সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়


বইমেলা এসে যাচ্ছে। আসবো না আসবো না করেও এসে যাচ্ছে ঠিক। যেন খুব রাগী লোক হাসবো না হাসবো না করেও হেসেছে কিঞ্চিৎ। হয়তো কিছুটা ভয়ে, কিছুটা সংকোচে, তবুও হেসেছে তো! ওই একচিলতে হাসিতেই লক্ষ আলোর রোশনাই। আমরা, যারা বই ভালোবেসে, বইয়ের আশেপাশেই বাঁচি তাদের কাছে এই বইমেলাটুকু এক টুকরো তাজা অক্সিজেন। প্রতিদিন অফিস ফেরতা ক্লান্ত শরীরেও ঘন্টাখানেক আড্ডা, পুরোনো বন্ধুদের সাথে বাৎসরিক দেখাসাক্ষাৎ, টুকটাক বই দেখা অথবা কেনা, লিটিল ম্যাগাজিনের জটলা, সব মিলিয়ে বড্ড বেশি প্রাণের কাছে থাকে এই বইমেলা। কোভিডের ভয়ে এবারে হয়তো ততখানি জমাটি হবে না বইমেলা, তবুও কিছু তো হবেই। সেই স্নিগ্ধ পরশটুকু নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে পরের বছরটুকু। সেই বইমেলার উপলক্ষেই সেজেছে আমাদের এই সংখ্যা। আমাদের পঞ্চালিকা পত্রিকাটা ওয়েব ম্যাগাজিন। ছাপা অক্ষরে আপনাদের হাতে আমরা নাই বা থাকলুম, তবুও, এই আন্তর্জালের দুনিয়ায়, আপনাদের আশেপাশে রইলুম আমরা। 

এবার আসি চারপাশের খবরে। চারপাশের পরিস্থিতি ভালো নয়। গুগাবাবার ভূতের রাজার মতো বলতে ইচ্ছে করছে, দিনকাল ভালো নয়, গ্রহতারা ভালো নয়, সোজাপথে থাকা চাই। তবুও দিনকাল যেন খারাপই হয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই তার থেকে রেহাই পাচ্ছি না। আমার দেশটা স্বাধীন। আর গণতন্ত্র খোঁড়া হলেও এতোদিন অন্তত সে নীরোগ ছিলো। তার প্রমাণ, আমরা যা খুশি বলতে পারি। আমাদের বাক স্বাধীনতা আছে। আমি আজ হয়তো সাদাকে ভালো বললুম, কালকে বেগুনিকে বললুম আরো বেশি ভালো। অথবা পরশু বললাম, আগেরটা ভুল, আমার বেস্ট চয়েজ ব্রাউন।

বলতেই পারি এমন। আমার সংবিধানে পারমিশন দেওয়া আছে। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে, আমার মত অমত পালটাতে পারে। আমার মতামত দেওয়ার অধিকার, আমার দল নির্বাচনের অধিকার, খাদ্যাভ্যাসের অধিকার, ধর্মাচরণের অধিকার, এমনকি সমালোচনা করার অধিকারের কথাও বলা আছে সংবিধানে। এই সমস্ত অধিকারের ওপর এখন ঢ্যাড়া পড়েছে। প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে সংবিধানের এই বেসিক নীতিগুলি। এখন জোর যার, মুলুক তারই। বাকিদের মতপ্রকাশেরও অধিকার নেই। 

ভলতেয়ার বলতেন, “আমি রাজনৈতিকভাবে তোমার কথার সঙ্গে দ্বিমত করতেই পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য জীবন দিতে পারি।”

এই উন্মত্ত ধর্মান্ধ দেশ, এসব তত্ত্বকথা বোঝে না। সে চায় দাঙ্গা, সে চায় বিধর্মীদের হত্যা, আর নিজ ধর্মের প্রভুত্ববিস্তার। সহনশীলতার নীতির কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। প্রতিবেশী ছাড়া যে বেঁচে থাকা দুস্কর তা তারা বোঝে না। এতোগুলো বিশ্বযুদ্ধ, নৃশংস দেশভাগ, মানবতার এতো চূড়ান্ত অবমাননার পরেও আমরা শিখে উঠতে পারিনি যে পাশের লোকটির হাত না ধরলে আমারও বেঁচে থাকা দুস্কর হয়ে উঠবে। ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলছে হিংসা, আর ধর্মীয় আগুন। এর অবধারিত ফল মৃত্যু। আমার পাপ, আমার হিংসার দায় বহন করবে আমারই সন্ততিরা। কেউ ছাড়া পাবে না। কেউ ছেড়ে দেবে না! দু'পক্ষই টিকে থাকবে জ্বলজ্বলে চোখে প্রতিহিংসার ঘৃণাটুকু লাগিয়ে। প্রতিহিংসা  আর অপমানের জ্বালা তো একজীবনে মেটে না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেই সেই গ্লানি বয়ে যায়। সেই গ্লানিকেই যেন জোর করে খুঁচিয়ে তুলছে এই দেশের সরকার। বর্তমান রাজনীতিতে আজকাল ঘনঘন সাম্প্রদায়িক হুংকার শোনা যাচ্ছে শাসকদলের মুখে। ভিন্ন ধর্মের লোককে বিদেশি তকমা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এন আর সি করে আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের রোজকার জীবনে। আমরা ভালো নেই। কেউ ভালো নেই আজ। সর্বত্র আতঙ্কের ছোঁয়া। কৃষক মরছে ঋণের বোঝায়, অথচ বড় বড় ব্যবসায়ীরা স্বচ্ছন্দে ঋণ খেলাপ করে লক্ষ কোটি টাকার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে আমাদের ঘাড়ে। কুটিরশিল্প হারিয়ে যাওয়ার পথে, এদিকে মহাকাশযান পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচা করে আমাদের মেকি জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি তলানিতে। রোজগারপাতি নেই চারদিকে, কি করে টিকে থাকবো আমরা? কি করে বাঁচবে আমাদের সন্ততি? কোন আশা নিয়ে? 

জনগণ ভাবুক। জোয়ারে গা না ভাসিয়ে আরো বেশি চিন্তিত হোক প্রতিটি মানুষ। আরো বেশি ভাবুক, নিজের মতো করে। নিজের ঘাম রক্ত বোধবুদ্ধি দিয়ে বিচার করুক সে। সিদ্ধান্ত নিক নিজের সমস্ত অনুভূতি দিয়ে। আমার দেশ আমাদেরই হাতে গড়া হবে। হয়তো একদিন এই অন্ধকার কাটিয়ে সূর্যের ভোর আসবে। আমরা আবার হয়তো বলতে শিখবো, 

দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে/

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে/

আমরা আশাবাদী। 

ভালো থাকবেন সকলে। আমাদের পত্রিকার সমালোচনা আমরা পেতে আগ্রহী। ভালো মন্দ যেমনই লাগুক, আমাদের ইমেলে জানান। আমরা প্রতীক্ষায় থাকলুম।


ধন্যবাদান্তে


পারমিতা মালী

প্রধান সম্পাদক

পঞ্চালিকা আন্তর্জাল সাহিত্য পত্রিকা


No comments:

Post a Comment