ভ্রমণঃ মোনালিসার বাড়ি - সুগত বন্দ্যোপাধ্যায়

মোনালিসার বাড়ি


সুগত বন্দ্যোপাধ্যায়


খুব ছোটবেলার যে স্মৃতিগুলো এখনও ঝাপসা হয়ে যায়নি, তার মধ্যে একটা হল হুগলিতে আমার দাদুর ঘরের দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি। ছবিটা এক বিদেশিনীর। হাতের ওপর হাত রাখা, ঠোঁটের কোনে  একটা মৃদু হাসির আভাস। পরে জেনেছিলাম দাদুর এক ছাত্র প্যারিস থেকে সেটা এনে দিয়েছে। ততদিনে অবশ্য আরও অনেক কিছুই জেনেছি মোনা লিসা সম্পর্কে, আমাদের বাড়িতেই আরও একটা প্রিন্ট এসেছে মোনা লিসার। কিন্তু আসল জিনিসটা চোখে দেখার জন্য ইউরোপ বেড়ানোর প্ল্যানে প্যারিস রাখতেই হয়েছিল। আমাদের প্যারিসের ছদিনের প্রোগ্রাম ছিল এরকম: প্রথমদিন পৌঁছে একটু পায়ে হেঁটে ঘোরা আর রাতে আইফেল টাওয়ারের আলো দেখা। পরদিন ভার্সাই প্রাসাদ, তার পরদিন বাসে করে প্যারিস ঘোরা আর বিকেলে আইফেল টাওয়ারে চড়া, পরদিন আবার বাসে করে প্যারিস ঘোরা, আর বিকেলে লঞ্চ করে ঘোরা, তার পরদিন গোটাদিন ল্যুভ্র আর শেষ দিন আরও দুটো মিউজিয়াম। তারও পরেরদিন ভোরবেলা দ্রুতগতির ট্রেন TGV ধরে আমরা প্যারিস ছেড়ে চলে যাব দক্ষিণ ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগর উপকূলে নিস্ (Nice) শহরে।


তবে ল্যুভ্র মিউজিয়ামের ব্যাপারটা বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়।

প্রথমত, ল্যুভ্র (মতান্তরে ল্যুভর বা ল্যুভ্) মিউজিয়ামটার আয়তন প্রায় আট লক্ষ বর্গফুট, আর সেখানে ৩৮,০০০ দেখার জিনিস আছে। একদিনে দেখা তো দূরের কথা, ল্যুভ্র এক সপ্তাহেও দেখা হয়না। অনেকে সিজন টিকিট কেটে ওখানে মাসের পর মাস যায়। আমাদের সে সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, ইদানিং ওখানে এত ভিড় হচ্ছে (এটা জুন ২০১৯ এর গল্প। ২০১৯ সালে প্রায় এক কোটি লোক ল্যুভ্র দেখেছে ) যে ওখানকার কর্মচারীরা কয়েকবার ধর্মঘট ডেকেছে। আগে থেকে টিকিট না কেটে গেলে ঢোকা মুশকিল। আমরা সে কাজটা অনলাইনে সেরে রেখেছিলাম। তাই প্যারিসে পৌঁছে ঠিক দিনে আমরা, মানে আমি, আমার গিন্নি পৌলমী আর এক বছরের ছানা অলি ল্যুভ্ৰ গিয়ে হাজির হলাম।

ল্যুভ্ৰ মিউজিয়াম একটা প্রকান্ড উঠোনের তিনদিক ঘেরা খানিকটা ইংরাজি "ইউ" অক্ষরের মতন একটা প্রাসাদ। সেই উঠোনের মাঝখানে একটা ৭১ ফুট উঁচু কাঁচের পিরামিডের মধ্যে দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা। উঠোনে বিরাট লম্বা লাইন, যারা টিকিট কেটে আসেনি তাদের জন্য। আমরা সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে লিফটে করে মূল মিউজিয়ামের লবিতে এসে পৌঁছলাম। মানে আমি ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নামলাম, আর পৌলমী প্র্যাম নিয়ে লিফটে নামল।


আমরা ঠিক করেছিলাম, মোনা লিসা (ফরাসি ভাষায় "La Joconde") দিয়েই শুরু করব। মোনালিসা অবশ্য মিউজিয়ামের ঠিক মাঝখানে, শুরু করার পক্ষে ভাল নয় মোটেই, কিন্তু কপালে কি আছে কে জানে? আবার হয়ত কর্মচারীরা ধর্মঘট ডেকে বসল আর মিউজিয়াম তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেল! আমার কপালে এসব খুব হয়। তাছাড়া কপালটা খারাপও চলছে, তার আগের দিনই মেট্রোয় দুশো ইউরো পকেটমার হয়েছে, তাই আসল জিনিসটা প্রথমে দেখে নেওয়াই ভাল। তা বুঝলাম অনেকেই আমাদের মতন চিন্তা করে, কারণ মিউজিয়ামের কর্মচারীরা মোনা লিসার ঘর চিনিয়ে দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েই আছে। তাদের জিজ্ঞেস করে করে সহজেই পৌঁছনো গেল সেখানে।

মিউজিয়ামের হিসেবে একটা ছোটোখাটো ঘর, তার একটা দেওয়ালে একটা মাত্র ছোট ছবি। ঘরের ভেতর দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের মতন ভিড়, লোকে সামনে যাবে বলে গুঁতোগুঁতি করছে। সেই ভিড় ঠেলে বাচ্চার প্র্যাম নিয়ে ছবির সামনে কি করে পৌঁছবো সেটাই ভাবছি, হঠাৎ গার্ড বলল, "আপনাদের বাচ্চা আছে, আপনারা এদিকে আসুন।" দেখি ঘরের দেওয়াল বরাবর দড়ি দিয়ে একটা পথ করে দেওয়া হয়েছে, হুইলচেয়ার আর প্র্যামওলা লোকেদের জন্য। আমরা সেখান দিয়ে যে শুধু হুশ করে সামনে পৌঁছে গেলাম তাই নয়, পৌঁছলাম মোনা লিসার একদম সামনে, বাকি লোকেরা যে দড়ির রেলিঙের বাইরে থেকে দেখছিল, তার ভিতরে। বুলেট প্রুফ কাঁচের পিছনে সেই চিরন্তন হাসি। ছবি-টবি তুলে যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছি তখন সেই হাসির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের মুখেও। "ওই অন্য লোকগুলো কেমন এখনও গুঁতোগুঁতি করছে দেখো!"


ল্যুভ্ৰ মিউজিয়াম বললেই লোকে মোনা লিসার কথা ভাবে ঠিকই, কিন্তু মোনা লিসা হল রেনেসাঁস যুগের ইউরোপের অনেক ছবির মধ্যে একটা ছবি। খুব সাধারণ একটা ছবি। ওই ঘরের বাইরের গ্যালারিতে আরও অনেক ছবি আছে, তার প্রায় প্রত্যেকটাই মোনা লিসার থেকে বড়, আর আমার মতে অনেকগুলোই আরও বেশি ভালোও। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকাই চারটে ছবি আছে এখানে। গ্যালারিটার এ মাথা থেকে ও মাথা দেখা যায়না প্রায়। দুদিকের দেওয়ালে পর পর বিখ্যাত ছবি টাঙানো। কিছু ছবি, যেমন "Virgin of the Rocks", "Grande Odalisque", "The Raft of Medusa" বা "Liberty Leading the People" আমার চেনা। কিছু ছবি দেখা কিন্তু নাম না জানা, কিংবা হয়ত শিল্পীর নাম চেনা। আর বেশিরভাগই ছবিই আমার অচেনা। কিন্তু চেনা বা অচেনা যাই হোক না কেন, প্রত্যেকটা ছবিই এমন যে সময় থাকলে একেকটা ছবিকেই কয়েক ঘন্টা ধরে দেখা যায়। যেমন তার ডিটেল তেমনই তার সাইজ। একেকটা ছবি মেঝে থেকে প্রাসাদের ছাদ অবধি উঠে গেছে। সোনার গিল্টি করা চওড়া ফ্রেমগুলোও দেখার মতন। আর শুধু কি ছবি? প্রাসাদের মেঝে, দেওয়াল, থাম, সিলিং সবই তো হাঁ করে দেখার মতন। মিউজিয়ামের বাড়িটাই যেন একটা মিউজিয়ামে রাখার মতন জিনিস। গ্যালারির মাঝখানে গদি দেওয়া বেঞ্চি পাতা, সেখানে ক্লান্ত লোকজন ঘুরতে ঘুরতে বসে পড়েছে। বসে বসেই ছবি দেখছে। আমরা এখনও ক্লান্ত হইনি, তাই আমরা গ্যালারিটা আস্তে আস্তে শেষ করে ফেললাম। শেষ মাথায় এসে দেখলাম সেটা আরেকটা গ্যালারির শুরু। সেখানে আবার একটা ইস্কুলের দল এসেছে, বাচ্চারা সব ঘরের মাঝখানে ভিড় করে বসেছে আর টিচাররা তাদের ফরাসি ভাষায় কিসব বোঝাচ্ছে।


ল্যুভ্র মিউজিয়ামে প্র্যাম নিয়ে ঘোরার একটা সমস্যা হল, পুরোনো দিনের বাড়ি বলে ক্রমাগত সিঁড়ি ভাঙতে হয়। কোনো দুটো ঘর এক লেভেলে নয়, দু-তিন ধাপ হলেও সিঁড়ি আছে। সেখানে হুইলচেয়ারের জন্য অবশ্য ছোট ছোট প্ল্যাটফর্ম লিফ্ট আছে, কিন্তু প্র্যাম নিয়ে সেগুলোতে চড়তেও সময় লাগে। আমরা কখনও কখনও অলিকে শুদ্ধ প্র্যামটা তুলে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছিলাম। আরেকটা ভয় ছিল, অলির চিৎকার করা নিয়ে। আগের দিন ভার্সাই প্রাসাদে গিয়ে অলি এমন হইচই বাঁধিয়েছিল যে সব লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। চিৎকার মানে কান্নাকাটি নয়, উল্লাসের চিৎকার। প্রাসাদের ঘরে চ্যাঁচালে যে প্রতিধ্বনি হয় সেটা আবিষ্কার করার ফল। তবে ভার্সাই এর পরিবেশ শান্ত ছিল। আজ এখানে এত ভিড় ছিল যে অলি চ্যাঁচালেও শোনা যেতনা। সেটা বুঝেই বোধহয় বেচারা একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।

আমরা সেদিন ঘন্টা ছয়েক টানা হেঁটে ল্যুভ্র দেখেছিলাম, মাঝে শুধু খাবার জন্য একটু বিরতি নিয়েছিলাম। কত কি যে দেখেছি সে কথা মনে রাখাই সম্ভব নয়, লিখব কি করে? শুধু তো রেনেসাঁস যুগের ছবি নয়, প্রাচীন মিশর থেকে প্রায় আধুনিক যুগ পর্যন্ত অজস্র ছবি, মূর্তি গয়না, মমি, ভাস্কর্য, বাসনকোসন, আসবাবপত্র আর যে কত কিছু কি বলব। ফরাসি সম্রাটদের প্রাসাদের একেকটা ঘর বানিয়ে রাখা আছে, সমস্ত আসবাব-গালচে-ঘড়ি-ঝাড়লণ্ঠন সবশুদ্ধ। তাও তো কত গ্যালারি বন্ধ ছিল সারাইয়ের জন্য, সেগুলো দেখা হলনা। দেখা হয়নি নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেকের ৩২ ফুট বাই ২০ ফুট মাপের প্রকান্ড ছবিটা, যেটা ছোটবেলায় একটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে দেখে থেকে আমার দেখার শখ ছিল। মিশরের আর মধ্যপ্রাচ্যের কিছু বিখ্যাত জিনিসপত্রও দেখা হলনা গ্যালারি বন্ধ ছিল বলে।

মোনা লিসা ল্যুভ্র মিউজিয়ামের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্ম, তবে আরও কয়েকটা জিনিস আছে যেগুলো প্রায় একইরকম বিখ্যাত। "Winged Victory of Samothrace" আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৯০-এর একটি মূর্তি। মাথাভাঙ্গা এই মূর্তিটা গ্রীক দেবী নাইকির (জয়ের দেবী, যার নামে Nike কোম্পানি)। সাদা মার্বেলের মূর্তির কাঁধে মার্বেলের ডানা আর গায়ে হাওয়ায় লেপ্টে থাকা মার্বেলের জামাকাপড় দেখে তাক লেগে যায়। এ মূর্তিটা রাখা আছে একটা প্রকান্ড সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে। এছাড়াও দেখলাম "Venus de Milo", যেটা সম্ভবত সবথেকে বিখ্যাত গ্রীক মূর্তি। হাতভাঙা এই নারীমূর্তির সামনেও মোনা লিসার মতোই ভিড়। রেনেসাঁস যুগের আরও অসাধারণ কিছু ভাস্কর্য আছে, যার মধ্যে দুটো মাইকেলেঞ্জেলোর তৈরী। একটা সময়ের পর আর পা চলতে চায়না, কিছু মাথায় ঢুকতে চায়না। তাও ধুঁকতে ধুঁকতে আমরা প্র্যাম ঠেলে গ্যালারির পর গ্যালারি ঘুরেছি, কারণ মধ্যবিত্ত মানুষের বেড়ানো, সময় আর পয়সা দুটোই সীমিত। আরেকদিন ল্যুভ্র ঘোরা যাবেনা, তাই একদিনেই যতটা সম্ভব দেখে নিতে হবে। কিছু ভাল লাগলে ফটো তুলেছি, আবার অনেক সময়েই ক্লান্তিতে ফটো তোলার কথাও মনে আসেনি। আর চারটি ফটো তুলে হবেই বা কি?  রেমব্রাঁ কি রুবেন্স-এর ফটো তুলে ফেসবুকে দেব? তার চেয়ে বরং নিজে কিছুক্ষণ চুপ করে দেখলে লাভ।

সব ভাল জিনিসই শেষ হয়, আমাদের ল্যুভ্র দেখাও এক সময় শেষ করতে হল। উঠোনের পিরামিডটায় সন্ধ্যায় আলো জ্বালা হলে দেখতে ভাল লাগে, কিন্তু আমাদের হোটেলে ফিরতে হবে কারণ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে অলিও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মিউজিয়ামের নিচে দোকান হয়ে বেরোনোর ব্যবস্থা। দোকানে বিখ্যাত সব ছবি আর ভাস্কর্যের নকল বিক্রি হচ্ছে। এই দোকান থেকেই আমাদের বাড়ির মোনা লিসাটা কেনা হয়েছিল। আমরা একটা ছবির প্রিন্ট কিনলাম ঘরে টাঙ্গাব বলে। ল্যুভ্র একদিন দেখেই ছেড়ে যেতে হবে, কিন্তু এক টুকরো ল্যুভ্র আমরা ঘরে রেখে দেব সারা বছর দেখার জন্য।


লেখক পরিচিতি


সুগত বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মসূত্রে হুগলি-চুঁচুড়ার বাসিন্দা হলেও তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে এলাহাবাদে। উচ্চশিক্ষা ও চাকরিসূত্রে থেকেছেন চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, কলকাতা, নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসি তে। তিনি বর্তমানে শিকাগোর শহরতলিতে লেক ফরেস্ট কলেজে কম্পিউটার সাইন্সের অধ্যাপক। বেড়াতে, ব্লগ লিখতে আর ছবি তুলতে ভালোবাসেন। এখানে ওনার লেখার সঙ্গে প্রকাশিত ছবিগুলি ওনার নিজেরই তোলা।

No comments:

Post a Comment