প্রবন্ধঃ 'আদি' সপ্তগ্রাম - শ্রীদীপ তালুকদার চৌধুরী


'আদি' সপ্তগ্রাম


শ্রীদীপ তালুকদার চৌধুরী 



"অভিনব সুরপুরী

দেখি ঘর সারি সারি

প্রতি ঘর কনকের বারা।"


চাঁদ সদাগর যখন তাঁর বাণিজ্যতরী নিয়ে যাত্রা করছিলেন, তখন জাঁকজমকপূর্ণ সপ্তগ্রাম নগরীর বর্ণনা করতে গিয়ে নাকি এমনটাই বলেছিলেন - একথা জানা যায় বিপ্রদাস পিপিলাই এর লেখা মঙ্গলকাব্যের একটি অংশ থেকে। এর থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি সেই মধ্যযুগীয় বাংলায় কতই না সমৃদ্ধ নগর ও বন্দর হিসেবে খ্যাত ছিল সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও। সময়ের সাথে সাথে ফরাসী, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ প্রভৃতি বহু জনজাতির আগমন ঘটেছে এই স্থানে, এসেছে বিশাল সব বাণিজ্যতরী, সাথে নিয়ে এসেছে কতশত বিদেশী দ্রব্য, চলেছে আমদানি-রপ্তানী, বদলেছে রাজনৈতিক পটচিত্র, ঘটেছে বহু জাতি-ধর্মের মিলন। অথচ আজকের প্রজন্মের কতজনই বা আমরা জানি সপ্তগ্রামের সেই সোনায় মোড়া ইতিহাস? 


হাওড়া-বর্ধমান মেইন লাইনে হাওড়া থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে, ব্যাণ্ডেল জংশনের ঠিক পরেই আসে আজকের আদিসপ্তগ্রাম স্টেশন। সারাদিন অগুনতি ট্রেন, অসংখ্য মানুষ যাওয়া আসা করে এই ছোট্ট স্টেশনটির ওপর দিয়ে, বহু মানুষ এখান থেকে কর্মসূত্রে যাত্রা করেন কলকাতার উদ্দেশ্যে। গুরুত্বহীন হওয়ায় বেশ কিছু ট্রেন এখানে দাঁড়ায়ও না। কিন্তু ভাবতেই কি অবাক লাগে এত সংখ্যক মানুষের প্রায় বেশিরভাগই আজও জানেন না যে মধ্যযুগে দক্ষিনবঙ্গের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও জমকালো নগর ছিল এই সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও। আজকের ঝাঁ-চকচকে কলকাতা শহর হয়ত তৈরিই হত না যদি না সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সরস্বতী নদীতে পলি জমে এটি নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত এবং তার সাথে সাথেই সপ্তগ্রাম বন্দর ও নগরটির গুরুত্ব হ্রাস পেত। এই সম্পর্কে এইচ.ই.এ.কটন লিখে গেছেন, "সেই সময়ে এই শহরের মধ্যেই হয়ত ভবিষ্যৎ কলকাতা মহানগরীর নিউক্লিয়াস লুকিয়ে ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাতগাঁওয়ের বিপরীত দিকের নদীতে পলি পড়ে তার ভাগ্যকেই উজ্জ্বল করে তুলেছিল।" কে জানে! ভাগ্যের চাকা হয়ত এভাবেই প্রতিনিয়ত পাল্টায়! আজ যে রাজা, সৃষ্টির নিয়মানুসারে কাল তাকে ফকির হতেই হয়। তবুও ফেলে আসা অতীতকে না চিনলে, নিজেদের ইতিহাসকে না জানলে হয়ত নিজেদের অস্তিত্বকেই অসম্মান করা হয়। তাই আজ আমরা বেড়িয়ে পড়ি চলো মধ্যযুগীয় বাংলার জাঁকজমকপূর্ণ সেই সপ্তগ্রাম নগরের খোঁজে। জেনে নিই কেমন ছিল সরস্বতী নদীর তীরে বিশাল সেই শহর, কেমন ছিল তার মানুষজন, কিভাবে ঘুরলো ইতিহাসের চাকা, কেন চুপচাপ, একলা দাঁড়িয়ে আছে এখন আজকের আদিসপ্তগ্রাম ..


'সপ্তগ্রাম' শব্দটির অর্থ সাতটি গ্রাম। এই গ্রামগুলি হল- বাঁশবেড়িয়া, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, কৃষ্টপুর, শিবপুর, সাম্বচোরা ও বলদঘাটি। 'সপ্তগ্রাম' নামটির ব্যুৎপত্তি সম্পর্কে একটি লোককথার কাহিনী প্রচলিত রয়েছে যার উল্লেখ পাওয়া যায় ঐতিহাসিক জে.জে.ক্যাম্পোজের লেখা 'হিস্ট্রি অফ দ্য পর্তুগীজ ইন বেঙ্গল' বইটিতে। উত্তরপ্রদেশের কনৌজের রাজা প্রিয়বন্তের নাকি সাত পুত্র ছিল- অগ্নিত্র, মেধাতিথি, দ্যূতিষ্মান, জ্যোতিষ্মান, বপুষ্মান, সবন ও ভব্য। বিলাসবহুল রাজকীয় জীবনে বিতৃষ্ণ হয়ে এই সাত ভাই নিরিবিলিতে ধ্যান করার জন্যে উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে বের হন। বেশ কিছুদিন দক্ষিণে যাত্রা করার পর গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সংগমস্থলে অবস্থিত এই পূণ্যভূমিতে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্থানের সন্ধান পান। এখানকার পছন্দমতো সাতটি গ্রামে তারা নিজ নিজ আশ্রম স্থাপন করে আধ্যাত্মিক চর্চায় লিপ্ত হন এবং এইভাবেই পরবর্তীকালে এই সাতটি গ্রামকে ঘিরে গড়ে ওঠে বিখ্যাত সপ্তগ্রাম নগর। 


যেকোনো সময়ের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস বহুলাংশে জানা যায় সেইসময়কার সাহিত্য ঘেঁটে দেখলে৷ সময় হারিয়ে যায় কিন্তু সাহিত্য থেকে যায়। একইভাবে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে সপ্তগ্রামের নাম উঠে এসেছে বারবার। সেখান থেকেই আমরা জানতে পেরেছি তৎকালীন সময়ে এই বন্দর ও নগরের খ্যাতির কথা। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে যেমন লেখা রয়েছে, চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী এই সপ্তগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্রের পথে যেত তেমনই ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন, "সপ্তগ্রাম থেকে বণিকেরা কোথায় না যায়?" 


যদিও সপ্তগ্রাম বন্দরের একেবারে প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করে আমরা জানতে পারি মৌর্য যুগ চলাকালীন সপ্তগ্রাম নাকি একটি নামকরা বন্দর ছিল। খুব সম্ভবত বাংলার মিহি সুতির কাপড় সেকালে খুব জনপ্রিয় ছিল ভারতের অন্যান্য জায়গায়, এমনকি ভারতের বাইরে রোম এবং গ্রীসেও। সেইসব সামগ্রী রপ্তানি করা হত প্রধানতঃ এই সপ্তগ্রাম থেকে জলপথে। ভাবলে অবাক হতে হয় আজকের অজ পাড়াগাঁ আদিসপ্তগ্রাম থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এমন কিছু মাটির আসবাব খুঁজে পেয়েছেন যা খুব সম্ভবত সেই সূদুর রোমে তৈরি! এরপর দীর্ঘ সময় ধরে বাংলার বুকে পাল ও সেন বংশ চলাকালীন সাতগাঁও একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দররূপে বিরাজ করে। এইসময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলির সাথে বাংলার বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সুতিবস্ত্র, চাল, চিনি, মরিচ, লাক্ষা, শুকনো হরিতকী ইত্যাদি ছিল এই বন্দরের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। এক আরব ব্যবসায়ীর লেখা থেকে জানা যায় যে বাংলার সুতির কাপড়ের তৈরি ধুতি নাকি একটি ছোট্ট আঙটির মধ্যে দিয়ে অনায়াসে গলে যেত! 


