নিরুপম কবিতা লিখত। তখন কতই বা বয়স। বড়জোর কুড়ি। বন্ধুদের দেখাদেখি সে-ও খুব গোপনে লিখতে শুরু করেছিল। তেমন কিছু ভাল হত না, নিজেই বুঝতে পারত। তবুও লিখত।
খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু সমর ব্যাপারটা জানত। তাদের এলাকায় তখন তেমন পত্রিকা ছিল না, যেখানে লেখা দেওয়া যায়। সে আত্মবিশ্বাসও ছিল না।
সমর একদিন বলল, “তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। অনেকে আসবে। তুই সেখানে তোর লেখা পড়বি।” শুনেই নিরুপমের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল! সে পড়বে কবিতা! তা-ও লোকের মাঝখানে!
সমর কোনও অজুহাত শুনল না, তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল।
একটা দোতলা বাড়ি। নিচের তলায় একটা প্রিন্টিং প্রেস, উপরে বাড়ির মালিক কার্তিকবাবু থাকেন। বেশ সাহিত্যমনস্ক মানুষ। প্রেস চালানোর পাশাপাশি তিনি একটা মাসিক পত্রিকা বের করেন। খ্যাত-অখ্যাত সব লেখকের লেখা জোগাড় করে খুব যত্ন করে পত্রিকাটি নিয়মিত বের করেন।
নিরুপম গিয়ে দেখল, দোতলায় নানাবয়সী মানুষের ভিড়। সিঁড়ির গোড়ায় অনেক জোড়া জুতোর ডাঁই! অতিথিরা সবাই লেখালখির সঙ্গে যুক্ত। নিরুপমের কপালে ঘাম দেখা দিল!...
সবাই তাদের লেখা পড়ছে। নিরুপম মাথা নিচু করে পিছনে বসে শুনছে। এক-একজনের পড়া শেষ হলে সবাই সেটা নিয়ে মতামত দিচ্ছে। ভালো-খারাপ--দুই-ই। একসময় কার্তিকবাবু নিরুপমকে কবিতা পড়তে বললেন। নিরুপম সসঙ্কোচে একটা কবিতা পড়েই মুখ লুকিয়ে বসে পড়ল।
এবার তার লেখা কাটা-ছেঁড়ার পালা। শ্রোতারা একবারে ছাল ছাড়িয়ে নিল! এটা একটা কবিতা হয়েছে! নিরুপম অপমানে মনে মনে সমরকে অভিশাপ দিচ্ছিল!
সবশেষে একটি মেয়ে--নিরুপমেরই বয়সী--বলল, “আমার কিন্তু কবিতাটা ভাল লেগেছে! সহজ, সাবলীল, শব্দের মারপ্যাঁচ নেই, অকারণে জটিলতা তৈরির চেষ্টা নেই, সততার সঙ্গে নিজের কথা বলার চেষ্টা আছে।” নিরুপম চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, ফরসা সুন্দর মেয়েটি। দু'চোখে গভীর দৃষ্টি, সন্ধ্যার মায়া জড়ানো। সমর ফিসফিস করে বলল, “কার্তিকবাবুর মেয়ে, অন্তরা। পত্রিকার জন্য কবিতাগুলো ও-ই দেখে।”
ফেরার সময়ে সিঁড়ির নিচে এসে নিরুপম দেখল, তার একপাটি চটি নেই! একটু দূরে একটা কুকুর শুয়ে আরাম করে তার চটি চিবিয়ে পুরো ছিঁড়ে ফেলেছে!
সস্তা কাঁচা চামড়ার চটি ছিল হয়তো। যা কুকুরকে আকৃষ্ট করেছিল। হো হো করে একসঙ্গে
হাসাহাসি শুরু হয়ে গেল!
হাসির শব্দ পেয়ে অন্তরা নিচে নেমে এল। সব শুনে খুব দু:খপ্রকাশ করল। বলল, “বাবার একজোড়া চটি দিচ্ছি, পরে যান।” নিরুপম প্রায় দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
দিনচারেক পরে এক বিকেলবেলা। খুঁজে খুঁজে অন্তরা এসে হাজির নিরুপমদের বাড়িতে। মা বারান্দায় বসে খৈয়ের থেকে ধান বাছছিলেন। অন্তরাকে দেখে বললেন, “তুমি কে, মা? নিরুর সঙ্গে কথা বলবে? দাঁড়াও, ডেকে দিই।”
বেশ কয়েকটা কথা হল দু'জনের। অন্তরা বার বার করে বলল, “পরের মাসেও কিন্তু কবিতা পড়তে হবে! ওইদিনের পুরো ব্যাপারটার জন্য আমি খুব লজ্জিত।” বলে, ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল নিরুপমের দিকে। নিরুপম জিজ্ঞাসা করল, “কী এটা?” অন্তরা বলল, “কিছু না! আমি চলে গেলে খুলে দেখবেন।” নিরুপম পরে প্যাকেটটা খুলে দেখেছিল, ভিতরে একজোড়া দামি চটিজুতো!
অন্তরা যে ব্যাগটি তার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে এনেছিল সেদিন, তার ভিতরে একটি স্থলপদ্মের কুঁড়িও ঘুমিয়ে ছিল। নিরুপম যদি লাজুক, ভীরু না হত, তবে সেই কুঁড়িটা ফুল হয়ে ফুটত না, কে বলতে পারে! নিরুপম সেই ফুলটাকে সম্মান জানাতে কোনওদিন চটিজোড়া পায়ে দেয়নি।
…………………..
অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment