নীল জরিপাড়ের আঁচলটা বেশ কায়দা করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে মেজোমাসি বলল – রুপাইকে দেখছি না? এখনও তৈরি হয়নি বুঝি?
ঠাকুরমশাইকে পুজোর জিনিস এগিয়ে দিতে দিতে মা বলল – না না, আজ বরং ওই আগে তৈরি হয়ে গেছে। ওপরে পাঠিয়েছি আরতির থালাটা নিয়ে আসতে।
পিসিমণির একটু দেরি হয়েছে। তবু দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই মেজোমাসির আঁচল জড়ানো আর মায়ের কথাটা দুটোই চোখে কানে লাগল। তাড়তাড়ি মায়ের পাশে বসে হাত দিয়ে ধুনোর ধোঁয়া সরাতে সরাতে বলল – তুই আর লোক পেলি না? সোনাইকে বললেই তো হতো! কথার সঙ্গে সঙ্গে ফরসা হাতের মোটা বালাটা ঝিকিয়ে উঠলো।
নলিনীদিদি মনে মনে একটা হুঁঃ বলল। সোনাইয়ের মোটেই ধোঁয়া সহ্য হয় না। সে তাই বাগানে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে। এখন ডাকলেও সাড়া পাওয়া যাবে না মোটেই। নেহাৎ রুপাইটা শান্ত....
ভাবনাটা শেষ হতে পেল না। সবাই চমকে উঠলো।
ঝন ঝন ঝন.........
সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে পিতলের ভারি দীপদানিটা। সিঁড়িময় ছড়িয়ে গেছে তেল, ফুল, থালা, আরও নানাবিধ হাবিজাবি। আর সিঁড়ির মুখটায় অপরাধীর মতো ছোট্ট মুখটা আরো ছোটো করে দাঁড়িয়ে আছে রুপাই। তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ ছাড়িয়ে ফুটে উঠেছে ভীত হরিণের আর্তি। সে জানে এখুনি শুরু হবে...
হলোও তাই। মায়ের চিৎকারে নীচের হলটা গমগমিয়ে উঠল _ হে ভগবান! এটুকু কাজও করে উঠতে পারলি না! আমারই ভুল। সোনাইকে বললেই হতো। সাজানো একটা থালা নিয়ে আসা – তোর দ্বারা কি কিছুই হবে না?
এতক্ষণ অধোবদনে বকুনি শুনছিল রুপাই। শেষ কথাটায় কেমন যেন চমকে উঠলো। ফ্যাকাশে মুখে পা টেনে টেনে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। পায়ের ওপর ভারি দীপদানটা পড়ে ছোট্ট পায়ের পাতাটা নীল হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য এক যন্ত্রণায় ওর মুখটা এখন তার চেয়েও নীল।
কিছুই পারে না সে! তার দ্বারা ‘কিস্যু’ হবে না। থালাটা দু হাতে ধরে খুব সাবধানেই তো আসছিল রুপাই, হঠাৎ ঘাগরায় পা আটকে গেল বলেই তো...
আসলে যমজ মেয়েদের একইরকম পোষাক পরায় মা। সোনাই একটু লম্বা বলে ওর ফিট হয়ে যায়, কিন্তু রুপাই বেঁটে বলে, বড়ো ঝুলের ড্রেসে ওর একটু অসুবিধে হয়। মা বলেছিল পুজোর পরে তলাটা মুড়ে দেবে। তবে এখন এসব বলে লাভ নেই, সেটা এই দীর্ঘ বারো বছরে তার ভালোভাবেই জানা হয়ে গেছে। নীচে পুজোর ফাঁকে ফাঁকে তার এমন নানাবিধ কাণ্ড নিয়ে বড়োদের হাসাহাসি চলছে, সেটা সে ভালোই জানে। বন্ধ দরজার পার করেও তার আওয়াজ এপারে এসে পৌঁছাচ্ছে বৈ কি!
আর হাসবেই তো! রুপাই যে কিচ্ছু পারে না। ক্লাসে পড়া দিতে গিয়ে কবিতার লাইন ভুলে যায়। একটা শক্ত অঙ্ক গোটাগুটি করে ফেলার পরে দেখা যায় মাঝখানে কোথায় যেন সাতে পাঁচে পনেরো হয়ে গেছে। দেখে শুনে দিদিমণি হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে – নাঃ, তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না।
সোনাই বেশ চটপটে। সে ঝরঝরিয়ে ছড়া বলে, তরতরিয়ে অঙ্ক করে, আবার নতুন আলাপেই সবার সঙ্গে টরটরিয়ে কথা বলে। রুপাইয়ের মতো নলিনীদিদি পিছনে লুকোয় না মোটেই। এ বাড়িতে রুপাইয়ের একমাত্র সহায় বা আশ্রয় তো ওই নলিনীদিদিই। একমাত্র সেই বলে তুই সব পারিস। শুধু ভয় পাস বলেই তো এসব হয়।
সোনাইয়ের জন্য রুপাইয়ের মনেও অনেকটা ভালোবাসা আর গর্ব জমা হয়ে আছে। তাই যখন মেজোমাসি সোনাইকে বড়ো আর রুপাইকে ছোট প্যাকেটে উপহার দেয় তখন তার একটুও খারাপ লাগলেও সেটা বেশিক্ষণ মনে রাখে না। পিসিমণি সোনাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় যখন, রুপাইও পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে শোনে। কিন্তু সব কথার শেষে একটা কথাই অবধারিত ভাবে এসে পড়ে – যমজ দুই বোনে এত তফাত যে কেন? আর এভাবেই যদি সব চলে তাহলে রুপাইটার যে কি হবে....
ঠিক তক্ষুণি রুপাইয়ের বুকের ওপর একটা বরফ ঠাণ্ডা হাতের চাপ পড়ে। দমবন্ধ হয়ে আসে। রুপাই দৌড়ে ওর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। চাপ চাপ অন্ধকার তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে। আর দেয়াল থেকে, খাট থেকে, পড়ার টেবিল থেকে ফিসফিসে শব্দেরা উঠে আসে – তোর দ্বার কিচ্ছু হবে না। তোর দ্বারা... পরতে পরতে শব্দেরা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না রুপাই নীল হয়ে কেঁদে ওঠে। তারপর এক নিস্তব্ধ আঁধার। যতক্ষণ না নলিনীদিদি আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত রুপাই প্রাণপণে খাটের মধ্যে মিশে যাতে থাকে। বিছানার চাদরের আলপনার একটা আঁচড় হয়ে যেতে চায়।
রোজ একটু করে তলিয়ে যেতে থাকে রুপাই। যতো বড়ো হচ্ছে কান্না কমে আসছে। বাড়ছে জেদ আর একগুঁয়েমি। অকারণে রাগ করে, ভাতের থালা ঠেলে উঠে যায়। রোজ রোজ ঝামেলা। সোনাইও আজকাল বিশেষ কাছে আসে না। বাবা, মা বন্ধু এদের সঙ্গেই থাকতে ভালো লাগে তার। রুপাইয়ের রাগ, দুঃখের পরোয়া করতে তার বয়েই গেছে।
এভাবেই চলত হয়তো। কিন্তু দিন কিছুটা হলেও বদলে গেল একটা দুপুরে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে ছাদে বসেছিল রুপাই। বাড়ি তখন শুনশান। বাবা, মা কাজে বেরিয়ে গেছে। সোনাই ইস্কুলে। রুপাইয়ের জ্বর হয়েছে দুদিন হলো। নলিনীদিদি ওকে খাইয়ে বলেছে ছাদে রোদ্দুরে বসতে। তাই এসেছিল। এমন সময়, পাশের বাড়ি থেকে গমগমিয়ে ভেসে এলো – আনন্দধারা বহিছে ভুবনে...
প্রথমে একটু বিরক্তই হলো রুপাই। এ নিশ্চয়ই ছবিকাকিমার কাজ। এতো জোরে গান যে কেন বাজায়? আর গানেরই বা কি ছিরি! জগতে এতো আনন্দ যে এরা কোথায় খুঁজে পায় কে জানে! তবু রোদ্দুরটা ভালো লাগছিল বলেই ছাদ ছেড়ে ধুপধুপিয়ে নেমে এলো না অন্যদিনের মতো। শীতের রোদ্দুরে নীল আকাশের তলায় গান বাজতে থাকল –
চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি,
প্রেম ভরিয়া লহ শূন্য জীবনে......
কখন যেন রুপাইয়ের দুচোখ বেয়ে অঝোরধারে জল ঝরেছে। সোনালী রোদ্দুরে তার যত ভয় কষ্ট যেন ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুরে, কথায় এতো শক্তি? রুপাই জানতো না কেন? পরপর শুনতে লাগলো - আমারে তুমি কাঙাল করেছ, প্রভু আমারো প্রিয় আমারো.... ভাসছে রুপাই। এ কোন মহেন্দ্রক্ষণে তার সঙ্গে সুরের দেখা হলো? ওই দেখো, শুনতে শুনতে আবার কেমন গলা ছেড়ে গাইতে লেগেছে - তুমি খুশি থাক, আমার পানে চেয়ে চেয়ে ...
নলিনীদিদি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে – রুপুমা, তুমি এতো সুন্দর গান করো!
হাসছে রুপাই – পারছি নলিনীদিদি? ভুল হচ্ছে না?
নলিনীদিদি অবাক – বুকের মধ্যে থেকে যে গান বেরিয়ে আসে, তা কি কখনো ভুল হয় গো?
সেদিন রাতে রুপাইরা ঘুমোতে যাবার পরে, দ্বিধা সংকোচ কাটিয়ে দাদাবাবু আর বউদির দরবারে দুপুরের ঘটনাটা পেশ করল নলিনী – রুপুমা সত্যিই ভালো গায়, বৌদিদি। ওকে একটু গান শেখাবে গো? আমাদের গাঁয়ের হারাণবুড়ো বলতো, গানের চেয়ে বড়ো ওষুধ নেই। কতোদিন পরে আজ রুপুমায়ের মুখে হাসি দেখলাম জানো?
একটা ছোট হাই তুলে দাদাবাবু বললো – তুমি তো সবসময়েই রুপুমার গুণ দেখতে পাও, তবু চেষ্টা করতে তো অসুবিধা নেই।
বৌদি সোফা থেকে উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো – করতে পারো, তবে টাকার শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছু হবে না, তা আগে থেকেই বলে দিচ্ছি।
তবু মাস্টারমশাই এলেন। সোনাই সে সময় আঁকা শেখে। নয়তো খেলতে যায়। মোদ্দা, রুপাইয়ের সঙ্গে বসে গান শেখার ইচ্ছে নেই তার। নাচ হলেও বা কথা ছিল। সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, বাবাইকে বলে সে বরং নাচ শিখবে। হারমোনিয়ামের পিছনে বসে আ আ আ করা তার পোষাবে না।
রুপাই অবাক। শুধুমাত্র তার একার জন্য এই ব্যবস্থা হয়েছে? এমনও হয় বুঝি? এক অনস্বাদিত ভালোলাগায় তার ছোট্ট মনটা উপছে উঠল। প্রাণমন দিয়ে সে গান শিখতে লাগলো। মাস্টারমশাই দেখলেন, সবকিছুতে পিছিয়ে পড়া মেয়েটির ওপর এই একটি ক্ষেত্রে ঈশ্বর দুহাত ভরে আশীর্বাদ ঢেলে দিয়েছেন। এমন ছাত্রী লাখে মেলে। শান্ত, ভীতু প্রকৃতির এই ছাত্রীটিকে তিনিও তাই মন উজাড় করে শেখাতে লাগলেন।
দিন যায়। সে গান কেমন শিখছে, নলিনীদিদি ছাড়া কেউ জানে না। জানতে চায়ইনি কেউ। সে খবর না রাখলেও রুপাইয়ের ব্যবহারের কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলেই, মায়ের গজগজানি সত্ত্বেও, বাবা মাস্টারমশাইয়ের আসাটা বন্ধ করেনি। এজন্য বাবার প্রতি ভারি কৃতজ্ঞ বোধ করে রুপাই।
স্কুলের পালা শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে দুজনে। সোনাইয়ের চোখধাঁধানো রেজাল্টের পাশে রুপাইয়ের কোনোমতে পাশ করাটা যতোই ম্যাড়মেড়ে দেখাক, বিয়ে না হওয়া অবধি, না পড়িয়ে আর উপায়ই বা কি মিত্রদম্পতির!
তা কলেজে ভর্তি হলেই নবীনবরণ হয়। আর সেই প্রোগ্রামে নতুনদের অংশগ্রহণ করতেও হয়। কপালগুণে সেই কলেজের জি এস মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র। সে এর আগে, স্যারের মুখে কোনো শিক্ষার্থীর এতো প্রশংসা শোনেনি। ফলে অনুষ্ঠানের দিন যখন মঞ্চে রুপাইয়ের নাম ঘোষণা করা হলো, তখন দুই বোনের চমকটা দেখার মতো। রুপাই মানা করতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সোনাইয়ের কথা কানে আসতে থেমে গেল। সোনাই প্রাণপনে এক কার্যকর্তাকে বোঝাচ্ছিল – কোথাও একটা ভুল হয়েছে। রুপাই কিচ্ছু পারে না। এতে মিছিমিছি লোক হাসানো হবে। রুপাইয়ের বোন হিসেবে সে দায়িত্ব নিয়ে বলছে.....
রুপাইয়ের পা টা যেন জমে গেল। কিচ্ছু পারেনার অন্ধকারটা হারিয়ে যায়নি তাহলে! সে কুঁকড়ে ছোট্ট হয়ে যাচ্ছিল আবার, হঠাৎ কানে ভেসে এলো মাস্টারমশাইয়ের গলা – গানটা তুই অনেকের চেয়েই ভালো পারিস। এটা যদি ভুলে যাস, তাহলে তোর এই আঁধারের আতঙ্ক জীবনেও কাটবে না।
আর না! ওই অন্ধকারে আর ফিরতে চায় না রুপাই। তাই মাথা কান চোখ ঝাঁ ঝাঁ করলেও নেহাৎ প্রাণের দায়ে, সোনাইকে একরকম উপেক্ষা করেই এগিয়ে গেল স্টেজের দিকে। দুহাতে চেপে ধরল মাইক। যেন পড়ে না যায়। তারপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বদুনিয়াকে ভুলে কিছুটা কাঁপা গলায় শুরু করল। আর শিগিরই সব ভুলে উদাত্ত গলায় তার আর্তি ঝরে পড়ল – মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
গান শেষ হলে সারা হল নিস্তব্ধ। এমন প্রাণ আকুল করা গান বুঝি তারা আগে শোনেনি। রুপাইয়ের আকুল প্রার্থনায় চঞ্চল চোখগুলো ভিজে উঠেছে। একটু অপেক্ষা। তারপরেই তুমুল হাততালির আওয়াজে রুপাইয়ের দুচোখে বর্ষার প্লাবন নামল। আজ আর এই অশ্রু তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিল না। তাকে শান্ত করল। আলোয় ফেরাল।
অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
লেখক পরিচিতি
দোলা সেন বিজ্ঞানের ছাত্রী। শিক্ষকতার সঙ্গে দীর্ঘ তিরিশ বছর যুক্ত ছিলেন। বই পড়া, বেড়ানো আর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোতেই দোলার আনন্দ। লেখা তাঁর অন্যতম নেশা।
No comments:
Post a Comment