প্রদীপ খোঁজে আলাদীন
(১৯৭৮ শিল্ড ফাইনালের সেই ঐতিহাসিক আরারাত ম্যাচ)
অর্পণ গুপ্ত
মোহনবাগানের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন ম্যাচ হল আটাত্তরের আরারাত ম্যাচ। আজ হয়ত আরারাতের নাম বললে খুব সহজে চিনতে পারবেন না ফুটবলপ্রেমীরা, কিন্তু সত্তরের দশকে ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলে বেশ সাড়াজাগানো নাম ছিল আর্মেনিয়ার দল আরারাত। তিয়াত্তরে ডি সি এম কাপের ফাইনালে ডোকরে গ্যাং-কে হারানোর পর এত কঠিনতম প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আর খেলেন নি পিকে। আটাত্তরে অদ্ভুতভাবেই এসে গেল সেই সুযোগ। আই এফ এ শিল্ডের ফাইনালে।
আরারাতের সেই সময়ের অবস্থান একটু দেখে নিলেই আজকের ফুটবলপ্রেমীর কাছে স্পষ্ট হবে যে পিকে আর তাঁর দলবল কি অসাধ্যসাধনটাই না করেছিলেন। ১৯৭২-৭৩ উয়েফা কাপে তৃতীয় রাউন্ড অবধি পৌঁছেছিল আরারাত। এর পরের বছর ১৯৭৪ সালে ইউয়েফা ইউরোপিয়ান কাপে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছোয় ইউরোপের এই ক্লাবদলটি। কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁরা মুখোমুখি হয় বায়ার্ণ মিউনিখের। ঘরের মাঠে বায়ার্ণকে ১-০ গোলে হারিয়েও দেয় আরারাত। কিন্তু দ্বিতীয় লেগে এরিনায় ২-০ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয় তাদের। এবার এই বায়ার্ণ দলে ছিলেন বেকেনবাওয়ার থেকে গার্ড মুলারের মতো কিংবদন্তিরা। আর্মেনিয়ান লিগে দুরন্ত খেলা ছাড়াও ইউরোপের সর্বোচ্চ স্তরে ৩৬টি ম্যাচ খেলে ১৬টিতেই জিতেছিল আরারাত। ৪টি ড্র । ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ২০০৮ সাল অবধি আরারত ৬টি ম্যাচ খেলে জিতেছিল ৫টিতেই। সুতরাং আরারাতের শক্তি যে সত্তরের দশকে কতখানি ছিল তা হয়ত আর বলে বোঝানোর দরকার নেই।
সেপ্টেম্বরের বর্ষাতে এই আরারাত পা রাখল শহরে। সোভিয়েত ইউনিয়ানের ঠাণ্ডা থেকে এই স্যাঁতস্যাঁতে বর্ষার মাঠে মানিয়ে নিতে প্রাথমিকভাবে অসুবিধা হলেও শিল্ডের প্রথম ম্যাচে তারা হারিয়ে দিলেন এরিয়ান্স ক্লাবকে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ফুটবলটা আরারাত খেলল এর পরের মহামেডান ম্যাচে। শক্তিশালী মহামেডানকে আরারাত হারালো ৪-০ গোলে এবং কলকাতার দর্শক মুগ্ধ চোখে দেখল তাদের খেলা। অপূর্ব এই ইউরোপিয়ান পাসিং কলকাতার দর্শক দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। মনে মনে অনেকে নিশ্চিতই হয়ে গেলেন যে শিল্ড এবার নিয়ে যাবে এই আরারাতই। সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল লড়ল কিছুটা। কিন্তু হেরে গেল ১-০ গোলে। আন্দ্রনিক খাচাত্রিয়ান গোল করলেন। খচাত্রিয়ান ছিলেন সোভিয়েত জাতীয় দলের প্লেয়ার।
