে, গরম হিটিং-এর আরাম আর আমেজ নিতে নিতে, ফায়ার প্লেসের নকল আগুন জ্বালিয়ে দু’দণ্ড সোফায় বসে একটু বই পড়া, এই সুখটুকুর জন্য আমি হাজার কষ্ট উজাড় করে দিতে রাজি আছি।
……………
No comments:
Post a Comment