১২৯৮ খ্রীস্টাব্দে দেবকোটের শাসক বাহরম ইৎগিন জাফর খাঁন সপ্তগ্রাম জয় করেন। এই জয়ের স্মারক স্বরূপ তিনি এই অঞ্চলের প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের আদলের মিশ্রনে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে বাংলায় পূর্ববর্তী রাজাদের শাসনকালেও সপ্তগ্রাম একটি সমৃদ্ধ নগর ছিল এবং এই অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভূত প্রসার ঘটেছিল। গঙ্গার ধারে 'জাফর খাঁন গাজীর দরগা' নামে প্রসিদ্ধ এই মসজিদটি এখনও গেলে চাক্ষুষ করা যায়। বর্তমানে এটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্গত। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলায় তিনটি শহর সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে- দক্ষিণবঙ্গে সাতগাঁও, উত্তরবঙ্গে গৌড় এবং পূর্ববঙ্গে সুবর্ণগ্রাম। ১৩৩৮ সালে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গৌড়ের আলাউদ্দিন আলি শাহ এবং সুবর্ণগ্রামের ইক্তিয়ারুদ্দিন গাজি শাহকে পরাজিত করে নিজেকে সপ্তগ্রামের স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ইলিয়াস শাহি বংশের সূচনা করেন। এভাবেই বাংলার বুকে স্বাধীন সুলতানি শাসনের শুরু হয়। ১৩৫০ সালে দিল্লীতে তুঘলক শাসন চলাকালীন বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতা বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে সপ্তগ্রামের বণিকেরা বিদেশে বাণিজ্য করতে যেতেন না, বরং আরব, পারস্য, তুরস্ক প্রভৃতি জায়গা থেকে বণিকেরা এখানে বাণিজ্য করতে আসতেন। অনেক পরে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিকে পর্তুগীজ বণিকেরা বাংলা তথা সপ্তগ্রামে যাতায়াত শুরু করেন। 


১৫১২ সালে প্রথম যে পর্তুগীজ কম্যান্ডার বাংলার মাটিতে পা রেখেছিলেন তার নাম ছিল সম্ভবত জোয়াও ডে সিলভেইরা। সপ্তগ্রাম নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম এসে পৌঁছোয় পর্তুগীজ নৌবাহিনী। তার কিছুকাল পর বাংলায় আসে এক চরম অস্থিরতার সময়। বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ তখন শেরশাহের প্রবল পরাক্রমী পাঠান সেনার ভয়ে কোণঠাসা। কূটনৈতিক কার্যে সিদ্ধহস্ত পর্তুগীজদের লক্ষ্য ছিল যেনতেন প্রকারেণ বাংলার মাটিতে পসার জমানো, তাই তারা এই লড়াইতে গিয়াসুদ্দিনের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। বদলে সুলতান তাদের দেন নূন্যতম শুল্কে বাংলার বুকে দীর্ঘসময় ধরে বাণিজ্য করার অধিকার। ইতিহাসের পাতায় ক্ষমতার কাছে মাটির অধিকার বিক্রি হয়ে যায় আরও একবার। কিন্তু এই লড়াইতে বাংলার সুলতান ও পর্তুগীজ সৈন্যদের হার হয়, উপরন্তু শের শাহ তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড় শহরটিকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেন। তার সাথে সাথে কালের গহ্বরে তলিয়ে যায় বাংলার এক প্রাচীন সোনালী অধ্যায়৷ গৌড়ের এই পতনের সাথে সাথেই চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব একেবারেই হ্রাস পায় এবং দক্ষিণবঙ্গে সপ্তগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব প্রবলভাবে বাড়তে থাকে৷ 


