গল্পঃ ফার্স্ট প্রাইজ - বাসু মুখোপাধ্যায়


ফার্স্ট প্রাইজ 


বাসু মুখোপাধ্যায়



আমার বাবার মতো এমন হাড়কিপটে ভূভারতে দুটো নেই। আরে বাবা! বেকার ছেলে হাত খরচ তো লাগবেই। তাই আবার প্রেম করছে! একবার রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে যতই চেপেচুপে খাও দু-তিনশো টাকা তো বেরিয়েই যায়। তারপরে আরও কত খরচ আছে! ফোনে টাকা ভরা, তবে এখন আমার অন্য কারণে টাকার দরকার। আমি বাবাকে বললাম, "কুড়ি হাজার টাকা দাও, একটা অনলাইন কোর্সে ভর্তি হব।"

ভুরু কুঁচকে বাবা বলল, "ভর্তি হয়ে কী হবে? তুই চাকরি করবি?"

আমি বললাম, "বিজনেস টিজনেস বিশেষ করে প্রোমোটারি বিজনেস আমার দ্বারা হবে না। আমি চাকরি করব।"

পিতাজি বলল, "আর কত ধাপ্পা দিয়ে টাকা নিবি? সবসময় শুধু টাকার দরকার। দিন পনেরো আগেই তো বই কিনবি বলে টাকা নিলি। সে বই কোথায়? বাবাকে উল্লু বানাচ্ছিস?"

নাহ্ এই লোকটার জন্যই আমাকে গৃহত্যাগী হতে হবে। টাকার পাহাড়ে বসে আছে তবু ছেলেকে দুটো বেশি টাকা দেবে না। টাকা চাইতে গেলে এমন করবে যেন একটা কিডনি চেয়েছি! আর আমার মাও সেইরকম। কঠিন পতিভক্ত। বাবা বলে দিয়েছে, আমাকে না জিজ্ঞেস করে তুরুককে দশ টাকাও দেবে না। ব্যাস মা বেদবাক্য করে নিয়েছে কথাটা।বেকার ছেলেদের সমস্যা কোনও শালা বুঝল না।

.

আসলে হঠাৎ করে কুড়ি হাজার টাকা তিস্তার জন্যই লাগবে। ওর মায়ের ভয়ংকর আর্থারাইটিস। হাঁটতে পারছেন না। ডাক্তার বলেছে তিন মাস ফিজিওথেরাপি করাতে হবে। ঘরে এসে ফিজিওথেরাপিস্ট করে দেবে। দুশো টাকা করে নেবে। মানে তিন মাসে আঠেরো হাজার টাকা। ওর বাবা পারবে না। অল্প রোজগার! সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। বাড়তি ছ'হাজার টাকা করে মাসে দেবেন কেমন করে! আমাকে তিস্তা টাকার কথা বলেনি। কিন্তু আমি জানি, কদিন ধরে এইজন্য ওর মন খারাপ। তিস্তার মন খারাপ হলে আমার পৃথিবী ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে করুণ একটা বেহালার সুর বাজতে থাকে। কিছু ভাল লাগে না। শালা! আজকাল কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপনও দেখতে পাই না। তাহলে একটা বিক্রি করে ওকে টাকাটা দিতাম। আগে ওটাই ছিল গরিবদের সৎ পথে টাকা পাওয়ার একমাত্র রাস্তা।

আমার বাবার বিশাল প্রোমোটারির বিজনেস। কিন্তু ভীষণ কঞ্জুস। হাত দিয়ে জল গলে না। 

.

সকালে ঘুম ভাঙিয়ে মা বলল, "তুরুক ওঠ। তোকে বাইরে কে ডাকছে দেখ।"

এখন আবার কে এল! গিয়ে দেখি বাইরের ঘরে বাবাও আছে।

উঁকি মেরে দেখলাম নকুলদা দাঁড়িয়ে আছে। 

আমি যেতেই বলল, "তুমি পরশু আমার কাছে একটা লটারির টিকিট কিনেছ না? সেটা কোথায়?"

বাবা প্রতিদিন এই সময় বেরোয়। শুনতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। টাকার গন্ধ আছে বলে কথা!

.

আমি আমার ঘরের টেবিল থেকে টিকিটটা নিয়ে এলাম। পকেটেই ছিল, মা বোধহয় কাচার জন্য জামাটা নিয়েছে। পকেটের সব জিনিস টেবিলে রেখে দিয়েছে। খান চারেক মেন্টোস, লটারির টিকিট, দশ টাকার দুটো নোট এইসব।

নকুলদাকে গিয়ে লটারির টিকিটটা দিতে নকুলদা ভাল করে দেখে লাফিয়ে উঠল, "ওরে তোর ফার্স্ট প্রাইজ লেগেছে! ফার্স্ট প্রাইজ লেগেছে!"

বাবা শুনে একটু থমকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল, তারপর বলল, "বলছেন কী!  তুরুকের লটারিতে প্রাইজ লেগেছে? ফার্স্ট প্রাইজ?"

তারপরেই বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "কী করেছিস তুই? তোর মতো অপদার্থ কোনদিন এক টাকাও রোজগার করবে ভাবতেও পারিনি। দেখি দেখি টিকিটটা দেখি?" 

বলে নকুলদার কাছ থেকে ছিনিয়ে টিকিটটা নিয়ে "পঞ্চাশ লাখ! পঞ্চাশ লাখ!" বলে লাফাতে লাগল।

আমিও দুবার লাফিয়ে বাবাকে বললাম, "আমি জানতাম আমার ফার্স্ট প্রাইজ লাগবে। আমাকে একজন জ্যোতিষী হাত দেখে বলেছিল আপনি পাক্কা জুয়াড়ি। জুয়া খেলায় আপনি অনেক রোজগার করবেন। লটারি তো জুয়াই!"

মাও ঘর থেকে বাইরের ঘরে চলে এসেছে চেঁচামেচি শুনে। 

প্রথমে বুঝতে পারেনি তার স্বামী ওভাবে লাফাচ্ছে কেন! পরে বুঝতে পেরে মাও লাফাতে শুরু করে দিল। যেন  "যেমন খুশি লাফাও" প্রতিযোগিতা চলছে।

একটু পরে বাবা বলল, "শোন, এই টিকিটটা তুই নয়, আমি কিনেছি বুঝলি তো! তাতে আমার বিজনেসের কিছু সুবিধা হবে। আর তোরই তো সব থাকবে। যখন যেমন দরকার আমার কাছ থেকে চেয়ে নিস।"

বুঝলাম ব্ল্যাক মানি হোয়াইট করার তাল।

আমি বাবাকে বললাম, "একটা সিগারেট দেবে? মাথাটা একটু ছাড়াতে হবে।"

মা চোখ বড় বড় করে বলল, "কী বলছিস তুরুক? তুই বাবার কাছে সিগারেট চাইছিস? এত অধঃপতন হয়েছে তোর?"

বাবা অবশ্য ততক্ষণে সিগারেট বের করে আমাকে দিয়েছে প্লাস লাইটার বের করে জ্বালিয়েও দিল সিগারেটটা। টাকার গন্ধ বাবার সবচেয়ে প্রিয় পারফিউম। সেই গন্ধ পেয়েছে এখন, সব করবে। আমিও হঠাৎ করে কেমন উদার হয়ে গেলাম। দু টান দিয়ে বাবাকে বললাম, "ওকে।"

বাবা নকুলদাকে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলল, "এই টাকাটা নিয়ে যাও। সেলার হিসেবে ভাগতো পাবেই। পরে আমিও কিছু দেব। আমি এখন আমার উকিলকে লটারির টিকিটটা দেব। যা করার ওই করবে।"

নকুলদা চলে যেতেই আমি বাবাকে বললাম, "এক্ষুনি আমার কুড়ি হাজার টাকা লাগবে।"

বাবার ভুরু একটুও কুঁচকাল না। উল্টে মোলায়েম হেসে মাকে বলল, "যাও তো আলমারি থেকে কুড়ি হাজার টাকা বের করে হাম্বুকে দিয়ে দাও।"

মা বলল, "তুই কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে এক্ষুনি কী করবি?"

বাবা বলল, "আরে যাক না একটু বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করুক না।"

বলে কী! আমি ভিরমি খেয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা।

.

জলখাবার খেয়ে সোজা গেলাম তিস্তাদের বাড়ি। তিস্তার মা বসতে বললেন। তিস্তা চান করতে গেছে। একটু পরেই তিস্তা চান করে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। 

মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর আর পবিত্র লাগে চান করার পর। আমার মনে হল তিস্তাকে একটু ছুঁই। তাহলে আমিও পবিত্র হয়ে যাব।

তিস্তাকে টাকাটা দিতে যেতে তিস্তা কিছুতেই নেবে না। অনেক মাথার দিব্যি টিব্যি দিতে তবে নিল। তার আগে ওকে ছুঁয়ে আমায় বলতে হল, আমি চুরি করে টাকাটা আনিনি। বাবা দিয়েছে।


আমি আরও কিছুক্ষণ পরে তিস্তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এখন ঘরে যাওয়া যাবে না। আর কোনদিন না যেতে পারলেই ভাল হত। বাবা নিশ্চই এতক্ষণে সত্যিটা জেনে গেছে। নকুলদা একজন ভবঘুরে টাইপের মানুষ। ওকেই কিছু টাকা দিয়ে লটারির টিকিটওয়ালা সাজিয়ে নাটকটা করেছি। আর আমার পিতাশ্রী জীবনে এই প্রথম ঠকে গেল। কেন যে খবরের কাগজটা দেখতে চাইল না ওইসময়! পঞ্চাশ লাখের লোভে ভুল করে ফেলেছে। ওই শাইলক টাইপ মানুষটার কাছ থেকে টাকাটা বের করতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছে। ঘরে ঢুকব অনেক রাত্রে। তারপর যা হয় হবে।

.

সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে রাত একটায় বাড়ি ফিরলাম।

দেখলাম বাবা জেগে বসে আছে। থাকারই তো কথা!

কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম বাবা এখনও রীতিমতো উৎফুল্ল, বলল, "সারাদিন কোথায় ছিলি তুরুক? জানিস, একটা কাগজে নম্বর ভুল ছাপা হতে পারে তাই ইংরেজি কাগজের সঙ্গেও মিলিয়ে নিয়েছি। ফার্স্ট প্রাইজই লেগেছে।টিকিটটা আমার উকিলকে দিয়েছি, যা করার ওই করবে। তুই তো নকুল টকুল নয়, ভঞ্জদের দোকান থেকে টিকিটটা কিনেছিলি। ওরাও ফার্স্ট প্রাইজ লেগেছে বলে ডিজে লাগিয়েছে। অনেক রাত হয়েছে, তোর মা বসে আছে। খেয়ে নিবি যা।"

এমন হয়! হতে পারে! হওয়া সম্ভব! যাহ্ সেই হাড়কিপটে বাবাই জিতে গেল!


অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত

লেখক পরিচিতি


রাজ্য সরকারি চাকুরে। বসবাস মেদিনীপুরে। কর্মস্থল ঝাড়গ্রামে। শখ হল অবসর সময়ে গল্প-উপন্যাস পড়া আর অল্প-স্বল্প লেখালিখি। প্রিয় লেখক অনেকে আছেন, যেমন শিব্রাম, পরশুরাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নবারুণ, সন্দীপন ।

1 comment:

  1. অসাধারণ!!! কেন যে সংকলন বের করছেন না!!

    ReplyDelete