গল্পঃ অনীকঃ প্রোজ্জ্বল পাল

 







                      

   

“দোলাদির বর কফি মেশিন দিয়ে একটা ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর আমি তাপসকে বললাম বিস্কুটগুলো নিয়ে আসতে। কাগজের কাপও আনতে বললাম। পঞ্চাশটা মত আনলেই হবে বল?” দোকানে ঢুকে বলল সঞ্জয়। অর্পিতা উত্তর দিল না। ক্যাশের ডেস্কটার সামনে চুপ করে বসে রইল চেয়ারে, দরজার উলটোদিকে মুখ করে।

সঞ্জয় এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখল ওর আলতো। দীর্ঘশ্বাসে একটু কেঁপে উঠল ও। “আছে তো মণিও আমাদের সাথে, সব দেখছে ও।” একটু পরে বলল সঞ্জয়। ওদের সামনেই দেওয়ালে আটকানো অনীকের ছবিটায় তখন বাইরের টুনি বাল্বগুলোর প্রতিবিম্ব। 

“চলো। গেস্টরা চলে আসবে এবার।” সঞ্জয়ের হাতটা ছুঁয়ে উঠল অর্পিতা। অনেকদিন পর একটু সেজেছে ও। খোঁপায় মালাটা দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল ছেলের ছবিটার দিকে। এরকম একটা সাদা মালা ঝুলছে ছেলের গলা থেকে। বেলফুল খুব পছন্দ করত বাবুই। অর্পিতার যেদিন প্রোগ্রাম থাকতো অনেক রাত করে ফিরে ও দেখত ঘুম চোখে ছেলে জেগে আছে, মায়ের খোঁপা থেকে মালাটা নিয়ে ঘুমোতে যেত ও। পরদিন খুব ভোরে ওর ঘুমন্ত মুখটাকে আদর করার সময় বেলফুলের গন্ধ পেত ওর বাবা। 

“সঞ্জয়দা, অর্ণব সাহা এসে গেছে প্রায়, বেলগাছিয়া ছাড়াল।” দরজাটা একটু ফাঁক করে মুখ বাড়িয়ে বলে গেল দোলাদি। 

“হ্যাঁ আসছি গো। চল তো” বলে ওর পেছন পেছন বেরিয়ে এল অর্পিতা। 

বেরিয়ে রীতিমত চমকে গেল ও। দোকানের সামনের চেয়ারগুলো প্রায় সবকটা ভর্তি। সামনের সারি থেকে পূরবী হাত নাড়ল ওর দিকে। সফিকুলদা দেখে এগিয়ে এলেন। “যাক এইবার লোককে বলতে পারব যে অন্তত একটা দোকানে আমার বই পাওয়া যায়” হেসে বলল সফিকুলদা।

“এসব বলো না তুমি, বইমেলায় তোমার সাথে সেলফী তুলবে বলে কত লোকে দাঁড়িয়ে থাকে জানো?” পালটা হাসল অর্পিতা। 

“তোরাই দাঁড়াস রে। বাকি সুন্দরীরা শুধু বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেলফি তোলে, নিদেনপক্ষে অর্ণব সাহার সাথে” দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হোহো করে হেসে উঠল সফিকুলদা। 

“এই তোর বর কোথায় রে? ডেকরেটার্সের ছেলেটা বলছে কী একটা প্রবলেম হয়েছে?” তন্ময় এসে বলল হঠাৎ।

“দোকানের ভেতরে কিনা দেখ তো। কী প্রবলেম হল আবার?” বলে স্টেজের দিকটায় দেখতে গেল অর্পিতা। 

স্টেজের পেছনে তখন ডেকরেটার্সের একটা ছেলের সাথে রীতিমত ঝগড়া হচ্ছে সঞ্জয়ের, “না আমরা তো আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম চারটে মাইক লাগবে। এখন পারব না বললে কী করে হবে? এমনিতে স্টেজটা আপনারা ছোট করেছেন।” 

ডেকরেটার্সের একটা ছেলে পালটা বলে উঠল, “দেখুন আমাদের সিচুয়েশনটা বুঝুন একটু কাকু। মিটিঙে মাইক চাইলে আমাদের কিচ্ছু করার নেই। আপনি কথা বলুন আমাদের মালিকের সাথে।” 

“কীসের মালিক? আমি কবে থেকে বলে রেখেছি, পুরো পেমেন্টও হয়ে গেছে, আর মিনিট দশের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হবে, আপনারা এখন বলছেন মাত্র দুটো মাইক? আরে মিটিঙে যারা আসছে তারা ইম্পর্টেন্ট, আর আমার এখানে যে রাইটাররা আসছেন তাদের দাম নেই?” ছেলেটার বাড়ানো ফোনটাকে পাত্তা না দিয়ে বলে চলল সঞ্জয়।

“আপনি মালিককে বলুন পুরোটা। দেখুন, আমরা কাজ করি, আমাদের হাতে তো কিছু নেই দাদা” পেছন থেকে আর একটা ছেলে এসে বলল। 

“ফোনটা কর না তুমি” বলে উঠল অর্পিতা। 

“দাও দেখি” বলে ফোনটা নিল সঞ্জয়। 

ঠিক তখনই পেছন থেকে তাপস এসে বলল, “বউদি এদিকের সব রেডি। ফুল টুল আনা হয়ে গেছে, বোকে দুটো অনেছি। তুমি একটু সবাইকে অ্যানাউন্স করে দাওনা যে অনুষ্ঠান আর মিনিট দশের মধ্যেই শুরু হবে।”

“দোলাকে বল না বলে দিতে একটু। ও-ই তো অ্যাঙ্কারিং করবে। আমি বরং ফুলগুলো দেখি।” বলে এগোলো অর্পিতা। 

“আচ্ছা। আর বলছি, এবার বাবুইয়ের ছবিটা আনি?” জিজ্ঞেস করল তাপস। 

“আনো। আমি আগে দেখে আসি এদিকে, ডেকরেটার্সের সাথে তোমার দাদার আবার ঝামেলা লেগেছে।” বলে আবার স্টেজের পেছনদিকে এগোলো ও।

“মানে এই পলিটিকাল পার্টিগুলোর জন্যেই দেশটা শেষ হয়ে গেল” ফোনটা ফেরত দিয়ে গজগজ করছিল সঞ্জয়। 

অর্পিতা সামনে যেতে বলে উঠল, “তুমি ভাবো জাস্ট, হঠাৎ নির্দেশ এসেছে ওদের কোথায় একটা মিটিং আছে, আরো পাঁচটা মাইক সাপ্লাই দিতে হবে। ব্যাস, আমাদের থেকে দুটো মাইক ওখানে চলে গেল। আর মালিককেও কী দোষ দেব! সাপ্লাই না দিলে হয়তো আজকেই ওর দোকানে হামলা করবে।” 

“ছাড়ো, একটা মাইক অর্ণব সাহার জন্য থাক, আর একটায় আমরা ভাগাভাগি করে নেব। দোলাকে বলব একটু ম্যানেজ করে নিতে” সঞ্জয়ের পাঞ্জাবীর হাতাটা ধরল অর্পিতা, “আগে এদিকে এসো তো, তাপস বাবুইয়ের একটা ছবি এনেছে নাকি।” 

স্টেজের ঠিক মাঝখানে চেয়ার দিয়ে বসানো হল ছবিটা। একটা বাচ্চা ছেলে, খিলখিলিয়ে হাসছে, অপাপবিদ্ধ হাসি। নীচে লেখা ‘অনীক রায়, ২০১০- অনন্ত’। 

দোলা অর্পিতার হাত থেকে মাইকটা নিয়ে বলতে শুরু করল, “আমাদের দোকানের শুভ উদ্বোধনে আসার জন্য সকলকে আমাদের বিপণীর তরফ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত আপনাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেব আমরা, আমাদের প্রধান অতিথি প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী অর্ণব সাহা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছবেন আমাদের মধ্যে। ওনার হাত দিয়েই আমাদের অনীক পুস্তকালয়ের শুভ উদ্বোধন হবে।” 


    

“সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছে আপনারা শান্ত হয়ে বসুন, আমাদের সভার প্রধান বক্তা প্রখ্যাত জননেতা শ্রী বাবলু দত্ত আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মধ্যে উপস্থিত হবেন। আপনারা জানেন বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরে বাইরে অনেক শত্রুর সাথে লড়তে হচ্ছে আমাদের। তাদের সবার চক্রান্ত ব্যর্থ করে আজকে আপনারা এই যে দলে দলে এই সভায় যোগদান করেছেন তার জন্য আপনাদের সভার জন্য আর একবার সবাই মিলে, বাবলুদা জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।” 

শেষ ‘জিন্দাবাদ’ টায় গলা মেলালো বুলু। ওর ঠিক পাশ দিয়ে একটা মিছিল ঢুকল। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। মিটিঙ শুরুর কথা চারটেয়। বুলু ভেবেছিল ছটার মধ্যে ফিরে যাবে। বোনের আজকে ঝিলপাড়ের দিকে পড়া থাকে, ও দিকে রাতে একা ছাড়াটা ঠিক না। ক’দিন আগেই একটা মেয়েকে রেপ করার হুমকি দিয়েছে পরী ওখানে। বাবলুদা ওর টোটোতেই পরে গেছিল মেয়েটার বাড়ি। বুঝিয়ে বাঝিয়ে থানা পুলিশ করতে না করে এসেছে। ওরা যতক্ষণ কথা বলেছে মেয়েটা একবারও বেরোয়নি।

পরী এখন সাউন্ডের দিকটা সামলাচ্ছে। বুলুও ওদিকেই ছিল। তারপর দুটো মাইক কম এসেছে বলে ডেকরেটার্সের একটা ছেলের সাথে ওকে পাঠালো এই প্রোগ্রামটা থেকে নিয়ে আসতে। অবশ্য তার আগে ছেলেটা পরীর হাতে চড় খেয়েছে একটা। গোটা রাস্তা একটাও কথা বলেনি ছেলেটা। একটা দোকান উদ্বোধন হচ্ছে এই প্রোগ্রামটায়। সেখানেও একটা লোক ‘আমাদের কথা ছিল চারটে মাইক দেবে’ বলে গাঁইগুঁই শুরু করেছিল। মালিকের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছে ছেলেটা। 

মাইকদুটো ছেলেটার হাত দিয়ে পাঠিয়ে চা নিল একটা ও, সিগারেটটা ধরাতে যাবে তখনই ‘জিন্দাবাদ’ টা উঠল। হাতটা তুলে জিন্দাবাদ বলতে গিয়ে দেশলাই কাঠিটা নিভে গেল ওর। ‘ধুশ্শালা’ বলে আর একটা ধরিয়ে চা টা দোকানের সামনে টেবিলটা থেকে তুলে নিল বুলু। দোকানদার বলে উঠল, “কী মনে হচ্ছে? একটা ক্যাঁচাল হবে আজকে?” 

“কেন?” এক চুমুক দিয়ে পালটা জিজ্ঞেস করল বুলু। 

“শুনছি নাকি দেবাদার ছেলেরা মিটিঙে ঝামেলা করবে। আগের সপ্তায় দক্ষিণপল্লীতে ওদের একটা ছেলেকে নাকি কেলিয়েছে খুব।” দোকানদার উনুনে কয়লা দিতে দিতে বলে গেল। 

“ও তো লেগেই আছে। ঝামেলাই তো হচ্ছে চারদিকে।” স্টেজের দিকে তাকিয়ে বলল বুলু।

আজকে ঝামেলা হবে মোটামুটি সবাই জানে। অ্যাকচুয়ালী ঝামেলা হবে বলেই আজকে মিটিংটা হচ্ছে। বুলুর এইসব লাফড়ায় পড়তে কোনোকালেই ভালো লাগেনা। কিন্তু ওই যে, বাবলুদা না হলে টোটোটা হত না। লোনের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডে গাড়ি ঢোকানোর পারমিশন, সব বাবলুদা না থাকলে হয় না। আর রিটার্নে একটু আধটু আসতেই হয় মিটিং এ। হাওয়া তেমন গরম দেখলে আগে থাকতেই উলটো ফুটে গিয়ে বাস ধরে ডানলপ চলে যাবে বুলু, পিসির বাড়িতে রাতে থেকে কাল ফিরবে। তার আগে বাবলুদা এলে কোনোভাবে একবার দেখা দিয়ে আসতে হবে। যাতে অন্তত বলতে না পারে যে বুলু আসেনি। কাপ টা ফেলে স্টেজের দিকে এগোলো বুলু। 

মাইকে আবার ঘোষণা হল, “আমাদের মধ্যে এইমাত্র এসে পৌঁছেছেন এই এলাকার সুযোগ্য সন্তান, সকলের কাছের মানুষ, কাজের মানুষ, আমাদের যোগ্য নেতৃত্ব শ্রী বাবলু দত্ত মহাশয়।” 


   

“আমি আর একটু লম্বা ভেবেছিলাম ওনাকে” একটা মেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল পাশের ছেলেটাকে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও কথাটা কানে এল অর্পিতার। অর্ণব সাহা সেই অর্থে বেঁটে খাটোই, তার ওপর চেহারাতেও তেমন চাকচিক্য নেই, গাড়ি থেকে নামার সময়ে ওরা কিছু বলার আগে নিজেই বলে উঠলেন, “আমি ভীষণ দুঃখিত আমার দেরি হয়ে গেল। আপনাদের অনুষ্ঠান কি শুরু হয়ে গেছে?’’ 

সবাইকে হাসিমুখে “আপনারা একটু শান্ত হয়ে বসুন, তিনি উদ্বোধনের পর সই করে দেবেন, ছবিও তুলবেন” বলতে বলতেই স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল অর্পিতা। ভদ্রলোক স্টেজে উঠে বাবুইয়ের ছবির দিকে একটু তাকিয়ে চেয়ারে বসলেন। দোলাদি হাত নেড়ে ডাকল ওকে। 

“আপনাদের সকলকে আমাদের বিপণীর তরফ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন এই শুভ অনুষ্ঠানে আমাদের পাশে থাকার জন্য। আর এর সাথেই আমরা ভীষণ ভীষণ আনন্দিত যে বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রী অর্ণব সাহা আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আমরা আমাদের অনুষ্ঠান শুরু করতে চলেছি। প্রথমেই শ্রী অর্ণব সাহাকে আমাদের পক্ষ থেকে বরণ করে নেবেন শ্রীমতি অর্পিতা রায়।” দোলাদি এতদূর বলে অর্পিতার দিকে ইশারা করল। তাপস ফুলের বোকে আর ব্যাজটা এগিয়ে দিল ওঁর দিকে। 

বোকেটা নিয়ে ভদ্রলোক হেসে বললেন, “আমি কিন্তু একবার দোকানটা ঘুরে দেখতে চাই।” 

“নিশ্চই। আপনি স্বাগত” বলে হাসি ফিরিয়ে দিল অর্পিতা। 

“এইবার আমরা মঞ্চে ডেকে নেব আমাদের অত্যন্ত কাছের মানুষ, আমাদের অভিভাবক কবি সফিকুল আলম কে। সফিদা, প্লিজ আসুন।” 

সফিকুলদাও মঞ্চে উঠে বাবুইয়ের ছবিটার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে অর্ণব সাহার পাশের চেয়ারে বসলেন। দোলাদি এবার সঞ্জয়কে ডাকল সফিকুলদাকে বরণ করে নিতে। 

“এইবার আমাদের বিপণীর শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হবে। এই মর্মে আমি আমাদের অন্যতম কর্ণধার শ্রী সঞ্জয় রায়কে কিছু বলতে অনুরোধ করব।” দোলাদি হঠাৎ এটা বলে একপ্রকার জোর করেই সঞ্জয়ের হাতে মাইক ধরিয়ে দিল। 

মাইকটা হাতে নিয়ে কেমন ইতস্তত করছিল সঞ্জয়। অর্পিতা এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। 

“আমি একজন ব্যবসায়িক। আমার একটা ছোটমত ফ্যাক্টরি আছে, মোটর পার্টসের। বইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ কলেজ ছাড়ার পর আর নেই। উলটোদিকে আমার স্ত্রী বইয়ের পোকা, ওর সাথে আলাপের পর ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছিলাম ওর ঘরে শুধু বই আর বই। ও আমায় বেশ কয়েকবার বই পড়ানোর চেষ্টা করেছে, আমার সত্যি বলতে ধৈর্যটা আমার একটু কম। ও আমায় পড়ে শোনাতে শোনাতে বিরক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আর আমি গল্পের শেষে কী হবে পাতা উলটে জেনে নিতাম। ওর খুব ইচ্ছে ছিল আমাদের সন্তান অনেক গল্পের বই পড়বে। বারবার বলত যে ও মায়ের মত হবে। বাবুই, মানে অনীক যে কদিন আমাদের সাথে ছিল সত্যিই মায়ের মত হয়েছিল, অন্য বাচ্চারা কার্টুন না চালালে খায় না, আর বাবুই হাতে একটা গল্পের বই না থাকলে খেতে চাইতো না। এমনকি ওর যখন খুব শরীর খারাপ, আমরা ভেলোরে গেছি, পরদিন অপারেশন ওর, সেদিন রাতেও ওর মা ওকে আবোলতাবোল পড়ে শুনিয়েছে খাওয়াতে খাওয়াতে। সেই জন্যই বাবুই চলে যাওয়ার পর আমাদের মনে হল একটা বইয়ের দোকান যদি খোলা যায়, তাতে ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও, ওর ভালোবাসাটাও বজায় থাকবে, আর ওর মা ও দোকানের কাজে একটু ব্যস্ত হলে শোকটা একটু কাটিয়ে উঠতে পারবে।” এতটা বলতে বলতে গলা ধরে এল সঞ্জয়ের। মাইকটা অর্পিতার দিকে এগিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করল ও। 

“আমার স্বামী বলছিলেন যে ও একটা বই পুরো গল্পটা না জেনেই আগে শেষটা পড়ে নিত। আমাদের সন্তানের ও যেন তাই হল, ওর পুরো জীবনটা জানার আগেই আমরা একদম শেষে চলে এলাম।” মাইক সরিয়ে দীর্ঘশ্বাসটাকে যেতে দিল অর্পিতা, তারপর আবার শুরু করল, “তাই ওর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের এই ছোট্ট বইয়ের দোকানটা খোলা। এই আইডিয়াটা আমার স্বামীর। আপনাদের সকলের আশীর্বাদ পেলে খুব ভালো লাগবে।” বলে গেল অর্পিতা। 

ওর হাত থেকে মাইক নিয়ে দোলাদি বলতে শুরু করল, “আমি শ্রী অর্ণব সাহা ও শ্রী সফিকুল আলমকে অনুরোধ করব অনীকের ছবিতে মাল্যদান করার জন্য।” 

নীরবতা পালনের কথা বলতে হল না কাউকে। কিছুক্ষণ যেন সবাই চুপ থেকে ছবির মধ্যে অনীককে হাসতে দিল প্রাণভরে। তারপর অর্ণব সাহা আর সফিকুল আলম ফিতে কেটে টুনিবাল্ব দিয়ে সাজানো কাচের দরজা ঠেলে দোকানের ভেতরে ঢুকলেন। উৎসাহী কয়েকজন দর্শকও এলেন সাথে সাথে। তাপস ইশারা করল সবাইকে কফি আর বিস্কুট দিতে। 


    

“বন্ধুগণ, আমায় অনেকে প্রশ্ন করে, অনেকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে দাদা তুমি এত সাহস কোথা থেকে পাও? আমি কী বলি জানেন? আমি বলি আমার এলাকার মানুষদের থেকে পাই সাহস। আমার এলাকার যে ভাইটা সারাদিন টোটো চালিয়ে পরিবারের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিচ্ছে, যে বোনটা সেলাই করে বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে, যে বাবা লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করছে ভীড়ে, সে আমায় সাহস দেয়।” 

বুলুর পাশের মাঝবয়সী লোকটা বাবলুদা স্টেজে ওঠামাত্র হাত নাড়তে শুরু করেছিল স্টেজের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন বুঝল বাবলুদা দেখতে পাচ্ছে না, তখন পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর বাবলুদা বক্তৃতা শুরু করার পর যতবার হাততালি পড়ছে লোকটা ততবার এপাশে ওপাশে তাকিয়ে সবাইকে বলছে, “এই লোকটার কথায় গা গরম হয়ে যায়। নেতা কাকে বলে দেখে শেখা উচিত শালাদের।” 

বুলু লোকটাকে দেখছিল আর বাবার কথা ভাবছিল, বাবা এইভাবে টিভিতে বাবার পার্টির বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললে খাওয়া থামিয়ে পাল্টা জবাব দিত। ওরা যত বলত যে, “বাবা লোকটা টিভিতে আছে, তোমার কথা শুনতে পাবে না”, তাও বুঝত না। 

বুলু শুধু বুঝতে পারছে বাবা কিম্বা ওর পাশের লোকটার মত করে ও পার্টিকে ভালোবাসতে পারে না। একটু আগে একটা ইয়ং ছেলে বলছিল, “বাবলুদার জন্য জান লড়িয়ে দেব বাঁড়া”, বুলুর সেটা শুনে আগে মনে হল ঝামেলায় ওইদিকের বাস বন্ধ হয়ে গেলে কী হবে। আর এমনিতেও বাবলুদার পুরো বক্তৃতাটা শুনতে শুনতে ওর মনে খালি এটাসেটা আসছিল, যেন ও টোটো চালিয়ে বক্তৃতাটাকে কোথাও পৌঁছে দিতে যাচ্ছে, চালাতে চালাতে দু একটা কথা কানে আসছে, স্ট্যান্ড এসে গেলেই পুরোটা নেমে যাবে। 

বাবলুদা বলে চলেছে, “আমি এই মঞ্চ থেকে, এই মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আগমনের মঞ্চ থেকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছি কোনো সুবিধাবাদী শক্তি যদি আমাদের আটকাতে আসে তাহলে মানুষ এর জবাব দেবে। আর মানুষের জবাব কিন্তু সব সময় হাত জোড় করে হয় না, হাত বাড়িয়ে ঠাসিয়ে চড় মেরেও হয়।” বুলু জানে এতটা অবধি বলে হাততালির জন্য থামবে বাবলুদা। হাততালির শব্দটা উঠতে শুরুও করে দিয়েছে। ঠিক তখনই প্রথমে আলোটা দেখতে পেল ও, মঞ্চের ডানদিক ঘেঁষে। তারপর জোরে একটা শব্দটা হল। তারপর ধোঁয়া। ‘বোম মেরেছে’, ‘বোম মেরেছে’ কথাটা ভেসে আসার আগেই উলটোদিকে ঘুরে বেরোতে গেল ও। ঠিক তখনই প্রথম লাঠির মারটা পড়ল ওর পিঠে। 


   

“টুকিটাকি নাম হওয়ার সুবাদে আমি অনেক অনুষ্ঠানে আজকাল আমন্ত্রণ পাই। ফলে আমার পরিচিতি, সহ লেখকদের ঈর্ষায়ও আমার সুগার বাড়ে। সত্যি বলতে সব অনুষ্ঠানের স্মৃতি আমার মনে থাকে না, হয়তো একটা গান কিম্বা একজন পাঠকের মুখ মনে থাকে বড়জোর। কিন্তু আজকের এই অনুষ্ঠানের প্রতিটা মুহূর্ত আমি মনে রাখব। মনে রাখব একজন বাবা মা কী অপূর্ব ভাবে নিজের সন্তানকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, মৃত্যুকে পাত্তা না দিয়ে তাকে চিরকালীন করে রেখেছেন, সেই জন্য। একটা কথা আছে, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী যখন পুড়ছিল, বলা হয়েছিল মানুষের স্মৃতির ইতিহাস পুড়ে যাচ্ছে। আসলে এক একটা বই সত্যিই যেন এক একটা মস্তিষ্ক, তার মধ্যে কত মানুষ, কত ঘটনা কত অনুভব ছাপার অক্ষরে ভরা থাকে, ঠিক যেভাবে আমাদের মস্তিষ্কের কোষে স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে। আর পার্থক্যটা হল মানুষ মারা গেলে তার মস্তিষ্কটা নষ্ট হয়ে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু বই ধ্বংস হয় না, কারণ বইয়ের কপি করা যায়, একজন ক্রেতা একটা বই কিনছেন মানে একটা মানুষের জীবনকে ধারণ করছেন, তাকে অমরত্বের পথে আর এক ধাপ এগিয়ে দিচ্ছেন। আর এই বিপণীতে সঞ্জয়বাবু এবং অর্পিতাদেবী সেই ব্রতই নিয়েছেন। আসলে একটা বইকে লালন করা মানেও তো একটা স্মৃতিভাণ্ডার লালন করা। আর এঁরা এত বইকে ঘর দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন ও আপনাদের আহ্বান করছেন এদের আপনাদের স্মৃতির শরিক করতে। এভাবে তাঁরা বাবা মা হিসেবে যেন আরো পূর্ণ হয়ে উঠলেন। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল তাঁদের উদ্দেশ্যে। আপনাদের সন্তানকে, সে যেখানেই থাকুক না কেন, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন একটা জানলার ধারে বসে সে কী একটা বই পড়ছে, তার চুল ছুঁয়ে যাচ্ছে রুপকথার মত মেঘ। বড় পূণ্য করছেন আপনারা।”

শেষটুকু বলে একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন অর্ণব সাহা। কয়েক মুহূর্ত পর একজন দুজন করে হাততালি বেজে উঠল। 

দোলাদি একটু পরে ঘোষণা করল, “এইবার অনুরোধ করব শ্রী সফিকুল আলমকে কিছু বলবার জন্য। আর দর্শকদের অনুরোধ করব সফিকুলদার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পরেই আপনারা আপনাদের প্রিয় সাহিত্যিককে প্রশ্ন করার সুযোগ পাবেন। তারপর সই ইত্যাদি তো থাকছেই।” 

“মাইকটা একটু তুলে দে রে ভাই, আমি লম্বা” বলে উঠে এলেন সফিকুল আলম। ডেকরেটার্সের একটা ছেলে মাইকটা সেট করে দিতেই বলা শুরু করলেন, “দোলা অলরেডি বলে দিয়েছে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে। সুতরাং আপনাদের ক্ষিপ্ত না করে আমি দু-চার কথা বলছি। প্রথমত এইটা গেঁয়ো যোগির প্রথম ভিখ পাওয়ার মত আমার কাছে, কারণ আমি কবিতা লিখি ও আমার বই কেউ কেনে না। এবার বই কেনে না এমন কবি হয় স্নান না করা আঁতেল অথবা মাতাল পঞ্চবিংশতি হয়ে যান। আমি একটাও হতে পারিনি এই মানুষগুলোর জন্য। আমার নিজেকে নিয়ে কিচ্ছু বলার নেই, নিজে থেকেও কিচ্ছু বলার নেই, আপনারা শুধু সঞ্জয় আর অর্পিতাকে আশীর্বাদ করুন, আমাদের সবার আদরের অনীককে আরো আদর দিন, ভালোবাসুন। ধন্যবাদ। শেষ করি আমার গুরুদেবের দুটো লাইন দিয়ে, কারণ একটা সাহিত্যানুষ্ঠান হচ্ছে আর রবীন্দ্রনাথকে কেউ আনেনি এটা ধর্মে সইবে না” গলাটা একটু খাঁকরিয়ে শুরু করলেন সফিকুল আলম, ‘সহায় মোর না যদি জুটে, নাজের বল না যেন টুটে/ সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা, নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়’। এই লাইন কটা সঞ্জয় আর অরূপিতার জন্য। সঞ্জয়, আমার প্যাকেটটা দিয়ে দিস বাবা।” বলে টুক করে বসে পড়লেন উনি। 

“অসংখ্য ধন্যবাদ সফিদাকে”, হাসি চেপে বলল দোলাদি, তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইবার আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন।” মাইকটা তন্ময়ের হাতে তুলে দিল ও। 


    

“বন্ধুগণ, এই এলাকার সুধী নাগরিকবৃন্দ, আপনারা দেখলেন কীভাবে নিরীহ শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের ওপর হামলা করা হল। আমরা খুব ভালোমত জানি এই ঘৃণ্য কাজ কে বা কারা করেছে। মনে রাখবেন আমরা চাইলে কিন্তু এই পালটা দিতে পারি। এমন পালটা দিতে পারি যে যারা এই কাজ করল, তারা আর বাড়ি ফিরবে না। কিন্তু আমি অনুরোধ করব আমার সহযোদ্ধাদের শান্ত হতে। মনে রাখবেন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি করি না যেন ভয়’। এই বলে আমার বক্তব্য শেষ করলাম আমি। বাকিটা লড়াইয়ের ময়দানে দেখা হবে। জয় হিন্দ।”  

দোকানের শাটারে হেলান দিয়ে বসে পুরোটা শুনছিল বুলু। পিঠটা সোজা করতে পারছে না ও। মাথাটাও অসহ্য যন্ত্রণা করছে। কাছাকাছি আর একটা বোম পড়ল। স্টেজটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল ওর চোখের সামনে। বুলু বুঝল ওকে যেভাবেই হোক এখান থেকে দূরে পালাতে হবে। মানুষজন যে যেদিকে পারছে দৌড়চ্ছে। পতাকা থেকে লাঠি খুলে নিয়ে মারছে ওরা। কে বাবলুদার দলের আর কে দেবাদার বুঝতে পারছে না বুলু। ওর চোখের সামনে একটা ছেলে মার খেয়ে ড্রেনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বুলু কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালো। ফোনটা কোথায় একটা পড়ে গেছে এরমধ্যে। 

বাবলুদার গাড়িটা হর্ন দিতে দিতে করে বেরিয়ে গেল ওর সামনে দিয়ে। পেছনে দুটো বাইকে চারটে ছেলে। দুজনের হাতে মেশিন। এই প্রথম গুলির আওয়াজ শুনল ও। একটা ফট করে শব্দ হল সামনেই। বুলু দেখল ওর পাশের সেই লোকটার হাতে গুলি লেগেছে। রাস্তায় পড়ে গেল লোকটা। বুলু যেভাবে পারল দৌড়ল। কোনোরকমে আর একটা লাঠির মার খেতে খেতে বাঁচল ও। বাঁশে লাগল লাঠিটা। বুলু পাগলের মত দৌড়তে লাগল। 

একটু পরেই সামনের পরপর দুটো দোকানের কাচ ভাঙল ওরা। বুলু থামটা ধরে কোনোরকমে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখল সামনে একটা বাস দাউদাউ করে জ্বলছে। 


    

“আপনার প্রতি আমার একটা অভিযোগ আছে” ঘাড় বেঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন মধ্য বয়স্কা ভদ্রমহিলা। হেসে এগিয়ে বসলেন অর্ণব সাহা।

“আপনার সব গল্পে নায়িকারা এত সুন্দর হয় কেন? মানে মেঘের মত চুল, নদীর মত ভুরু কেন? এমন তো হতেই পারে একজন মহিলা যার উসকোখুসকো চুল, গায়ের রং চাপা, মোটা বা মুখে শ্বেতি। সে কি আপনার নায়িকা হতে পারে না?” 

“পারে। সে-ই আমার নায়িকা। আসলে জানেন তো, আমার বাবা এখনো আমার মায়ের ভুরুর প্রশংসা করেন, বলেন তোরা কেউ তোর মায়ের মত চুল পেলি না। অথচ আমার মায়ের ভুরু আর্ধেক উঠে গেছে, চুল পাতলা হয়ে গেছে, পাকা তো ছেড়েই দিলাম। ভালোবাসলে না সব কিছুতেই রুপকথার রং লেগে যায় জানেন তো, ভালোবাসলে সবাই রাজকুমারী। আর মেঘ তো কালোও হয়, নদী তো শুকনো বালি ভর্তিও হয়, তাই না?” হেসেই বললেন অর্ণব সাহা। 

“আচ্ছা এইবার আপনি বলুন” ডানদিকের ছেলেটির দিকে মাইকটা এগিয়ে দিল তন্ময়। 

“প্রথমেই বলি আমি আপনার বিরাট ফ্যান। আমার নাম সাম্য পাল। মানে আপনার লেখা রাত জেগে পড়েছি এক সময়ে। বন্ধুদের সাথে আপনাকে নিয়ে তর্ক করেছি। কিন্তু একটা প্রশ্ন পরে আমার মনে জেগেছে, আপনার লেখায় প্রেম যতটা জায়গা নিয়ে থাকে, আমাদের চারপাশের অন্য নানা সমস্যা ততটা জায়গা পায় না। মানে এ বিষয়ে যদি কিছু বলেন।” ছেলেটি মাফলার ঠিক করে দাঁড়িয়ে রইল। 

“তোমায় একটা কথা বলি সাম্য, আমার না মাঝেমধ্যে আজকাল খুব ভয় হয় জানো। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় তেমন অ্যাক্টিভ নই, তবে চারপাশে তো দেখি, মাঝেমাঝে মনে হয় আমাদের চারপাশের সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যেন সব কিছু ক’টা পাতলা নড়বড়ে কাঠের পায়ার ওপর বানানো, আমাদের বিশ্বাস, রাজনৈতিক আনুগত্য, শিক্ষা, আদর্শ, সংযম, সবকিছু। কেমন মনে হয় কাল সকালে উঠে দেখব পুরোটা ধবংসস্তুপ হয়ে গেছে, আমি দেওয়াল ঘড়ির মত একা জেগে আছি। এই ভয়ে আমি আরো প্রেমের গল্প লিখি জানো, আরো বেশি করে কঠিন পরিস্থিতিতে আমার গল্পের চরিত্রদের ভালোবাসায় জড়িয়ে দিই। যে একা গলিটায় এমনি তোমার আমার মা বোন গার্লফ্রেন্ড বান্ধবী যে কেউ আসতে ভয় পাবে, আমার গল্পে আমি মেয়েটাকে সেই গলিটায় রাতে একা জ্যোৎস্না দেখতে পাঠাই। যে ছেলেটা বাস্তবে একা একা বাথরুমে চীৎকার করে কাঁদে কিন্তু শব্দ বেরোয় না, সেই ছেলেটা আমার গল্পে একটা হাইরাইজের মাথায় উঠে বলে এই শহরের সবকটা মুখোশ আমি টেনে খুলে ফেলব একদিন। এই লেখাগুলো আমার কাছে একমাত্র এসকেপ। যে জায়গাটা বাস্তবে বোমায় ধুলিসাৎ হয়ে যায়, আমার গল্পে সেখানটায় একটা ছেলে আর মেয়ে চুমু খায়।” 

অর্ণব সাহা থেমে যাওয়ার অনেকক্ষণ অবধি হাততালি পড়ল। 

“আচ্ছা এইবার শেষ প্রশ্ন। আমরা খবর পেয়েছি কাছেই একটা সমস্যা হয়েছে, পুলিশ আমাদের আর বেশিক্ষণ সময় দিতে রাজি নয়। আপনারা প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করবেন” মাইকটা দোলার থেকে নিয়ে বলল তাপস। 

“নমস্কার অর্ণবদা, আমি দিশারি। আমার কোশ্চেনটা আপনার কাছে হল, আপনার লেখার কোনো চরিত্রর সাথে ধরুন আপনার পলিটিক্যাল মতামত মিলল না, আপনি তখন লেখায় তাকে কী এমন কিছু করবেন যে সে তার মতামতের জন্য পস্তাবে বা কিছু?” মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল। 

উত্তর দিতে একটু সময় নিলেন অর্ণব সাহা।


   

আর একটু হলে কাচে পা পুরো ফালাফালা হয়ে যাচ্ছিল বুলুর। জুতোর একপাশ আড়াআড়ি ঢুকে গেছে কাচটা। এইটাই সোজা হয়ে ঢুকলে পা ফুঁড়ে বেরিয়ে যেত। নিচু হয়ে কাচটা সাবধানে বের করে আনল ও। পাশেই ভাঙা দোকানটার কাচ এটা। এখন দোকানটা স্রেফ জ্বলছে। একটু আগেই বোতল বোম ছুঁড়েছে দোকানটায় পরী। বুলু থামটার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেছে পুরোটা। 

একটু কমেছে ঝামেলাটা। এখনো রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত আর কাচভাঙা পড়ে। বুলু খুব সাবধানে এগোচ্ছিল, বাস স্ট্যান্ডের মোড়টা অবধি গেলে কিছু একটা পেয়ে যাবে ও। পেছনের দিকে এখনো ঝামেলা চলছে। একটা ছেলেকে একটু আগেই মাথা চেপে দৌড়তে দেখেছে ও। ছেলেটার হাতে মাংস ঝুলছে। গা গুলিয়ে উঠছে বুলুর। বাস স্ট্যান্ডের মোড় থেকে যা কিছু একটা পেয়ে পিসির বাড়ি চলে যাবে ও। কদিন ফিরবে না। মাকে একটা ফোন করে দেবে গিয়েই। 

হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল কয়েকটা ছেলে। বুলু দেখল ওদের সবার হাতে লাঠি, একজনের হাতে পাঞ্চার ও দেখতে পেল ও। ছেলেগুলোর মুখ ঢাকা। বুলু ঘুরে দৌড় লাগাল। ছেলেগুলো “ধর শালা কুত্তার বাচ্চাকে” বলে তাড়া করল ওকে।

বেশিদূর যেতে হল না। দশ পা মত দৌড়েই একটা ভাঙা সাইনবোর্ডে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল বুলু। ওকে ঘেঁটি ধরে তুলল আশিস। তুলেই পেটে পাঞ্চার হাতেই ঘুষি মারল একটা। বুলুর মনে হল ওর ভেতরে সবকিছু ফেটে গেছে। মাটিতে ফেলে ওর বুকের ওপর পা তুলে আশিস চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোর জন্য আমি টোটোটা পাইনি বুলু। শালা সেদিন তুই আমার বাপকে হাসপাতালে নিয়ে না গেলে আজকে তোর গাঁড়টাও কেউ খুঁজে পেত না।” 

বুলু কোনোক্রমে মুখে হাতটা দিতে পেরেছিল, না হলে থুতুটা ওর মুখেই পড়ত পুরো। ভাগ্যিস সেদিন আশিসের বাবাকে বাজারে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে দেখেই ও হাসপাতালে নিয়ে ছুটেছিল। আশিস এখন দেবাদার দলে গেছে জেনেও। 

ওরা চলে যাওয়ার পরেই উঠে পড়ল বুলু। এইবার একটা লাঠি নিয়ে নিল ও সাথে। পেট থেকে রক্ত পড়ছে ওর। অসহ্য যন্ত্রণা করছে। সোজা হয়ে হাঁটতে পারছিল না ও। উঠে দাঁড়ানো মাত্র আবার একটা বোম পড়ল কাছেই। বুলু দেখল একটা দোকানের চাল উড়ে গেল। বাইকে করে ক’টা ছেলে বেরিয়ে গেল ওর পাশ দিয়েই। বুলু বুঝল বড় রাস্তাটা দিয়ে এগোলে যে কোনো মুহূর্তে হয়তো মরেই যাবে ও। সামনের গলিটা অবধি যেতে পারলে অন্তত লুকিয়ে থাকা যাবে। 


   

