আজ রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বে বলে ঠিক করল রঞ্জিত। কাল সকাল আটটায় রিপোর্টিং। এই শব্দটা বেশ নতুনত্ব ওর কাছে, কিন্তু বাজনার মতন বাজতে লাগল কানে। সকাল মানে তো আজকাল নটার আগে দিন শুরুই হয় না ওর। সেই শেষবার ভোরবেলা উঠেছিল ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়। আটটায় রিপোর্টিং মানে ওকে সকাল ছটায় তো উঠতেই হবে। সাতটায় না বেরোলে আটটার মধ্যে সেক্টর ফাইভ পৌঁছান সম্ভব নয়।
বসার ঘরটা বেশ ছোট। একদিকে রান্নাঘর, আর একদিকে সদর দরজা। পাশের দেওয়ালে মাখন হাতে শ্রীকৃষ্ণের ছবিওলা ক্যালেন্ডারটা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে আর মাঝেমাঝে কাপড়ের আলনায় ধাক্কা খাচ্ছে। আলনাটা কাপড়-চোপড়ে বোঝাই হয়ে আছে। উলটোদিকে জানলা, সেখান থেকে পাশের বাড়ির রান্নাঘরটা দেখা যায়। জানলার পাশে একটা লম্বা আয়না, দেওয়ালে পেরেক দিয়ে লাগানো। আয়নার ওপরে, কোণার দিকে পাঁচটা লাল রঙের টিপ লাগানো আছে। আর আছে একটা পাখির স্টিকার। সেই কবে রঞ্জিত পাড়ার দোকান থেকে একটা গোটা পাতা স্টিকার কিনেছিল, তখন কতই বা বয়স, বড়জোর আট কী দশ! তার থেকে এই একটাই অবশিষ্ট আছে। এই একটাই তার শৈশবের শখের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে।
রান্নাঘরে ঢোকার দরজার ডানহাতে সানমাইকা লাগানো নিচু টেবিলের ওপর একটা বেশ পুরোনো সাদাকালো টিভি রাখা। সেই কবেকার কথা, এই পাড়ায় প্রথম রঞ্জিতদের বাড়িতেই টিভি এসেছিল। ক্রিকেট ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে শনি–রবিবারের বিকেলের সিনেমা দেখার জন্য ওদের বাড়িতে লম্বা লাইন পড়ত। আস্তে আস্তে গোটা পাড়ায় রঙিন টিভিতে ছেয়ে গেছে, কিন্তু রঞ্জিতদের ক্ষমতার উন্নতি হয়নি। এলাকায় এই বাড়ির ঔজ্জ্বল্য ধীরেধীরে মহাশূন্যের হাজার আলোকবর্ষ দূরের কোনও গ্যালাক্সিতে বিলীন হয়ে গেছে। সোফাটার একটাদিক বেশ ঢালু। মনে হচ্ছে যেন গতবারের উম্পুনের হাত থেকে সোফাটাও বাঁচতে পারেনি। তারই একটা প্রান্তে বসে রঞ্জিত টিভি দেখছে। যদিও টিভির সেই একঘেয়ে অনুষ্ঠানে মন না বসে মাথার মধ্যে কী সব আবোল তাবোল চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ভাবছে কত তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া যেতে পারে। সকালে না উঠতে পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তবে বাড়িতে একটা উৎসবের মহল। বাবা এখন নেই, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে গেছে। আড্ডা মানে তো নিজের ছেলের প্রশংসা আর অন্যের ছেলের অপারগতা জনসমক্ষে জানিয়ে দেওয়া। যাকগে যাক! কাল কী পরে সে যাবে? টাই তো পরতেই হবে। কলেজে অলক স্যার বলেছিলেন, টাই না পরলে প্রফেসনালিজম স্পষ্ট হয় না। কিন্তু ওর তো সেরকম ভাল টাই কিছু নেই! ইশ্, একটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। আজ সকালেও যদি মনে পড়ত! এখন সাড়ে ছটা, কোনও মানেই হয় না, এই সময় দোকানে যাওয়ার। নীলচে টাইটা খারাপ তো কিছু নয়। ওটা পরেই তো ইনটারভিউ দিয়েছে সে।
খবরটা যেন হঠাৎ একটা শীতল মৃদু বাতাস এনেছে জীবনে। মাস খানেক আগে রঞ্জিতের ইনটারভিউ হয়েছিল। ওটাই ওর জীবনের প্রথম ইনটারভিউ। একটা নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য গেছিল। কল্পনাও করেনি যে হয়ে যাবে। কেমন হয়েছিল ইনটারভিউ–নিশ্চয় ভাল, না হলে আর ওকে সিলেক্ট করবে কেন! আজ হঠাৎ করে সেদিনের ঘটনা ভাববার চেষ্টা করল রঞ্জিত, কিন্তু একটা প্রশ্নও মনে পড়ল না।
কাগজে তো আজকাল চাকরির খবর কিছু থাকে না। মন্দা চলছে সর্বত্র। হঠাৎ করেই খবরের কাগজের মাঝের পাতার শেষের দিকে একটা বিজ্ঞাপন দেখে বরেণ বাড়ি এসে জানিয়েছিল। দুজনেই গেছিল ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বরেণ ফেল আর ও পাশ। ব্যাপারটা সত্যি আশ্চর্যের। সেই ক্লাস সেভেন থেকে ওরা বন্ধু। তারপর একসাথে সিনেমা দেখা, রাস্তায় চাট খাওয়া, এক্সাইডের মোড়ে দাঁড়িয়ে মোমো খাওয়া, গোয়েঙ্কায় কমার্স পড়া, এমনকি ইউনিভার্সিটিতে এম-কম - সব একসাথে। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে বরেণ অনেক এগিয়ে গেছিল। ওর রেজাল্টের জন্য প্রফেসররা ওকে অন্য নজরে দেখতেন। কিন্তু মিডিওকার রঞ্জিত আজ চাকরি পেল, বরেণ নয়। মনে একটা উচ্ছাস এল।
অথচ, বরেণের চাকরিটা দরকার ছিল। বাবার রিটায়ারমেন্ট আগামী বছর। জলের মতন টাকা খরচ হচ্ছে ওর মায়ের ক্যান্সার চিকিৎসায়। সারভাইকাল ক্যান্সার হয়েছে তাঁর। এবছরের মধ্যে মহিলা চলে গেলে ওরা বেঁচে গেল। না হলে কপালে দুঃখ আছে। কী আবোল তাবোল চিন্তা করছে রঞ্জিত! চমকে উঠল সে নিজেই। কেমন যেন স্বার্থপরের মতন শোনাচ্ছে কথাগুলো। এই কাকিমাই একটা সময় নারকেলের নাড়ু, মুড়কির মোয়া করে বরেনের হাত দিয়ে পাঠাতেন, কারণ রঞ্জিত ওগুলো খুব ভালবাসত। সেবার ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় রঞ্জিতের বাবা মা গেছিল মামার বাড়ি, কারণ দিদার খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। পরীক্ষার সময় নিয়ম করে বরেনের মা ওর খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। রঞ্জিত কিনা সেই মানুষের মৃত্যু কামনা করছে! কান্নাটা দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে গেল।
