গল্পঃ কো মাইয়া - পল্লবী গুহ সাহা


 

কোচ রাজ্যের অন্তর্গত একটা লোকালয়ের নাম দিনবাজার, যে এলাকা বর্তমানে নর্থবেঙ্গলের অন্তর্গত । আড়াইশো তিনশো বছর আগেও দিনবাজারে ক্রীতদাস বিক্রি হতো। এসব ক্রীতদাস আসত দিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ, মুঙ্গের, গোলকন্ডা এসব জায়গা থেকে।সমাজের বিত্তশালী লোকেরা নানাভাবে ক্রীতদাসদের ব্যবহার করতো।অনেক ধনী মনস্কামনা পূরণ করতে বিশেষ তিথিতে নরবলি দিত ক্রীতদাস কিনে।তবে সেটা হত লোকচক্ষুর আড়ালে।

 

এইরকম সামাজিক অবস্থায় ঐ এলাকায় বেড়ে ওঠা দুটি তরুণ তরুণীর নাম নীলাদ্রি বনিক এবং ছবি বালা রায়চৌধুরী।  তাদের মধ্যে ছিল বিস্তর সামাজিক ব্যবধান। নীলাদ্রি ছিল এক ছোট ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র পুত্র সন্তান,যে জন্মের সময়ই তার মাকে হারিয়েছিল। আর ছবি দেবী ছিল ধনী জমিদার পরিবারের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বেড়ে ওঠা সর্বকনিষ্ঠ।

 

আঠারো বর্ষীয় নীলাদ্রি মাধাই কালি মেলায় মহিষ বলি দেখতে গিয়ে ফেরার সময়  প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়েছিল তার সঙ্গীদের সাথে। গরুর গাড়ি ঝড়ে আর এগোতে পারেনি। একটা বিরাট বাড়ির ঠাকুরদালানের চাতালের নিচে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাদের। গরুগুলোকে গাছের সাথে বেঁধে পাঁচ যুবক বন্ধু আশ্রয় নেয় ঠাকুরদালানের চাতালে। 

 

প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি আছড়ে পড়তে থাকে ধরিত্রীর উপর। চোখের সামনে মাঝখান থেকে ভেঙ্গে পড়ে দুটো সুপারি গাছ। দিনের বেলায় নেমে আসে অন্ধকার।বিদ্যুতের চমকানিতে চমকে উঠতে থাকে ধরাধাম। প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর রোষানলের মধ্যে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ঝুনঝুনি বাজিয়ে এগিয়ে আসে একটা ঘোড়ার গাড়ি। চাতালে আশ্রয় নেয়া ছেলেগুলোর নজর কেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বাড়ির সামনে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে চাতালে এতগুলি মানুষ দেখে একটু ঘাবড়ে যায় গাড়োয়ান। তবে ভদ্রস্থ কচি মুখগুলো দেখে আশ্বস্ত হলে একজনকে এগিয়ে আসার জন্য গাড়ি থেকে হাঁক ছাড়ে। এই বৃষ্টিতে কে আর ভিজতে চায়.. শেষে পরপোকারী নীলাদ্রিই  এগিয়ে যায়।একটা সাহেবী  ছাতা তার হাতে দিয়ে ঘোড়া সামলাতে গাড়িতে উঠে যায় গাড়োয়ান। দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসেন সাদা শাড়ি পরিহিতা একজন বয়স্কা মহিলা। নীলাদ্রি ঠাকুমাসুলভ মহিলাটিকে বাড়ির দরজায়  এগিয়ে দিয়ে আসে। আসবার সময় মহিলাটি নীলাদ্রিকে উদ্দেশ করে বলেন, "বাছারে আরেকজন আছে গাড়িতে। একটু সামলাইয়া লইয়া আহো... বড়ই ছেলেমানুষ"। বৃষ্টিতে স্নান করে ওঠা নীলাদ্রি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। তবে দ্বিতীয় বার গাড়ি থেকে যিনি নামেন তিনি কোন বয়স্ক মহিলা নন। সাদা কুচি দেওয়া ব্লাউজ, বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিহিতা কিশোরী। এই কিশোরীই আমাদের গল্পের ছবি রায়চৌধুরী।গাড়ি থেকে নামার সময় হঠাৎ মেঘ গর্জনের কানফাটা শব্দে ঘোড়াগুলি ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। গাড়িটি নড়ে যায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে নীলাদ্রি তাকে ধরে ফেলে, আর পড়ে যাওয়ার হাত থেকে  সামলে নেয়। এমত অবস্থায় নবযৌবনে  উদ্ভাসিত দুটি প্রাণের দ্বার উন্মুক্ত করে ঢুকে পরে দেবী আফ্রোদিতির প্রেমবান। সকলের অলক্ষ্যে দু'জনেই বন্দী হয়ে যায় দুজনার মনিকোঠায় ।

