ফেসবুকের ভূত
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
তথাগত মজুমদারের স্ত্রী সুতপা মাস ছয়েক আগে কঠিন অসুখে চলে যায়। ওদের বছর দশেকের সংসারে কোনও সন্তানের পা পড়ে নি। তাই বলে কিন্তু জীবন নিয়ে মেতে থাকায় সুতপা এতটুকু ভাঁটা পড়তে দিতো না। তথাগতও বউয়ের যত্নে দুধেভাতেই ছিল। সন্তানহীন দুজনের ছোট সংসারে চাপা দুঃখ কোথাও হয়ত লুকিয়ে ছিল, কিন্তু সুতপার ভালবাসার নিবিড় বন্ধন, সংসার যাত্রার পথ মাখনের মতো মসৃণ করে রেখেছিল। কার যে কখন ডাক আসে কে বলতে পারে!
সুতপা চলে যাবার দুমাস পর্যন্ত তথাগতর শাশুড়ি তার দ্বিতীয় মেয়েকে নিয়ে তথাগতর সংসারটা চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সময়ের ঘুরন্ত চাকা সব ভুলিয়ে দেয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সময় লাগে নি তথাগতর। শালী সুমনা চলে যাবার সময় বলেছিল, “ভেব না দেবুদা, সব ঠিক হয়ে যাবে। দিদিকে কেউ রিপ্লেস করতে পারবে না জানি। যোগাযোগ রেখো।”
কথাগুলো বলার সময় সুমনা একটু ঘন হয়ে বসেছিল তথাগতর পাশে। তথাগতর গালে সুমনার খোলা চুলের সুড়সুড়ি, সদ্য স্নান শেষে সাবানের মাদকতাময় সুবাস। তথাগতর গা সিরসির করেছিল। বেদনাময় হাসিতে মুখ ভরিয়ে শুধু বলেছিল, “তুমিও সাবধানে থেক।”
অনেকদিন পর আজ যেই তথাগত ফেসবুকের পাতা খুলে বসেছে, ওমনি ঝড়ো হাওয়ায় জানলার কপাটগুলো দড়াম করে বন্ধ হয়ে আবার খুলে গেল। গুমোট গরম ছিল। মনে হচ্ছিল বৃষ্টি হবে। হলও তাই। জানলার পাটগুলো খুলে দিয়ে ক্যাচার লাগিয়ে দিল তথাগত। আসুক না ঝড়ো হাওয়া, ভিজুক না বিছানা বৃষ্টিতে!
হাওয়ার দাপট কমে যেতে বৃষ্টির তোড় বেড়ে গেল। জানলা দিয়ে বৃষ্টি এসে বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তথাগত জানলা বন্ধ করে ল্যাপটপে বসল। তখনি পিং শব্দ করে মেসেঞ্জারে লেখা ভেসে উঠল। “ওগো শুনছ, সুগারের ওষুধ খেয়েছ?”
তথাগত বিরক্ত হল। একী অসভ্যতা! সাধারণত ও ইনবক্সে মেসেজ পাঠায় না কাউকে। ফেসবুকে সে এখনো বিশেষ সড়গড় নয়। সুতপাই জোর করে ফেসবুক একাউন্ট খুলিয়েছিল। মাঝে মাঝে লাঞ্চ ব্রেকে ফেসবুক খুললেই দেখত, অদ্ভুত মেসেজ পাঠিয়ে বিরক্ত করছে সুতপা। বাড়ি ফিরে এই নিয়ে কিছু বললেই বলত, “কেমন মজা বল তো! অফিসে গিয়ে বউটাকে যাতে মনে পড়ে, তার কেমন চমৎকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আহা, ফেসবুক না থাকলে কোথায় পেতাম এমন মজা?”
বাদলা রাতে মেসেঞ্জারে নাম দেখা গেল, ‘মনামী’। এ আবার কে? ছোট্ট ফ্রেন্ড লিস্ট চেক করে দেখল, নাহ্, এমন নামের কেউ নেই। আজকাল এই হয়েছে বিপদ। অনেকেই নিজের আসল নামে ফেসবুক করে না। উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ ইনবক্সে তাকিয়ে থেকে তথাগত বন্ধুর লেখা রম্য রচনাটাতে নির্লিপ্ত ভাবে চোখ বুলাতে লাগল।
আবার পিং শব্দ শুনে নাভির কাছটা কেমন যেন চিনচিন করে উঠল। লেখা ফুটে উঠল, “জবাব দিচ্ছ না যে, ওষুধ খেয়েছ?”