ফাইনালে এই আরারাতেরই মুখোমুখি হল পিকের মোহনবাগান। দেশের সম্মান রক্ষার একটা অঘোষিত দায়িত্বই যেন এসে পড়ল ফাইনালে মোহনবাগানের ঘাড়ে। সাতাত্তরে পেলে ম্যাচের পর পিকে যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলেন তা অনেকটাই সাহায্য করেছিল এই আরারাত ম্যাচে দলকে চাঙ্গা করতে।
দিনটা ছিল ১৫-ই সেপ্টেম্বর। শুক্রবার। শিল্ড ফাইনালে তখনও অবধি মোহনবাগান মাত্র ২ বার বিদেশী দলের মুখোমুখি হয়েছিল। প্রথমবার ঐতিহাসিক ১৯১১-এর শিল্ড ফাইনালে ইস্ট ইয়র্ক রেজিমেন্ট এবং ১৯২৩ সালের ফাইনালে ক্যালকাটা ক্লাব। আরারাত ছিল তৃতীয় বিদেশী দল যাঁদের সাথে মোহনবাগানের সাক্ষাৎ হল শিল্ড ফাইনালে। পিকে খুব সুচতুরভাবেই এই ম্যাচে নামালেন ৫ ডিফেন্ডার। বৃষ্টি হবার ফলে মাঠে জমে থাকা কাদায় আর্মেনিয়ার দলটির বল কন্ট্রোলে অসুবিধা হবে আর এই সুযোগ কাজে লাগাতেই চার ডিফেন্ডার ও এক সুইপার নামিয়ে দেন পিকে। ফর্মেশন ৪-১-২-৩। শ্যামল ব্যানার্জি-প্রদীপ চৌধুরী-কম্পটন দত্ত ও সুধীর কর্মকারের সামনে সুইপার হিসেবে সুব্রত ভট্টাচার্য। কিন্তু আরারাতের শক্তি বুঝতে শুরুতে একটু ভুলই করে ফেলেছিলেন পিকে। আরারাতের এই দলটির সামনে কোরোপিয়ান-অন্দিয়াসিয়ানদের সাথে ছিলেন এটাকিং মিডফিল্ডার খোরেন ওগানেশিয়ান। অন্দিসিয়ান যেমন ছিলেন মিউনিখ অলিম্পিকে সোভিয়েতের জাতীয় দলের সম্পদ তেমনই খোরেন ওগানেশিয়া ছিলেন আর্মেনিয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার। আরারাতের ইতিহাসেও অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিঃসন্দেহে। আরারাতের হয়ে ৩৪১ ম্যাচে ১১ গোল ছিল তাঁর। ঐ কাদামাঠেও এই ওগানেশিয়ার দুরন্ত স্কিল আটকানো ক্রমশই কঠিন হতে থাকল মোহনবাগান ডিফেন্সের কাছে। মূলতঃ পেলে ম্যাচে যেভাবে ডিফেন্স লাইনের ওপর পায়ের জঙ্গল বাড়ানোয় জোর দিয়েছিলেন পিকে আরারাতেও তাঁর ফর্মূলা ছিল বেশ কিছুটা এক। কিন্তু ওগানেশিয়া শুরুতেই গোল করে চাপে ফেলে দিলেন তাঁর দলকে। সাথে পুরো মাঠ জুড়ে আশ্চর্য নীরবতা। একটু হতোদ্যম হয়ে পড়লেও পিকে বুঝলেন আরারাতকে আক্রমণে যত আসার সুযোগ দেবে মোহনবাগান ততই জাঁকিয়ে বসবে তারা। তাই আক্রমণের পাল্টা আক্রমণের প্ল্যান বি-তে চলে গেলেন পিকে এবং ডিফেন্ডার কম্পটন দত্তকে তুলে নামিয়ে দিলেন বিদ্যুৎ গতির উইঙ্গার বিদেশ বসুকে। খেলার মাঝে বৃষ্টি শুরু হবার ফলে পিচ্ছিল মাঠে এই পরিবর্তনটাই মাস্টারস্ট্রোক হয়ে গেল পিকের। ভেজা মাঠে বিদেশের উইং দিইয়ে দৌড় শুরু হতেই চাপে পড়ে যেতে শুরু করল আরারাত। ফলে চাপ কমল মোহনবাগান ডিফেন্সের ওপর থেকে। তবে এই ম্যাচে অনবদ্য ফুটবল খেলেছিলেন মোহনবাগানের আর এক ফুটবলার তিনি গোলকিপার শিবাজী ব্যানার্জি। বেশ কয়েকবার নিশ্চিত গোল শরীর ছুঁড়ে বাঁচালেন তিনি। মোহনবাগানের গোল শোধ করতে যদিও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বিদেশ বসু উইং থেকে কাটিয়ে বল রাখেন শ্যাম থাপার উদ্দেশ্যে, শ্যাম থাপা এই বল ফের বাড়িয়ে দেন আগুয়ান হাবিবকে লক্ষ্য করে এবং গোলকিপারের ডানদিক দিয়ে মাটি ঘেঁষে বল জালে জড়িয়ে দিতে কোন ভুল করেননি ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই প্লেয়ারটি। ম্যচের ৪১ মিনিটে প্রসূন-হাবিব হয়ে বল আসে মানসের কাছে। আরারাত হাফ আজারিয়ানের পায়ের ফাঁক দিইয়ে বলটা কাটিয়ে দুরন্ত গতি বাড়িয়ে এগোতে থাকেন তিনি সামনে আগুয়ান সারকিসিয়ানক কাটিয়ে স্টেডিয়ামকে উত্তাল করে দিয়ে মোহনবাগানকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেন মানস ভট্টাচার্য।
প্রথমার্ধে ২-১ এগিয়ে শেষ করলেও দ্বিতীয়ার্ধে আরারাত ফের একবার আক্রমণের ঝড় তোলে মোহনবাগান ডিফেন্সে। কিন্তু মোহনবাগান ডিফেন্সে সেদিন পাহাড় হয়ে ওঠেন শ্যামল ব্যানার্জি। তবে বহু লড়াই-এর পরেও সেদিন মোহনবাগান ডিফেন্স দ্বিতীয়ার্ধে পুরো অটুট থাকে নি। ৬০ মিনিটের মাথায় কোরেন আগানেসিয়াস প্রায় ১৮ গজ দূর থেকে গোলার মতো শটে মোহন ডিফেন্সকে দাঁড় করিয়ে ২-২ করে যান। এই ম্যাচ শেষ হয় ২-২ গোলে। আরারাত প্রথম আটকাল শিল্ডে মোহনবাগানের কাছে। কিন্তু যুগ্মবিজয়ী হিসেবে শিল্ড জিতল আরারাত ও মোহনবাগান। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী শিল্ড যুগ্মবিজয়ী হলে ৬ মাস করে থাকত দুটি দলের কাছেই। কোন দলের কাছে প্রথম ৬ মাস শিল্ড থাকবে তা নির্ধারিত হত টসের মাধ্যমে। এই টসে মোহনবাগান অধিনায়ক প্রসূন ব্যানার্জি জেতায় শিল্ড থেকে গেল এদেশেই। কিন্তু আরারত স্মৃতিস্বরূপ শিল্ডের একটি প্রতিকৃতি নিয়ে গেল আর্মেনিয়ায়। এই ম্যাচটির পর পিকের ডিফেন্সিভ থেকে এটাকিং হয়ে যাবার দুরন্ত স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আলোচনাও হয় পত্রপত্রিকায় বিস্তর। তবু এই ম্যাচ নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর লেখাটি লিখেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়:
" পিকে ভেবেছে সারারাত
কীসে হারবে আরারাত?
কী হয়, কী হয় সারাদিন
প্রদীপ খোঁজে আলাদিন..."
সত্তরের দশকের ফুটবল, সাহিত্য আর রোম্যান্টিসজম আলাদা করা যায় না, এখানেই বোধহয় ফুটবল নিয়ে আসে তার সমস্ত নির্যাস. যার সম্মোহন থেকে বেরোনো বড্ড কঠিন...
আঁকাঃ পূজা কর
লেখক পরিচিতি
আমি এবিপি স্কুল, শুকতারা এই দুই প্রিন্ট মাধ্যম আর প্রহর ডিজিটাল মাধ্যমে ক্রীড়া নিয়ে লিখি।
No comments:
Post a Comment