পুকুরের ধারে ইটের পাঁজাটার ওপর শুয়েছিল কালুয়া। বৈশাখের চড়া রোদে চারদিক ঝাঁ ঝাঁ করছে। এদিকটা ছায়া হলেও রোদের আঁচ এসে লাগছে। জিভ বার করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছিল ও। গরমে একটু আগে পানাপুকুরে পিছন ডুবিয়ে খানিকক্ষণ বসেছিল। এখন উঠে পড়াতে গা কুটকুট করছে। মুখ দিয়ে ল্যাজের গোড়াটা চুলকানোর চেষ্টা করছে মাঝে মাঝে, কিন্তু ঠিক ম্যানেজ করতে পারছে না। ওখানটায় কাল থেকে ব্যাথাও হয়ে আছে।
এটাই এ সময়ের রোজকার ঠেক কালুয়ার। সামনের দোতলা বাড়ির বারান্দাটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। দুপুরের দিকে ওখানে একবার না একবার মিরাণ্ডার দেখা মেলে। হালকা চালে একবার এসে ও বারান্দাটায় দাঁড়ায়। আনমনে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে, সামনের মাঠটার দিকে। কালুয়াকে পাত্তা দেয় না। তাতে কিছু যায় আসে না অবশ্যি, সয়ে গেছে। তবে এই সময়ে কালুয়া ওকে দূর থেকে দেখে। মিরান্ডার চলাফেরায় বেশ একটা ব্যাপার আছে। অনেকটা ওদের বাড়ির মেয়েটারই মত, বড় গাড়িটা থেকে নেমে যখন বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায় পিছন থেকে দেখেছে কালুয়া। মিরাণ্ডা যখন মাঠে আসে, তখনো ব্যাপারটা মিলিয়েছে, শালা এক্কেবারে সেম টু সেম।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কালুয়া টের পাচ্ছিল পেটের মধ্যে চিনচিনে খিদেটা একটু যেন মরে আসছিল। ও এটা কদিন ধরেই লক্ষ্য করেছে। মিরান্ডার কথা ভাবলে খিদেটাকে ম্যানেজ করা যায়। সেটাও অনেকক্ষণ ধরে। আর বারান্দা থেকে যদি একবার দর্শন মেলে তবে তো কথাই নেই, রাতটাই কাবার হয়ে যায়।
এমনিতে এসব নিয়ে ওর ভাবার কথাই নয়, ভাবতে হয়ওনি কখনো। কালুয়ার মা মুক্তির আমল থেকেই ওরা এপাড়ার রাজা। ওর খাবারে ভাগ বসাবে এমন মাই কা লাল এ পাড়ায় কেউ নেই। সকালে ও রবিনের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাজের ফাঁকে রবিন ওকে একটা হাফ পাউন্ড রুটি ঘুগনিতে ডুবিয়ে দিয়ে দেয়। এরপর গোটা পাড়ায় ও একটা চক্কর দিয়ে দুপুর দুপুর নাগাদ রাজাদের ভাতের হোটেলের পিছনে চলে যায়। তপনদা ওখানে রান্না করে। ওখানে ওর জন্য একটা কলাইয়ের বাটি রাখা আছে। সেই বাটিতে ভাত ডাল, কোনদিন মুরগির একটা হাড় দিয়ে দেয় তপনদা-ওর দুপুরের খাওয়া। বাকিদের তপনদা মাটিতেই দেয়। রাতের দিকে ও চলে যায় বাসস্ট্যান্ডের পাঞ্জাবি ধাবাটায়, ওখান থেকে গোটাকয়েক রুটি পাওয়াই যায়। এছাড়া তল্লাটের বাকি ফেকুদের ভাগ থেকেও দয়া করে একটু আধটু চেখে দেখে মাঝে মাঝে। যার থেকে খায় সে শালা ধন্য হয়ে যায়।
এক পা নুলো ম্যাচিস, ওর সাথে থাকে সারাক্ষন, সে বলে 'রেলা আছে তোমার ওস্তাদ'
-এ পাড়ার সব কুত্তিগুলো তোমার পেছনে ছোটে, লাগিয়ে দাও না একটার সাথে।
-চোপ বে, ঢ্যামনা, তুই কি বুঝবি গর্জে ওঠে কালুয়া।
-ওই ঘিয়েভাজা গুলোর সাথে আমি লাগাবো! আমার শালা আশনাই হবে, আশনাই বুঝিস? লাব বে, লাব।
-তাই গুরু তুমি ওই বিলাতিটার পিছনে ঘুরঘুর করো?
-বিলিতি তো কি হয়েছে বে? বিলিতি খুন আমারও বডিতে আছে জানিস? আমার মা মতি সাহেবের অ্যালসেশিয়ান এর সাথে শুয়ে ছিল।
-তা গুরু মিরাণ্ডা তো তোমায় পাত্তা টাত্তা বিশেষ,
এবার কালুয়া একটু চুপ মেরে যায়। সত্যিই সে অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছে মিরান্ডার সাথে একটু কথা বলার। সকালে বিকালে মিরান্ডা দুবার করে মাঠে আসে। ও পিছনে পিছনে ঘুরেছে। কিন্তু শালির হেবি দেমাক। বেশি কাছে যেতে চেয়েছিল একদিন। একটা চাপা গরগর শুনেছে আর সোনালী ল্যাজের ঝাপটা খেয়েছে। শালা ল্যাজে কি সুন্দর গন্ধ, কি দিয়ে চান করে কে জানে! যাইহোক, ব্যাপারটা যে খুব একটা জমছে না এটা কালুয়াও বোঝে, তাও, ওই যে গন্ধ, মাতাল মাতাল লাগে।
মিরান্ডার বাড়ির লোকেরা ওকে যে তেমন কিছু বলে এমনটা নয়। তা সে, এ পাড়ার সবাই ওকে একটু সমীহই করে। ওর দলটার জন্য রাতে পাড়ায় চোর ছ্যাঁচোর ঢুকতে পারে না। রবীন তো পয়সার বাক্স নিয়েই দোকানে ঘুমোয়। রাতের দিকে কালুয়া মাঝে মাঝে দোকানের সামনে গিয়ে বসে। পেচ্ছাপ করতে উঠে কালুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রবিন।
এমনিতে থাকা খাওয়া নিয়ে কোনো ল্যাঠাই ছিল না। দাদাগিরি করে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। এক ওই মিরান্ডার কাঁটাটাই মাঝে মাঝে খচখচ করত। লাফড়াটা শুরু হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকে। প্রথম প্রথম দেখে পাড়ার লোক গুলো সব মুখে মুখোশ পরে ঘুরছে। কারো কারো হাতে গ্লাভস, সবাই দূরে দূরে দাঁড়িয়ে। এই কদিন আগে ও পাড়ার বান্টিকে সন্ধ্যেবেলা গলির মুখে, মুখুজ্যেদের দেবলীনাকে অন্ধকারে চুমু খেতে দেখেছে। আর সেদিন দেখে দুজনে তিন হাত দূর থেকে মুখোশের ভেতর দিয়ে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ছে। আজব ব্যাপার! এরমধ্যে ইস্কুল বন্ধ হয়ে গেল। মাঠে ছেলেগুলো খেলতে আসত। আর আসে না। তারপর একদিন পুলিশের সাদা গাড়িটা এসে বলে গেল দোকান-বাজার বন্ধ। লকডাউন কথাটা কালুয়া প্রথমে ভালো বুঝতে পারেনি। ভেবেছে ওই এক দিনের বন্ধ্ যেমন হয় আরকি, লোকে লুকিয়ে লুকিয়ে বাজার দোকান ঠিকই খুলবে। কিন্তু দেখল এবার সে ভুল ভেবেছিল। ভুলটা ভাঙলো যখন দেখে রবিন বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাস রাস্তা ধরে হাঁটছে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। অনেকক্ষণ ওর পিছনে হেঁটেছে কালুয়া। শেষমেষ রবিন ওকে ঢিল মেরে তাড়িয়েছে। বলেছে 'আমি বাড়ি চললাম রে হতভাগা, তুই তোর বাড়ি যা।
একে একে সব দোকান বন্ধ হল। ওষুধের দোকান শুধু খোলা, ওখানে ঘুরাঘুরি করতে গিয়ে শুনেছে, কি একটা রোগ হচ্ছে সবার। ছড়িয়ে পড়ছে তাড়াতাড়ি। লোক মরছে অনেক। আর যমে যদি বা নিচ্ছে, ডোমে নিচ্ছে না। পুলিশ বডি গায়েব করে দিচ্ছে। জ্বর কাশি হলেই ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখছে জেলখানার মতো হাসপাতলে।
ক'দিন ধরে তাই খাবার জুটছে না কালুয়ার। যে কদিন মিষ্টির দোকান খোলা ছিল অল্প কিছু জুটেছে। কিন্তু লোকে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে কই; সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির দিকে ছুটছে। রাজাদের হোটেল বন্ধ। হোটেলের পিছনে একটা নালার ধরে অনেক সময় খাবারের টুকরো পড়ে থাকে। সেখানে খুঁজতে গিয়ে দেখে একটা বউ, সেও খুঁজছে। একটু দাঁত বার করলেই তাড়িয়ে দেওয়া যেত, তাই করতেই গিয়েছিল, বউটা ওর দিকে ফিরতেই দেখে কোলে একটা বাচ্চা। ও সরে পড়েছিল ওখান থেকে। আরেকদিন গিয়েছিল বাংলার ঠেকের পিছনটায়। সন্ধ্যেবেলা ওখানে মাঝে মাঝে ঝাঁপ তুলে হারিকেনের আলোয় বোতল বদল হতে দেখেছে। এমনিতে বাংলার ঠেকের দিকে ও যায় না। ঝাল মাংস চাট এসবের লোভ থাকলেও ওই গন্ধটা ওর সহ্য হয়না। কিন্তু সেদিন কিছুটা নাচার হয়েই গেল। পিছনটায় দুটো লোক বসে ছিল, কোঁচড় থেকে মুড়ি বার করে ওকে দিল। খেতেই গা গুলিয়ে উঠে ছিল ওর। চুল্লুতে ভেজানো মুড়ি।
সেই থেকে ও এই একটা ভালো কায়দা পেয়েছে। দুপুরবেলায় এখানটা শুয়ে থাকে। শরীরটা অবসন্ন লাগে প্রথমে প্রথমে, একটা ঘোরের মতন। তারপর মিরান্ডা বারান্দায় আসে, না আসলেও ওর কথা ভাবতে থাকে, ঘোরটা গাঢ় হয়, খিদেটা ক্রমশ মরে যেতে থাকে। কাল অবশ্যি এই মৌতাতে কিছুটা তাল কেটেছিল। মিরান্ডাদের পাশের বাড়ির মনোজকে দেখে ব্যাগে করে কি একটা নিয়ে যাচ্ছে। মাংসের গন্ধ পেয়ে পিছনে পিছনে শুঁকতে গিয়েছিল। শালা একটা আধলা ইট ছুড়ে মেরেছে ওর দিকে। পিছনে এসে লেগেছে। অন্য সময় হলে কালুয়া ওর পা থেকে মাংস খুবলে নিত। কিন্তু কাল আরো কেস খেলো ও যখন মুখ তুলে দেখে বারান্দায় মিরান্ডা দাঁড়িয়ে। চুপচাপ ওখান থেকে সরে পড়েছিল ও।
আজ তাই খিদেটা একটু বেশি চাগাড় দিয়ে উঠছিল। পিছনটাও ব্যথা; মেজাজটাই খিঁচড়ে আছে ওর। আজ আর আসবে না ভেবে উঠতেই যাচ্ছিল; এমন সময় দেখে বারান্দায় মিরান্ডা। সেই হিরোইনের মত চাল, একটা মাতাল করা ব্যাপার। কিন্তু আজ একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। মুখ তুলে দেখে, মিরান্ডা রোজকার মত অন্যদিকে তাকিয়ে নেই। সে ওরই দিকে স্পষ্ট তাকিয়ে। ডাকছে ওকে চোখের ইশারায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল কালুয়ার। চামড়ায় দাঁত দিয়ে চিমটি কাটল একবার। নাহ্, কোন ভুল নেই। ওকেই ডাকছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বারান্দার নিচেটায় গিয়ে দাঁড়ালো কালুয়া। মিরাণ্ডা বারান্দা থেকে একবার পর্দাঘেরা ঘরটার মধ্যে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এলো। ঘাড় তুলে তাকিয়ে কালুয়া দেখে মিরান্ডার মুখে একটা বড় রুটির টুকরো। মাঝখানে নিশ্চয়ই মাংস আছে। আস্তে আস্তে বারান্দার ধারে এসে দাঁড়ালো মিরান্ডা। সেই গরবিনী হাঁটা। কালুয়া মুখ তুলে দেখল-উঁচুতে-, অনেক উঁচুতে। ঘাড়ে যেন সামান্য চিনচিনে ব্যাথা লাগছে ওর। মাংস শুদ্ধু রুটির টুকরোটা ওপর থেকে পড়ছে-পড়ছে... পড়ছে।
রুটিটা, মাংসটা শুঁকলো একবার কালুয়া। খেতেও গেল। কেমন যেন বমি আসছে ওর। একটা অস্বস্তি পেটের ভিতর থেকে গুলিয়ে উঠছে। বেরিয়ে আসতে চাইছে ভেতর থেকে। রাগ? হবে হয়তো। ঘেন্না? হবেও বা। মাথাটা ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। খুব চেঁচালো ও। লাল পড়ছে। ওপর দিকে একবারও না তাকিয়ে পিছন ফিরে হাঁটা লাগালো ও।
দারুণ লাগল।
ReplyDeleteধন্যবাদ
DeleteKhub sundar
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো। অন্যরকম মেজাজ পেলাম।
ReplyDelete