আবুল ফজল তাঁর বিখ্যাত আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সাতগাঁওকে বাংলার উনিশটি সরকারের মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করেছেন। সাতগাঁও সরকারের ৫৩টি মহল (রাজস্ব ইউনিট) ছিল এবং তৎকালীন সময়ে এর আয় ছিল ৪,১৬,১১৮/- টাকা। সাতগাঁও বন্দরের বার্ষিক রাজস্ব ছিল ৩০,০০০/- টাকা। পর্তুগীজ পর্যটক টোমে পাইরেস ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে ভারত ভ্রমণের সময় সুমে ওরিয়েন্টাল নামে বিখ্যাত বইটি রচনা করেন যার মধ্যে আমরা সপ্তগ্রামের বিবরণ পাই। তিনি লিখেছেন, “এটি (সপ্তগ্রাম) ছিল একটি বড় শহর। এখানে অনেক বণিক আছেন। এই শহরে নিশ্চয়ই দশ হাজার লোক বাস করেন।” ইংরেজ পর্যটক বণিক র‍্যালফ ফিচ লিখেছেন, "উত্তর আফ্রিকার শহরগুলির তুলনায় সপ্তগ্রাম রূপকথার নগরী।" যে রূপকথা এরপর সরস্বতী নদীতে পলি জমতে শুরু করলে হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে। ভেনেসীয় পর্যটক সিজার ফ্রেডেরিক যে বন্দরে প্রতিদিন ৩০-৩৫টি জাহাজে মাল বোঝাই হওয়া দেখেছিলেন, সেই বন্দর একদিন কালের পরিহাসে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও নদীতে পলি জমার কারণে হয়ে যায় পরিত্যক্ত। ছোটো ছোটো নৌকা ছাড়া বড় জাহাজ আর ভিড়তে পারে না সপ্তগ্রামে তাই সময়ের দাবীতে আবার নতুন একটি বন্দর তথা নগরের উত্থান প্রয়োজন হয়ে পরে। ১৬৩২ সালে মুঘলদের হুগলী বিজয়ের পর শুল্ক অফিস পাকাপাকি ভাবে সপ্তগ্রাম থেকে হুগলীতে স্থানান্তরিত হয়, তার ফলে বহু বণিক সপ্তগ্রাম ছেড়ে চলে আসেন হুগলীতে এবং নদীর পশ্চিমপারে বেতর হয়ে ওঠে নতুন সময়ের বড়ো বন্দর৷ নদী অনেক চওড়া হওয়ায় বাণিজ্যের সুবিধার্ধে আদিগঙ্গার পথ ধরে মালবোঝাই জাহাজ চলাচল করতে থাকে। জনবসতি গড়ে ওঠে গোবিন্দপুর ও আশেপাশের এলাকায়। অনেক পরে সুতানুটি এসে পৌঁছোন এক বিদেশী বণিক, নাম জব চার্নক৷ সপ্তগ্রামের পতনের সাথে সাথেই উত্থান হয় কলকাতা মহানগরীর৷ 


সপ্তগ্রাম যদিও এরপরে কাগজ ও অন্যান্য হস্তশিল্পের উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত টিকে ছিল। ডাচ পর্যটক স্ট্যাভারনিয়াস ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে এই নগরের কথা উল্লেখ করেন। আঠারো শতকের শেষার্ধে ওলন্দাজ সৈন্যবাহিনী নিকটবর্তী  চুঁচুড়া শহর থেকে সাতগাঁওয়ে অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে আসলে নগরটিকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখতে পান। নগরটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর স্বাধীন জমিদারদের সহায়তায় পার্শ্ববর্তী বাঁশবেড়িয়ার মত জায়গা গড়ে ওঠে।


এভাবেই হয়ত রূপকথারা গড়ে ওঠে। এভাবেই হয়ত রূপকথারা শেষ হয়৷ সময়ের আগে মাথা নিচু করতে হয় প্রবল পরাক্রমশালী রাজা, ভিখিরি সবাইকেই। যে বন্দর থেকে শয়ে শয়ে মালবোঝাই জাহাজ ছড়িয়ে পড়ত দেশে বিদেশের নানান স্থানে, যে নগর একদিন নিয়ন্ত্রণ করত বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্র, সেই স্টেশনে আজ সব ট্রেন পর্যন্ত দাঁড়ায় না৷ হারিয়ে গেছে সপ্তগ্রাম, হারিয়ে গেছে সপ্তগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস, পড়ে আছে শুধু একরাশ ধুলোবালি, ভাঙা বাড়ি, ধ্বংসপ্রায় কিছু মন্দির, বাংলার টেরাকোটার ঐতিহ্যমাখা মসজিদ, গঙ্গার পার ইত্যাদি। হয়ত আমরা জানি না কিন্তু এই শহরের প্রতিটা রাস্তা, দেওয়ালের প্রতিটা ইঁট, নদীর অসীম জলরাশি আজও স্পষ্ট দেখে সেই সপ্তগ্রামকে যেখানে একদিন মধুকর ডিঙায় চেপে পৌঁছেছিলেন চাঁদ সওদাগর, যে বন্দরে বসে মাঝরাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সুদূর ইওরোপে থাকা প্রেয়সীর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল কোনও পর্তুগীজ যুবক, যে নগরের রাস্তায় রাস্তায় দেখা যেত বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাষার মানুষকে! জাহাজ নোঙরের শব্দ আর ঘোড়ার খুরের অনুরণন এখনও শুনতে পাওয়া যায় হয়ত এখানে রাত গভীর হলে৷


কথায় বলে নদী সব জানে৷ নদীর বুকে কান পাতলে শোনা যায় সেইসব হারিয়ে যাওয়া শব্দ, গুঞ্জন, হাসি, কান্না, পরিহাস৷ হয়ত নদী সেকালের গল্প বলতেও চায় আমাদের, সামনে এগোনোর দৌড়ে নিজেদের এত ব্যস্ত করে ফেলেছি আমরা যে পিছনে তাকানোর কথা মনেই আসেনা আর৷ তাই নদী বুজে যায় সভ্যতার সিমেন্টে, সাথে ডুবে যায় সোনালী অতীতও৷ তাদের খুঁড়ে বের করার দায়িত্ব এখন আমাদেরই, শিকড়ের টান যে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই..


তথ্যসূত্র :


১. বাংলার ইতিহাস, নব ভারত পাবলিশার্স,

২. পুরোনো কলকাতার কথাচিত্র, পূর্ণেন্দু পত্রী, 

৩. 'সাতগাঁও অর ত্রিবেনী, এ্যসিয়াটিক সোস্যাইটি

৪. মধ্যযুগের ভারতীয় শহর, অনিরুদ্ধ রায়

৫. সপ্তগ্রামের সন্ধানে, দিলীপ সাহা  

৬. সপ্তগ্রাম ইতিহাস, উইকিপিডিয়া, 

৭. সপ্তগ্রাম, বাংলাপিডিয়া,

৮. Saptagram: A port that ran aground- Live History India


লেখক পরিচিতি



২৭ বছর বয়সী শ্রীদীপের জন্ম হুগলি জেলার পান্ডুয়ায়৷ বর্তমানে তিনি একটি জনপ্রিয় ফুড-জয়েন্টের কো-ফাউন্ডার৷ ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র শ্রীদীপের বই পড়া এবং লেখালিখি করা হল অবসর যাপনের প্রিয় মাধ্যম৷ আর স্বপ্ন বলতে পাহাড়ে একটা নিজের বাড়ি আর ভারতের প্রতিটা কোণ কে ছুঁয়ে দেখা।

No comments:

Post a Comment