প্রবন্ধঃ কনৈয়ালাল মুনশীর ঐতিহাসিক উপন্যাসত্রয়ী - জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 


কনৈয়ালাল মুনশীর ঐতিহাসিক উপন্যাসত্রয়ী 


জয়ন্ত ভট্টাচার্য



ভারতীয় বিদ্যা ভবনের প্রতিষ্ঠাতা, মহাত্মা গাঁধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, স্বাধীনতাসংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ কনৈয়ালাল মাণেকলাল মুনশী (১৮৮৭-১৯৭১) আধুনিক গুজরাতী সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখনীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর রচিত উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ বিংশ শতকের গুজরাতী সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে। মূলতঃ মহাভারতের কাহিনীর ভিত্তিতে লেখা অসমাপ্ত উপন্যাস ‘কৃষ্ণাবতার’ সম্ভবতঃ তাঁর সর্বাপেক্ষা পরিচিত সৃষ্টি। সামাজিক পরিস্থিতি, ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনী তাঁর উপন্যাসের প্রধান বিষয়। 

আধুনিক গুজরাতী সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার সূত্রপাত ঊনবিংশ শতকে। নন্দশঙ্কর তুলজাশঙ্কর মেহতার (১৮৩৫-১৯০৫) লেখা ‘করণ ঘেলো’ (১৮৬৮) বাঘেলা রাজবংশের শেষ রাজা কর্ণদেবকে (রাজত্বকাল ১২৯৬-১৩০৪ সাধারণাব্দ) নিয়ে রচিত। এরপর জাহাঙ্গীর আর্দেশির তল্যারখান (১৮৪৬-১৯২৩) রচিত ঐতিহাসিক রোমান্স, ‘মুদ্রা অনে কুলীন: অথবা অঢারমী সদীনু হিন্দুস্তান’ (১৮৮৪) যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়। এই একই কালপর্বে মহীপতরাম রূপরাম নীলকণ্ঠের (১৮২৯-১৮৯১) লেখা দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘সধরা জেসংগ’ (১৮৮০) ও ‘বনরাজ চাবড়ো’র (১৮৮১) বিষয়বস্তু যথাক্রমে সোলঙ্কিবংশীয় রাজা জয়সিংহ সিদ্ধরাজ (রাজত্বকাল ১০৯৪-১১৪৪ সাধারণাব্দ) ও চাবড়াবংশীয় রাজা বনরাজ চাবড়ার (রাজত্বকাল ৭৪৬-৭৮০ সাধারণাব্দ) রাজত্বকাল। কনৈয়ালাল মুনশীর রচনারীতি এই ধারারই অনুসারী এবং সম্ভবতঃ তাঁর লিখনশৈলীর প্রেরণার উৎস গোবর্ধনরাম মাধবরাম ত্রিপাঠীর (১৮৫৫-১৯০৭) চার খণ্ডের উপন্যাস ‘সরস্বতীচন্দ্র’ (১৮৮৭-১৯০১)।  

‘পাটণত্রয়ী’ নামে পরিচিত আদি মধ্যযুগের গুজরাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কনৈয়ালাল মুনশীর লেখা তিনটি ধারাবাহিক উপন্যাস – ‘পাটণনী প্রভুতা’ (১৯১৬), ‘গুজরাতনো নাথ’ (১৯১৭) ও ‘রাজাধিরাজ’ (১৯২২) আজও গুজরাতী সাহিত্য পরিমণ্ডলে জনপ্রিয়। হিন্দী ও ইংরাজিতে এই উপন্যাসত্রয়ী অনুদিত হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসকে তথ্যের সঙ্গে কাল্পনিক ঘটনাবলীর সংযোজন করে ঐতিহাসিক উপন্যাসের আঙ্গিকে উপস্থাপন করে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জনপ্রিয় করার যে রীতি ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় ভাষায় সাহিত্যিকরা প্রচলন করেন, কনৈয়ালাল মুনশীর এই তিনটি উপন্যাস সেই ধারার প্রামাণ্য প্রতিনিধি। বিংশ শতকের গোড়ায় মুনশী ‘গুজরাতনী অস্মিতা’র (গুজরাতী আত্মাভিমান) জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারণার উদ্ভাবন করেন। এই রাজনৈতিক মতাদর্শ তিনি তাঁর ‘গুজরাতনী অস্মিতা’ (১৯২২) নিবন্ধে প্রথম ব্যাখ্যা করেন। আলোচ্য তিনটি উপন্যাসে, তাঁর মতাদর্শকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশে, এই ‘অস্মিতা’র ধারণার ঐতিহাসিক ভিত্তি স্থাপনের প্রয়াস করা হয়েছে। মুনশীর লেখা অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাস, যেমন, ‘পৃথিবীবল্লভ’ (১৯২১), ‘জয় সোমনাথ’ (১৯৪০) বা ‘ভগ্ন পাদুকা’য় (১৯৫৪) তাঁর এই বিশিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন পরিদৃষ্ট হয়েছে।

মুনশীর ‘পাটণনী প্রভুতা’, ‘গুজরাতনো নাথ’ ও ‘রাজাধিরাজ’, এই তিনটি উপন্যাসের পটভূমি গুজরাতের চৌলুক্য বা সোলঙ্কি রাজপূত বংশীয় রাজা জয়সিংহ সিদ্ধরাজের রাজত্বকালের (১০৯৪-১১৪৪ সাধারণাব্দ) অণহিলবাড়া-পাটণ, চৌলুক্যদের রাজধানী। মুনশীর এই উপন্যাসত্রয়ী রচনার মূল উদ্দেশ্য গুর্জরদেশের (অর্থাৎ আদি মধ্যযুগের গুজরাতের) এক উচ্চাভিলাষী তরুণ শাসকের, তাঁর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রত্যুৎপন্নমতি  ও ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ মন্ত্রীর পরামর্শ ও সহায়তায়, ক্রমিক সাফল্যের মাধ্যমে সমগ্র গুর্জরদেশ জয়ের কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে আদি মধ্যযুগের হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাজাদের শাসনকালে গুজরাতের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের ধারণার প্রসার। এই কাহিনীত্রয়ীর মুখ্য চরিত্র গুজরাতের মহামন্ত্রী ও পাটণের নগরসেঠ মুঞ্জাল মেহতা, একটি কাল্পনিক চরিত্র। মুনশীর সৃষ্ট এই চরিত্র, মুঞ্জাল মেহতা, রাজশক্তির রক্ষক। জ্ঞান বা নৈতিকতা তাঁর ক্ষমতার উৎস নয়; চাণক্যসুলভ কূটবুদ্ধি, বিরোধীদের চেয়ে দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপ চিন্তা করার ক্ষমতা এবং গুপ্তচরবাহিনীর ব্যাপ্তির কারণে তিনি একই সঙ্গে প্রজাদের ভীতি ও প্রীতির উদ্রেককারী। 

মুঞ্জাল মেহতা ও গুজরাতী আত্মাভিমানের মতাদর্শের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে মুনশী তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘সীধা চঢ়াণ’ (১৯৪৩) গ্রন্থে লিখেছেন: 

“কিন্ত, আজ সাতাশ বছর পরে, আমি এইটুকু বলতে পারি যে যখন থেকে আমি মুঞ্জালের কল্পনা করেছি, তখন থেকে আমার মধ্যে গুজরাতের অস্মিতা জাগরিত হয়েছে।...১৯১৫তে গুজরাতীদের মধ্যে - কিছু সাহিত্যিক ছাড়া – জাতীয় বা সাংস্কৃতিক অস্মিতা ছিল না।...ঐ সময় গুজরাতের ইতিহাস ছিল না।...১৯১৬তে ‘পাটণনী প্রভুতা’র ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম-‘গুজরাত এক মহা বৃক্ষ, তার মূলে পরমাত্মা কৃষ্ণের কর্মযোগ লুকিয়ে রয়েছে, তার ডালে দয়ানন্দ আর গাঁধীর কুঁড়ি ফুটেছে’। এই মহত্বের নিষ্পাদকের সন্ধান করতে গিয়ে আমার কল্পনা আমার প্রবৃত্তির সহায়তায় মুঞ্জাল মেহতার জন্ম দিয়েছে। এই কারণে মুঞ্জাল আমার গুজরাতের অস্মিতার সন্তান ও পিতা দুইই।”

মুনশী তাঁর এই তিনটি ঐতিহাসিক উপন্যাসে প্রকৃত ইতিহাসের বর্ণনার মত বিক্রমসম্বতে সাল-তারিখ উল্লেখ করেছেন। উপন্যাসত্রয়ীর শুরুতে দেখা যায় গুর্জরদেশ পাটণ, সোরঠ, খম্ভাত ও লাটের মত কয়েকটি পৃথক রাজ্যে বিভক্ত, শেষে দেখা যায় রাজা জয়সিংহ সিদ্ধরাজের অধীনে সমগ্র গুর্জরদেশ ঐক্যবদ্ধ।   

মুনশীর প্রথম উপন্যাস ‘পাটণনী প্রভুতা’র কাহিনী ১১৫০ বিক্রমসম্বতের (১০৯৪ সাধারণাব্দ)। উপন্যাসের শুরুতে চৌলুক্যবংশীয় রাজা কর্ণদেবকে (রাজত্বকাল ১০৬৪-১০৯৪ সাধারণাব্দ) মৃত্যুশয্যায় দেখা যায়। কর্ণদেবের মৃত্যুর পর. রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে জনৈক ‘জতি’ (জৈন সন্ন্যাসী) আনন্দসূরির কর্ণদেবের বিধবা রাণী মীনলদেবীকে প্রভাবিত করে গুজরাতকে জৈন রাজ্যতে পরিবর্তিত করার ষড়যন্ত্র ও মুঞ্জাল মেহতার মীনলদেবীর হৃদয় পরিবর্তন করে এই ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার কাহিনী বর্ণনার পর এই উপন্যাসের সমাপ্তি হয়েছে ‘জয় সোমনাথ’ ধ্বনির সঙ্গে বালক রাজকুমার জয়দেবের (জয়সিংহ) পাটণের সিংহাসনে আরোহণে। 

মুনশীর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘গুজরাতনো নাথে’র শুরু ‘পাটণনী প্রভুতা’র কাহিনীর সমাপ্তির চার বছর বাদে, ১১৫৪ বিক্রমসম্বতে (১০৯৮ সাধারণাব্দ)। কাহিনীর সুচনা মুঞ্জালের অনুপস্থিতির সময় প্রতিবেশী অবন্তীর (মালব) রাজা লক্ষ্মবর্মার (রাজত্বকাল আনু. ১০৮৬-১০৯৪ সাধারণাব্দ) সৈন্যবাহিনীর পাটণ আক্রমণের (কাল্পনিক) ঘটনার বর্ণনায়। এরপর, সমগ্র উপন্যাসে কিশোরবয়সী রাজা জয়সিংহের রাজত্বকালে, তাঁর মন্ত্রী হিসাবে মুঞ্জাল মেহতার বুদ্ধিমত্তা, জয়সিংহের খুড়তুত দাদা ত্রিভুবনপাল ও লাটের এক ব্রাহ্মণ সেনাপতি কাক ভট্টরাজের বীরত্বের দ্বারা সৌরাষ্ট্র (সোরঠ) ও স্তম্ভতীর্থের (খম্ভাত) শাসকদের বিদ্রোহ পরাস্ত করার কাহিনী বর্ণিত।  

মুনশীর তৃতীয় উপন্যাস ‘রাজাধিরাজে’র কাহিনীর সূত্রপাত, ‘গুজরাতনো নাথে’র সমাপ্তির পনের বছর পর, ১১৬৯ বিক্রমসম্বতে (১১১৩ সাধারণাব্দ)। কাহিনীর শুরু জয়সিংহের বাহিনীর সৌরাষ্ট্রের রাজধানী দুর্ভেদ্য জুনাগড় দুর্গ আক্রমণ ও জয়ের বর্ণনার মাধ্যমে। উপন্যাসের প্রথম অংশে মুনশী গুজরাতী লোক ঐতিহ্য অনুসরণ করে সৌরাষ্ট্রের রাজা রা খেঙ্গরের মৃত্যুর পর জয়সিংহের খেঙ্গরের পত্নী রণকদেবীর প্রতি আকর্ষণ ও রণকদেবীর খেঙ্গরের চিতায় আত্মবিসর্জনের বর্ণনা করেছেন। এরপর বর্ণিত হয়েছে লাটের নগরসেঠ তেজপালের পুত্র রেবাপালের বিদ্রোহ দমন করে লাটের উপর জয়সিংহের অধিকারস্থাপনের কাহিনী। ‘রাজাধিরাজ’ সমাপ্ত হয়েছে গুর্জরদেশের সমস্ত বিরোধী শক্তির অবসানের পর লাটের রাজধানী ভৃগুকচ্ছের (ভারুচের) পথে পুনঃপুনঃ ‘জয় সোমনাথ’ ধ্বনির সঙ্গে ‘রাজাধিরাজ’ জয়সিংহ সিদ্ধরাজের মুঞ্জাল মেহতা, কাক ভট্টরাজ ও অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ে বিজয় শোভাযাত্রায়। 

১৯৫৬ সালে কনৈয়ালাল মুনশীর ৭০তম জন্মদিন পালনের উদ্দেশে গঠিত নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে চার খণ্ডে প্রকাশিত ‘মুনশী: হিস আর্ট অ্যান্ড ওয়ার্ক’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে (পৃ.৪১) তাঁর এই তিনটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের গুজরাতের জনমানসে প্রভাব সম্পর্কে কৃত মন্তব্যে বাস্তবতা প্রতিফলিত:

“These three works, which depict Hindu Gujarat at its best, have made a strong appeal to the people of Gujarat who,  till they appeared, lacked consciousness of their heroic heritage. Some of the characters, which were mere names before, have now found a proud and permanent place in the popular imagination.”  

বিংশ শতকের প্রথমার্ধে, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের গুজরাতী ভাষাভাষী পাঠকসমাজের কাছে কনৈয়ালাল মুনশীর লেখা এই উপন্যাসগুলি সত্য ঘটনা হিসাবে প্রতিভাত হতে শুরু করে, এবং ‘গুজরাতনী অস্মিতা’র ধারণা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই উপন্যাসত্রয়ীর বহুসংখ্যক সংস্করণের মুদ্রণ নিঃসন্দেহে পাঠকদের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সংযোগের সাক্ষ্য বহন করে।    

তথ্যঋণ:

১. Dave, J.H., Gheewala, C.L., Bose, A.C., Aiyar, R.P. and Majumdar, A.K. (1956) (eds.) Man of Letters, Vol. 3 of Munshi: His Art and Work in 4 Vols. Bombay: Associated Advertisers and Printers. pp.41-60.

২. Kothari, R. and A. (2017)(tr.). The Glory of Patan, K.M. Mumshi. Gurgaon: Penguin Random House, India.

৩. Kothari, R. and A. (2018)(tr.). The Lord and Master of Gujarat, K.M. Mumshi. Gurgaon: Penguin Random House, India.

৪. Kothari, R. and A. (2019)(tr.). The King of Kings, K.M. Mumshi. Gurgaon: Penguin Random House, India.

৫. মুনশী, কনৈয়ালাল মাণেকলাল (১৯১৮). ‘গুজরাতনো নাথ’, প্রথমাবৃত্তি, মুম্বই: কনৈয়ালাল মাণেকলাল মুনশী. 

৬. মুনশী, কনৈয়ালাল মাণেকলাল (১৯৪৩).‘সীধা চঢ়াণ’. আহমেদাবাদ: গুর্জর গ্রন্থরত্ন কার্যালয়.

৭. Pare, S.V. (2014). “Writing Fiction, Living History: Kanhaiyalal Munshi’s historical trilogy” in Modern Asian Studies, Vol. 48, Issue 3. pp. 596-616.    


লেখক পরিচিতি


জয়ন্ত ভট্টাচার্য প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক, দীর্ঘদিন যাবৎ বিমান পরিবহন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। বিগত তিন দশকের বেশি মুম্বই প্রবাসী। ইতিহাস ও সাহিত্যের চর্চায় আজীবন উৎসাহী। বাংলায় লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।

No comments:

Post a Comment