গল্পঃ বিচার - দেবব্রত দাশ




বিচার


দেবব্রত দাশ



দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুলিশ-সুপার সেমন্তী ঘোষ তার অফিস-চেম্বারে রিভলভিং চেয়ারে বসে দোল খেতে খেতে তলিয়ে গেল স্মৃতির সায়রে।আজ ২০২০-র ২০-এ মার্চ। সোশ্যাল মিডিয়ায় সকালেই সে পেয়েছে খবরটা।ক্রমাগত পিছিয়ে যেতে যেতে  শেষমেশ আজ ভোরে ২০১২-তে সংঘটিত নির্ভয়া-কাণ্ডের চার ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। নির্ভয়া মানে যার আসল নাম জ্যোতি সিং পাণ্ডে।তার শরীরের উপর এই নরপিশাচের দল যেভাবে খোদ দিল্লির রাজপথে বাসের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে বীভৎসতম যৌন নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছিল, তা বিরলের মধ্যে বিরলতম, এই কথাটা বুঝে উঠতে আট আটটা বছর লেগে গেল...আশ্চর্য !  তারপরেও তো হাজার বাহানা আসামী পক্ষের  উকিলের!  এই তো দু'দিন আগে কী বললেন তিনি  বললেন, এদের মধ্যে এক আসামীর স্ত্রী নাকি তার স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলা আনতে চায় এবং সেজন্যে পিছিয়ে দিতে হবে ফাঁসির দিনক্ষণ।সব বাহানা যে খারিজ হয়েছে, এত বছরের অপেক্ষার পর যে জ্যোতি-র মা-বাবা ন্যায়বিচার পেয়েছেন, এটাই হল খবর। সেমন্তীর মনে হচ্ছে, আজ এক ঐতিহাসিক দিন । কিন্তু সমাজের তো কোনো পরিবর্তনই হয়নি, দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। তিরিশ বছর আগে ১৯৯০ এর  তিরিশে মে, দিনটা তো ভুলতে পারবে না সেমন্তী তার জীবৎকালে কখনোই। কত বয়েস তখন তার?  নয়  পেরিয়ে সবে দশে পড়েছে।পরের দিন সকালে কাগজে খবর আর ছবি দেখে আঁতকে উঠেছিল সে। গলার কাছে দলা পাকিয়ে এসেছিল কান্না, অথচ কাঁদতে পারছিল না।সেমন্তীর বাবা আই.এ.এস অফিসার, সেসময় দিল্লির সাউথ ব্লকে কর্মরত উচ্চপদস্থ আধিকারিক। খবরটা পড়েই তিনি দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাইরে। সেদিনের কথা ভাবলে তিরিশ বছর পরেও সেমন্তী শিউরে ওঠে। কী সেই খবর ? 


দিনটা শুরু হয়েছিল অন্যান্য আর পাঁচটা দিনের মতোই। সকাল সাতটা নাগাদ স্বাস্থ্য-পরিষেবা দেওয়ার জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য-দফতরের একটা গাড়ি নিয়ে সুন্দরবন-অঞ্চলের গোসাবার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তিন মহিলা-অফিসার। দু'জন স্বাস্থ্য-দফতরের আধিকারিক আর অন্যজন 'ইউনিসেফ'-এর সঙ্গে যুক্ত।কাজ-শেষে দিনান্তে সন্ধে সাড়ে ছ'টা নাগাদ সেই গাড়ি যখন কলকাতার উপকণ্ঠে বানতলায় ঢুকেছে, তখন রাস্তার পাশে অবস্থিত কোনো এক রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল জনা তিন চার যুবক এবং চেষ্টা করেছিল গাড়িটিকে থামিয়ে দিতে।কিন্তু ড্রাইভার কোনোক্রমে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় । সামান্য দূরত্ব পার হতে না হতেই দশ বারোজনের একটি দল গতিরোধ করে আবার এবং গাড়িটিকে শুধু ঘিরেই ধরে না, দরজা খোলার জন্যে চেষ্টা চালাতে থাকে প্রাণপণ।সাহসী তরুণ ড্রাইভার অবরোধ কাটিয়ে চালিয়ে দেয় গাড়ি, কিন্তু কপাল মন্দ...উল্টে যায় গাড়ি একটু গিয়েই এবং সেই সুযোগে দুর্বৃত্তের দল দরজা খুলে ফেলে টেনে বের করে আনে তিন মহিলাকে। ড্রাইভার ছোকরা ওই অবস্থাতেও প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বৃথাই...মারতে মারতে তাকে আধমরা করে ফেলে রাখে ওরা । ততক্ষণে গোধূলির আলো মিলিয়ে গিয়ে আঁধার নেমেছে আর হায়নার দল তিন তিনটে শিকার নিয়ে ঢুকে পড়েছে পাশের ধানক্ষেতে। একজন মহিলা ওই অবস্থাতেও প্রবলভাবে বাধা দিতে থাকেন।কিন্তু হিংস্র হায়নারা ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে থাকে তিন  তিনটে  নারী-শরীর। 


প্রায় মাঝরাতে ধানক্ষেত থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুলিশ যখন উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায় তিনটি দেহ, তখন প্রথমে মনে করা হয়েছিল, সকলেই মৃত।কিন্তু কিছু সময় পরে ডাক্তারেরা বুঝতে পারেন, দু'জন তখনও বেঁচে আছেন। আর স্থির রাখতে পারে না নিজেকে সেমন্তী, ভাবনার মাঝে চেয়ার থেকে উঠে ঘরময় পায়চারি শুরু করে দেয় । জোরে জোরে শ্বাস পড়ে তার। পারলে তিরিশ বছর আগে ফিরে গিয়ে হায়নাগুলোকে ধরে এনে সোজা লটকে দিত ফাঁসির দড়িতে। ন'বছর বয়েসে সবটুকু না বুঝলেও ভেবেছিল, ভবিষ্যতে সে এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত করবে নিজেকে যে, সেই কাজের সুবাদে অসহায় মেয়েদের জন্যে কিছু করতে পারে । 


আজ বিকেলে এমন একটা খবর সেমন্তী পেয়েছে, যাতে মাথায় রক্ত উঠে যাওয়াই স্বাভাবিক। এমনিতেই প্রতিবছর মে মাস যত এগিয়ে আসতে থাকে, ততই তার চঞ্চলতা বেড়েই চলে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সন্ধ্যের বীভৎস সব দৃশ্য ।এখনো গুগল-এ ঢুকে মাঝেমধ্যেই বিবরণ পড়ে সে। আসলে, না পড়ে পারে না। তিরিশ বছর পরেও স্বাভাবিক হতে পারেনি রেণুকা বেন্দে ঘোষ।তার হতভাগ্য মা।নাগপুরের মেয়ে রেণুকা বেন্দে আর সেমন্তীর বাবা সায়নজিৎ ঘোষের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মুসৌরিতে ট্রেনিং-এর সময়। বিয়ের পর রেণুকা চাকরি করতে চায়নি, কিন্তু সায়নজিৎ বলেছিল, “তুমি শুধুমাত্র হাউস-ওয়াইফ হয়েই যদি জীবন কাটাবে ভেবেছিলে, তবে কেন এত পড়াশুনা...পরীক্ষা...!”


সায়নজিৎ মনে করত, মেয়েরা দশভুজা...দশ হাতে সব সামলাতে পারে। আসলে, ভুল ছিল অন্য জায়গায়।উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেন ছিল না সেদিন! তার মায়ের বোঝা উচিত ছিল রাজনৈতিক আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি। চাইলে, ইউনিসেফ-এর আধিকারিক হিসেবে নিরাপত্তা-রক্ষী পেতেই পারত অফিশিয়াল ট্যুরে।'গতস্য শোচনা নাস্তি' জেনেও  সেমন্তী পরবর্তীকালে বহুবার তার মাকে প্রশ্ন করেছে, “কেন তুমি নিজেকে অরক্ষিত রেখেছিলে সেদিন?” উত্তর পায়নি, মা নীরবে চেয়ে থেকেছে তার সমঝদার প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের মুখের দিকে, চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে নেমেছে জলের ধারা।মনে মনে শপথ নিয়েছিল সেমন্তী, সমাজের আগাছাগুলো উপড়ে নির্মূল করবে।সে-কাজে কিছু সাফল্য পেলেও সে মনে করে, কাজটা আদৌ সহজ নয়।বাধা হাজার রকমের।এই যে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুলিশ-ডিপার্টমেন্টের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে অনেক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে সে এখন, কিন্তু তা সত্ত্বেও  বিগত একবছরে কী করতে পেরেছে... কতটুকু জঞ্জাল সাফ হয়েছে?  সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা বিপুল এক কর্মযজ্ঞ, দরকার সাধারণ মানুষের সচেতনতা এবং নিরন্তর সহযোগিতা। বহু সময়েই প্রশাসনের সদিচ্ছা সত্ত্বেও গরিবগুরবো খেটে খাওয়া মানুষের নিষ্ক্রিয়তা সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়েছে  ! আর আছে প্রভাবশালী মহলের বাধাদান। এই তো, গত সপ্তাহে নিজে উদ্যোগী হয়ে রাজনৈতিক চাপের কাছে নুয়ে পড়া ও.সি-র পাশে দাঁড়িয়ে সে গ্রেফতার করিয়েছিল সোনারপুর-অঞ্চলের তিন কুখ্যাত মস্তান-কে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল   ধর্ষণের। কোর্টের আদেশ-অনুসারে রাখা হয়েছিল পুলিশ-কাস্টডিতে।থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করতেই  বেরিয়ে এসেছিল ওদের  কুকীর্তির আরো অনেক অনেক খবর।কিন্তু, খানিক আগে ওই তিনজনের জামিনের আবেদন মঞ্জুর হওয়ার সংবাদ শোনার পর থেকেই সেমন্তী তার পরবর্তী কার্যপদ্ধতি 'চক আউট' করে ফেলতে শুরু করে দিয়েছে। পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলছে, মদত পেতে পেতে এই দুষ্কৃতিরা  যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না, আবার সুযোগ দেবে ওরা এবং তখন আর কোনো কমপ্রোমাইজ নয়...প্রাপ্য পাওনাটুকু চুকিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করবে না সে...ভাবতে ভাবতে  চেয়ারে বসে সেমন্তী তার মুঠো করা ডানহাতটা এমনভাবে আছড়ে ফেলল সামনের টেবিল-টপের ওপর, যেন সে আঘাত করছে ওই তিন  ধর্ষককেই! 

  

দুই 


পরের দিন একেবারে ফার্স্ট আওয়ারেই সোনারপুর থানার ও.সি জগদীশ জোয়ারদারকে তার  অফিস-চেম্বারে ডেকে  পাঠাল সেমন্তী, “আমি চাই, আপনি  ফাঁকফোকর না রেখে চার্জশিট তৈরি করে ফেলুন, যাতে করে কোর্টে কেস উঠলেই ওই অতি প্রয়োজনীয় তথ্য-সংবলিত পেপার পেশ করতে পারেন  সঙ্গে সঙ্গে এবং যত  শিগগির সম্ভব আনানোর  ব্যবস্থা করুন ধর্ষিতার মেডিক্যাল  টেস্ট-রিপোর্ট, আই মিন, পারসু করুন।আর  এসবের চেয়েও জরুরি  হল গিয়ে... ‍‍‍‍‍‍ বাক্য শেষ না করে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সেমন্তী  প্রশ্ন  ছুড়ে  দিল ও.সি-র উদ্দেশে, “বুঝলেন কি,  কোন্ বিষয়টিকে জরুরি  বলতে চাইছি আমি?” কাঁচুমাচু মুখ করে ও.সি বললেন, “বুঝলাম না ম্যাডাম, ঠিক কী বলতে চাইছেন আপনি!” 

“যেটা বলব, সেটা তো আপনার নিজে থেকেই করা উচিত। যদি না করে থাকেন এখনও, তবে ইমিডিয়েটলি করুন।জামিনে মুক্ত ওই তিনজনের গতিবিধির উপর নজর রাখার ব্যবস্থা করুন মিস্টার জোয়ারদার ।”

“ঠিক আছে ম্যাডাম, ভিজিল্যান্স জোরদার করছি।”

“ভিক্টিম মানে জবা, ওর সঙ্গে আমি আজ দেখা করতে চাই...হোমে আছে তো...ওয়ার্ডেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলুন, আমি আজ বিকেল ঠিক চারটেয় যাব।” 

      


চব্বিশ ঘণ্টা পর...সন্ধে লেগেছে সবে, সেমন্তী ও.সি-কে ডেকে পাঠাল তার চেম্বারে, “আপনি কয়েকজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে তৈরি হয়ে নিন, বেরোব।“

“কোথায় ম্যাডাম?”

“বুঝতে পারছেন না কোথায়!” সেমন্তীর ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি, “জবাকে তো আজ দুপুরেই হোম থেকে নিয়ে এলেন আমার কাছে, তারপর একটু আগে যে আমাকে জানালেন, ওই তিন মূর্তিমান আতঙ্ক সোনারপুর রেলস্টেশনের ডিসট্যান্ট সিগনাল-পয়েন্টের কাছের পরিত্যক্ত গোডাউন-লাগোয়া ঠেকে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, তাতে আমার গন্তব্যস্থল এখন কোথায় হবে, সেটা কি স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে আপনাকে?”

“বুঝেছি ম্যাডাম, বুঝেছি...”ও.সি কাঁচুমাচু মুখ করে বলেন, “আমি মিনিট দশেকের মধ্যেই আসছি ম্যাম, আপনি চিন্তা করবেন না ।”

“দাঁড়ান আপনি, অত ছটফট করছেন কেন...আশ্চর্য ! আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”  “বলুন ম্যাডাম ।” 

“আপনি কিন্তু মুখে তালাচাবি লাগান মিস্টার জোয়ারদার, কোথায় যাচ্ছি অপারেশনে...কখন যাচ্ছি, ভুলেও যেন...”

“জানি ম্যাম, ভরসা করতে পারেন আমাকে...একবছরের বেশি সময় কাজ করছি আপনার সঙ্গে...”

“বেশ,” সেমন্তী বলল, আমি যাব গাড়িতে নয়, বাইকে... সিভিল ড্রেসে।”



তিন


সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হলে জবাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে সেমন্তী বেরোল সোনারপুর থানা থেকে।  জবার বয়েস বাইশ । দোহারা চেহারা। গরিব ঘরের খেটে খাওয়া আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সে । যৌবনের দীপ্তি ছাড়া আলাদা কোনো জৌলুস নেই তার মুখমণ্ডলে।  নিম্নবিত্ত পরিবার। বাবা ভ্যান রিকশা চালাত।সম্প্রতি টোটো চালাচ্ছে। নিজস্ব টোটো নয় অবশ্য, মালিকের হাতে  দৈনিক রোজগারের একটা অংশ তুলে দেওয়ার বিনিময়ে চালাতে পারছে।আর জবার মা কাজ করে ওদের বস্তির কাছর এক আবাসনের কয়েকটা ফ্ল্যাটে, জবাও ওই একই আবাসনে কাজ নিয়েছিল সম্প্রতি। অভাবের দরুন ক্লাস নাইনের পরে আর পড়াশুনা চালাতে পারেনি।ঘটনার দিন  কাজ সেরে বেরোতে বেরোতে ওর রাত হয়ে গিয়েছিল।শর্টকাট পথে রেললাইনের পাশের রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছিল জবা আর তখনই...। 

“তুমি ছেলেগুলোকে চিনতে কি আগে থেকে?” জিজ্ঞেস করেছিল সেমন্তী । 

জবাবে জবা বলেছিল, “হ্যাঁ দিদি ছেলেগুলো মুখচেনা।পথেঘাটে মাঝেমধ্যেই বিরক্ত করত আমাকে, একবার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু আমি চিৎকার করায় পালিয়েছিল। এবার কোনো সুযোগ না দিয়ে প্রথমেই ওরা আমার মুখের ভেতর রুমাল গুঁজে দিয়ে...”

“বেশ, আর বলতে হবে না ।” সেমন্তী জবাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, “একদম ভয় পাবে না, আমি আছি তো তোমার সঙ্গে...তুমি শুধু চিনিয়ে দেবে ছেলেগুলোকে, কেমন ?”

“ঠিক আছে দিদি ।“

 

গোডাউনের ধারেই ছোট্ট এক চালাঘর।বেঞ্চে বসে তিনটে ছেলে  গুলতানি করছে। সেমন্তী বাইকের গতি ধীরে ধীরে কমিয়ে এনে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল ঠেকের ঠিক সামনে। পরমুহূর্তেই বন্ধ করে দিল বাইকের ইঞ্জিন এবং তারপর স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করে ইচ্ছাকৃত ব্যর্থ হতে থাকে  বারকয়েক। ইতিমধ্যেই জবা কনফার্ম করেছে, “এরাই দিদি ।”

সেমন্তী বাইক স্ট্যান্ডে দাঁড় করাতে না করাতেই বেঞ্চ থেকে উঠে গুটিগুটি  পায়ে ছেলেগুলো সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন জবার মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠল, “তু ফির আ গয়ী মেরে বুলবুল! তু হি না ওহ দিন...ফির তু ! ক্যা খুশ নেহি হুই...?”

অবাঙালি ছেলেটা আর কথা বলার সুযোগ পেল না, তার নাক আর মুখের সংযোগস্থলে যে বজ্রকঠিন ডানহাতের পাঞ্চ গিয়ে পড়ল, তার ধাক্কায় সে ধরাশায়ী হল মুহূর্তে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট-হোল্ডার সেমন্তীর বাঁ পায়ের দুরন্ত কিক গিয়ে লাগল ছেলেটার তলপেটে। গলা দিয়ে সামান্য গোঙানির আওয়াজ বেরোনোর পর দাঁড়ানো অবস্থা থেকে  একেবারে চিত হয়ে পড়ে গেল সে।

হিংস্র দৃষ্টি মেলে সেমন্তীর মুখের দিকে তাকাল অন্য দু'জন । শক্তিশালী বিপক্ষকে যে আর উপেক্ষা করা যাবে না, এ কথাটা  বুঝতে পেরে ওই দু'জনের একজন    নিজের কোমর থেকে টান মেরে বেল্ট খুলে ফেলে ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটে এল।দ্রুত পাশে সরে গিয়ে সেমন্তী পুরো একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে বাঁ পায়ের উপর নিজের শরীরের ভার রেখে  আক্রমণকারীর মুখমণ্ডলে ডান পায়ের ভারী বুটের প্রচণ্ড আঘাত হানল। কাটা কলাগাছের মতো শুয়ে পড়ল সে মাটিতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই। 

যারা ক্যারাটে জানে, তাদের বোধহয় মাথার পেছনে আর দু'পাশে একটা করে চোখ থাকে। তাই, ছুরি-হাতে পাশ থেকে কোণাকুণি ধেয়ে আসা তৃতীয় জনের লাইন থেকে চোখের পলকে সরে গিয়ে সেমন্তী রক্ষা করল নিজেকে এবং ছেলেটি ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র উদ্যত রিভলভার বাড়িয়ে ধরে বলল, “তিন গুনব আমি, তার মধ্যে হাত থেকে ছুরি ফেলে না দিলে...এক...দুই...”

ছেলেটি ছুরি ফেলে দিয়ে তার মাথার উপরে দু'হাত তুলে ধরল । 

সেমন্তী চোখে চোখ রেখে কয়েক পা পিছিয়ে বাইক পর্যন্ত এসে আবার এগিয়ে গেল দ্রুত এবং হাতবদল করে ডানহাতে ব্যাটন নিয়ে সজোরে আঘাত করল ছেলেটির বাঁ হাঁটুতে, পরমুহূর্তে ডান হাঁটুতে। পরপর চলতেই থাকে মার। সেই মুহূর্তে সেমন্তীর চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মায়ের তিরিশ বছর আগের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ছবি, যা সে দেখেছিল খবরের কাগজের পাতায়। গোঙানির আওয়াজ বাড়তে বাড়তে যখন থেমে গেল একেবারে, তখন সেমন্তী  পড়ে থাকা অন্য দু'জনের হাঁটু আর ফিমার-বোন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল একই ভাবে । 

দেরি দেখে ইতিমধ্যে ও.সি চলে এসেছেন স্পটে । আঁতকে উঠে বললেন, “কী করছেন আপনি ম্যাডাম !”

“ঠিক যা যা করা উচিত, তাই তাই করছি । আপনি কি আমার কৈফিয়ত তলব...”

“কী বলছেন ম্যাডাম, আমি আপনার অধস্তন এক সরকারি কর্মচারী, আমি কি আপনাকে...!”  অস্বস্তিতে জিভ কাটেন ও.সি।

 “শুনুন আপনি...কান খুলে শুনুন, এখানেই শেষ নয়, এখান থেকেই শুরু... এমন ব্যবস্থা করব যে, জীবনে আর কোনো মেয়েকে কোনোদিন...”

“কিন্তু ম্যাডাম, মিডিয়া যদি...”

বাক্য শেষ করতে পারেন না ও.সি,  ফুঁসে ওঠে সেমন্তী, “আপনি মাথাভারী করছেন কেন বলুন তো মিস্টার জোয়ারদার ?  পুরো অপারেশনটা করলাম আমি নিজের হাতে, সবদিক সামলানোর দায়িত্বও আমার।আপনার করণীয় একটাই।”

“কী কাজ ম্যাডাম ? 

“ঠোঁটদুটোতে তালাচাবি লাগিয়ে রাখুন।আমি যখন প্রেসের লোকের সঙ্গে কথা বলব, তখন আপনি একটা কথাও বলবেন না, কেমন? হ্যাঁ, আর এই মুহূর্তে আপনার আর একটা কাজ আছে বটে, সরকারি হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ডাকিয়ে এনে এদেরকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।যদিও সারাজীবন খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারবে না, তবু তো বাঁচিয়ে তুলতে হবে ...না হলে, শাস্তি সম্পূর্ণ হবে না!” 


সরকারি বাংলোয় না গিয়ে সেমন্তী বহুদিন পর গেল মা-বাবার কাছে তাদের বালিগঞ্জের অ্যাপার্টমেন্টে।দরজা খুলে রাত দশটায় মেয়েকে সামনে দেখে সায়নজিৎ এতটাই চমকে উঠলেন যে, কথাই বেরোল না তাঁর মুখ থেকে। 

“আমি থাকতে এলাম বলে তুমি খুশি হলে না বাবা ?” সেমন্তীর কণ্ঠস্বরে অভিমান । 

“কেমন করে ভাবলি তুই মা!” আহত কণ্ঠে বলে ওঠেন সায়নজিৎ, “আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম...তুই তো না বলে-কয়ে এভাবে...ঠিক আছিস তো মা ?”

“ঠিক তো আছিই বাবা, আজ এমন একটা কাজ করেছি যে, তোমাদেরকে না জানালে রাতভর জেগে কাটাতে হত আমায় ।”

“আগে ধড়াচুড়ো খুলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে, তারপর...”

“কাল খবরের কাগজে বিস্তারিত পাবে, আমি দু'চার কথায় বলে নিয়ে ভার লাঘব করি।”

“বল, যা বলবি ।” 

“এই যে আমি বসলাম চেয়ারে, তুমি বোসো না বাবা সোফায়।” সেমন্তীর চোখেমুখে প্রশান্তি, “তিরিশ বছর আগে পুলিশ যে কাজ করেনি বা করতে পারেনি, সেই কাজ আমি করেছি কিছুসময় আগে...”

“কী কাজ?” উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর সায়নজিতের । 

“জঞ্জালসাফ করে সমাজ-সংস্কারের কাজ...one small foot step বাবা, তুমি আমায় আশীর্বাদ করো, যেন সমাজকে আমি এমন পরিষেবা দিয়ে যেতে পারি আজীবন।”

রেণুকা যে কখন পাশের ঘর থেকে এসে সেমন্তীর পেছনে দাঁড়িয়েছেন, দেখেনি সে । মাথায় মায়ের হাতের কোমল স্পর্শ পেয়ে পেছন ঘুরে সেমন্তী শিশুবেলার মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাকে । 


(এই গল্পের সব চরিত্রই কাল্পনিক।)


অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত



লেখক পরিচিতি






No comments:

Post a Comment