তথাগতর অজান্তেই যেন বুড়ো আঙুল দেখানোর আইকনটাতে তর্জনী ঠেকে গেল। উত্তর এল, “হুম, নিজের দেখাশুনো এখন থেকে নিজেকেই করতে হবে।”
কি আপদ! বেজায় রেগে তথাগত লিখল, “কে আপনি? বিদেয় হন তো! আমি অচেনা লোকের সাথে আলাপ জমাই না। মেসেজ করা পছন্দও করি না।”
সে রাতের মত আর কোনও মেসেজ এল না। ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল তথাগত। বৃষ্টি ধোয়া রাতে জানলা খুলে দিতেই মিষ্টি ঠাণ্ডা হাওয়ায় মনে হল যেন সমুদ্রের তীরে কোনও অচেনা দ্বীপের বালিয়াড়িতে শুয়ে আছে তথাগত।
অফিস যাওয়ার সময় বাঘাযতিন মোড় থেকে এসি বাস পেয়ে গিয়ে বেজায় আনন্দ হল তথাগতর। এসপ্ল্যানেড যেতে ঘণ্টা খানেক লেগে যাবে। তথাগত বাস যাত্রীদের মুখের ফরেন্সিক করে দেখে বোঝার চেষ্টা করল, কে আগে নেমে যেতে পারে। সামনের সিটে মাঝবয়সী একটা লোক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাশের লোকটার ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে, সহজে উঠবে বলে মনে হয় না। আর একটু এগিয়ে যেতে জানলার ধারে বসা লোকটার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে বোঝা গেলো, নামার তাড়া আছে। কাঁধের অফিস ব্যাগটা সামনে গুছিয়ে হ্যান্ডেল চেপে ধরে বেশ ছড়িয়ে দাঁড়ালো তথাগত। তার ভঙ্গীটা তখন হল ঠিক উইকেট কিপারের মতো। বাস গোলপার্ক আসতেই লোকটা উঠে দাঁড়ালো, আর দক্ষ উইকেট কিপারের মতো জানলার ধারেই সিটটা ক্যাচ করে নিল তথাগত।
সিটে বসে ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করে ডাটা অন করতেই পিং পিং শব্দে একগাদা মেসেজ ঢুকে গেলো। এবার কিছুক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা, কতক্ষণে সব শান্ত হয়। মেসেঞ্জারে আবার নাম এলো, মনামী। তলপেটের কাছে একটা অস্বস্তি নিয়ে মেসেজবক্স খুলতেই নজরে এলো, “টিফিনে কি নিলে আজকে? কতদিন বারণ করেছি না, রাস্তার ছাইপাঁশ গিলবে না!”
তথাগত বেজায় রেগে জবাব দিলো, “কে আপনি? এসব কি লিখে চলেছেন?”
পিং শব্দে, “ওগো তুমি আমায় চিনতে পারলে না? বিয়ের পর সোহাগ করে আমার নাম ‘মনামী’ দিয়েছিলে, মনে পড়ে?”
এসি বাসেও গেঞ্জির নিচে গা ঘামতে শুরু করেছে তথাগতর। ভূত টুতে তার বিশ্বাস ছিল না কস্মিন কালেও। তবে ভূতে চরম অবিশ্বাসীও বেকায়দায় পড়লে ভূতে ভয় পায়। মোবাইল বন্ধ করে ভাবতে থাকে তথাগত। সুতপার শ্রাদ্ধ শান্তিও করা হয়েছিল বেশ কায়দা মাফিক। পুরোহিত বরদাচরণ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। তার কাজে ভুল হবার নয়। তাহলে কি ফেসবুক করাই বন্ধ করে দেবে তথাগত? মুশকিল হচ্ছে সুতপা চলে যাওয়ার পর থেকে এই এক ফেসবুক তাকে সব কিছু ভুলিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সেটা চলে গেলে এক জীবনে আর থাকে কী?
পাশে বসে থাকা লোকটা এতক্ষন ঘুমাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে উঠে কখন যে তথাগতর মোবাইলের স্ক্রিনে আড়চোখে দেখছে খেয়ালই হয়নি। তথাগত একপলক তাকাতেই লোকটা মুখ ফিরিয়ে নিল। রবীন্দ্রসদন ছাড়াতেই তথাগত উঠে পড়ে। নামতে হবে। ঠিক সেই সময়ে মোবাইল সুর করে বেজে উঠলো। সুমনা, রাঁচি থেকে ফোন করেছে। এই সময়ে ওর তো স্কুলে থাকার কথা। ইচ্ছা করেই ফোন তুলল না তথাগত। বাস ভর্তি লোকের সামনে শ্যালিকার সাথে সাত সকালে ফোনালাপ করা যায় না। মোবাইলটা দ্বিতীয়বার আর বাজল না। অফিসে চেয়ারে বসে এক গ্লাস জল খেয়ে ধীরে সুস্থে ফোন করল সুমনাকে। ওদিক থেকে ফোনটা বেজে গেলো। সুমনা তুলল না। কিন্তু মেসেজ এলো, “আমাকে ভুলে গেলে দেবুদা? ফিরে যাওয়ার পর থেকে এতগুলো মাস কেটে গেল, একবারও ফোন করলে না?”
সত্যি, তথাগতর ভুল হয়ে গিয়েছে। সুমনা তার দিদির মতো প্রাণ চঞ্চল নয় ঠিকই, তবে ভিতরে ভিতরে কোথাও যেন একটা আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকে ওর মধ্যে। অনেকটা যেন - উত্তাপ আছে, কিন্তু ধোঁয়া দেখা যায় না। দুটো মাসে বড় কাছে এসে গিয়েছিল সুমনা। সময় মতো এটা ওটা এগিয়ে দেওয়া, সামান্য পারফিউমের গন্ধ শোবার ঘরে ছড়িয়ে চলে যাওয়া, এ ছাড়া কিছুই নয়। সুতপা চলে যাওয়ার পর তার জায়গা দখল করে নেওয়ার মতো কোনও গোপন অভিপ্রায় সুমনার মনের মধ্যে কুসুমিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা থেকে থাকবে কী? প্রশ্নটা মাথায় আসতে যেন নিজের কাছে লজ্জা পায় তথাগত। তখনি আবার সামনে খুলে রাখা কম্পিউটারে মেসেজ এলো মনামীর নামে, “কাজকম্ম ফেলে রেখে মোবাইল নিয়ে বেশি খেলো না।”
এইরে, গতকাল কম্পিউটারে ফেসবুক লগ আউট করতে ভুলে গিয়েছিল তথাগত। লগ আউট করে মোবাইলে চোখ বুলিয়ে দেখল, সেখানে মোবাইল ডাটা বন্ধ। এবার কাজে মন দিলো তথাগত। কাজ জমে আছে বিস্তর- প্রজেক্ট ডেডলাইন শেষ হতে আর বেশি দেরী নেই।
কিছুক্ষণ পর টেবিলে রাখা ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলো। অভ্যস্ত হাতে আলগোছে কানের কাছে ছোঁয়াতেই অপর প্রান্ত থেকে এক ভদ্রমহিলার গলা ভেসে এলো, “কী গো, বললে না তো টিফিনে কি এনেছ? তুমি সুগারের রুগি সে খেয়াল আছে তো?”
তথাগতর সারা শরীরে বিদ্যুৎ ছুঁয়ে গেলো। কেউ কি তাকে নিয়ে মজা করছে? ভূতেরা দিনের বেলায় কথা বলছে, তাও ফোনে - এই ব্যাপারটা যুক্তিবাদী না হলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। কড়া গলায় তথাগত প্রশ্ন করল, “কে আপনি? অনধিকার চর্চা করতে লজ্জা করছে না?”
অপর প্রান্তের গলা কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর মৃদু স্বরে সরব হল। “গলা শুনেও চিনতে পারলে না আমি কে? তুমি তো কোনোদিন এভাবে আমার সাথে কথা বলতে না!”
তথাগতর মুখ দিয়ে অনবধানে বেরিয়ে গেলো, “কে সুমনা?”
“ও, এখন সুমনার কথাই ভাবো বুঝি? পেটে পেটে এত তোমার? বেঁচে থাকতে তো জানতে পারিনি! তাহলে তুমিও অন্যদের মতোই, আলাদা নও! আমি কিন্তু ভেবেছিলাম...।”
তথাগত কথা শেষ করতে না দিয়ে ফোন কেটে দিয়ে বেজায় রেগে টেলিফোন অপারেটারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, “কে ফোন করেছিল দেখুন তো আমায়? এক অসভ্য মহিলা...।”
“কেউ না স্যার। আজ তো আপনার ইন্টারকমে কোনও ফোন আসেনি। মানে এলে আমি জানতে পারতাম। আর কে অসভ্য.....”
কথা না বাড়িয়ে গোটা ব্যাপারটা ভাবতে বসে তথাগত। টেলিফোন অপারেটার গলা বদলে তার সাথে মজা করছে না তো? উনি আবার একটু বেশিই গায়ে পড়া। দেখা হলে কথা বলতে গিয়ে একেবারে কোলে চড়ে বসে আর কী! একবার সুমনাকে ফোন করে দেখলে হয় না? যদি সুমনা গলা বদলে ফোন করে থাকে!
এবার সুমনাকে ফোন করতেই সুমনা ফোনটা সাথেসাথে রিসিভ করলো। যেন তথাগতর ফোনের জন্যই এতক্ষন অপেক্ষা করে বসেছিল সে। সুমনা সব শুনে অস্বীকার করে বলল, “দেবুদা, আর যাই হোক এই সক্কাল সক্কাল অফিসে বসে তোমার সাথে ইয়ার্কি করতে যাব না নিশ্চই। দেখোগে অন্য কোন মহিলা তোমাকে বিপত্নীক দেখে ঘাড়ে চেপে বসতে চাইছে বোধহয়! এতদিন পাত্তা দাওনি...... আর পাত্র হিসাবে তুমি মন্দ নও মোটেই। অনেকেই লাইন দিয়ে বসে আছে। তারপর আজকাল আবার দোজবরই মেয়েদের বেশি পছন্দ। আমারই তো বয়সে বড় মানুষের সাথে প্রেম করতে বড় ইচ্ছে জাগে!”
তথাগতর মনে যেন আবার এক অজানা শিহরণ খেলে যায়। মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। মুখে বলে, “তোমার কথা বাদ দাও। তোমার মতো সুন্দরীর জন্য কত রাজপুত্র স্বয়ম্বর সভায় আসবার জন্য উন্মুখ! ওকথা ছাড়ো, কে ফোন করতে পারে বল দেখি!”
“সেটা তুমিই ভালো জানবে দেবুদা। দিদি চলে যাওয়ার পর তোমার ডিম্যান্ড বেড়ে গেছে দেখছি। দেখি আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।”
“তুমি আবার কি করতে যাবে...”
“তোমার গলায় ঝুলেও পড়তে পারি মশাই।” বলেই হাসির জলতরঙ্গ বাজিয়ে দিলো সুমনা।
ফোন কেটে যেতে কেমন যেন ঘাড়ের কাছে সুমনার চুলের মৃদু স্পর্শ, নাকে পারফিউম্ড সাবানের হালকা গন্ধ ভেসে এলো।
সপ্তাহ খানেক কেটে গেলো। মোবাইলের স্ক্রিনে মনামীর মেসেজ আসা বন্ধ হল না, বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। তথাগতর উদ্ভ্রান্ত দশা দেখে অফিসের গোমড়া মুখো অমিশুক বস পর্যন্ত মন্তব্য করল, “তোমার মনে কোনও অশান্তি চলছে নাকি তথাগত? বুঝতে পারছি, অল্প বয়সে বউ হারানোর দুঃখ তোমাকে ভিতর ভিতর একেবারে কুরে খাচ্ছে। একা জীবন, বড় নিঃসঙ্গ, বড় কষ্টের। তুমি বরং কদিন বাইরে কাটিয়ে এসো। কাজে মনও আসবে, শরীরও চাঙা হয়ে উঠবে। কিন্তু যাবে তো সেই একা। বন্ধু বান্ধবদের বলে দেখ, যদি ওরা সাথে যায়।”
ফেসবুকের ভূতের কথা বলা যায় না বসকে। নিজের চেয়ারে এসে বসতেই আবার টেবিলে ফোন বেজে উঠল। ফোন তুলেই চিৎকার করে উঠল তথাগত, “কে আপনি? বিরক্ত করছেন কেন? বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
ফোনের অপর দিক কিছুক্ষণ নিরব থেকে জবাব আসে, “স্যার এক ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন। পাঠাবো কী?”
এতো রিসেপশন থেকে ফোন! কি বিপদ, তথাগত ভেবেছিল ভূতুরে ফোন এসেছে বুঝি। লজ্জার কথা, রিসেপশনিস্ট তাকে পাগল ঠাওরাল না তো? কিন্তু এদিকে আবার এক ভদ্রমহিলা দেখা করতে আসছে। কে সে? না বলে সুমনা চলে আসে নি তো! অফিসের কাজে মাঝেমধ্যে ওকে কোলকাতায় আসতে হয়। সুতপা বেঁচে থাকতে বেশ কয়েকবার কাজে এসে তথাগতদের কাছেই উঠেছে সুমনা। এখন যদি ওর কাজ পড়ে, তাহলে তথাগতর ফ্ল্যাটে উঠবে, নাকি গেস্ট হাউস বা হোটেলে উঠবে। খালি ফ্ল্যাটে ও আর সুমনা! ভাবতেই শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায় তথাগতর।
টেবিলের সামনে কেউ এসে দাঁড়াতেই চমক ভেঙে যায়। আরে, এ তো বিশাখা। এতকাল পরে? বিশাখাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে তথাগত। বিস্ময় চাপা থাকে না।
“কী রে, তুই হটাত! এতদিন পরে?”
“কেন? আগেও তো এসেছি তোর অফিসে! এটা ঠিক, যে বহুদিন এদিকে আসা হয়নি। তার কারণ আমাদের অফিস এখন প্রিন্সেপ স্ট্রীটে শিফট হয়ে গেছে”, টেবিলের অপরদিকে বসতে বসতে বলে বিশাখা।
ব্লু জিন্স আর ব্ল্যাক টপে বিশাখার বয়স একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। সেই ছিপছিপে তরুণীটি রয়ে গেছে এখনো। মাথার সামনে চুল পিছনে ঠেলে দিয়ে বিশাখা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “তোর বউ......কী হয়েছিল রে?”
হাতের সামনে পিন কুশনটা ঘোরাতে ঘোরাতে তথাগত বলে, “হার্ট ফেল। জানতেই পারিনি।”
“জানতে পারিস নি মানে? আগে কোনও লক্ষণ দেখতে পাস নি? রুটিন চেক আপেও ধরা পড়েনি?”
“আমি অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। কোনোদিন বলেওনি কোনও অসুবিধার কথা। বাদ দে, অনেকদিন পরে এলি, কিছু আনাই?” কথা ঘুরায় তথাগত।
চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে অফিসের কিউবিক্ল গুলোতে এক নজর বুলিয়ে নিয়ে বিশাখা বলে, “এখানে নয়। বরং বাইরে কোথাও...এখানে বেশ উঁকি ঝুঁকি চলছে। বেশি নয় এই ঘণ্টা খানেকের জন্য যদি আমরা বাইরে যাই, খুব অসুবিধা হবে?”
কলেজের সহপাঠীকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা যথেষ্ট অসম্মানজনক। তাই হাতের কাজ সরিয়ে রেখে ইন্টারকমে বসের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তথাগত। কিউবিক্ল থেকে জোড়া জোড়া চোখ ওদের অনুসরণ করে।
সাউথ ইন্ডিয়ান কাফেটা বেলার দিকে বেশ ফাঁকা। বিশাখা নিজের জন্য একটা কোল্ড কফি আর তথাগতর জন্য হট কফির অর্ডার করে ছড়িয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “তারপর, এবার জীবনটাকে নিয়ে কি ভাবছিস? অবশ্য এটা হয়তো এই সব কথা বলার উপযুক্ত সময় নয়, তবুও......জীবনের একটা মানে তো খুঁজে নিতেই হবে বল?”
ফিক করে হেসে ফেলে তথাগত। “আবার বিয়ে করতে বলছিস? কিন্তু কাকে করি বল? তোর তো বিয়ে হয়েই গেছে অনেক আগে। এই বুড়োকে আর কে বিয়ে করবে?”
“ইয়ার্কি না করে সিরিয়াসলি ভাব একটু। একা একা জীবন বয়ে বেড়ানো এক অভিশাপ। শুনেছি তোর বাবা মার কেউ বেঁচে নেই, আর তুই তো মাত্র এক সন্তান তাদের। কতদিন একা থাকতে পারবি?”
বিশাখার কথা শেষ হতে না হতেই তথাগতর মোবাইলে একটা অচেনা নম্বর ভেসে এলো। মোবাইল তুলতেই কানে ভেসে এলো অতি পরিচিত এক গলা, অনেকটা কি সুতপার মতো? শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে যায় তথাগতর। ওর পাঁশুটে মুখ দেখে বোধহয় বিশাখা খানিক অপ্রস্তুত। চোখ কফির গ্লাসে রেখে ছোট ছোট চুমুক দিতে থাকে।
“কী, আজ বন্ধু এসেছে দেখছি! ওর তো একটা মেয়ে আছে শুনেছি। ভরা সংসার ডুবিয়ে তোমার ঘাটে নাও ভেড়াবার তালে আছে নাকি? এই তো সবে আমি তোমাকে ছেড়ে গেছি। এর মধ্যেই ......।”
তথাগতর মনে হয় তার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে, জিভ শুকিয়ে উঠেছে। ফোনের লাইনটা কেটে গেলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে তাকিয়ে দেখে বিশাখা মাথা নিচু করে কফি খেয়ে চলেছে। তথাগতকে চুপ থাকতে দেখে বিশাখা অস্বস্তি কাটিয়ে দেবার জন্য বলে ওঠে, “তুই এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? কিছু হলে আমাকে বলতে পারিস, অবশ্য যদি অসুবিধা না থাকে।”
বিশাখাকে সব খুলেই বলে তথাগত। বহুদিনের পুরনো বন্ধুকে বলে ফেলে খানিক হালকা বোধ হয়। আসলে যুক্তিবাদী তথাগত ভূত বলে কিছু আছে সেটা মানতে পারছিল না। বিশাখা বলে এই ভূতুড়ে ফোন আসার ব্যাপারটা অবিলম্বে পুলিশে জানিয়ে দেওয়া উচিত আর তথাগত সেটা মেনেও নেয়। পুলিশে খবর দেওয়ার ব্যাপারটা ওর মাথাতে কেন আসেনি, সে নিয়ে নিজেকে নিতান্ত নির্বোধ বলে মনে হতে থাকে।
আজকাল পুলিশ স্টেশনগুলো আগের চাইতে অনেক সিটিজেন-ফ্রেন্ডলি হয়ে গেছে। থানার তরুণ পুলিশ অফিসারটি অনেক ধৈর্য ধরে তথাগতর বিবরণ শুনে নিয়ে সামনের ক্লিপবোর্ডে সেঁটে রাখা সাদা কাগজে খসখস করে লিখে নিলেন তথাগতর অভিযোগ। লেখা শেষ হলে তথাগতর দিকে কাগজটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি নিচে একটা সই করে আপনার মোবাইল নম্বর লিখে দিন। আমরা খোঁজখবর নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি। আর একটা কথা, আপনার ফেসবুক একাউন্ট খুলে রাখবেন মোবাইলে। মেসেজ এলে আমাদের ফরোয়ার্ড করে দেবেন আমাদের কলকাতা পুলিশের ফেসবুকের ইনবক্সে।”
তথাগত আনাড়ির মতো প্রশ্ন করে বসে, “সে না হয় করলাম অফিসার। কিন্তু তাতে অপরাধী ধরা কি করে পড়বে সেটাই বুঝতে পারলাম না।”
“আমাদের উপর ভরসা রাখুন স্যার। যেই থাকুক না এর পিছনে, সে ধরা পড়বেই। আর হ্যাঁ, আর একটা কথা, আপনি বললেন আপনার অফিসেও মাঝে মাঝে ফোন আসে, তাহলে অফিসের ফোন নম্বরটাও দিয়ে দিন আমাদের।” অফিসারটি কিছুক্ষণ একটু ভেবে নিয়ে আবার বলে, “আপনার কারো উপর সন্দেহ হলে সেটাও বলতে পারেন, মানে পুরনো প্রেম বা এমন কিছু যদি থেকে থাকে। ভূত আছে কিনা জানি না, তবে তেনারা যে দিনে দুপুরে ফোন করেন না সেরকমই জানা আছে।”
তরুণ পুলিশ অফিসারের কথার শ্লেষটুকু গায়ে লাগলেও উপেক্ষা না করে উপায় নেই। পুলিশ স্টেশন থেকে বাইরে এসে অনেকদিন পর তথাগত একটা সিগারেট ধরায়। একসময় সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস ছিল। সুতপা বিয়ের বছর খানেকের মধ্যে সে নেশা ছাড়িয়ে ছেড়েছিল। হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে দু হাত দিয়ে তথাগতকে জড়িয়ে ধরে তার দুই ঠোঁটে নিজের কবোষ্ণ ঠোঁট চেপে ধরে বলত, “আমাকেই খাও। সিগারেটের মতো পুড়ে যাই আমি।”
সিগারেটে দুটো টান দিয়ে আর ভালো লাগলো না। ছুঁড়ে ফেলে দিল তথাগত। শাট্ল অটো সামনে আসতেই উঠে পড়ে তথাগত। পিছনের সিটে দুই কলেজ তরুণী বসে অনর্গল কথা বলে চলেছে। নিজেকে তিন নম্বর যাত্রী হিসাবে সিধিয়ে দিয়েই উরুর কাছে অচেনা তরুণীর উষ্ণতার ছোঁয়া পেল নিজের উরুতে। মনটা অন্যাদিকে ঘোরানোর জন্য ফেসবুকের পাতা খুলতেই অনেকগুলো গুডনাইট মেসেজ ঢুকে পড়ল। পুলিশের ভরসা সম্বল করে মেসেজ বক্স খুলে কোনও ভূতুড়ে মেসেজ আজ দেখতে পেল না। ছোটবেলার বন্ধুর কবিতা সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে। আসন্ন বইমেলায় তার মোড়ক উন্মোচন। আনেকের লাইক কমেন্ট দেখে নিয়ে নিজেও এক লাইন লিখে দিলো — অনেক শুভেচ্ছা রইল, এগিয়ে যা।
পুলিশে রিপোর্ট লেখানোর পর থেকেই মেসেজ আসা বা ভূতুড়ে টেলিফোন আসা আশ্চর্যরকম ভাবে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। থানায় ফোন করে সে কথা জানাতেই অফিসারটি বললেন, “ওই ভূতুড়ে মেসেজ যে পাঠাতো, এবার আপনি তাকে একটা দুটো মেসেজ পাঠান। আমরা আপনার ফোন সারভিলেন্সে রেখেছি।”
তথাগত প্রমাদ গোনে। সর্বনাশ, তার মোবাইলের সব গোপন তথ্য পুলিশ জেনে যাচ্ছে। একটু একটু অপমানিত বোধ হলেও এখন আর কিচ্ছু করার নেই। উপদ্রবের হাত থেকে তো বাঁচতে হবে! অফিসার আরও নির্দেশ দিয়ে চলে, “শুনুন, যদি এবার ফোন আসে, তবে কেটে দেবেন না। কথাবার্তা প্রলঙ করবেন। তাহলে অপরাধীকে ধরতে সুবিধা হবে।।”
পরদিন রোববার। ফোন এলো সুমনার, রাতের দিকে, “হাই জিজু, কি করছ?”
“কিচ্ছু না। বসে বসে টিভিতে উত্তমকুমারের পুরনো সিনেমা দেখছি। তোমার কি খবর?” গলায় বেশ খুশির লহর তুলে বলে ওঠে তথাগত।
“কাল সকালের ফ্লাইটে কোলকাতা আসছি। কিছু কাজ আছে। দুদিনে কাজ শেষ করে আবার ফিরে আসতে হবে।”
“কোথায় উঠছো? মানে, সকালে কখন আসবে? কাল আবার আমার অফিস আছে কিনা, তাই...।”
“শোন মশাই। এখন তুমি ব্যাচেলার তাই তোমার ওখানে উঠলে আমার আর সারাজীবন বিয়েই হবে না। তখন তুমি ছাড়া আর কোনও উপায়ই থাকবে না। আর সজ্ঞানে আমি আমার মৃত দিদির কোপানলে পড়তেও চাই না। কোনও চিন্তা করো না। আমি সোজা আমাদের পার্ক স্ট্রীটের অফিসে যাব। সেখানে ক্লায়েন্ট মিটিং শেষ করে তোমার অফিসে চলে আসব...।”
“একদম না, অফিস নয়, আমরা বরং লাঞ্চ করে নেব কথাকলি রেস্টুরেন্টে। আমি খাওয়াবো।”
“সেটাই ভালো হবে। আমি তোমার অফিসে পৌঁছে গেলে বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে, আর আরও বেশি করে ভূতুড়ে মেসেজ পেতে থাকবে। আমি পৌঁছে তোমাকে ফোন করব।”
সুমনার ফোন কেটে গেলো। তথাগত উঠে গিয়ে টিভির সুইচ বন্ধ করে গ্যাসে ভাত বসায়। ভাত বসিয়ে শোবার ঘরে ঢুকতেই মেসেজ এলো ইনবক্সে, “নিজের হাতে রান্না করে খেতে কেমন লাগছে মশাই? আমি থাকতে টের পেতে না। বউ কত কাজের জিনিষ, বোঝো এখন! দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কি কেউ দেয়?”
এবার তথাগত লেখে, “দাঁতের মর্যাদা দিইনি একথা বলে কোন শালা?” তারপর সাগ্রহে অপেক্ষা করে উত্তরের জন্য। কিন্তু সময় পার হয়ে যায়, মেসেজ আর আসে না।
পরদিন সকাল বারোটা নাগাদ থানা থেকে ফোন আসে। পুলিশ নাকি অপরাধীকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে। এখুনি তথাগতকে পুলিশ স্টেশনে আসতে হবে। তথাগত দ্বিধায় পড়ে। সুমনার সাথে লাঞ্চ ভেস্তে যাবে মনে হচ্ছে। এদিকে ফোন করে সেটা সুমনাকে জানানোও ঠিক হবে না। হয়তো মিটিঙে ব্যস্ত আছে। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তথাগত।
কলকাতা শহরে এখন ট্যাক্সি পাওয়া দুষ্কর। ‘নো রিফিউসাল’ লেখা ট্যাক্সিগুলো বেশি করে রিফিউস করে। আর বরাবরই এটা লক্ষ্য করেছে, যেদিকে সে যেতে চাইবে, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ট্যাক্সি চালকের সেদিকে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হয় না। পনের মিনিট ঘাম ছুটিয়ে ভাড়ার উপর পঞ্চাশ টাকা বেশি দেবার শর্তে ট্যাক্সি পেয়ে যায় তথাগত। রবীন্দ্রসদন পার হতে না হতেই সুমনার ফোন আসে।
“দেবুদা। হল না গো। লাঞ্চ ক্যান্সেল। আমাকে এখন ক্লায়েন্টের নতুন প্রজেক্ট ইন্সপেক্ট করতে রাজার হাট যেতে হবে। আজ ডিনারটা না হয় একসাথে করে নিই। মুশকিল হচ্ছে আমার গেস্ট হাউস তোমার বাড়ি থেকে অনেক দূর। তুমি বরং আমার গেস্ট হাউসে চলে এস রাতের দিকে।”
থানায় যাওয়ার ব্যাপারটা বেমালুম চেপে যায় তথাগত। নির্ভেজাল মিথ্যে কথা বলে দেয়। “তাহলে কাল কথা হবে। আমি এখন বেজায় ব্যাস্ত, আর রাতে একটা পার্টিতে নেমন্তন্ন আছে। পড়ে কথা বলছি।”
অপরাধী ধরা পড়েছে এই সম্ভাবনার উত্তেজনায় সুমনাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে তথাগত। লম্বা লম্বা পা ফেলে থানায় ঢুকে সোজা অফিসারের ঘরে ঢুকেই দেখে উলটো দিকের টেবিলে তাদেরই পাড়ার পরিচিত এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক মাথা নিচু করে বসে। তরুণ অফিসার কৌতুকের সুরে বলে, “এনাকে চেনেন? আপনার পাড়ার লোক, তাই তো?”
তথাগত ঘাড় নাড়ে। অফিসার বলতে থাকেন, “আপনার ফোনের ভূতুড়ে মেসেজগুলো ইনিই পাঠাতেন। আসলে রিটায়ার করার পর কোনও কাজ নেই এনার। তাই বসে বসে এই কুকীর্তি করেন। আই পি এড্রেস আইডেন্টিফাই করে ধরে ফেলেছি।”
তথাগতর মন যেন পুরো বিষয়টা বুঝতেই চাইছিল না। এও কি সম্ভব? মাত্র দুটো বাড়ি ছেড়ে ওনার বাড়ি। কোনোদিন কথাবার্তা হয়নি ঠিকই, তবে মুখ চেনাচেনি ছিল বৈ কী! বয়স্ক মুখচোরা মানুষটির এমন বালক সুলভ আচরণের উপযুক্ত যুক্তি খুঁজে পেল না তথাগত। লোকটি একমনে তার পায়ের চপ্পলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একেবারে শব্দ করে কেঁদে ফেলল, “ভুল হয়ে গেছে স্যার। আর হবে না। একটু মজা করতে চেয়েছিলাম বিশ্বাস করুন। আমার কোনও ক্ষতি করার উদ্দেশ্য ছিল না।”
তথাগত কিছু বলতে যাবার আগেই পুলিশ অফিসার তার টেবিলে রাখা রুলটা হাতে তুলে ধরে বলে ওঠেন, “একদম চুপ করুন। লজ্জা করেনা? বাপের বয়সী লোক আপনি। ভালো চাকরিও করতেন। বুঝতে পারছেন না, এনার কতখানি মানসিক ক্ষতি করে দিয়েছেন। আবার মুখে বলছেন, ক্ষতি করিনি?” তারপর রুলটা আবার যথাস্থানে রেখে তথাগতকে বলে, “আপনি ফর্মাল ডায়েরিটা করে দিন নিচে ডিউটি অফিসারের কাছে। আমি বলে রেখেছি। একে কাস্টডিতে নিয়ে নিয়েছি। এভিডেন্স আছে। মেসেজগুলো একটাও ডিলিট করবেন না। একবছরের জেল, মিনিমাম।”
লোকটা এবার অফিসারের পায়ে কেঁদে লুটিয়ে পড়ে, “ছেড়ে দিন স্যর। সমাজে আর মুখ দেখাতে পারব না। আর কোনোদিন হবে না। স্যর এবারের মতো.....।”
লোকটার কান্নায় বোধহয় অফিসারেরও মন গলে গেলো। সে তথাগতর দিকে অর্থপূর্ণ ভাবে তাকালো। ভাবটা এমন যে এবার আপনিই ডিসিশন নিন। তথাগত লোকটার পিঠে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে, “আর কোনোদিন কাউকে বিরক্ত করবেন না। কিছু একটা কাজকম্ম জুটিয়ে নিন। সময় কাটানোর জন্য এই বালক সুলভ আচরণ আর করবেন না। যান বাড়ি চলে যান।”
কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। একটা কাগজে লোকটার কাছ থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তথাগত বাইরে এসে বাড়ি ফেরার বাস ধরে।
সুমনার গেস্ট হাউসের পাশে একটা ভালো নতুন রেস্তোরাঁ খুলেছে – বাঙালির রান্নাঘর। দামটা একটু উপরের দিকে হলেও উপাদেয় পদগুলো টেবিলে সাজিয়ে দিতেই উৎসাহী হয়ে পড়ল তথাগত। ফেসবুকের ভূতের উপদ্রবের রহস্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মনটা হালকা।
‘নিজের হাতের রান্না খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গিয়েছে। এই রেস্তোরাঁটা বেশ ভালই মনে হচ্ছে”, তথাগতর কথা শুনে ওর পাতে সর্ষে ইলিশের টুকরো চামচ দিয়ে তুলে দিতে দিতে মৃদু হাসল সুমনা। তথাগতর মনে হল, সুমনাকে হাসলে বড় সুন্দর লাগে তো! আজ শাড়ি পরে আসায় ওর প্রতি কেমন এক অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করছে তথাগত।
পুরুষ মানুষের মনের কথা কোন এক অজানা উপায়ে কোন মন্ত্রবলে মেয়েরা ঠিক পড়ে নিতে পারে। সুমনা বলে, “তাকিয়ে না থেকে খাও। বেশি তাকালে আবার ভূতুড়ে মেসেজ আসতে থাকবে কিন্তু!”
রসিকতাটা পছন্দ হল না তথাগতর। সদ্য রাহুমুক্তি ঘটেছে। কোনও প্রয়োজন ছিল নতুন করে প্রসঙ্গটা তোলার। তথাগতকে মাথা নিচু করে ঝোল দিয়ে সরু চালের ভাত মাখতে দেখে সুমনা বলে ওঠে, “দেবুদা, যদি বলি নিজের হাতের রান্না খেয়ে আর বেশিদিন থাকতে হবে না...”
মুখের কথা মুখেই আটকে থাকে সুমনার। চামচ দিয়ে ডালের বাটিতে ঘাঁটাঘাঁটি করতে থাকে তার আঙুল। তথাগত ভ্যাবাচেকা খেয়ে নিরেট নির্বোধের মতো সুমনার মুখের দিকে তাকায়। সেখানে তখন নানা রঙের খেলা চলছে। দুজনের নিরবতায় সরব হয়ে ওঠে মাথার উপর এসির গুঞ্জন। তথাগত হাঁ করে আছে দেখে হটাত হেসে গড়িয়ে পরে সুমনা, “ভেবেছিলে একা একা কাটিয়ে দেবে জীবনটা? সেটি হচ্ছে না মশাই। চট করে নিজের মতটা বলে দাও দেখি। আমি কিন্তু ঠিক করেছি বুড়ো বর দিয়ে দিব্বি বাকি জীবনটা চালিয়ে দেব। শত হলেও তোমাকে এমন একা একা ফেলেও রাখতে পারব না আবার কাউকে যে গছিয়ে দেব, সে উপায় নেই......”
সুমনার কথাগুলো কিছুই কানে ঢোকে না তথাগতর। সে বাঁ হাত সুমনার হাতের উপর আলতো করে রেখে দেয়। সুমনা কথা থামিয়ে একমনে খাবারে মনোযোগ দেয়, হাত সরায় না।
সুমনাকে বিদায় জানিয়ে মোবাইল এ্যাপ থেকে ক্যাব ডাকে তথাগত। রিনরিনে চাপা একটা উত্তেজনা সারা শরীর আর মন জুড়ে। ক্যাবে হালকা মিউজিকের সাথে পা কখন যে তাল মিলিয়েছে জানতেও পারে না সে।
ঠিক সেই সময় পিড়িং শব্দে মেসেঞ্জারে মেসেজ ঢোকে। “বাড়ি ফিরে সুগারের ওষুধ খেয়ে নিও কিন্তু। শরীরের অযত্ন করো না।” --- পড়ে ঘেমে নেয়ে ওঠে তথাগত।
অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
লেখক পরিচিতি
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান নৈহাটি। পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে দিল্লী আই.আই.টিতে।বর্তমানে প্রায় তিন দশক ধরে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার পাশাপাশি ছোটগল্প লেখেন। প্রকাশিত গল্পের বই – “তুষার দেশের রূপকথারা”, একপর্ণিকা প্রকাশনী। সম্পাদিত বিজ্ঞান বিষয়ক বই- “চিরকালের হকিং” , জয়ঢাক প্রকাশনী।
No comments:
Post a Comment