 

দিন সাতেক ঘুরতে না ঘুরতেই নীলাদ্রি আবার মধুভৃৎ এর ন্যায় সেই বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয়। দেখে আরো কিছু সম ও অসম বয়সি বালিকার সাথে ছবি কুলমাখা ভাগ করে খাচ্ছে, আর হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। এত সহজেই দেখা পেয়ে যাবে নীলাদ্রি ভাবতেও পারেনি। গ্রামের সহজ সরল ছেলে নীলাদ্রি সেদিন ভালোভাবে ছবির দিকে তাকাতে  পারেনি। তবে  দিনের আলোয় ছবির লক্ষ্মী প্রতিমার মত রুপ, দুধেআলতা গায়ের রং দেখে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় ছবি দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়।কয়েকদিনের মধ্যে নীলাদ্রি তার বন্ধুদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সেই বাড়ির সবচেয়ে আদরের ছোটমেয়ে ছবি, আর রায়চৌধুরী পরিবার ছিল  দিনবাজারের সবচেয়ে ধনী পরিবারের একটি। নীলাদ্রি চিন্তায় পড়ে যায় কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। দিবস-রজনী নয়নে শুধু ছবির'ই প্রতিচ্ছবি ঘোরাফেরা করতে থাকে। নীলাদ্রির বাবা দরিদ্র না হলেও রায়চৌধুরী পরিবারের সমকক্ষও নয়। রায়চৌধুরীরা ক্ষত্রিয়, আর নীলাদ্রিরা সাধারণ বণিক সম্প্রদায়। 

 

তবে ঈশ্বরের ইচ্ছে শুধু তিনিই জানতেন। কালাচাঁদ মন্দিরে নতুন বছরে ঠাকুরকে পূজো দেবার জন্য ঠাকুমার সাথে ছবি উপস্থিত হলে সেখানেই  প্রতিবছরের ন্যায় ঠাকুরের পায়ে নতুন হালখাতা ঠেকাতে উপস্থিত ছিল নীলাদ্রি এবং তার বাবা। গ্রামীণ উচ্চ সম্প্রদায়ের ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়েছিল তারা। পুজো দিয়ে ফেরার সময় আবারও দেখা হয় দুটিতে। তবে এইবার প্রসাদ দেওয়ার নাম করে ছবি এগিয়ে আসে নীলাদ্রির দিকে এবং হাতে তুলে দেয় দুটো নারকেলের সন্দেশ।আর ফিসফিসিয়ে বলে ‘কাঁঠালিচাঁপা ঘাট বিকেলে’।

 

এভাবে দৃঢ় হয় তাদের ভালোবাসা এবং গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে দিনের পর দিন। কিন্তু সুখ যে বেশি দিন সবার কপালে স্থায়ী হয় না।ওদের জীবনেও নেমে আসে দুঃখের তামসরাত্রি।এক চতুর কাকিমার সন্দেহের পাত্রী হয়ে বসে ছবি এবং সেই সন্দেহ কাটাতে একদিন ছবির পিছু নেয় সে। যখন ছবি এবং নীলাদ্রি ঘনঝোপে আবৃত কাঠলিচাঁপা গাছের পেছনে পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ শিকারি বিড়ালের ন্যায় সন্তর্পনে ধীরে ধীরে পা ফেলে পথ অনুসরণ করে এসে সেই  ঘনিষ্ঠ দৃশ্য চোখে পড়ে যায়  তার। আর খুব অল্প সময়েই কথাটি ছড়িয়ে পড়ে বাড়ির পুরুষদের মধ্যে। বাবা কাকা সবাই ক্রোধোন্মত্ত হয়ে ওঠে। কি করে সাহস হয় এক ক্ষুদ্র বেনের ছেলের তাদের মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকানোর।

 

ছবিকে ঘরে বন্দি করা হয়। আর নীলাদ্রিকে তার বাড়ি থেকে লেঠেল দিয়ে তুলে নিয়ে আসা হয় রাতে। তার বাবা অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারেনি।ঘটনার আকস্মিকতায় আর ভয়ে নীলাদ্রী জ্ঞান হারায়।যখন জ্ঞান ফেরে চোখ খুলে দেখে, গভীর জঙ্গলের ভেতর একটা কালী মন্দিরের সামনে  কতগুলো মশাল জ্বলছে। আর তার সামনে জনা বিশেক ভয়ঙ্কর  চেহারার অর্ধউলঙ্গ পুরুষ  কপালে তিলক কাটা, হাতে লাঠি নিয়ে  পায়চারি করছে। গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত এক পূজারী মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। সারা শরীর যন্ত্রনায় কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে নীলাদ্রির। দুজন ষন্ডামার্কা লোক তাকে তুলে পাশের নদীতে চুবিয়ে নিয়ে, নতুন সাদা ধুতি পরিয়ে গলায় জবা ফুলের মালা ও সিঁদুরের তিলক কেটে দেয় কপালে। আর হাতে ধরিয়ে দেয় একটা জলের পাত্র। প্রচন্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল নীলাদ্রির। পাত্রটি হাতে পেয়ে ঢকঢক করে সম্পূর্ণ জলটুকু খেয়ে নেয় সে। শেষ করার পর বুঝতে পারে এটা শুধু জল ছিল না, তার মধ্যে মিশেছিল নানা ধরনের জরিবুটি ও কর্পূর। বিকট হেসে ওঠে সকলে। নীলাদ্রি ঘাবড়ে যায় তেলসিঁদুরে চকচকে সামনের  হাড়িকাঠটি দেখে। তার আর বুঝতে বাকি থাকে না কী হতে চলেছে। আকাশে চাঁদ নেই, চারিদিকে নিঃসীম  অন্ধকার। মনের মধ্যে ছবির মায়াভরা মুখ।মাথাটা টলে যায় নীলাদ্রীর।

 

ঠাকুমা ঘরে আটক ছবিকে খাবার দিতে এসে দেখে কাঁদতে কাঁদতে অর্ধচেতন হয়ে ছবি শুয়ে আছে বিছানায়। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে ‘কে? কে? নীল? নীল এসেছ?’ ঠাকুমা ছবিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে সে আর আসবে না রে! আজ যে অমাবস্যা, রাকানি তিথি।পরের জন্মে তোর উপযুক্ত হয়ে ফিরে আসবে দেখিস। ছবি দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মাটিতে, আর ওদিকে গভীর জঙ্গলে বলি হয় নীলাদ্রি বনিক।

 

 (২)

এয়ারপোর্টে অপেক্ষারত লেখন নিজের ল্যাপটপে কিছু অফিশিয়াল মেইল চেক করছিলো। হঠাৎ একটা উত্তেজিত মেয়েলি কন্ঠস্বর।কাকে যেন বকছে বলে মনে হতে, চোখ তুলে দেখে একজন মোটাসোটা মহিলা একটা মেয়েকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লেখনের সামনে থেকে। বাবা বলেন "অনেকক্ষণ থেকে বাচ্চা মেয়েটি তোর দিকে তাকিয়েছিল.. কি মিষ্টি  মুখখানা"। লেখন তা দেখতে পায়নি। অফিসের কাজে এতই ব্যস্ত থাকে সে যে বাবা-মাকেই সময় দিতে পারে না। এবার মায়ের আবদারে ঘুরতে রাজি হয়েছে  লেখন চৌধুরী, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, দিল্লির নামি এক ফার্মে কর্মরত ত্রিশ বর্ষীয় ব্যাচেলার।

 

ছুটি কাটাবার জন্য একটা শান্তশিষ্ট নিরিবিলি জায়গা পছন্দের তালিকায় ছিল তাদের। তাই নর্থ বেঙ্গলের অফবিট জায়গায় তারা রিসোর্ট বুক করেছিল। রিসোর্টে ঢুকতেই পার্কিংয়ের জায়গায় একটা ছোট্ট দুর্গা মন্দির। রিসোর্টটি কোন বনবাংলো নয়।তবে একটা পুরনো জমিদারবাড়ি-টাইপ যেটাকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে পুরনো নকশা বজায় রেখেই।

 

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয় গেলে লেখন কেয়ারটেকার-কাম-গাইড বুধিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখার জন্য।বুধিয়া তাকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে ওঠে একটা পুরনো কালিমন্দিরে। মন্দিরটি প্রাচীন।মন্দিরের সামনে  একটা  গোল পাকা বেদী।বুধিয়া জানায় আগে এখানে নরবলি হতো । এখনও কেউ কেউ মানতের পাঠা বলি দিয়ে যায়।

 

লেখন চারিদিক ভালো করে দেখতে থাকে। তার বারবার মনে হতে থাকে এই জায়গা তার খুবই পরিচিত। কিন্তু কোন যোগসূত্র খুঁজে পায় না, কারণ সে কলকাতার মানুষ,চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে গেছে অনেকদিন।নর্থ বেঙ্গল এর সাথে কোন যোগাযোগই নেই।দিনবাজার জায়গাটা তার বাবাই নেট ঘেটে বের করেছিল ঘুরতে যাবার জন্য। এখানে আসার পর থেকে লেখন যাই দেখছে,মনে হচ্ছে খুব চেনা।

বিশেষ করে এই  মন্দিরে আসার পর, যেন কতকাল কাটিয়েছে সে এখানে।

 

বুধিয়া লেখনের বয়সেরই। সে বাপঠাকুর্রদার কাছ থেকে শোনা দিনবাজারের পুরাতন কাহিনী শোনাতে শুরু করে লেখনকে। লেখন চুপচাপ সেসব শুনতে থাকে ।তখনই আর একজন কেয়ারটেকার এর সঙ্গে আরেকটা  টুরিস্ট পরিবার এসে উপস্থিত হয় মন্দিরে। সেই পরিবারটি হল, এয়ারপোর্টে যে মহিলাকে লেখন একটা বাচ্চামেয়েকে বকতে  দেখেছিল তাঁরাই। এভাবে একই জায়গায় দেখা হয়ে যাবে তাঁরা কেউই ভাবতে পারেনি।আলাপ-পরিচয়ের পর সবাই মন্দিরের বাইরে বাঁধানো চাতালে বসে বুধিয়ার গল্প শুনতে থাকে।হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া ওঠে।

 

সবাই যখন প্রকৃতির তান্ডব দেখতে ব্যস্ত বাচ্চা মেয়েটি লেখনের পাশে এসে বসে এবং  গভীরভাবে দেখতে থাকে লেখনকে।লেখন একটু অন্যমনষ্ক ছিল।মেয়েটি কখন এসে তার পাশে বসেছে খেয়ালই করেনি সে। "দেখ দেখ মেয়ের কান্ড" বলে তার মা হেসে উঠলে লেখন চমকে পাশে তাকিয়ে দেখে সেই বাচ্চা মেয়েটিকে।তার চোখ দুটো যেন আটকে যায়।এই মুহূর্ত তার বহুদিনের চেনা।সেই চেনা মুখ, সেই চোখ যা আগেও তার পাশে বসে থেকেছে অনন্ত সময় ধরে। কিন্তু কোথায়? কিছুতেই মনে করতে পারেনা লেখন।

বুধিয়া সকলকে কালীমন্দিরের নরবলির কাহিনী শোনাচ্ছিল। শেষ বলি হয়েছিল  সতেরো আঠারো বছরের এক ছেলে। আর ওই যে দেখছেন সামনে বেদিটা, ওখানে তাকে বলি দেওয়া হয়েছিল। লেখনের  কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। অস্বস্তি বোধ হতে থাকে তার। 

 

ঝড়ের গতিবেগ বেড়ে যায়। লেখন খেয়াল করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে  বাচ্চা মেয়েটা। তার গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা । হয়তো ভয় পেয়েছে, তাই ভেবে মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার মাথা স্পর্শ করতেই লেখন যেন ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে চমকে ওঠে । এই স্পর্শ লেখনের জন্মজন্মান্তরের পরিচিত। কিন্তু একদমই অপরিচিত একটা বারো তের বছর বয়সী মেয়ে যাকে সে জীবনে কোনদিন চোখেই দেখেনি কি করে সম্ভব। মুচড়ে ওঠে লেখনের অন্তরাত্মা।কৌতুহল মেটাতে জিজ্ঞেস করে,`তোমার নাম কি’? কোন উত্তর মেলে না।মেয়েটির ব্যাকুল চাহনি লেখনের তিরিশ বছরের সমস্ত স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না কোন যোগসুত্র। পাশ থেকে  মেয়েটির মা  বলেন- ও বোবা কথা বলতে পারেনা। তবে খুব সুন্দর ছবি আঁকে, বিশ্বাসই করবেন না যে ওর  আঁকা। নূরী... এদিকে এসো বলে ডেকে ওঠেন মেয়েটির মা।

 

বাতাসের ঝাপটা কমে গেছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে।সবাই উঠে পড়তে উদ্যত। কিন্তু লেখন সেখানেই বসে থাকে। নূরীও শক্ত করে লেখনের হাত ধরে থাকে। ওদিকে লেখনের বাবা-মা রিসোর্টের গার্ড নিয়ে  চলে আসে ওদের খুঁজতে খুঁজতে মন্দিরে, পাছে কোন বিপদ ঘটে ঝড়ের কবলে পড়ে। বাবা-মাকে দেখে লেখন স্বাভাবিকতা ফিরে পেল, নূরীকে তার মায়ের হাতে  দিয়ে ফিরে আসতে পা বাড়ায়। পেছন ফিরে নূরী ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে ব্যাকুলভাবে "নীল... নীল.." বলে ডেকে ওঠে। নূরীর বাবা মা অবাক হয়ে যায়। এত বছর ধরে যে মেয়েটার মুখে বাবা মা ডাকটা পর্যন্ত শোনা যায়নি,  সে আজ নীল নীল বলে ডাকছে।হঠাৎ করে মরমর শব্দ তুলে সবাইকে চমকে দিয়ে বহু পুরাতন এক বিরাট বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মরা শিমুল গাছ মন্দিরের সামনের গোলাকৃতি পাকা জায়গাটার উপর  উপড়ে পড়ে। আর তার সাথে বলি দেওয়ার স্থান ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

 

১৪ বছর ১১ মাস বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল নূরী। তবে লেখন যে ছিল তার প্রাণভ্রমর তা বুঝতে বাকি ছিল না দুই পরিবারেরই। লেখনকে কিছুদিন না দেখতে পেলেই অসুস্থ হয়ে পড়তো সে। দুই পরিবারের মধ্যে তার ফলে একটি সম্পর্কের অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়। সারাদিন নানান ছবি আঁকতো নূরী, যেগুলোর মানে তার বাবা-মা উদ্ধার করতে পারেনি কোনদিন। লেখনকে দিল্লী থেকে বারবার ছুটে আসতে হতো নর্থবেঙ্গলে নূরীদের বাড়ি। কারণ তাকে  সুস্থ করতে সেটাই ছিল একমাত্র ওষুধ।  অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোন সুরাহা হয়নি। ফ্যাকাশে মুখখানি লেখনকে দেখার সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠত।লেখন কেন ছুটে আসতো তা সে নিজেও জানে না। নূরীর বাবা-মাও বাধা দেবার কারণ খুঁজে পায়নি।কারণ লেখনের সাথে তাদের বোবা অসুস্থ মেয়ের এই সম্পর্ককে কোনভাবেই কালিমালিপ্ত করা যায় না। তবে লেখনের মায়ের অনেক দুশ্চিন্তা হতো লেখনের জন্য, তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে।লেখনকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টাও করেছে তার বাবা, সে যেন নূরীকে  তার ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়। 

 

তবে লেখন ছুটে যেত শুধুই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। চেনা অচেনার বৃত্তে গোলকধাঁধার মত নূরী হাজারটা প্রশ্নের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকতো। নূরীও কিছুই বলতে পারতো না, তার মধ্যে কি রহস্য নিহিত আছে। তবে যখন লেখনকে অনেক দিন পর দেখতো, নীল.. নীল বলে ডাকত আর খিলখিলিয়ে হাসত। দু’পক্ষের বাবা-মা এই সরল নিষ্পাপ ভালোবাসার দৃশ্যের সাক্ষী এবং তারা সকলেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন এটাকে পূর্বজন্মের সম্পর্ক বলে।

 

যেদিন শেষরাতে নূরী চলে  যায়, সেইবার  এক অফিশিয়াল কনফারেন্সে ব্যস্ত থাকার দরুণ লেখন আসবে বলেও আসতে পারেনি। রাতে স্বপ্নের মধ্যে লেখন স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল নূরীকে। একটা  কুচি দেওয়া সাদা ব্লাউজ আর বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে হেঁটে চলে যাচ্ছে সে। পরের দিন ভোরে নূরীর মা লেখনকে ফোন করে জানায়, তাকে আর কষ্ট করতে হবে না নূরীর জন্য, সে এখন সকল সুখদুঃখের ওপারে।

 

লেখনের জন্য একটা আঁকার খাতা রেখে গিয়েছিল নূরী। লেখন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই আঁকার খাতাটা বুকে আগলে রেখেছিল। মনের অতৃপ্তি এবং নানান  প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একচল্লিশ বছর বয়সে হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে লেখন পাকাপাকিভাবে চলে আসে নর্থ বেঙ্গলে।দিনবাজার এলাকায় একটা বাড়ি তৈরি করে, নূরীর খাতায় আঁকা একটা বাড়ির ছবির আদলে। 

 

খাতাটা বাঁধাই করে একটা সুন্দর নামও রেখেছিল সে "কো মাইয়া"। সেখানকার দেশীয় ভাষায় যার মানে ‘কোথায় মেয়ে’ বা ‘কে সেই মেয়ে’?

 

অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত



লেখক পরিচিতি



পল্লবী গুহ সাহার কোচবিহার জেলার অন্তর্গত ছোট্ট শহর দিনহাটায় জন্ম ।নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে M.A পাস । বর্তমান বাসস্থান দিনহাটা।


No comments:

Post a Comment