গল্পঃ নিশিডাক - সায়ন্তন ঠাকুর


তখন আমার বয়স চব্বিশ কি পঁচিশ, কাজকর্ম তেমন কিছু করি না, পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন। ওই বয়সে যুবকরা থিতু হওয়ার চেষ্টা করে, অনেকের পীরিত জমে ওঠে, পদ্মকুসুমের মতো ঢলোঢলো যুবতি নিয়ে সংসার-বাসনা জন্মায় মনে, আমার সেসব কিছুই হয়নি। বুড়ো শিবের দালানে ক্ষীণ প্রদীপের মতো একমাত্র যে প্রেম ছিল, নিজের দোষেই তাকে নষ্ট করে ফেলেছি। পয়সা রোজগারের ফন্দিফিকির খুঁজি, আর কলকাতা শহরের উত্তরদিকে একটা সস্তা ঘরে দিন কাটাই। বাড়ির মালিক অল্প টাকার বিনিময়ে খাওয়াদাওয়া দেয়। সে খাবার মুখে তোলা যায় না। সকালে  পাউরুটি আর একখানি চমচম বা শুকনো শোনপাপড়ি, বেলা গড়ালে এক থালা হড়হড়ে ভাত, ডাল, এককুচি মাছ বা ডিমের ঝোল। তবে বয়স তো ভালোমন্দ নিয়ে অত ভাবিনি। দুপুরের দিকে তক্তপোষে শুয়ে শুয়ে বই পড়ি, একফালি জানালার ওপারে ঝিমঝিম আলো। তখনও কিছু ফিরিওয়ালা বেঁচে ছিল, শিলবাটা কোটা, চাবি বানানো বা তালা সারাইঅলা, হরেকমাল নিয়ে ফিরিওয়ালারা হাঁক দিয়ে ফিরত গলির পথে পথে। গরমের দিনে লাল শালু জড়ানো মটকা, কুলপি বা লাল নীল কাঠি আইসক্রিম।

বিকেলের দিকে একদিন চা খেতে বেরিয়েছি পাড়ার দোকানে, তা সেখানেই আলাপ হল চন্দন ব্যানার্জির সঙ্গে। বয়স্ক মানুষ, একমুখ সাদা দাড়ি,মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, পরনে হাফহাতা জামা আর ঢলঢলে সুতির প্যান্ট। চা-দোকানের পাশেই পুরাতন একখণ্ড জমি ছিল, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ভেতরটা বড় বড় গাছ আর মানুষ-সমান আগাছায় ভর্তি। দু’একটা প্রকাণ্ড পাকুড় গাছ ছিল, তাদের মাথা জংলা বুনো লতায় ছাওয়া, বেগনে রঙের কী একটা বুনো ফুল ফুটতো সেখানে, কত শ্রাবণের অপরাহ্ণে সেই প্রাচীন বৃক্ষরাজির মাথায় ঘন হয়ে আসতো মেঘ, অবিকল ছেলেবেলার শ্লেটের মতো, আর ওই মেঘচ্ছায়ায় ঝলমল করে উঠতো ফুলগুলি, যেন সবুজ সমুদ্রে উড়ে বেড়াচ্ছে একগুচ্ছ রঙিন প্রজাপতি! সেদিন কাকার চা-দোকানে বসে শুনি ওই জমির ওপর নাকি নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠবে, সব গাছ কেটে ফেলবে। চন্দন ব্যানার্জি কাকাকে বলেছে।

--তুই কিছু বলতে পারলি না নারাণ ? সব গাছ কেটে ফেলবে! মামদোবাজি নাকি!

কাকা, চা তৈরি করতে করতে উত্তর দিল।

--একি তোমার জঙ্গল  পেয়েচ ? মানুষ গাচ কেটিই তো ঘরবাড়ি দোকান করবে!

--চুপ কর! জঙ্গল,হু জঙ্গল আর আছে ভেবেছিস নাকি!

--তা তুমি যে এত জন্গলে জন্গলে ঘুরি বেড়াও, যকনই শুনি,নাই একানে, কোতায় গেচে, না জন্গল! কী মদু পাও জন্গলে কে জানে বাবা!

হা হা করে হেসে উঠল প্রৌঢ় মানুষটি। বড় রাস্তায় ওপর চুপিসারে নেমে আসছে তখন কার্ত্তিক মাসের সন্ধ্যা, কেমন ময়লা আলোয় ভরে উঠেছে চারপাশ। এখানে ওই আলোর বিষাদবিধুর রূপটি ধরা দেয় না ভালো, কোন দোকানে উনানে কয়লা সাজিয়ে আঁচ দিয়েছে, দিনান্তে মানুষের ভিড় পেটে নিয়ে বয়ে চলেছে বাস আর ছোট ছোট অটোরিক্সার দল, আমি কান পেতে শুনছি চন্দন ব্যানার্জির কথা। আশ্চর্য মানুষ তো, জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়! গায়ে পড়ে যেচে আলাপও করেছিলাম সেদিন। আমাকেও হয়তো পছন্দ হয়েছিল চন্দনদার, দাদাই বলতাম আমি, সেই শুরু, তারপর কত কথা,গল্প, সেসব আখ্যানের গায়ে লেগে থাকতো বনকুসুমের মৃদু সুবাস!

বিয়ে-থা করেনি, দেশ ছিল ওপারে পাবনায়, এদিকে চলে এসেছিল সেই ভাগাভাগির সময়, দু তিন বছরের খোকা তখন চন্দনদা। লোকের কাছে জীবন বিমার পলিসি বিক্রি করে, ভাড়া বাড়িতেই অর্ধেক জীবন কেটে গেল, নির্বিবাদী একলা মানুষ, শুধু সামান্য পানদোষ ছিল। সূর্য ডুবলে কাছেই একটা সস্তা পানশালায় বসে তিনটি বড় ভোদকা খেত, চাকা চাকা করে কাটা শশা, পেঁয়াজ টম্যাটো আর বিট লবণ রাখা থাকতো সামনে থালায়। ওইরকম এক সন্ধ্যায় আমাকে বলেছিল, জানবে, অরণ্যের কথা বললেও মন পরিস্কার হয়!

একটু বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করেছিলাম, মানে ?

--এই যে তোমাকে জঙ্গলের গল্প করি, আমার যৌবনের কথা মনে পড়ে, মনে ময়লা জমলে তা কেটে যায় তখন!

--আচ্ছা,চন্দন’দা কতবার বাঘ দেখেছ তুমি ?

সাদা দাড়ি-গোঁফের ফাঁক থেকে মিটিমিটি হেসে উত্তর দিল

--একবারও না!

--সে কী! এতবার বাঘের জঙ্গলে গেছ আর বাঘই দ্যাখোনি কোনওদিন ?

--নাহ! ইচ্ছেই করেনি!

--কেন ? কতজনের লেখায় যে তবে পড়েছি, অরণ্যে ‘রাজা’কে দেখলে নাকি আশ্চর্য এক রোমাঞ্চ হয়!

--আমার মনে হয়নি ও-কথা কখনও। চাইলে দেখতে পেতাম অবশ্যই, এই যে বান্ধবগড়, মধ্যপ্রদেশে, চার-পাঁচটা গাড়ি ভর্তি টুরিস্ট নিয়ে গাইড নিয়ে রেডিও-কলার পরানো বাঘ দেখাতে নিয়ে যায় ওরা...কী জানি আমার ইচ্ছেই করেনি।

--তাহলে, কী দেখতে যাও তুমি বারবার অরণ্যে ?

--তেমন কিছুই না! কিছু দেখতেই যাই না, সবুজ রঙের একটা মায়া আছে, জানো। এই যে সকাল হয়, তারপর বেলা গড়িয়ে দুপুর দিন শেষ হয়ে আসে, কতরকম আলো, বুনো ঝোপের ওপর ছোট ছোট পোকার দল পাক খেয়ে উড়ে বেড়ায়,গাছগুলোর শুকনো ছাল-বাকল, সরু রাস্তায় ধুলোর ওপর হাতির পায়ের ছাপ...

কথা শেষ না করেই চুপ হয়ে যায় চন্দন’দা। চোখদুটোয় রিনরিনে নেশা, আমি বুঝতে পারি একজন প্রাচীন উদ্বাস্তু অরণ্যকথা বলতে বলতে সোতাপন্ন হয়ে পড়েছে।মনে মনে স্থির করি, আমিও একদিন ওইরকম বনপথে হেঁটে যাব, আমার এলোমেলো জীবনে অস্পষ্ট বাতিঘরের মতো জেগে ওঠে অরণ্য ভ্রমণের বাসনা। 

তা বাসনা জাগলেই তো হল না, তার নিবৃত্তির জন্য পয়সা দরকার! কাঠ বেকার তখন আমি, দু একটা টুকটাক টিউশনি করি, চা-বিড়ির খরচা ওঠে, বাবা অল্প টাকা পাঠায় মাসে মাসে, ওই ব্যাঙের পুঁজি নিয়ে আর যাই হোক অরণ্যভ্রমণ হয় না! 

চন্দন’দা সবই জানতো, একদিন এ-কথা সে-কথা হতে হতে হঠাৎ বলল, কাছেই একটা জঙ্গল আছে, বেশি টাকা পয়সার ব্যাপার নয়, তুমি ঘুরে আসতে পারো!

অবাক হয়েই জিগ্যেস করলাম, এখানে জঙ্গল ?

--এখানে না, একটু দূরে, বেথুয়াডহরী, এই নদীয়া!

--হ্যাঁ হ্যাঁ, বেথুয়া চিনি তো! কিন্তু সেখানে জঙ্গল কই ?

--ওই যে রাস্তার ধারে ডিয়ার পার্ক, হাইরোডের ধারেই, অনেকখানি জায়গা জুড়ে, প্রচুর গাছগাছালি আছে।

একটু হতাশ হয়েই বললাম

--ধুস! শেষে ডিয়ার পার্ক! ওই তোমার জঙ্গল ?

--আরে! জঙ্গল মানে সবসময় বড় বড় নাম হতেই হবে নাকি! যাও, ঘুরে এসো, বেশ লাগবে তোমার।

প্রথম যৌবনের চকমকি লেগে আছে তখন চোখে,গাঁ-ঘরের কথায় মন ওঠে না। চুপ করে থাকলাম, কোথায় পেঞ্চ,বক্সা, বান্ধবগড়, সব রঙিন বাঘের জঙ্গল, আর কোথায় নদীয়া জেলার একটা ডিয়ার পার্ক! আমার মন বুঝতে পেরে চন্দন’দা ফের বলে উঠল

--ভেতরের দিকে রাতে থাকার একটা আস্তানা আছে, কেউই যায় না, অনেক পুরোনো একটা বাংলো। সামনে ছোট একখান দীঘি আছে,অনেকটা পরিখার মতো। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, দুশো-আড়াইশো টাকা ভাড়া! যাও যাও, একরাত কাটিয়ে এসো!

তারপর একদিন খুব ভোরবেলা, আলো ফোটেনি তখনও, রেলগাড়ি চেপে বসলাম। কার্ত্তিকের শেষ, ঘন মেঘের মতো কুয়াশা, নিজের মাথায় লাগানো মস্ত আলোর ছুরি দিয়ে কেটে কেটে এগিয়ে চলল রেলগাড়ি। কামরায় লোকজন তেমন নাই,  যে-কজন আছে তারা প্রায় সবাই হকার। বড় বড় চটের বস্তায় কাঁচা সবজি, ডাঁই করা খবরের কাগজ, ভেতরটা বিড়ির ধোঁয়ায় অন্ধকার। জানলার ধারে বসেছি, দুপাশে ঘুমন্ত বাড়িঘর, ছোট ছোট পাড়া, কলতলা, মাঝে মাঝে দু-একটা পুকুর, কলকাতা শেষ হয়ে আসছে। ডানদিকে অনেক দূরে আকাশের নিচে ঘোলা লাল রঙের ছোপ ধরেছে, দিবাকরের জেগে ওঠার সময় হল! মাঠ জুড়ে ফুলকপি চাষ হয়েছে, ধানের শিষ দুলছে বাতাসে, গতরাতের শিশির-জলে সপসপ করছে ভুবনডাঙা, যেন অস্ফূট একখানি ছবি, কুয়াশা আর নবীন আলোর রহস্য দিয়ে ঘেরা। 

আমার বুকপকেটে জঙ্গলবাড়ির রসিদ, চন্দন’দা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। লাল সস্তা কাগজের ওপর কালো কালি দিয়ে লেখা, বেথুয়াডহরী এফ-আর-এইচ, তার নিচে আমার নাম। যাওয়া-আসার একটাই লাইন, সিগন্যাল না পেয়ে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছে ট্রেন, মানুষজন উঠছে নামছে, ভিড় বাড়ছে আস্তে আস্তে, হরেক কিসিমের ফিরিওয়ালা বিচিত্র সব পশরা সাজিয়ে বেচাকেনা শুরু করেছে কামরায়। এদিকে বেশ শিরশিরে ঠাণ্ডা, রাঙা আলোয় তেমন ওম নাই। কামরার ধুলাময় মেঝের ওপর বসে খঞ্জ ভিখিরি সুর করে টেনে টেনে গাইছে, ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সঙ্গীত ভেসে আসে! একজন ফিরিওয়ালা কাঁচের বাক্সে রাজভোগ বিক্রি করছিল, দুটো কিনে জল খেলাম, সস্তায় বেশ পেটভরা খাবার। নরম আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। সবুজের জেল্লা আর নাই, কেমন ধূসর রঙ ধরেছে, দূরে দূরে বসতবাড়ি, গেরস্ত উঠোন, লকলকে পুঁইমাচা, কলাঝাড়, মানুষের নিবিড় সংসারের মধ্যে দিয়ে হেলে দুলে চলেছে রেলগাড়ি। 

স্টেশনে যখন নামলাম, সদ্য আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে বেথুয়াডহরী। এখান থেকে একটু দূর বনবাংলো, স্টেশনের বাইরে রেলবাজার, এর মধ্যেই বেশ জমজমাট। হাঁড়ির জলে ছটফট করছে জ্যান্ত মাছ, মাটি আর শিশির লাগা তাজা সবজি নিয়ে দুপাশে বসেছে ব্যাপারীরা, হেমন্তের ছটফটে জ্যান্ত বাজার দেখলেই কেন জানি না আমার ঘর-গেরস্থালির কথা মনে পড়ে। আমারও কোথাও কবে যেন একটি শান্ত নির্জন সংসার ছিল, বাস্তুভিটা ছিল, ভালো মনে পড়ে না, ভাসা ভাসা অস্পষ্ট গতজন্মের কুয়াশার মতো। 

একটা দোকানে পথের হদিশ জেনে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। জাতীয় সড়ক ধরে হাঁটা, ভেঁপু বাজিয়ে হুশ হুশ করে ছুটে যাচ্ছে মালবোঝাই লরি,বাস। রাস্তার দুধারে বড় বড় বৃক্ষদল, শিরীষ, দেবদারু, তাদের পুরোনো পাতার ফাঁক দিয়ে সকালের আলো গলে গলে পড়ছে। গাছ আর পাতার ছায়ার ওপর দিয়ে হাঁটছি আমি। মনে মনে একটু দমে গেছি, এই এতবড় বাসরাস্তার পাশে জঙ্গল, শব্দেই তো সব অরণ্যমায়া ভেঙে যাবে ! 

আধখানা চাঁদের মতো সবুজ রঙের গেট, তার ওপরে গোলাপি কাগজফুলের ঝাড়, ওপরে সাদা হরফে লেখা‘বেথুয়াডহরী অভয়ারণ্য’! বাব্বা! একেবারে ‘অভয়ারণ্য’! আমাদের দেশে আশেপাশের কয়েকটা পাড়া নিয়ে একটা ক্যারম প্রতিযোগীতা হত, তার নাম ছিল ‘অল বেঙ্গল ক্যারম কম্পিটিশন’,এও যেন তেমনই! পাশেই টিকিটঘর, লোকজন কেউ নাই। একটু ডাকাডাকি করতে লুঙ্গি আর ফুলহাতা জামা পরা একজন চিমসে মতো লোক বেরিয়ে এল। আমি বললাম, বাংলোয় বুকিং আছে আমার। ভারী অপ্রসন্ন স্বরে বলে উঠল

--ও। তা বুকিং সিলিপ দেখি।

দেখালাম। জামার পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে এঁটে অনেকক্ষণ দেখল, তারপর বলল

--কোনও খপর দেয়নি কেউ, ঘর পরিস্কার নাই কিন্তু। 

--মানে ? তাহলে থাকব কোথায় ?

--ঝাড়ুদারকে খপর দিতে হবে, সে এসে পরিস্কার করবে। আর হ্যাঁ, রান্নাবান্না হবে না।

--আপনি কি কেয়ারটেকার ?

মাথা নাড়ল লোকটি। কী করব বুঝতে না পেরে আমি বললাম

--আচ্ছা, ঘরটা খুলে তো দিন তারপর দেখছি।

ব্যাজার মুখে উত্তর পেলাম

--আচ্ছা, আসেন।

গেটের ভেতর ছোট একটা ঘর, সেখানে ঢুকে জাবদা খাতা খুলে দিয়ে লোকটা বলল

--আপনি ফিল করেন, আমি চাবি নিয়ে আসছি।

নাম-ধাম-বাপের নাম-হাল সাকিন সব লিখলাম। আগে পিছে সব সাদা পাতা, লোকজন কেউ আসে বলে মনে হল না!  ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, সরু একটা পথ এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। দুপাশে সার সার শালগাছ। তবে জায়গাটা মন্দ নয়, কী একটা পাখি ডাকছে আপনমনে, দুপাশে বড় বড় শিশির ভেজা ঘাস, ইতিউতি কুচি কুচি ঘাসফুল উঠেছে, তিরতির করে সেখানে কাঁপছে সকালবেলার আলো। পথের ওদিকটা কেমন আবছা, কুয়াশা জমে আছে। জংলা গন্ধ চারপাশে।

লোকটা একগোছা চাবি হাতে এসে জিগ্যেস করল

--খাতা লিখেছেন ?

মাথা নাড়লাম আমি। উল্টেপাল্টে খাতা দেখে বলল

--মাত্র একদিন থাকবেন ?

--হ্যাঁ!

--আসেন আমার সঙ্গে!

সরু বনপথ ধরে এগোতে থাকলাম। জুতোয় জলমাখা ঘাস লেগে যাচ্ছে, কী ইচ্ছে হল, চটি খুলে হাতে নিলাম। সেদিকে আড়চোখে চেয়ে লোকটি বলে উঠল, পিপড়া আছে, এই বড় বড় কাঠপিপড়া!

--আপনার নামটা তো জানা হল না দাদা!

--মদন, মদন পাল।

শালের পাতা খসে পড়ছে, সারা পথ জুড়ে শুকনো পাতা, এখনও পাতাগুলো ভিজে ভিজে। দুপাশে বড় বড় গামহার গাছ, এই সকালেও একটানা ঝিঁ ঝিঁ ডেকে চলেছে। কী একটা বড় পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেল, পেঁচা মনে হয়,সারা দিনমান কোটরে লুকিয়ে বসে থাকবে। বড় রাস্তার শব্দ আর একটুও নাই এখানে, মনে হচ্ছে সত্যি কোনও অরণ্যে চলে এসেছি। পাশেই একটা শুখা নালা, কালো ছাই পড়ে আছে, জঙ্গলে নাকি ওরকম নালায় শুকনো ডাল-পাতা জড়ো করে পোড়ানো হয়, শুনেছিলাম চন্দন’দার মুখে। আলো অনেক কম, যদিও এখন বেশিরভাগ গাছ পাতা ঝড়িয়ে ফেলছে, পত্রশূন্য ডালপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে অনেক দূর অবধি চোখ চলে যায়। ছায়া আর আলো একসঙ্গে হাত ধরে ধুলার ওপর ছক কেটে কেটে বাঘবন্দী খেলা খেলছে! আমার পায়ের নিচে ভেজা মাটি, অনেকদিন পর যেন কোনও যুবতি নরম কুসুমের মতো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শরীরে। গাছপালার গায়ে কী এক অপরূপ সুবাস লেগে আছে। 

একটা সরু পথ  বাঁদিকে ঢুকে গেছে। সেদিকে আঙুল তুলে মদন পাল বলল

--ওইদিকে ঘড়িয়ালের পুকুর!

--আর হরিণ ?

--ওরা সবখানেই চড়ে বেড়ায়! দাঁড়ান না, একটু পরেই আসবে সব দলবেঁধে!

--আর কী কী জন্তু আছে এখানে ?

--কী আর থাকবে, ভাম আছে, দু চারটে শেয়াল, বেজি এইসব!

দূরে একটা জীর্ণ সাদা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি, সামনে গোল বারান্দা। ঢোকার পথে ছোট সবুজ রঙের গেট, তারও আগে একখানি মজা দীঘি, রাশি রাশি শাপলা ফুল থইথই করছে জলের ওপর। দু চারখান বক বসে আছে নিশ্চিন্তে একটা ঠ্যাঙ ডুবিয়ে, আমাদের পায়ের শব্দ পেয়েই ঝটপট করে উড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল গাছপালার ভেতর। বাড়িটাকে দু’পাশ থেকে আগলে রেখেছে এক প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছ, অসংখ্য ঝুরি নেমে এসেছে তার শরীর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে চার-পাঁচটা ধাপ উঠেই বারান্দার ওপর ঘর, দরজার তালা খুলল মদন, অনেকদিনের ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগল। ভেতর দিকে আরও একখানা ঘর, পেছনে রান্নাঘর, তার পাশেই কলঘর। খাট-বিছানা সবই আছে, তবে ধুলায় মলিন, দেওয়ালে উইয়ের লম্বা বাসা, মাকড়সা জাল বিছিয়ে রেখেছে কুলুঙ্গির মধ্যে।

--দেখছেন তো অবস্থা! পারবেন থাকতে ?

--আপনি একটু পরিস্কার করানোর ব্যবস্থা করুন না!

--আর পরিস্কার, লোক নাই জন নাই, করবে কে বলুন দেখি!

নরম গলায় অনুনয়ের সুরে বললাম

--দাদা, একটু দেখুন না! 

একথা ওকথা চলতে চলতে মদনের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল বেশ। ডানলপের দিকে বাড়ি, আজ পনেরো বচ্ছর এখানে আছে। বিয়ে-থা করেনি, আপনি-কোপনির সংসার! ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ হয়ে গেলাম দুজনেই!  নিজেই কোথা থেকে ঝাঁটা এনে সাফসুতরো করতে লেগেছে, ব্যাগে অল্প রাম, প্লাস্টিকের গেলাস ছিল, ওই কবেকার কলের জল খুলে তাই মিশিয়েই খেতে শুরু করেছি, মদন’দাও নিল, বিড়ি দিলাম। দুপুরে কোথায় কী খাব, ঈশ্বরই জানেন! 

বারান্দায় রোদ্দুরের আলো পোষা বিড়ালের মতো এসে পা মুড়ে শুয়ে আছে, বাতাস উঠেছে, দীঘির জলে থিরথির করে দোলা খাচ্ছে শাপলা ফুলের দল। এ জগত আগে দেখি নাই কখনও, চিরকালের চেনা রমণী যেন সাজগোজ করে অকস্মাৎ অচেনা হয়ে উঠেছে। বারান্দায় ধুলার ওপরেই এসে বসেছি, আশ মিটিয়ে দেখছি গাছপালার রূপ। বেশিক্ষণ ওই রূপের জগতের সামনে বসে থাকলে বুক টনটন করে ওঠে, দোলা লাগে হৃদিপদ্মে। কী যেন হারিয়ে গেছে আমার, জন্ম-জন্মান্তর ধরে খুঁজে চলেছি, কিন্তু পাইনি কখনও, কানে ফিসফিস করে অশরীরী এক কণ্ঠ বলে যায়, এসো এসো, তুমি দেখবে বলেই তো এত আয়োজন!

সে-রাতে অরণ্যে একটু দেরী করে, বেশি রাতের দিকে চাঁদ উঠেছিল । ফিনফিনে কাপাস তুলোর মতো জোছনা খুলে দিয়েছিল অন্য জগতের মায়ার দুয়ার। চোখের পাতা আঁঠা আঁঠা হয়ে এসেছিল, নিজের এতদিনের চেনা শরীর যেন স্পর্শ করলেই গলে জল হয়ে গড়িয়ে যাবে শাপলা ছাওয়া দীঘির দিকে। চিরকালের জন্য আমাকে গ্রাস করেছিল অরণ্যভূমির নিশিডাক। সেই ডাক অগ্রাহ্য করে জগতকে‘ভ্রম’ বলতে পারার সামর্থ্য আমার আজ এতদিনেও হল না!


অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত



লেখক পরিচিতি


সায়ন্তন ঠাকুর, জন্ম পৌষ মাসে, রাঢ়বাংলার এক অখ্যাত মফস্বলে। ছেলেবেলা আর কিশোরবয়স কাটে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নির্জন গ্রাম আর নিস্তরঙ্গ ছোট ছোট গঞ্জ বাজার ও শহরে। অধুনা নিরুপায় হয়ে চাকরির কারণে কলকাতা প্রবাসী।

2 comments:

  1. ভাল লাগল। ছোট ছোট বর্ণনা অপূর্ব। আপনি যে বিভূতি ভূষণের ভক্ত e লেখাটা তার প্রমাণ। আমাদের কাছেই চার পাশে কত এমন অবাক অরণ্য লুকিয়ে আছে। আশা করি আপনি তার খবর পান আর আমাদেরকেও নিয়ে যান আপনার কলমের টানে।

    ReplyDelete
  2. ভাল লাগল। ছোট ছোট বর্ণনা অপূর্ব। আপনি যে বিভূতি ভূষণের ভক্ত e লেখাটা তার প্রমাণ। আমাদের কাছেই চার পাশে কত এমন অবাক অরণ্য লুকিয়ে আছে। আশা করি আপনি তার খবর পান আর আমাদেরকেও নিয়ে যান আপনার কলমের টানে।

    ReplyDelete