গল্পঃ মেডেল - বিভাবসু দে


মেডেল


বিভাবসু দে 



বাপ-পিতেমো তিন পুরুষ ধরে এই কাজ করছে ওরা, কিন্তু কেউ কোনওদিন মেডেল পায়নি। এই প্রথম রঘু পাবে। ভাবলেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন গর্বে গুমগুম করে বেজে উঠছে। বছরের সেরা সাফাইকর্মী সে। ওর বাপও এই কাজই করত, আর ঠাকুরদা ছিল ইংরেজের আমলের মেথর। সাফাইয়ের কাজ তো ওর রক্তে বইছে। ও মেডেল পাবে না তো কি ওই হাড়গিলে সুখেন পাবে! 

যতবার ঠিকেদারের কথাগুলো মনে পড়ছে, কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে রঘুর। আর তো মাত্র ক'টা ঘন্টা। কর্পোরেশনের সামনে স্টেজ সাজানো হয়ে গেছে, বিকেলে গিয়ে দেখে এসেছে রঘু। সামনে রঙিন ঝালর, ওপরে লাল কার্পেট পাতা, এমনকি সিঁড়িগুলোতেও।  

ওখানে কত লোক আসবে কাল। কাগজের লোক, পুলিশ, নেতা, অফিসার। আর সবার সামনে মেয়র সাহেব খোদ ওর নাম ধরে ডাকবেন--- 'এবছরের সেরা সাফাইকর্মী হিসেবে পুরস্কার পাচ্ছেন শ্রী রঘুবীর দাস'। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ওর গলায় মেডেল পরিয়ে দেবেন। সব কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল রঘুর কাছে। গলায় জ্বলজ্বল করছে মেডেলটা। এখনই যেন বুকের ওপর ওই ঠাণ্ডা ধাতব ছোঁয়াটা বেশ অনুভব করতে পারছে রঘু। পিন্টু বলল, কাগজেও নাকি ছবি ছাপবে ওর। কালকের কাগজে? না না, কালকের কাগজে কী করে হবে, পরশু ছাপবে। পল্টুর চায়ের দোকানে কাগজ রাখে। কিনে আনতে হবে একটা। অনেক কিছু নিশ্চয়ই লিখবে ওকে নিয়ে। পল্টুকে বললে কি পড়ে দেবে না একবার? দেবে, দেবে। হাজার হোক, মেডেল পাওয়া তো কম কথা নয়। হয়তো ওর বাপ-ঠাকুরদার কথাও লিখবে। বাপটা আজ বেঁচে থাকলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলত, সাবাশ ব্যাটা! 

ঠিকেদার আরও বলছিল, সঙ্গে পাঁচশো টাকাও নাকি দেবে। এখন তো নতুন নোট বেরিয়েছে। ফ্যাকাশে শেওলা রঙের, আর সাইজেও আগের চেয়ে একটু ছোট। দিনের মজুরির বাইরে একসঙ্গে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকা! সব হিসেবের বাইরে একটা পাঁচশো টাকা কাল হাতে পাবে রঘু। কী করবে সেটা দিয়ে? হঠাৎ মনে পড়ল সেবার চৈত্রের মেলায় একটা লালে হলুদে কাজ করা শাড়ি দেখেছিল হরেন দাসের স্টলে। আড়াইশো টাকা দাম। ভারী মানাবে মিনতিকে। কাল বিকেলেই একবার যেতে হবে হরেনের কাছে। কে জানে এখনও ওই শাড়ি ওর কাছে আছে কি-না।  না থাকলে হরেনকে বলবে একটা আনিয়ে দিতে। দেবে নিশ্চয়ই। গলায় মেডেলটা ঝুলিয়েই যাবে রঘু।  

আচ্ছা, তারপরও তো আরও আড়াইশো থেকে যাবে। 

ছেলেমেয়ে তিনটে মাটিতে বসে একটা ভাঙা প্লাস্টিকের টুকরো নিয়ে খেলছে। বড়টা এবার পাঁচে পড়ল। ওদের দিকে তাকাতেই একটা হালকা হাসি যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল রঘুর কাঁচাপাকা পুরুষ্টু গোঁফটার আড়ালে। মাংসের কেজি আড়াইশো তো হবে না। কমই হবে। আচ্ছা, খাসি কি পাওয়া যাবে? পিন্টু বলছিল খেতে নাকি খুব স্বাদ, খুব তেল হয়। সে কোথায় যেন খেয়েছিল একবার।

উনুনে কী একটা চাপিয়েছে মিনতি। সম্ভবত বেগুনভাজা--- বাজার শেষে পোকায়-ধরা বলে যে-কটা পড়েছিল তার থেকেই খানকয়েক, মিনতি বলে-কয়ে সস্তায় নিয়ে এসেছে। ওদের উনুন বলতে কেরোসিনের স্টোভ। আর রান্নাঘর? যার একটাই ঘর, তার আবার রান্নাঘর কীসের! রাস্তার এপারের বুড়ো বটগাছটার তলায় গা ঘেঁষে ঘেঁষে বেশ কিছু ঝুপড়ি, পুরোনো ছেঁড়াখোঁড়া পলিথিন, টিনের টুকরো আর বাঁশের জোরে টিকে থাকা, তারই একটাতে রঘুর সংসার। মাটির ওপর একটা চওড়া নীলচে পলিথিন বিছানো, তার ওপর ক'টা ধ্যারধ্যরে ন্যাতানো কাঁথা--- ওটাই বিছানা, বাচ্চাদের খেলাঘর, শোবার ঘর, আর তারই একপাশে স্টোভ জ্বালিয়ে মিনতির রান্নাঘর। মাথার ওপর তেমন মজবুত ছাদ না থাকলেও বটগাছটা তো আছে, তাই রোদবৃষ্টিতে তেমন অসুবিধে হয় না। তবে ঝড়জলের দিনে রাস্তায় মাঝে মাঝে জল জমে গেলে বড্ড সমস্যা হয়ে যায়। মাথা বাঁচে তো কাঁথা বাঁচে না। 

সরকারি স্ট্রিটলাইটের হলদে আলো এসে গড়িয়ে পড়ছিল মিনতির ঘাম-চিটচিটে তামাটে কোমর বেয়ে। সেদিকেই তাকিয়েছিল রঘু। আচ্ছা, সোনার রঙও ওই গ্যাসবাতির আলোর মতোই হলুদ, তাই না? মেডেলটা কি সোনার হবে না রুপোর? নাকি তামার? ঠিকেদারকে জিগ্যেস করেছিল সে, ঠিকমতো বলতে পারেনি। তবে ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, "তুই এত ভালো কাজ করিস, তোকে নিশ্চয়ই সোনার মেডেলই দেবে।" 

সোনার মেডেল? ঠিক বিশ্বাস হয়নি রঘুর। তবে সরকার চাইলে তো সবই পারে। নয়া-বস্তির রথীন দলুইয়ের বৌয়ের গলায় একটা সোনার চেন আছে। রঘু দেখেছে। একটা চেনে কতটা সোনা থাকে কে জানে! মেডেলের চেয়ে কমই হবে। 

আচ্ছা, মেডেলের ওপর কি নাম লেখা থাকবে? রঘুবীর দাস? আজই একবার সুযোগ বুঝে ওয়ার্ড অফিসের বাবুকে জিগ্যেস করে নিত রঘু, কিন্তু তিনি কালকের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। কাছে যাবার ঠিক সাহস হয়ে ওঠেনি ওর, পাছে যদি রেগে গিয়ে মেডেলটাই বাতিল করে দেন!

"তখন থেইকা কী অত ভাবতাছ?" মিনতির কথায় হঠাৎ চমকে উঠল রঘু। 

মুচকি হাসিটা চওড়া হয়ে উঠল ওর ঠোঁটে। "আচ্ছা, তুই খাসির মাংস রাঁধতে পারস?"

হাতের খুন্তিটা হঠাৎ থামিয়ে সোজা হয়ে ঘুরে তাকাল মিনতি। ওর চোখের চাউনিতে প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক, তবু জিগ্যেস করল, "হঠাৎ এই কথা কেরে?"

