শ্মশান বোলান
অভিজিৎ দাশগুপ্ত
গাজনের সময় মহাদেবকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয় বোলান। 'বুলা' ধাতু থেকে শব্দটির উৎপত্তি ; এমন কথা বলেছেন ডক্টর সুকুমার সেন । এই বোলান মূলত ধর্ম পূজার উৎসব হিসেবে গাওয়া হয়। শ্মশান হলো তার এক প্রতিফলিত দৃশ্য । এখানে শিল্পীরা কাল্পনিক শ্মশান তৈরি করে মড়ার মাথা হাতে নিয়ে বৃত্তাকারে গান গায় । তাদের সাজ-পোষাক অনেকটা রাক্ষসের মত হয় । কখনো কখনো কুকুর, শেয়াল ইত্যাদি ভঙ্গিমাও লক্ষ্য করা যায় । এরা রাম-দা ,তলোয়ার ,টাঙি ইত্যাদি হাতে তুলে নেয় অভিনয়ের জন্য। গবেষক তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, 'এই খেলায় কেউ কুকুর সাজে আবার কেউ শকুন । চলে মড়া নিয়ে টানাটানি । একজন মড়া সেজে কেন্দ্রবিন্দুতে শুয়ে থাকে । 'সেই' কল্পিত শ্মশান ধূপ ধুনোতে ভরে ওঠে। ভক্তরাই সেই কাজগুলি করে দেয়।
আসলে শ্মশান বোলান হল ভাড়া করা কাঁদুনে । আগে এরা মড়ার মাথা নিয়ে কাজ করতো । বর্তমানে তা সম্ভব নয় বলেই প্লাস্টিক বা অন্য কোনও ধাতুর তৈরি পুতুলে কাজ সারা হয় । আমাদের ভারতবর্ষের রাজস্থানে এমনটা দেখা যায় । এ প্রসঙ্গে আমরা মহাশ্বেতা দেবীর একটি বিখ্যাত গল্পের অনুসরণে কল্পনা লাজমির 'রুদালী ' (১৯৯৩) চলচ্চিত্রটির কথা বলতে পারি । রাজস্থানের ধনীগৃহে কেউ মারা গেলে কালো পোশাক পড়ে এই সম্প্রদায় উপস্থিত হয় এবং মাটি চাপড়ে শোক প্রকাশ করে।
কিন্তু আমাদের বাংলায় এমন হওয়ার কথা নয় । সে সংস্কৃতিগত কারণেই হোক বা এখানকার জল-বাতাসের গুণেই হোক । প্রিয়জন মানে প্রিয়জন । তার মৃত্যুর ঘটনা প্রাণের স্পন্দন থামিয়ে দেয় । ফলে বাংলায় শ্মশান সম্প্রদায়ের টিকে থাকা খুবই কষ্টকর। তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, 'যেখানে একদিন না খাটলে মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে সেখানে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী শিল্পীদের শিল্পীমনা অভিনয়কে ফুটিয়ে তোলা খুবই কঠিন।' তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এইরকম একটি পালার সন্ধান দিয়েছেন আমাদের । ১৯৯৪ সালে বর্ধমানের দাঁই-হাটার রঞ্জিতকুমার দাস 'শ্মশান মিলন' নামে একটি পালা রচনা করেন। শৈব্যা- হরিশচন্দ্রের প্রচলিত কাহিনিকেই তুলে আনা হয়েছে পালাটিতে । আসলে এখানে কাহিনীর শেষ অংশ তুলে ধরেছেন রচয়িতা । অর্থাৎ মৃত রোহিতাশ্বকে নিয়ে শৈব্যার শ্মশানে গমন এবং অসহায় কান্না । পরে হরিশ্চন্দ্রের সঙ্গে মিলন এবং সবশেষে বিশ্বামিত্রের আগমন । ১৫ টি সুরের সাহায্যে এই রচনা । সুর: ১ এর পূর্বে ধুয়ো -
"রোহিত রে --- ও বাপ রোহিত
কোথায় গেলি ফুল তুলিতে ও রে বাছাধন হায়রে (২ বার)
আজ তোরে না দেখিয়া আমার, মন করে কেমন ।।"
তারপর সুর:১ থেকে সুর:৬ পর্যন্ত শৈব্যার কথনে পুত্রহারা মায়ের কান্না আর্তনাদের মতো প্রকাশ পেয়েছে । এরপর থেকে সুর:১৪ পর্যন্ত প্রথম পুরুষে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আবার কখনো কখনো শৈব্যা বা হরিশচন্দ্রের কথা এসেছে প্রয়োজনের কারণে।
বস্তুত এই বোলান বাংলার নিজস্ব সংগীত । এ হলো লোকসঙ্গীতের এক অপূর্ব নিদর্শন। বন্দনা, মূল পালা, ও ভণিতার মিশ্রণে তৈরি হয় বোলান। এই গানগুলির বেশ কয়েকটি ভাগ লক্ষ্য করা যায় । যেমন - সখীনাচের বোলান , দাঁড় বোলান, পালাবন্দী বোলান , সাঁওতেলে বোলান ইত্যাদি।
শ্মশান বোলানের পালাগুলি সাধারণত পৌরাণিক হয়। যেমন , 'তরণীসেন বধ', 'বালী বধ', 'অভিমুন্য বধ' ইত্যাদি । যুগ যুগ ধরে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের অভিজ্ঞতাই এই পালাগুলির সৃষ্টির পশ্চাতে কাজ করেছে । শিল্প এবং জীবন - এই দুয়ের পরিপূর্ণতায় তৈরি হয়েছে শ্মশান বোলান।
গ্রন্থ ঋণ:
১. পাঁচালিকার ও বোলান গানের ইতিবৃত্ত : তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
২.বলেন্দ্র-গ্রন্থাবলী : সম্পাদনা --- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস।
৩.বইয়ের দেশ।
লেখক পরিচিতি
জন্ম ১৭ই জাউয়ারি, ১৯৭০ কলকাতায়। বাবার রেলে চাকরির সুবাদে শৈশবে ভাগলপুর, রামপুরহাটে বসবাস। বর্তমানে কলকাতাবাসী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর অভিজিৎ পেশায় শিক্ষক। পাশাপাশি অব্যাহত সাহিত্যচর্চা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৮টি, গদ্যগ্রন্থ ৩টি। গদ্যগ্রন্থগুলো গবেষণা-প্রসূত। 'খোয়াই' নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত। ২০১৬-তে 'ইলিশমঙ্গল কথা' বইটির জন্য 'আত্মদ্রোহ সাহিত্যকৃতি সম্মান' লাভ। স্বল্পভাষী এই কবি ও গবেষকের প্রিয় শখ ইতিহাস চর্চা ও ভ্রমণ।
No comments:
Post a Comment