“দ্যাখো আমি যতটুকু লিখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে মানুষে মানুষে যুক্তিপূর্ণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করাটা বেশ কঠিন কাজ। অন্তত একজন লেখকের পক্ষে, কারণ লেখককে দুজনের হয়েই ভাবতে হয়, দুজনকেই নিজের যুক্তিতে অটল ও ব্যাখ্যায় বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হয়। লেখককে দুজনের মতাদর্শ এবং তারা কেন ওই পার্টিকুলার আদর্শের প্রতি অনুগত হল সেটা ভাবতে হয়। কাজটা কঠিন, কারণ মানুষ স্বভাবতই বায়াসড, দুটো বিরুদ্ধ মতের মধ্যে একটা মতের প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্ব থাকাটা খুব স্বাভাবিক। তবে দুজনের মধ্যে যুক্তির দ্বন্দ্ব তৈরি করতে গিয়ে নিজের বিরুদ্ধ মতের যুক্তিগুলোও জানতে হয়, ফলে মনটা আরো প্রসারিত হয়। আমি মনে করি মানুষ একই সাথে একটি আদর্শে বিশ্বাসী এবং সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেভাবে তুমি দেখবে বড় বড় সাধকরা নিজের ধর্মের ঈশ্বর ছাড়াও নানা ধর্মের ঈশ্বরের সাধনা করেছেন, পড়েছেন। আর আমার বিরুদ্ধ মতের চরিত্রের কোনো খারাপ পরিণতি আমি গল্পে তৈরি করব কিনা সেটা ঠিক বলতে পারি না জানো তো আমি। মানে লেখক তো তার সৃষ্ট চরিত্রের ঈশ্বর, তাই ঈশ্বরের খেয়ালখুশি সব সময় প্রেডিক্ট করা যায় না। এটুকু বলতে পারি একটি মেয়ে আমায় বহুদিন আগে ছেড়ে গেছিল, আমি আমার একটি গল্পে, আমার প্রথমদিককার একটি গল্পে একটা খুব খারাপ লোকের নাম তার সেই সময়কার প্রেমিকের নামে দিয়েছিলাম।” 

সবাই হেসে উঠল কথাটায়। আর এর মাঝেই অর্ণব সাহা উঠলেন। সবাই কোন চরিত্রটা সেই ছেড়ে যাওয়া মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড হতে পারে এই নিয়ে আলোচনা করতে করতেই এগোলো তাঁর দিকে। দোলাদি মাইকে ঘোষণা করল, “আপনারা অনুগ্রহ করে একটা লাইনে দাঁড়ান, তিনি থাকবেন আপনাদের জন্য। তবে একটু তাড়াতাড়ি করবেন, এখানে কিছুক্ষণ আগে একটা বড় ঝামেলা হয়ে গেছে।” 

এর মধ্যেই অর্পিতার কানে কানে “আমি একটু আসছি, জাস্ট একটা সিগারেট খেয়েই” বলে বেরিয়ে এল সঞ্জয়। অনুষ্ঠানটাও শেষ হয়ে গেল। এইবার ওর সবকিছু কেমন হালকা হালকা লাগছে। দোকান থেকে এগিয়ে ফাঁকা গলিটায় ঢুকল ও। 


১০

    

গলির মুখে ছেলেটা আলপটকা লাথি চালালো বুলুকে লক্ষ করে। নিশ্চয়ই মালটা এখানে লুকিয়েছিল কাউকে মারবে বলে। বুলু পেটটা আড়াল করতে পারল না পুরোপুরি। মাথা থেকে পা অবধি ব্যথায় কেঁপে গেল ওর। ঝাপসা চোখ নিয়েই হাতের লাঠিটা চালালো ও। থ্যাপ করে আওয়াজ হল একটা। অস্ফূটে একটা আওয়াজ করে পড়ে গেল ছেলেটা। বুলু লাঠিটা ছাড়িয়ে আনল ওর মাথা থেকে। তারপর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ওর পাশে ছেলেটা নড়তে নড়তে থেমে গেল একসময়। 

‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’। এই একটা কবিতার লাইনই মনে আছে সঞ্জয়ের। ক্লাস এইটে আবৃত্তি করেছিল ও এটা। কীভাবে যেন লাইনদুটো মাথায় গেঁথে গেছে ওর। রাস্তায় বেরিয়েই ও টের পেয়েছে চারপাশের অবস্থা একদম ভালো না। পুলিশের গাড়ি পরপর যাচ্ছে ওদিক দিয়ে। একটু দূরে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। একটা জানলা ভাঙা ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল বড় রাস্তায়। ওরা যখন বইয়ের দোকান উদ্বোধন করছিল তখন চারপাশে সবকিছু এইভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে। ওর কারখানাটা এই রাস্তায় হলে হয় তো ওটাতেও আগুন লাগিয়ে দিত অলরেডি। অন্ধকার গলিটা দিয়ে হাঁটছিল সঞ্জয়। এই কবিতার লাইন দুটো আজকে সন্ধে থেকে মাথায় ঘুরঘুর করছে। গলির মাথায় তারের জট পেরিয়ে অল্প অল্প চাঁদের আলো আসছে। স্ট্রিট লাইটের ঘোলাটে আলোয় যেন অন্ধকার চুঁয়ে পড়ছে গোটা এলাকায়। বাবুই নেই, ঝামেলাটা আর একটু গড়ালে বইয়ের দোকানটাও ভেঙে যেতে পারত। হয়তো কালকেই ভাঙবে। কিছু একটা করতে হবে সঞ্জয়কে, কিছু একটা করা দরকার যাতে বইয়ের দোকানগুলো না ভাঙে, যাতে এই তারের জটলা পেরিয়ে জ্যোৎস্নাটা বাবুইয়ের মুখ অবধি নেমে আসতে পারে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটার সামনে এসে থমকে গেল সঞ্জয়।

ছেলেটা মরে গেছে সম্ভবত। আর নড়ছে না। লাঠিটা ধরে আছে বুলু। একটু পরে পুলিশ এসে ওকে তুলে নিয়ে যাবে। কাল কাগজে বেরোবে 'গোষ্ঠিদ্বন্দ্বে যুবক খুন, ধৃত এক'। ধৃত যুবকের নাম সঞ্জয় রায়, ওরফে বুলু। ছেলেটা দেবাদার না বাবলুদার দলের জানেনা ও। ছেলেটার দিকে তাকাতে পারছে না বুলু। একপাও নড়তে পারছে না ও। কে যেন আঠা দিয়ে ওকে আটকে রেখেছে এই খুনটার পাশে। সারা জীবনের মত খুনি হয়ে গেল বুলু। সারা জীবনের মত একটা খুন করে ফেলল ও। 

বুলু চুপচাপ ওর থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়ানো লোকটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এক রাস্তা ভর্তি রক্তের মধ্যে লাঠি হাতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সঞ্জয়।


……………….


অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


No comments:

Post a Comment