"কিছু না, এমনওই।" রঘু আবার মুচকি হাসল। মিনতি কয়েক সেকেন্ড নিজের স্বামীকে পা থেকে মাথা অবধি একহারা জরিপ করে নিয়ে আবার কড়াইয়ের দিকে চোখ ফেরালো। নাড়তে দেরি হলেই পোড় ধরে যায় ভাজাগুলোয়। 

গরিবের সংসারে অবান্তর কথা নিয়ে মাথা ঘামানো বিলাসিতার পর্যায়েই পড়ে। যে-ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সে ঘরে খাসির মাংস! বিয়ের আগে বাপের বাড়িতে তবু বছরে এক-আধবার গাঁয়ের বাবুদের কল্যাণে মুরগি জুটত, রঘুর সঙ্গে ঘর-পালানোর পর থেকে তো সেই স্বাদ প্রায় ভুলেই গেছে মিনতি।

আসলে রঘু যে মেডেল পাবে, সঙ্গে টাকাও সেটা মিনতিকে বলেনি এখনও। কাল সকালবেলা যখন গলায় মেডেলটা ঝুলিয়ে বাড়িতে এসে ঢুকবে, মিনতির মুখটা একেবারে হাঁ হয়ে যাবে। টাকাটা ওর হাতে দিয়ে...না না, টাকা না, একেবারে ওর জন্যে ওই শাড়ি আর সবার জন্যে খাসির মাংস এনে ধরিয়ে দেবে মিনতির হাতে। ও বিশ্বাসই করতে পারবে না যে রঘু পুরস্কার পেয়েছে। বছরের সেরা সাফাইকর্মী ওর স্বামী। রঘুবীর দাস। মিনতি যখন অবাক হয়ে চেয়ে থাকবে, ও সোনার মেডেলটা খুলে পরিয়ে দেবে মিনতির গলায়। সোনার? 

হ্যাঁ, সোনারই হবে। রঘুর মতো সাফাইকর্মী আর ক'টা আছে পুরো শহরে? রোজ সেই কাকভোরে উঠে রাস্তা সাফ করা থেকে পুজো-পার্বনের আগে ড্রেন সাফাই কোনটা করেনি রঘু! এমনকী বেশ কয়েকবার ম্যানহোলও সাফ করেছে। বড্ড ঝক্কির কাজ, কিন্তু করতে পারলে পঞ্চাশ টাকা বেশি দেয় ঠিকেদার। সেই উনিশ বছর বয়েস থেকে, যখন বাপটা যক্ষায় মরল, তখন থেকে এসব কাজ করে যাচ্ছে সে। এখন তো ওর চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। চুলে গোঁফে পাকও ধরেছে একটু একটু। এতগুলো বছরের অভিজ্ঞতা ওর, কম কথা নয়। একেবারে ঠিক লোককেই বেছেছেন মেয়র সাহেব। 

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আবার যেন বুকের ওপর সেই ঠাণ্ডা চাকতির ছোঁয়াটা টের পেল রঘু। কেমন একটা অদ্ভুত উত্তেজনায় থিরথির করে কেঁপে উঠল ওর হাতের আঙুলগুলোও। 

রঘুর ঘর থেকে রাস্তার অনেকটাই চোখে পড়ে--- কিছুটা আলো, কিছুটা অন্ধকার। স্ট্রিটলাইট আর হুঁশ-হুঁশ করে ছুটে চলা গাড়ির আলো, সব কেমন যেন ম্লান হয়ে মিশে যায় এই রাতের অন্ধকারে। রঘুর মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে অন্ধকারটাই বোধহয় সত্য, আলো শুধুই একটু আধটু অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা করে, এই যা। রাস্তার ওপারের কিছু কিছু ঝুপড়িতে বাল্ব জ্বলছে, হুকলাইন টেনে। রঘুর এই ছোট্ট ঘরেও যেন আস্তে আস্তে একটা আলো জ্বলে ওঠে--- ষাট পাওয়ারের হলুদ আলো; সরকারি স্ট্রিটলাইটের নয়, রঘুর নিজের ঘরের আলো। সোনার মতো উজ্জ্বল হলুদ আলো। তবু অন্ধকার তো অন্ধকারই, সকাল না হলে কাটে না। 

সকালের সূর্যটাও ঠিক মেডেলের মতোই গোল হয়, তাই না? কাল কোনদিক দিয়ে স্টেজে উঠতে হবে কে জানে! বাঁদিকে কাঠের সিঁড়ি ছিল, রঘু দেখেছে; ডানদিকেও আছে নাকি? আচ্ছা, কাল কি ওকেই স্টেজ সাফ করতে হবে? না না, কাল তো ও মেডেল পাবে। কাল নিশ্চয়ই অন্য কেউ করবে। ওই সুখেনকে দিয়ে করালে বেশ হয়। শালার হাড়ে বড্ড জ্বালা ধরেছে! এইতো গতকাল ওয়ার্ড অফিসের সামনে বীণা মাসিকে বলছিল, রঘু নাকি ঠিকেদার আর ওয়ার্ড-বাবুর পা চেটে মেডেল পাচ্ছে। দূর থেকে সব শুনেছে রঘু। ওই হারামজাদা খানকির পো নিজে তো কাজে ফাঁকি দিয়ে বেড়ায় আবার কত বড় কথা। ঝাড়ুটাও তো ঠিকমতো ধরতে শেখেনি এখনও! ঝাড়ু দেয়, দেখলে মনে হবে যেন কাক তাড়াচ্ছে!

বাইরের ছোট্ট একফালি আকাশটার দিকে একবার তাকাল রঘু। ওদের বুড়ো বটের ঝুরি, রাস্তার চোখ-ধাঁধানো শহুরে আলো আর ওপারের উঁচু উঁচু দালান-বাড়ির ফাঁক দিয়ে ওটুকুই দেখা যায়। মিশমিশে কালো আকাশ। একটা তারাও নেই। মাঝরাত্তির কি পেরিয়ে গেছে? বাইরে একনাগাড়ে ছুটে চলেছে গাড়িগুলো, সারারাত ছোটে--- কোথায় যায় মানুষ কে জানে!  

শুয়ে শুয়ে ওপাশ থেকে মোবাইলটা তুলে নিল রঘু। সস্তা দরের একটা চায়না মোবাইল, তাও সেকেন্ড-হ্যান্ড। তিনবছর আগে একশো টাকায় পেয়ে গেছিল। কেনার সময় একটা রুপোলি রং ছিল দুপাশে, বোতামগুলোও সাদা রবারের ছিল। টিপলে সবুজ আলো দেখা যেত বোতামের ফাঁকে ফাঁকে। এখন অবশ্য দুপাশের সেই রংটা চটে গেছে, সাদা বোতামগুলোতেও কেমন একটা ময়লাটে ছোপ পড়েছে। তিনটে চল্লিশ বাজে। ভোর হতে এখনও মেলা বাকি।   

অনেকক্ষণ হল খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই শুয়ে পড়েছে। রঘুর পাশেই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মিনতি আর ওপাশে বাচ্চা তিনটে। কিন্তু রঘুর আজ আর ঘুম নেই। ওর আজ স্বপ্নের রাত। বোজা চোখে স্বপ্ন ঝাপসা হয়ে এলে চোখ খুলে স্বপ্ন খুঁজছে সে। 

বাইরে একটু একটু করে ঝিমিয়ে আসছে গাড়ির আলো আর হর্নের শব্দ। মিনতির গালের ওপর এসে পড়েছে স্ট্রিটলাইটের আলোটা। ওকে ঠিক যেন একটা পাথরের মূর্তির মতো লাগছিল রঘুর কাছে। কিংবা সোনার মূর্তি! বুক থেকে শাড়ির আঁচলটা নেমে গেছে। টানটান বুকের ঠিক মাঝখানে ব্লাউজের ওপর অন্ধকারের একটা গাঢ় খাঁজ। আর ওর ছিপছিপে নির্মেদ পেটের ওপর সরু অন্ধকার বিন্দুটা, শ্বাসের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। কোমরের পাশ দিয়ে সেই মালিকানাহীন আলো গড়িয়ে পড়ছে ওর নাভির কিনারায়, কিন্তু সেই অন্ধকারের ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র নেই তারও। ছুঁতে গিয়েও পিছিয়ে এল রঘু। একটা অকারণ হাসি খেলে গেল ওর ঠোঁটে। দিনের আলোয় হয়তো লোকে পাগল বলত, কিন্তু এই অন্ধকারে সে মেডেলজয়ী সেরা সাফাইকর্মী রঘুবীর দাস। বুকের কাঁচাপাকা লোমে হাত বুলিয়ে যেন আবার কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল রঘু। সোনার মেডেল? কাল বোধহয় সবকিছুই সোনালী হয়ে যাবে। রাতটাও। 

বেশ রাতের দিকে চোখটা যখন প্রায় বুজে এসেছিল রঘুর, হঠাৎ ঘুম ভাঙল মোবাইলের শব্দে। পিঁচুটি-লাগা চোখদুটো রগড়ে উঠে বসল সে। 

"হ্যালো...কে?"

"আমি। সুজিত বলছি। রঘু, হেব্বি ঝামেলায় পড়ে গেছি রে।"

শুধু 'আমি'-টুকু শুনেই চিনতে পেরেছিল রঘু। ঠিকেদার সুজিতের ফোন। এমনভাবে কথাগুলো বলছিল যেন সত্যিই খুব বিপদে পড়ে গেছে। জিগ্যেস করায় বলল, ওপর থেকে নাকি খুব জরুরি ডাক পড়েছে। কাজটা এক্ষুণি না করলে ভীষণ সমস্যা হয়ে যাবে। আর এই চরম মুহূর্তে রঘু ছাড়া কাউকে ফোনেও পাচ্ছে না। সব ক'টা ফোন অফ করে ঘুমোচ্ছে। 

"কই আইতে হইব বাবু?" রঘু জিগ্যেস করল। 

ফোনের ওদিক থেকে জবাব এল, "মহাত্মা গান্ধী সরণির সামনে যে পুরোনো মন্দিরটা আছে, ওখানেই।"

"মহাত্মা গান্ধী সরণি!" এই রাস্তার নাম কি আগে শুনেছে রঘু? ঠিক খেয়াল করতে পারল না। 

"আহা, বটতলার রাস্তাটা আরকী। জলদি কর রঘু, দেরি করিস না একদম।" 

এবার আর চিনতে অসুবিধে হল না। সেই উনিশ বছর বয়েস থেকে কতবার এই রাস্তা সাফ করেছে। সাফ করতে করতে কবে যে বটতলাটা মহাত্মা গান্ধী সরণি হয়ে গেছে টেরই পায়নি! ফোনটা কাটতেই আগে সময় দেখল রঘু, সাড়ে চারটে। বাইরে এখনও বেশ অন্ধকার। অক্টোবরে ছটার আগে আকাশ লাল হয় না। আজকে হঠাৎ এত ভোরে কী দরকার পড়ল! অন্যদিনও তো ছ'টার আগে কেউ কাজে যায় না। আর এই ঠিকেদার নিজেই তো ন'টায় আসে। কী জানি, আজ হয়তো বিশেষ কিছু...ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধুকপুক করে উঠল রঘুর। আজই তো ও মেডেল পাবে। সোনার মেডেল। 

অনেকদিন আগে একটা ঘিয়া রঙের শার্ট কিনেছিল চৈত্র সেলে, ওটাই পরবে। বেশ মানায়। কিন্তু এখনই কি পরে বেরিয়ে যাবে না পরে ফিরে এসে আবার তৈরি হবে? না না, তাহলে তো মিনতি টের পেয়ে যাবে। আর আজকে তো ওকে আর ঝাড়ু হাতে রাস্তা সাফ করতে হবে না, আজ তো ও বছরের সেরা সাফাইকর্মী রঘুবীর দাস। আজ তো ওর সেজেগুজে যাবারই দিন। 

মিনতি এখনও গভীর ঘুমে। ঘুমোক, যখন রঘু বুকের ওপর মেডেলটা নিয়ে ফিরবে তখন আর মুখে কথা সরবে না ওর। আর হ্যাঁ, সঙ্গে খাসির মাংস আর সেই লাল-হলুদ শাড়িটাও আনতে হবে। ভুললে চলবে না। মাংস নাকি বেশি বেলাতে গেলে ভালো পাওয়া যায় না। 

শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে একচিলতে হাসি হঠাৎ হঠাৎ যেন ওর ঠোঁটের কোণে অকারণেই কাঁপন ধরিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল। 

মহাত্মা গান্ধী সরণি ওরফে বটতলার কাছাকাছি পৌঁছতে মিনিট দশেকের বেশি লাগে না। ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে বেরিয়ে বড় রাস্তা পেরোলে প্রথম যে গলিটা পড়ে, সেটা দিয়ে সোজা কিছুটা হাঁটলেই পুরোনো মন্দিরটা। রঘুকে আসতে দেখেই বেশ পা চালিয়ে কাছে এগিয়ে এল ঠিকেদার সুজিত সামন্ত। 

"বাঁচালি বাপ! তুই না হলে আজ বড় ঝামেলায় পড়ে যেতাম।" 

ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝে ওঠার আগেই রঘুর চোখ পড়ল ওদিকে রাস্তার ধারের মুখখোলা গর্তটার দিকে। পাশে দড়ি, বালতি, কোদাল, আরও কিছু জিনিস রাখা। কিন্তু আজকে তো ও মেডেল পাবে!    

সুজিত রঘুর আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, "জানিস তো, আমাদের কর্পোরেশনে অপোজিশন দল। তাই মুখ্যমুন্ত্রী একটু খুঁত পেলেই মেয়রকে কথা শোনাতে ছাড়বে না। আর তখন আমার গর্দান যাবে সেটা তো বুঝতেই পারছিস।" 

পোজিশন অপোজিশন ঠিক বোঝে না রঘু, তবে এটুকু জানে যে এখনের সরকার খুব ভালো। সে মেয়রের সরকার না মুখ্যমন্ত্রীর সরকার তা ঠিক খোলসা করে বুঝতে পারেনি আজ অবধি। তবে যেই করছে, সে সত্যিই দেশের কথা দশের কথা ভাবে, নইলে এর আগে ওর বাপ-দাদা কারোর আমলেই সাফাইকর্মীকে পুরস্কার দেওয়া হয়, এমনটা কেউ দেখেনি। এমনকী ও নিজেও না।   

পাশের খোলা ম্যানহোলটার দিকে মুখ ফিরিয়ে ঠিকেদার সুজিত বলল, "কাল রাতের দিকে এখান দিয়ে যাবার সময় নাকি বেজায় গন্ধ লেগেছে মেয়রের নাকে। ওই ম্যানহোল থেকে বেরোচ্ছে, ভেতরে হয়তো কিছু জাম হয়ে আছে। মুখ্যমন্ত্রী আজ আবার এদিক দিয়েই ঝাড়ু লাগাবে। তাঁর নাকে এই গন্ধ ঠেকলে আর রক্ষে নেই।"    

"কিন্তু আজ তো..." , কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল রঘু। শব্দ তিনটে সুজিতের কান অবধি পৌঁছেছিল কি-না কে জানে! অবশ্য পৌঁছলেও বিশেষ কিছু আসে যায় না। 

"নে, রঘু আর দাঁড়িয়ে থাকিস না। হাতে এখনও চার ঘন্টা আছে। সাড়ে ন'টা নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী আসবে এদিকে। তার আগে যতটা পারিস সামলে দে। এখন তুইই ভরসা।" একটা হালকা চাপড় মেরে হাতটা রঘুর কাঁধে রাখল সুজিত। "সব জিনিস আমি এনেই রেখেছি। আর আকাশও তো ফর্সা হয়ে গেছে এখন। নে, তুই শুরু কর; আমি দেখি বিমলকেও খুঁজেপেতে আনতে পারি কি-না। দু'জন হাত লাগালে তাড়াতাড়ি হবে।" 

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না সুজিত, ডানপাশের কোনও এক বেনামি গলির দিকে এগিয়ে গেল বিমলকে খুঁজতে। 

রঘু কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল আবার। না, আজকেই তো নিজেকে প্রমাণ করার দিন। রঘু, বছরের সেরা সাফাইকর্মী রঘুবীর দাস। বুক ভরে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেল সে। এ তো আর নতুন কিছু নয়, ম্যানহোল সাফাই আগেও করেছে। চৈত্র সেল থেকে কেনা ঘিয়া রঙের শার্টটা আর ও-পাড়ার ডাক্তারবাবুদের দেওয়া খয়েরি পেন্টটা খুলে, পাশের যে ফলকটায় 'মহাত্মা গান্ধী সরণি' লেখা, তারই পেছন দিকটায় ঝুলিয়ে রাখল রঘু। 

ওর সামনে রাক্ষসের মতো হাঁ করে আছে একটা কালো গর্ত। মুখের আবছা অন্ধকারটা ভেতরে বড় ভীষণরকম ঘনিয়ে ওঠে। তবু আজ ওকে নামতেই হবে। ও তো আর সুখেন নয়, বছরের সেরা সাফাইকর্মী রঘুবীর দাস। বুকের কাঁচাপাকা লোমগুলোর ফাঁকে হাত বুলিয়ে অদৃশ্য কিছু একটা যেন ছুঁয়ে দেখল সে। আর কয়েকটা ঘন্টা, তারপরই তো ওই ঘিয়া রঙের শার্টের ওপর জ্বলজ্বল করবে মেডেলটা। সোনার মেডেল। আর হাতে পুরস্কারের টাকা। 

ছলাৎ করে ছিটকে উঠল ম্যানহোলের ভেতরের পচা নোংরা জল। পেট অবধি ডুবে আছে রঘুর। এই গন্ধ সইবার দম যার-তার হয় না, কলজে লাগে। ওই ঠিকেদারকে এখানে একবার নামালে আর দু'পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে না ব্যাটার। এই দমবন্ধ-করা তীব্র দুর্গন্ধের মধ্যেও যেন হাসি পেয়ে গেল রঘুর। আর সেই সঙ্গে মাথার ভেতরটাও কেমন যেন একটু ঝিনঝিন করে উঠল। আজ দোসরা অক্টোবর। আগে শুধু গান্ধী জয়ন্তীই ছিল, আজকাল সঙ্গে স্বচ্ছতা দিবস না কী জানি একটাও পালন করা হয়। 

সকাল দশটা বাজে কিন্তু রাস্তায় রোজকার মতো তেমন স্কুল-অফিস ছোটা সেই ভিড়টা নেই। তবে একটা অন্যরকম ভিড় যেন আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে মহাত্মা গান্ধী সরণির এই পুরোনো মন্দিরটার দিকে। ভিড়ের ঠিক মাঝখানে একজন খাদির কুর্তা, পায়জামা আর জহর-কোট পরে বেশ নিখুঁত ভঙ্গিতে ঝাড়ু দিতে দিতে এগিয়ে আসছেন। ইনিই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সামনে বড় বড় ক্যামেরা হাতে ঘিরে আছে কিছু লোক, ওঁর দিকে তাক করে বেশ সুন্দরভাবে তাল মিলিয়ে প্রতিটা মুহূর্তের ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে চলেছে তারা। একটু পর পর আলোর ঝলকানি উঠছে ক্যামেরাগুলোয়। টপাটপ উঠে যাচ্ছে ভিড়ের ছবি, ঝাড়ুর ছবি, ঝাঁ-চকচকে ধুলিহীন রাস্তার ছবি, আর স্বচ্ছ ভারতের রাজ্যস্তরীয় কাণ্ডারীর ছবি। নিজের নিজের অলিখিত আদর্শ অনুযায়ী ছবি বেছে নেবে কাগজের লোকেরা। একই ঘটনা পাল্টে যাবে কাগজে কাগজে। কারও কাছে মুখ্যমন্ত্রীর ঝাড়ু দেওয়াটা বড় হবে, আবার কারও কাছে মুখ্যমন্ত্রীর পরিষ্কার সাফ রাস্তায় ঝাড়ু দেওয়াটা বড় হবে। বাকিটা পাবলিক নিজের অগাধ বিচার বুদ্ধি দিয়ে নেড়েচেড়ে ঠিক বুঝে নেবে। 

মুখ্যমন্ত্রীকে পেছন থেকে ঘিরে আছে জনা ছয়েক বেশ পালোয়ান গোছের নীলাভ-ধূসর সাফারি পরা লোক। ওঁর বডিগার্ড। শত্রুর তো অভাব নেই, কে কোন ফাঁকে ওঁৎ পেতে আছে কে জানে! আর তার পেছনে একটা লম্বা ভিড় হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে। কর্পোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, কয়েকজন রাজ্যস্তরের বড় বড় আমলা, নেতা, পাড়া-লেভেল সমর্থক, কর্মকর্তা আর একেবারে পেছনে বেশ কয়েক হাত তফাতে কয়েকজন সাফাইকর্মী। সুখেন, বীণা মাসি, পিন্টু, সবিতাদি, সনাতন, অসীমদা, মহিম। রঘুও কি আছে তাদের মধ্যে? 

হঠাৎ মহাত্মা গান্ধী সরণি ওরফে বটতলার সেই পুরোনো মন্দিরটার কাছাকাছি পৌঁছেই কেমন যেন থমকে দাঁড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী। বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। চোখে একটা ধারালো চাউনি। কিছু একটা যেন খুঁজছেন। ঠিক! যেটা ভেবেছিলেন সেটাই। ম্যানহোলের মুখটা খোলা, পচা গন্ধটা সেখান থেকেই বেরোচ্ছে। ক্যামেরার অলক্ষ্যে একটা শিকারী হাসি একমুহূর্তের জন্যে ওঁর ঠোঁটে ঝিলিক দিয়েই আবার মিলিয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকালেন রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। "কী মেয়র সাহেব, এভাবে স্বচ্ছ শহর বজায় রাখেবন আপনারা? একদিকে দুর্গন্ধ তো ছড়াচ্ছেই তার ওপর কেউ পড়ে গেলে কী হবে একবারও ভেবেছেন?" 

"সরি, স্যার। আমি দেখছি।" মেয়র বেশ ভালোই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি পেছনে কাউকে ইশারা করলেন গর্তের মুখটা বন্ধ করতে। আর বোধহয় ভিড়ের মধ্যে একবার সুজিতকেও খোঁজার চেষ্টা করেলন। কিন্তু চোখে পড়ল না হারামজাদাটা। হয়তো দূর থেকে গর্তের মুখ খোলা দেখে আগেই সরে পড়েছে। ঠিক আছে, আজ নাহয় কাল তো আসবেই। 

মুখ্যমন্ত্রী হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন গর্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া লোকটাকে। এত বড় একটা পলিটিক্যাল স্টান্ট মারার মওকা এমনি এমনি তো যেতে দেওয়া চলে না। নিজেই এগিয়ে গেলেন ম্যানহোলটার দিকে। ক্যামেরাওলা আর প্রেসের লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কালকের পত্রিকার হেডলাইন আর অপোজিশনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ, দুটোই একসঙ্গে যেন লুফে নিল কাগজের পোড়খাওয়া নিজস্ব প্রতিনিধিরা। 

চারপাশে ঘিরে আছে কত গন্যমান্য লোকজন, অফিসার, পুলিশের লোক, মুখ্যমন্ত্রীর বডিগার্ড, নেতা, কর্মী, কর্পোরেশনের মেয়র সাহেব, কাউন্সিলর, আর একেবারে পেছনে সুখেন, বীণা মাসি, পিন্টু, সবিতাদি, সনাতন, অসীমদা, মহিম। কাগজের লোকেরা তরতর করে কতকিছু নোট করে নিচ্ছে আর সেকেন্ডে সেকেন্ডে আলোর ঝলকানি খেলে যাচ্ছে ক্যামেরাগুলোর মুখে। 

মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে আস্তে আস্তে তুলে নিলেন লোহার ভারী ঢাকনাটা। ছবিওলাদের ছবি তোলার গতি বেড়ে গেল। এই চরম মুহূর্তটা কেউ মিস করতে চায় না। চারপাশে জড়ো হওয়া একগাদা উজ্জ্বল চোখের ভিড় অবাক হয়ে দেখল, কীভাবে একটু একটু করে মেডেলটা চেপে বসে যাচ্ছে বছরের সেরা সাফাইকর্মী রঘুবীর দাসের বুকের ওপর। ভারত আরও স্বচ্ছতর হয়ে উঠছে।


অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত



লেখক পরিচিতি



জন্ম ১৩ জানুয়ারি, ১৯৯৪। সক্রিয়ভাবে লেখালেখির শুরু ২০১৭-র মাঝামাঝি সময়ে। এখনও দেশ, কিশোর ভারতী, কথাসাহিত্য, যুগ ইত্যাদি ম্যাগাজিনে এবং পরবাসিয়া পাঁচালী, ম্যাজিক ল্যাম্প, জয়ঢাক, একপর্ণিকা ইত্যাদি বহুল প্রচারিত ওয়েবজিনে বিভিন্ন সময় গল্প ও উপন্যাসিকা প্রকাশিত হয়েছে।


2 comments: