গল্পঃ রাজবাড়ির দুর্গোৎসব - প্রদীপ কুমার বিশ্বাস


রাজবাড়ির দুর্গোৎসব

প্রদীপ কুমার বিশ্বাস 

(এটি একটি কাল্পনিক  কাহিনী, কোনো রাজপরিবারের কাহিনীর সাথে কিছু মিল থাকলে তা কাকতালীয়।) 


গঙ্গার ওপারে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে, নৌকাতেই তারা তিনভাই সাধুর বেশ ধরলো। এপারে এসে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বনের রাস্তা ধরে হাঁটাপথে  লাল রুক্ষমাটির দেশ মল্লভূমির দিকে তিনভাই এগিয়ে চললো। আলীবর্দীর কারাগার থেকে পালিয়ে, এই তিন প্রাক্তন রাজপুরুষ আত্মগোপনের জন্য মল্লভূমকেই  নিরাপদ মনে করেছিলেন। জঙ্গলের কাঠ কুড়ানো লোকদের বেশে, সামু আর দামুর নেতৃত্বে অনুগত দেহরক্ষীদের একটি ছোটো দল সামান্য তফাত রেখে চলছিল।


এই তিন ভাইয়ের মধ্যে, শঙ্খনাথ অগ্রজ, মধ্যম ভাই রুদ্রনাথ আর সর্ব কনিষ্ঠ প্রিয়নাথ। কিছুদিন আগেও এরা ছিলেন আলীবর্দীর মন্ত্রীসভার সদস্য। পরপর তিনরাত অরণ্যের রাস্তায় পায়ে হেঁটে, চতুর্থ দিনে পৌঁছালেন লালমাটির দেশ  মল্লভূমিতে। জঙ্গলের মাঝে এক বিশাল দীঘি দেখে তারা  বিস্মিত হলেন আর রাতটা সেখানে যাপন করা ঠিক করলেন।


ভোররাতে একসাথে ঘুম ভেঙ্গে গেল  তিন ভাইয়ের।  কি আশ্চর্য! তিন ভাইই দেখেছেন একই স্বপ্ন। স্নানের জন্য তারা  এগিয়ে  যাচ্ছিলেন কাছের সেই বড় দীঘির দিকে।  থমকে দাঁড়ালেন শঙ্খনাথ, আর তাঁর পেছনে আসা দুই ভাই।  স্বপ্নে তিনজনেই যা দেখেছেন, ঠিক সেইমত  দীঘির ঠিক মাঝখানে পূর্ব-পশ্চিম দিকে কোনাকুনি হয়ে সত্যিই ভাসছে সিঁদুরে রাঙানো এক মাঝারী আকৃতির পাটাতন।


স্বপ্নে তাঁরা তিনজনই শুনেছেন যে চতুর্ভুজা এক দেবী তাঁদেরকে আহ্বান করে  বলছেন, “বর্গী দস্যুরা আমার মূর্তিরূপের  ক্ষতি করতে পারে ভেবে পূজারী আমাকে দীঘির জলে বিসর্জন দিয়েছে। কাল সকালে  সিঁদুররঞ্জিত একটা পাটাতন  মাঝ দীঘির জলে পূব-পশ্চিম কোনাকুনি হয়ে ভাসছে দেখতে পাবি। আমি আছি সেই পাটাতনের ঠিক নিচে কিন্তু অনেক গভীরে এক সুড়ঙ্গের ভেতর। আমি আমার ভবনে ফিরতে চাই।”  


যেহেতু তিন ভাই একই স্বপ্ন দেখেছেন, অগ্রজের আদেশে তারা একসাথে সাঁতরে চললেন মাঝদিঘিতে। পাটাতনের কাছে  পৌঁছেই স্বপ্নের আদেশানুসারে ডুবসাঁতার দিয়ে খুজতে থাকলেন সেই সুরঙ্গ। পরপর নয় বার বিফল চেষ্টার পর তাঁরা তখন পাটাতন ধরে কিছুক্ষন হাঁফ নিচ্ছিলেন। সেইসময় এক প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে পাটাতন জলে ডুবে যায় এবং তার পিছুপিছু সাঁতরে তিনভাই জলের ভেতর এক গুহামুখের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পান স্বপ্নে দেখা সোনালী হলুদবরন দেবীমূর্তি।দেবীমূর্তিকে জলসমাধি থেকে উদ্ধার করে যখন নিয়ে এলেন তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে। তিন ভাই দীঘির পাড়ে এসে চিন্তা করছিলেন, দেবীর আদেশ তাঁকে তার ভবনে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কোথায় তার ভবন? 


দীঘির পাড়ে অপেক্ষামান সামু দামু ভাইদের মুখে শোনেন বেশ কয়েকটি সুসংবাদ। তাঁদের অনুগত প্রজারা অনেকেই তাদেরকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পৌঁছেছে। অন্য আর এক রাস্তা দিয়ে নেপাল থেকে  গুরুদেবও এসেছেন। নবাব আলীবর্দী দেহত্যাগ করেছেন এবং চেহেলসুতুনের দখল নিয়ে পারিবারিক  লড়াইয়ে এখন সবাই ব্যস্ত রয়েছেন। বিচক্ষণ শঙ্খনাথ বুঝে নিলেন যে শেষ পর্যন্ত নবাব যেই হোক তাদের তিন ভাইয়ের খোঁজ করার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই তাঁর থাকবে না।


সামু-দামুর পল্টন ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে সারা দিন এই এলাকাটা ঘুরে দীঘি থেকে একটু দুরেই গভীর জঙ্গলের ভেতর পেয়েছে নাটমন্দির সমেত একটা ধংসপ্রাপ্ত পুরানো মন্দির, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া একটি গড়, আর তার চারপাশে একটা বড় গ্রামের ধংসাবশেষ। গুরুদেব এখন সেই মন্দিরেই আছেন। এই কি তাহলে দেবীর ভবন? 


সিক্ত বসনেই তিন ভাই দৌড়ালেন গুরুদেবের কাছে। দীঘি থেকে তুলে নিয়ে আসা দেবীমূর্তিকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে তিনি বললেন “ইনি দেবী চামুণ্ডা, যথাবিহিত পূজা এনাকে করলে তোমরা শত্রূবিজয়ী এবং রাজঅনুগ্রহে পুনরায় উচ্চপদাভিষিক্ত  হতে পারবে। এই মন্দির সংস্কারের পর আমি আবার এসে এনার যথাবিহিত পূজন করবো। ততোদিন ইনি এই মন্দিরের কাছে পঞ্চবটীতলায় থাকবেন। এনার নিত্য পূজা আমার এক সুযোগ্য শিষ্য করবেন। তোমাদের উচিত হবে এইখানেই নিজ নিজ বাসস্থান নির্মাণ করে এইখানেই অবস্থান করা। তবে এই দেবী নির্জনে থাকতে পছন্দ করেন। তাই তোমরা এই দেবস্থান থেকে দূরে, নগরী স্থাপনা করবে”। 


প্রজাদের থেকে লোকচয়ন করে, মন্দির সংস্কার এবং নগরনির্মাণ শুরু হলো। চর মুখে খবর পেয়ে, বিষ্ণুপুর মহারাজ হাম্বিরমল্ল তাদেরকে রাজসভায় ডেকে পাঠালেন। তাঁদের পরিচয় পেয়ে তিনভাইকে রাজদরবারে উচ্চপদে নিযুক্ত করলেন।


রুদ্রনাথের পরামর্শে, রাজ্যের  নদীতীরবর্তী  অরণ্য  অঞ্চলে বর্গী চলাচল নজরে  রাখবার জন্য উঁচু উঁচু মাচান বানিয়ে রাখা হলো। ঝটিকা বাহিনীর তত্বাবধানে প্রতি গ্রামে যুবকদের অস্ত্রচালনায় শিক্ষিত করে প্রতিরোধ বাহিনী তৈরী করা হলো।


এদিকে নেপাল থেকে চামুন্ডাদেবীর নিত্য এবং বাৎসরিক পূজার জন্য তালপাতার পুঁথি নিয়ে গুরুদেবের শিষ্যের একটি দল পৌঁছেছে। সেই দলের সদস্যরা তান্ত্রিক পূজাবিধি ছাড়াও নিজ নিজ মঠের সুরক্ষার জন্য হাতাহাতি যুদ্ধ এবং সোরা, গন্ধক, ধাতু চূর্ণ দিয়ে আগুনে গোলা বানাবার গোপন বিদ্যাও জানতেন।


রুদ্রনাথ আর তার ঝটিকা বাহিনীর নেতৃদ্বয়  সামু এবং দামু, এদের যুদ্ধ কৌশল, বোমা-পটকার বিকট আওয়াজ আর সেই সাথে হাউই বাজির মহড়া দেখে বুঝে নিলেন যে এদের শত্রূসেনাকে বিভ্রান্ত করবার আর পিছে হটিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে। রুদ্রনাথের মুখ্য কর্মকার একটি সরু নলের মত যন্ত্র নিয়ে এসেছে। যন্ত্রটি আর তার গোলাগুলো এতটাই হাল্কা যে একজন গোলন্দাজ একাই এই কামান এবং তার গোলাগুলো বয়ে নিয়ে যেতে পারে।


মাসখানেক পরে, সেই রাতটা আশ্বিনের প্রথম অমাবস্যা। রাজ্যের কিছু প্রহরীচৌকি থেকে আর গুপ্তচরদের কাছ থেকে খবর এলো যে ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে প্রায় পাঁচশো অশ্বারোহীর একটি বর্গি সেনার দল  মুন্ডেশ্বরী নদী পার হয়ে রাজধানী বিষ্ণুপুরকে কামানের গোলা দিয়ে আক্রমণ করে মল্লরাজ্য দখল করতে চাইছে। ভারী কামান নিয়ে যাবার জন্য মোরামের শক্ত মাটি একমাত্র আড়াবনীর শাল জঙ্গলেই আছে । রুদ্রনাথ আড়াবনির শাল জঙ্গলের কাছেই বর্গিদের সাথে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করলেন। এই বনে শালগাছের ফাঁকে ফাঁকে  উঁচু তালগাছ প্রচুর।


প্রতিটি তালগাছে দু-তিনজন সেনা থাকবে সদ্য আবিষ্কৃত হাল্কা কামান নিয়ে অতর্কিতে গোলাবর্ষণের জন্য। এছাড়াও তাঁদেরকে সহায়তা করবে নিচে অশ্বারোহী সেনারা যারা তীর-ধনুক, আর তরোয়াল দুটোতেই সমান দক্ষ। তবে তাদের সাথে থাকবে সাধারন তীরের সাথে সাথে বেশ কিছু অন্য রকমের তীর। এসব তীরের শলাকার সাথে থাকবে তিব্বতি গুরুর তৈরি বিশেষ ধরনের আগুনে বোমা। শালবনের জঙ্গলী রাস্তায় দু পাশের গাছের অনেক গুলোতে দিনের বেলাতেই গর্জনতেল মাখিয়ে রাখা হয়েছে আর তাতে লাগিয়ে রাখা আছে বিকট আওয়াজ করতে পারে এমন সব বোমা পটকা।


আশ্বিনের অমাবস্যা কেটে যাবার পর আজ অষ্টমী  তিথি। দূর থেকে আসা ঘোড়াদের  চিঁ হিঁ চিঁ হিঁ  আওয়াজ আর চাঁদের ক্ষীণ আলোতে ভাস্কর পণ্ডিতের দলকে তালগাছের মাথায় থাকা সেনারা দেখামাত্রই সাংকেতিক আওয়াজে খবর পাঠিয়ে দিল। এক লহমার মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে আগুন লাগানো তীর গিয়ে পড়লো গর্জন তেল মাখানো গাছগুলোতে । সেগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠার সাথে সাথে তাতে লাগানো পটকার বিকট আওয়াজে ঘোড়ারা হকচকিয়ে পিছু হঠতে গিয়ে তাদের পেছনের ঘোড়াগুলোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বর্গী সেনারা এইরকম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে হতভম্ব হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তালগাছের মাথায় থাকা রুদ্রনাথের সেনারা হালকা কামান থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করতেই বর্গী সেনাদের মৃতদেহ জমতে শুরু করল। বিচক্ষণ ভাস্কর পন্ডিত ব্যাপারটা চট করে বুঝে নিয়ে পেছনে থাকা কামান থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করতেই যুদ্ধটা এবার তার নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করল। এইবার রুদ্রনাথ আর তার সেনারা তীরধনুক আর বল্লম দিয়ে আক্রমণ করে তার কয়েকটা কামান দখল করে ভাস্করবর্মার ওপর গোলাবর্ষণ শুরু করলে ।


এইসময় দেখা গেল রনাঙ্গনে এক দেবীমূর্তি আবির্ভূতা হলেন আর তার অসি এবং ত্রিশূল চালনায় বর্গীসেনারা ছিন্নভিন্ন হতে লাগলো। ভাস্করবর্মা অস্ত্র পরিত্যাগ করে তাঁর কাছে যখন ক্ষমা প্রার্থনা করছিলেন, তখন সেই মৃদু চন্দ্রালোকে দেবীর কাছে এসে রুদ্রনাথ চমকিত আর শিহরিত হয়ে দেখলেন আর ভাবলেন এ কি দেখছেন তিনি? পঞ্চবটিতে রাখা দেবী চামুন্ডা আর এই বীরাঙ্গনা হুবহু একই রকম দেখতে। পলকের মধ্যে দেবী অন্তর্হিতা হয়ে সেই রহস্য আরো গভীর করে তুললেন।


গৌরবের ঠাকুমার গল্প আর  শেষ হতে পারলো না। দু’জন পরিচারিকা দুটি বিশাল বড় পিতলের থালাতে অনেক হলুদ রঙের নাড়ু্ নিয়ে এসেছে। ঠাকুমা তাঁর মেহগিনির পালঙ্কে আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসে ডাকলেন “তোমরা সবাই  এসো। আকাশ, এ হল আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজোতে মহাপঞ্চমীর দিনের নারায়ণ শিলা পুজোর প্রসাদের মিষ্টি আনন্দনাড়ু্”। বাকি গল্প উনি কাল শোনাবেন বলে দাসীদের সাথে দৌড়ালেন পুজোর দালানে।


আকাশ আর গৌরব কার্শিয়াঙের বোর্ডিং স্কুলে পড়ে। গৌরবের  বিশেষ অনুরোধে  আকাশের মা বাবা রাজি হয়েছেন তাকে এখানে আসতে দিতে। ঠাকুরমার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই নাকে এলো খাঁটি ঘি আর বাদাম এলাচের সুগন্ধ।   সামান্য দূরে বিশাল খোলা প্যান্ডেল খাটিয়ে সাত আটটা জ্বলন্ত উনুনে ভিয়েনের কাজ চলছে। গৌরবের এখন সেখানেই থাকার কথা ।


গৌরব বলে “আমরা কায়স্থ বলে মা দূর্গাকে শুধু মিষ্টি ভোগ দিতে পারি। তাতেও আবার  ছানার মিষ্টি চলবে না। আজ রাতভর চলবে মিষ্টি বানানো আর তা  মাটির হাঁড়িতে শালপাতা  ঢাকা দিয়ে ভালো করে পাটের দড়ি দিয়ে বেঁধে চলে  যাবে ভাঁড়ার ঘরে। ওই দ্যাখ গুড়ের পাক চলছে। ঠিকমতো পাক হলেই তাতে বেসনের সরু সরু সেউভাজা ফেলে, হাতে করে পাকিয়ে বানানো হবে টানামিঠাই। আর তার পাশে শালপাতা ঢাকা বড়ো ঝুড়িগুলোতে খৈ কোটা আছে। এইগুলোও পাক করা গুড়ে ফেলে তৈরী হবে খৈচুর। তৈরী হবে মেচা, খাজা, বালুশাহী, মন্ডা, সন্দেশের মতো দেখতে গুড়ের পাটালি, কাজুর তক্তি, নারকেলের  সাদা বোঁদে, বাদামপেটা সন্দেশ, জিলিপি, অমৃতি, লালবাদামের রুদ্রভোগ, আতা আর  দুধের পাকে তৈরী  রঘুনাথ, এছাড়া ক্ষীরের চমচম, ক্ষীরমোহন।


আকাশ বলে  “বিজয়া নবমী? বিজয়া দশমী  জানি”।


সগর্বে গৌরব বলে, “রনাংঙ্গনে  ভাস্করবর্মাকে যখন দেবী পরাস্ত করেন, তদানীন্তন গুরুদেবের গণনা অনুযায়ী তা হলো অষ্টমী আর নবমীর সন্ধিক্ষণ। নবমীর দিন বিজয় উৎসব করা হয়েছিল বলে তাকে আমরা বিজয়নবমী বলি। এই নবমীর দিন বিজয় উৎসবে মাঠিপাড়ার লোকেরা ছোরা আর তরোয়ালের খেলা, লাঠি খেলা আর মাঠিদের সাথে নকল যুদ্ধ এইসবে জমে থাকে। এছাড়া সপ্তমীর সন্ধ্যেতে যাত্রা, অষ্টমীর বিকেলে পুতুল নাচ আর আমাদের পূর্বপুরুষদের বর্গীবিজয় নিয়ে গাথাকীর্তন প্রতিদিন চলতেই থাকে ।

আকাশ বলে, “মাঠি মানে?” 


গৌরব বলে, “এরা আসলে যুদ্ধে পরাজিত বর্গী।  পরে এদেরকে মুক্ত করা হলেও বেশিরভাগ আর ফিরে  না গিয়ে এখানেই রয়ে যায়। ক্ষত্রিয় বলে পরিচিত এই উপবীতধারীদেরকে এখানে মাঠি বলে” ।


আকাশ বলে, “আমি ভিয়েনের এখানে আসবার সময়  দূর্গাদালান হয়ে এলাম। প্রতিমাতে তখন ডাকের সাজ পরানো চলছে। একচালা দ্বিভুজা অসুরবিহীন দূর্গা, তার পাশে শিব আর বাকি দেবতারা যেমন থাকেন তেমনই আছেন, এই রকম সপরিবারে শিব সাথে দূর্গামূর্তি আমি আগে দেখি নি। তাহলে তোদের বাড়িতে কি এখন চামুন্ডা মূর্তিতে আর পুজো হয় না?”


আকাশ বলে, “ নিশ্চয় হয়। এখান থেকে সিকি মাইলের কম দূরে জঙ্গলের ভেতর প্রাচীন মন্দিরে আছেন দীঘির জল থেকে উদ্ধার করা চামুন্ডা মূর্তি। মহারাজা শাক্ত থেকে বৈষ্ণব হয়ে গেলেন। তখন তার দেওয়ান রঘুনাথ যিনি আমার ঠাকুরদার ছয় সাত পুরুষের ওপরের বেশি হবেন, তিনি শাক্তমতে এই পুজোটি করবার ভার মাঠিদের ওপর  ছেড়ে দেন। কিন্তু সেই বছরই ঘটল এক দারুন ঘটনা।


মহালয়ার পুন্য প্রাতে রঘুনাথ সূর্যোদয়ের আগেই তাঁর প্রাসাদের কমলদীঘিতে স্নান সেরে আকাশের সূর্য ওঠার প্রতীক্ষায়। সূর্য প্রণাম করে, এইবার তিনি জঙ্গলমহালে গিয়ে পারিবারিক দেবী চামুন্ডাকে প্রণাম করতে যাবেন। এইসময় যে কেউ তাঁর কাছে আসতে পারে আর তাদের ঝুলি ভরে দেন দানে। আজ এক পরমাসুন্দরী গৃহবধূ সপরিবারে এসে রঘুনাথকে বললেন যে তিনি সাতদিন পরে ফিরবেন। সেসময়ে দুর্গামন্দিরের অতিথিশালায় তিনদিনের জন্য থাকার অনুমতি চাইলেন। দেওয়ান রঘুনাথ সম্মতি দিয়ে  দেখেন দেবী অন্তর্হিতা। গৃহবধূ চলে গেলে রঘুনাথের মনে হল এই গৃহবধূকে তিনি কোথায় যেন দেখেছেন।


দেওয়ান পক্ষকাল পূর্বে স্বপ্নে এক দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন। আজ এক পটুয়া তাঁর কাছে এসে বলে যে কাল সে এক কৃষক পরিবারের পটচিত্র এঁকেছে । দেওয়ান রঘুনাথ পটচিত্র দেখে অবাক। আজ মহালয়ার সকালে ইনিই তো তিনদিনের জন্য আশ্রয় চেয়েছিলেন আর এই তো সেই তাঁর স্বপ্নে দেখা দেবী যা তিনি তখন স্মরণ করতে পারেন নি । কুলগুরু, রঘুনাথের মুখে সব শুনে আর পটচিত্র দেখে বললেন, “রঘুনাথ তুমি ধন্য।  এই পারিবারিক রূপে স্বয়ং দেবী দুর্গা তোমার কাছে আজ থেকে সাতদিন পর অর্থাৎ সপ্তমী তিথি থেকে তিনদিনের জন্য পুজা প্রার্থনা করেছেন। আমার আর এক শিষ্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে এই অকাল বোধনের পুজা দেখেছি। তোমায় পুজার বিধি এবং তন্ত্রধারক (যিনি তালপত্রে লেখা মন্ত্রপাঠ করেন) পাঠিয়ে দিচ্ছি”। সেই থেকে আজ অবধি সেই রাজপরিবারে দেওয়ান রঘুনাথের স্বপ্নে দেখা শিবদুর্গা মূর্তি রুপে সপরিবারে আসেন এবং সেই তালপত্রে লেখা মন্ত্র এবং বিধি অনুসারে  যথাসাধ্য উপচারে দুর্গাপুজা হয় সনাতনী প্রথায়”।


একটা বেশ চওড়া নালা পুরো  রাজবাড়িকে ঘিরে আছে। নালা পার হবার জন্য একটা বড় সেতু। ঢাকের বাদ্যি  আর গোম্ফাতে যেরকম  বড়ো ঢোল বাজে সেই রকম আওয়াজ আর থেকে থেকে তূরী বাজিয়ে দূর থেকে একটা বেশ বড়ো  শোভাযাত্রা, সেইদিকে এগিয়ে  আসছে। আকাশ সেদিকে চেয়ে বলে, “আমাদের গুরুদেব আসছেন শিষ্যদের নিয়ে।  খয়েরী লাল রঙের বিশাল ছাতার নিচে মাথা কামানো, পরনে খয়েরী রঙের আলখাল্লা, টকটকে ফর্সা রঙ, উনিই হলেন কুলগুরু আর ওনাকে ঘিরে আছেন ওনার শিষ্যেরা। ওনার পেছনে, গুম্ফাতে যে রকম গুমগুম করে ঢোল মতো বাজে সেই বাজনদারেরা আসছে।” তিনদিনের পুজোতে তালপত্রে লেখা প্রাচীন পুঁথি থেকে মন্ত্রোচ্চারণ করবেন ওনারা, নাটমন্দির গমগম করবে সেই সব শব্দে আর ঢোলের আওয়াজে ।


আকাশ বলে, “তাহলে এখানের দুর্গাপুজোতে ঢাক বাজবে না?” 

গৌরব  বলে “অবশ্যই বাজবে। ঢাকি, সানাই নিয়ে সে প্রায় পঞ্চাশ জনের দল। আজ বোধনের সময় থেকে সেসব বাজবে দশমীর দিন অবধি। কিন্তু সন্ধিপুজোর সময় আর প্রতিদিন সন্ধ্যারতির আগে গুম্ফার ওই ঢোল ধুম-ধুম আওয়াজ করে বাজবে জঙ্গলমহলের চামুণ্ডা মন্দিরে।”

“বেশ জমে উঠবে তাহলে তোদের এই পুজো’

“হ্যাঁ। এই বাড়ি এখন গমগম করবে। বাবারা ছ’ভাই, চার পিসি। এছাড়া আমাদের মামারাও কেউ কেউ আসেন । পিসতুতো, খুড়তুতো, মামাতো ভাইবোন মিলে আমরা প্রায় সত্তর-আশিজন। নিচের খাবারঘরের দালানে একসাথে সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া, হৈ-হৈ, মজা, ফুর্তি চলতেই থাকবে। তবে গা শিউরে ওঠে মহাষ্টমীর মাঝরাতে। বাড়ির সব পুরুষেরা যান জঙ্গলের মধ্যে চামুণ্ডা মন্দিরে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বর্গি আক্রমণ থেকে সাধারন মানুষকে বাঁচাতে অনেক রক্ত দিয়েছিলেন। সেই কথা নিজেদের এবং বংশধরদের স্মরণ করাতে বাবা, কাকা এনারা সবাই আঙুল চিরে রক্ত নিবেদন করেন চামুণ্ডা দেবীকে। নবমীর দিন আরতির পর সারারাত চলে আমাদের পারিবারিক জলসা।”


সূর্য অস্ত যাচ্ছেন দুরের নীল পদ্মদিঘির জলে। জঙ্গল মহালে ইতিহাস-প্রাচীন চামুন্ডা মন্দিরে আর গড়বাড়ির নাটমন্দিরে একে একে ঝাড়বাতিগুলো জ্বলে উঠছে। ঢাক, সানাই আর তিব্বতি গোম্ফার ঢোল বেজে উঠতেই আকাশ বলে, ‘চল, বিল্ববরন শুরু হবে। দেবী চামুণ্ডারূপে যেমন রণাঙ্গনে সামনে থেকে যুদ্ধ করেন, দেশরক্ষার জন্য তেমনি পারিবারিক মাতৃরূপেও আবির্ভূতা হন’।


লেখক পরিচিতি


প্রদীপ কুমার বিশ্বাস খনিজ অনুসন্ধানের পেশার কারনে, প্রায় পুরো পৃথিবীই ঘুরেছেন।  তবে অরন্যে ও পাহাড়-পর্বতে জীবনের  বেশিটা কাটিয়েছেন বলে, বেশির ভাগ লেখাতে, ঘটনাস্থল সেই স্থানগুলো। লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছে  কিশোরভারতীতে এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে,  ফেস বুকের একাধিক গ্রুপে প্রতিলিপি ও শপিজেনে  । লেখা পুরস্কার পেয়েছে কিশোরভারতী, শুকতারায । লেখা চলছে এবং প্রকাশিত হয়ে চলেছে    বিভিন্ন মুদ্রিত এবং ওয়েবজিন পত্র পত্রিকায়। প্রকাশিত উপন্যাস “A Trek to unknown”(Bibliofil 2012), অজানা দ্বীপের আতংক (নালক, 2019), রহস্যের অন্তরালে :শরীরী ও অশরীরীরা (2020, কর্পোরেট)  

No comments:

Post a Comment