বাংলা খবরে কী একটা স্টিং অপারেশনের ক্লিপিং দেখাচ্ছে। কাস্টিং কাউচের রসালো খবর। রঞ্জিত গোগ্রাসে গিলে চলল খবরটা। চোখে মুখে একটা উত্তেজনা হচ্ছে ক্লিপিংটা দেখে। সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। মোবাইল থেকে ফোন করল দেবযানীকে। এই দেবযানীর সাথে আলাপ করিয়েছিল বরেনই। প্রথম দিন কেমন একটা আড়ষ্টতা ছিল। ভেবেছিল ওটা বোধহয় বরেনের গার্লফ্রেন্ড। রঞ্জিত বরেনের মতন স্মার্ট নয়, সপ্রতিভ নয়, এমনকি সকল বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতাও নেই। চটজলদি যেকোনও আড্ডায় মিশে গিয়ে সেখানকার বিষয় নিয়ে আলোচনাও করতে পারে না। তবু দেবযানী রঞ্জিতকেই পছন্দ করেছিল, ওর লাজুকতার জন্য। ওর মধ্যে একটা সরলতা দেখেছিল। দেবযানীর মনে হয়েছিল, রঞ্জিত আর যাই হোক ঠকাবে না, অজানা রাস্তায় ফেলে রেখে পালাবে না। রঞ্জিতের মনে হল, সেবারের মতন এবারও ও-ই জিতেছে। হোক না বরেনের জ্ঞানের পরিধি বিশ্বজোড়া, হোক না বরেন সকলের থেকে আগে, কিন্তু তবু আজ ও-ই জিতেছে।
“হ্যালো! কী খবর! আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। সব রেডি?” এক নিশ্বাসে কথা বলল দেবযানী।
“এই তো বসে আছি, রেডি আর কী!”
“কাল কিন্তু মনে করে সব ডকুমেন্ট নিয়ে যাবে।” একটু আদুরে গলায় দাবি করল দেবযানী।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে। জামা প্যান্ট, টাইটা বের করে রাখব, যাতে সকালে হুড়োহুড়ি না করতে হয়।” নিশ্চিন্ত করল রঞ্জিত। এরপর, ও সাহস করে কথাটা পেরেই ফেলল, “বাবা মাকে বলেছ?”
“হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।”
ঝাঁঝালো গলায় রঞ্জিত বলল, “হবে কী করে? ওরা কী জানেন, আমার সাথে তোমার সম্পর্ক! এবার সব কথা বলে দেওয়াটা কি উচিত নয়?”
আশ্বস্ত করে দেবযানী বলল, “বলব বলব, কাল জয়েন কর। সব বলব। চাকরির কথা শুনলে, আর কোনও কথা বলতে পারবে না।”
রঞ্জিতের মনের মধ্যে কেমন যেন গুলিয়ে গেল কথাগুলো। কোনও কথা না বলে ফোনটা কেটে দিল। মানুষের সম্পর্ক কী এই এতটাই ঠুনকো! দরকারে না হলে, উপকারে না আসলে কোনও মানুষ অপরকে চেনে না!
এই যে বাবা আজ বুক ফুলিয়ে চলেছে, ছেলে চাকরি না পেলে এই প্রতিক্রিয়া থাকত? চাকরি না পেলে কি দেবযানী এত অবলীলায় বাড়ির মধ্যে সবার সামনে ফোনটা ধরত?
কিন্তু রঞ্জিত নিজে? কেমন অবজ্ঞার চোখে দেখছে বরেণকে! যেন সে কৃপার পাত্র। একবারও কি ভেবেছে, ঐ বিজ্ঞাপনের খবরটা সেদিন বরেন না আনলে, আজ এই যে আনন্দ, সকলকে নস্যাৎ করার বিপুল প্রচেষ্টা, সংসারের সকল সমস্যা এক নিমেষে অস্বীকার করার মানসিকতা– সবকিছু কেমন ফিকে হয়ে যেত। বরেণ কেন জানিয়েছিল! ওর তো কোনও স্বার্থ ছিল না। স্বার্থ থাকলে যেচে কেউ কম্পিটিশন বাড়ায়! মনে মনে দুবার ভেবেছে, একটা রেকমেন্ড করে দেবে বরেণের নামটা। চিরকাল বরেণ ওর অনুরাগী হয়ে থাকবে। কিন্তু বন্ধুত্ব! সেটা হারিয়ে যাবে চিরকালের জন্য।
হঠাৎ করেই রঞ্জিতের চোখের সামনে কিছু ঘটনা ভেসে উঠল। সেদিন সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছিল, আকাশ কেমন কালো মেঘে ঢেকে গিয়ে বিষণ্ণ পরিবেশ বানিয়েছিল। একটা মেটে রঙের বারমুডা ও ধুসর রঙের জামা পরে ঘরের দরজা ধরাম করে খুলে বরেণ বলল, “খবর আছে, একবার চোখ বুলিয়ে দেখ।” হাতের রঙ্গিন কাগজটার নিচের অংশে প্রায় অর্ধেক জুড়ে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন। সব লেভেলে লোক নিচ্ছে। বাবা লাফিয়ে উঠল খবর শুনে। হঠাৎ ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। একজন মেয়ে বলল, “আমার নাম দেবযানী, আমি কোম্পানীর এইচ আর থেকে বলছি। একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনার ছেলে রঞ্জিতকে পাঠিয়ে দিন একবার। ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ভুল করে ইস্যু হয়েছে। ওটা হবে বরেণ বসাকের নামে। আর হ্যাঁ, ওকে বলবেন আমার সাথে আর যেন কোনও যোগাযোগ না রাখে। আমি এখন শুধু বরেণের।” বাবা হঠাৎ করেই মাটিতে বসে পড়ে অসম্ভব ঘামতে শুরু করল।
চমকে উঠে একবার তাকালো রঞ্জিত। সারা ঘর অন্ধকার। মশারিটা টাঙ্গানো আছে। ঘরে দেওয়াল ঘড়িটার টিক্ টিক্ শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। কপালের ঘামটা মুছে একবার মশারি তুলে বিছানার পাশে রাখা টেবিল হাতরে জলের গ্লাসটা নিল। ঠক করে একটা কিছু পড়ল মাটিতে।
উফ! একটা মারাত্মক স্বপ্ন। ওর কিছুতেই মনে পড়ছে না, ও কখন ঘুমাল। বিছানার পাশে রাখা বেডসুইচটা টিপে লাইট জ্বালালো। ঠিক যেটা মনে হচ্ছিল, ওর কালকের জামা প্যান্ট টেবিলের ওপর রাখা আছে। সবকিছু একদম ঠিক। শুধু মাটিতে পড়ে আছে ওর প্রিয় পেনটা। তার মানে ঘুমানোর পর ও সব ভুলে গেছে, হয়তো এই মারাত্মক স্বপ্নই সব ভুলিয়ে দিয়েছে। ঘড়িতে এখন প্রায় সাড়ে চারটে। দুয়েকটা কাক ডাকছে কাছের অশ্বত্থগাছটা থেকে। নাঃ, আর ঘুম হবে না রঞ্জিতের। টেবিল থেকে ফোল্ডারটা নিয়ে বিছানায় বসল। সব ডকুমেন্টে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া ভালো, তারপর স্নান করে নেবে।
সাড়ে ছটায় বাবা একটা ট্যাক্সি ডেকেছিল। আজ প্রথমদিন, একটু চাল মারলে খারাপ কী! দু মিনিট পর ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বাঁদিক করে দাঁড়াতে বলল। সামনের বাড়ির দোতলায় বরেণরা থাকে। একবার দেখা করা খুব দরকার।
“আরে কী সৌভাগ্য! এত সকালে! আজ না তোর জয়েনিং?” বেশ অবাক হয়েই কথাগুলো বলল বরেণ।
“যাবার আগে তোর সাথে একবার দেখা করতে এলাম রে। তুই না থাকলে আজকের দিনটা স্পেশাল হত না।”
ঘরে ঢুকে বরেণের শয্যাশায়ী মাকে একটা প্রণাম করে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিল রঞ্জিত। আর বলল, “চলি রে, বিকেলে এসে অভিজ্ঞতা জানাব”।
………………….
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment