সুভাষদা পলিটিক্স করে। আসলে করে না। সম্ভবত করতে পারে না। এটা কেন সেটা বুঝতে পারি না আমরা পাড়ার ছেলেছোকরারা। সুভাষদাকে সেই কবে থেকে দেখছি পাড়ায় ঘুরে ঘুরে মানুষের ফাইফরমাশ খাটে। এমনকি একটা দলও করে। ছোট বামপন্থী একটি দল। সেই দল কখনওই ক্ষমতায় আসে না। প্রভাবের শীর্ষেও থাকে না। সুভাষদার দাদু সেই দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তাই সুভাষদা সেই দলেরই হয়ে যায়। ইচ্ছে করলেই তো অন্য দলে চলে যেতে পারে। সেরকম কখনও চেষ্টাই করেনি। সুভাষদার সঙ্গে স্কুটারটা অঙ্গাঙ্গি হয়ে গিয়েছে। সারাদিনই প্রায় চরকিপাক খাচ্ছে। একটা চাকরির মতো কাজ করে অবশ্য কোর্টে। সুভাষদার কাছে জনসেবা শেখা যায়। সারাজীবন পাড়ার মানুষের আপদে বিপদে ঠিক ছুটে আসে। এতে করে একটা আশ্চর্য ইমেজ হয়েছে সুভাষদার। সেটা হল, সুভাষদাকে কেউ আর কোনও একটি দলের লোক হিসেবে দেখে না। সুভাষদা প্রত্যেকবারই পুরসভার ভোটে প্রার্থী হয়। কিন্তু জেতে না। অথচ সকলেই পাড়ার অভিভাবক কিংবা ত্রাতা হিসেবেই ধরে নেয় তাকে। তার দল যে ক্ষমতায় নেই, এটা কেউ ভাবে না। পাড়ার কাউন্সিলারের পরিবর্তে যে কোনও দরকারে সকলেই ফোন করে সুভাষদাকে। তা এরকম ইমেজ হলে তো কাউন্সিলার কিংবা অন্য দলের নেতাদের রেগে যাওয়ার কথা। তারা ভাবতেই পারে যে, এই লোকটার প্রতি মানুষের এত আস্থা কেন? তা কিন্তু হয় না আমাদের এই মফসস্বল টাউনে। কারণ, অন্য বড়সড় দলের নেতারাও জানে যে, সুভাষ কোনও কাজ নিয়ে এলে কিংবা রিকুয়েস্ট করলে সেটা জেনুইন। আর সুভাষ আছে বলেই এই পাড়ার সমস্যা নিয়ে কিছু চিন্তা নেই। সামান্য নর্দমা পরিষ্কার না হলেই ঠিক খবর পেয়ে যাবে পুরসভা। কারণ সুভাষ আছে। তাই অযথা এই পাড়া নিয়ে মাথা ঘামাতেই হয় না শাসক দলকে।
আমরা সকলেই কি আসলে হতে চাই না খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন? কিন্তু ঠিক কোন আচরণকে ব্যক্তিত্ব বলে সেটাই ধরতে পারি না। পরিচিতেরা যাঁর সম্পর্কে বলে থাকে ‘লোকটার কিন্তু বেশ পার্সোনালিটি আছে’, সেই লোকটিকে আমরা পর্যবেক্ষণ করি। তাঁর কথা বলা, তাঁর মুখের অভিব্যক্তি, অন্যের কথা শুনে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ধরণ, রেগে যাওয়া, হেসে ওঠা, এসবই আমরা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করি যে, এর মধ্যে কোনও একটিকেই কি বলা হয় ব্যক্তিত্ব? নাকি সবকিছুর একটা সম্মিলিত রূপরেখা? মাঝেমধ্যেই আমি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে থাকার চেষ্টা করে দেখেছি যে, সেটা হয়ে যায় উৎকট গাম্ভীর্য। মনে মনে ভেবেই নিই, গম্ভীর থাকাই বোধহয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। অর্থাৎ হাসির কথা শুনে বেশি উচ্ছ্বসিত হেসে ওঠা চলবে না। সাংঘাতিক বিস্ময়কর খবর কানে এলে একেবারে চোখ কপালে উঠে গেল, এরকম মনোভাব দেখানো সম্পূর্ণ বারণ। কথা বলা তো অত্যন্ত মেপে। আর পাঁচটি প্রশ্নের জবাব হবে একটি। নিজে থেকে কোনও আলাপচারিতায় প্রবেশ না করা। সোজা কথায় মনের ভাবের সংযত প্রকাশকেই নির্ঘাৎ বলে ব্যক্তিত্ব। আর বেশি উচ্ছ্বাস দেখানো চলবে না। সুখ, দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ সবকিছুর প্রতিক্রিয়া হবে মেপে। কিন্তু তারপর দেখি আরে সে তো এরকম কম কথা বলা লোক আশেপাশে প্রচুর আছে। তারা সবাই ব্যক্তিত্বপূর্ণ নাকি? তাদের অনেকে তো গোমড়ামুখো বলে। অথবা কখনও সখনও বোরিং পার্সোনালিটি। কম কথা বলে, শুধুই শোনে এরকম এক বন্ধুই তো ছিল আমার সেই ছেলেবেলা থেকে। সুকান্ত। কিন্তু আমরা তো তাকে শেষ পর্যন্ত পাত্তাই দিতাম না। বলতাম, আরে ওকে জিজ্ঞাসা করে কী হবে? ও তো চুপ করে থাকবে আর বলবে তোরা যা ভালো বুঝিস তাই কর। তার মানে কম কথা বললেই যে সেটা ব্যক্তিত্ব তা নয়। তাছাড়া কলেজে দেখেছি কম কথা বলাদের মেয়েরা বলেছে ম্যান্তামারা, হাবা টাইপের ছেলেটা। তাহলে কাকে বলে ব্যক্তিত্ব? ও, আর একটা কথা, রাশভারী আর গম্ভীর, এ দুটোর ফারাক কী? এটাও প্রাঞ্জলভাবে জানা হয়নি।
আমাদের এই পাড়ার নাম আনন্দমঠ। যে কারণে সুভাষদার কথাটা তুললাম, সেটা হল ওই ব্যক্ত্বিত্ব। কই সুভাষদার তো যাকে বলে বিরাট কিছু পার্সোনালিটি, তা নেই। তাহলে সুভাষদাকে সকলে এত গুরুত্ব দেয় কেন? প্রভাবশালী কথাটা কি সুভাষদার সম্পর্কে খাটে? কিছুটা খেটে যায় বটে। লোকের ছোটখাটো কাজ সুভাষদা পুরসভা থেকে যে করে দেবেই সেটা নিশ্চিত। রক্ত যোগাড়ও হয়ে যাবে। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সও। কিন্তু সুভাষদাকে দেখে ঠিক প্রভাবশালী মনে হয় না। তার চারপাশে অনেক খুচরো যুবক ঘুরে বেড়ায় এমনও নয়। স্কুটার নিয়ে একাই ঘোরে সুভাষদা। আমরা পাড়ার মধ্যে থাকা প্রায় পরিত্যক্ত একটা জলের ট্যাঙ্কের সামনের ছোট্ট সবুজ ঘাসে বসে আড্ডা মারি। আর আমাদের মধ্যে সবথেকে বেশি আলোচনা হয় যে সুভাষদার বিনোদনটা কী? এই যে সারাদিন কোর্টে কাজ করে আর নয়তো ধুম ধরে স্কুটার নিয়ে পাড়ায় পাক খেয়ে কারও কোনও কাজের অর্ডার নিয়ে আবার বেরিয়ে যায় বাজারের দিকে। সুভাষদা আমাদের এই আড্ডাতেও এসে কিছুক্ষণ দাঁডিয়ে যায়। আবার আমাদের বড় ব্যাচ আমার সেজদাদের নবীন সংঘের সামনেও দাঁড়াতে দেখেছি। সকলের সঙ্গেই তো সদ্ভাব। অঘচ সুভাষদার একটা কোনও শখ কিংবা অক্সিজেন তো চাই। সারাক্ষণ কাঁহাতক এই লোকজনের কাজ করে দেওয়া যায়? আশ্চর্য মানুষ। আমরা কখনও সখনও বলেছি সুভাষদা নিশ্চয়ই পাগলাটে।
সুভাষদার দুটো নেশা। সিগারেট আর সারাদিনে একবার নলেজ হোম স্কুলের সামনে থেকে স্কুটার করে যাওয়া। দেড়টা দুটো নাগাদ। ওই স্কুলে পড়ায় মিষ্টিদি। সুভাষদার লাভার?
আমরা বলি বটে। কিন্তু কেউ কখনও ওদের রাস্তায়, পার্কে, স্টেশনের ডাউন প্ল্যাটফর্মের পরিত্যক্ত ওভারব্রিজেও দেখেনি কোনওদিন। সুভাষদা যখন স্কুটি নিয়ে যায়, তখন নলেজ হোমের টিফিন টাইম। তাই এই যাওয়াটুকুই ওদের দেখা হওয়া। সুভাষদার স্কুটারটা সামান্য স্পিড কমায়। সুভাষদা একবার তাকায় বাঁদিকে। আমরা জানি মিষ্টিদি সেই সময় স্কুলের একতলার ক্লাস টু লাগোয়া বারান্দার গ্রিলের কাছে আপাত নির্লিপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্রতিদিন। ঠিক সেই স্কুটার যাওয়ার সময়ই মিষ্টিদি গ্রিল থেকে বাইরে হাত বাড়িয়ে জল দিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। টিফিন বক্স খোলার আগে। কীভাবে সময়ের এই ছন্দটি মিলে যায়? সুভাষদা কাজের মানুষ। একদম সঠিক সময়েই রোজ আসা কী সম্ভব? সুভাষদার উপর তাঁর বিধবা মা, ছোট দুই ভাই আর বোনের জীবনধারণের দায়িত্ব। ঠিক একইভাবে আমরা জানতাম, মিষ্টিদির কখনও বিয়ে হবে না। কারণ, কাকু, মানে মিষ্টিদির বাবা পঙ্গু। ভাই পড়াশোনা করছে। মিষ্টিদির দাদা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কোথায় আর কেন, কেউ জানে না।
আজ অনেকদিন পরে আমরা সেদিনের কিশোর আর তরুণের দল পরিণত বয়সে বুঝতে পেরেছি, সুভাষদার পুরনো স্কুটারের শব্দটা চিনে গিয়েছিল মিষ্টিদি। ওই যে নলেজ হোমের সামনে এসে স্কুটারটা সামান্য স্লো করে সুভাষদার বাঁদিকে তাকানো, আর তখনই মিষ্টিদির বেরিয়ে এসে জল খাওয়া, ঠিক ওই মুহূর্তটাই এই দুটি মানুষের গোটা জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কয়েকটি নিমেষ। ওটাই ওদের দুজনের দমবন্ধ জীবনের মধ্যেই ছিল চিরন্তন এক দখিনা বাতাস! ওই মুহূর্তটাকে কী বলে? ভালবাসা?
……………
অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment