গল্পঃ ঘোরঃ চুমকি চট্টোপাধ্যায়






“বাড়িতে ঢোকার পথে একটা গেট পড়বে প্রথমে। সেটা ফুলের গেট।”

“ফুলের গেট মানে?”

“মানে হল, অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে আর্চের মতো একটা স্ট্রাকচার করা। তাতে লতানো গোলাপে ছাওয়া। গোলাপের যেটা অরিজিনাল কালার, সেই গোলাপি গোলাপ।”

“ওরেব্বাস! সে তো অপূর্ব লাগবে দেখতে!”

দীপনের কথা শুনে স্মিত হাসে সুরঞ্জন। ছোটবেলার বন্ধু ওরা। স্কুল-জীবন অবধি একসঙ্গে ছিল। তারপর ছাড়াছাড়ি। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে সম্প্রতি যোগাযোগ হয়েছে দুজনের।

সুরঞ্জন এখন রাঁচিতে থাকে। দীপন কলকাতায়। চিরকালই আর্টের দিকে ঝোঁক সুরঞ্জনের। ভালো ছবি আঁকত। পাড়ায় সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল সাজানোর দায়িত্ব ওর ওপরেই পড়ত। পড়াশোনার থেকে এসব দিকেই বেশি আকর্ষণ ছিল ওর।

একটু অগোছালো ধরনের ছিল তখন। চুল আঁচড়াত না, জামা প্যান্টের ঠিক ঠিকানা ছিল না। একই শার্ট দিনের পর দিন পরেই যেত। চোখে অদ্ভুত ঘোর। যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে। 

দীপন আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতোই ছিল। পাসকোর্সে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে একটা ক্যুরিয়র কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে ঢোকে। এখনও সেই কোম্পানিতেই আছে, দু'ধাপ উঠেছে এই যা। 

প্রায় ষোলো সতেরো বছর বাদে সুরঞ্জন এসেছে কলকাতায়। বাবা, মা কেউই বেঁচে নেই। বাকি আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছে, কিছুই জানা নেই ওর। কোনোদিন খোঁজ করার চেষ্টাও করেনি। তাই দীপনের বাড়িতেই উঠেছে। 

রাত্রে দুই বন্ধু গল্পে মেতেছে। সুরঞ্জন বলছে, দীপন শুনছে। মাঝেমধ্যে টুকিটাকি প্রশ্ন করছে। 

“তুই বিয়ে করেছিস তো দীপন?”

“করেছি তো। এলার বাবার শরীর খারাপ হওয়াতে মেয়েকে নিয়ে বাবার কাছে গেছে গতকাল। তুই কতদিন আছিস?”

“আমি পরশু চলে যাব।”

“ওহো! তাহলে বোধহয় তোর সঙ্গে দেখা হবে না। সপ্তাহখানেকের জন্য গেছে।”

“আরে ঠিক আছে। দেখা হবেখন। ব্যস্ততা কীসের?”

“তুই বিয়ে করেছিস?” 

প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল সুরঞ্জন। প্রসঙ্গ পালটে দিতে জিজ্ঞেস করল, “এই ক'দিন তোর খাওয়াদাওয়া?” 

“আমাদের পাড়াতেই বুড়ির হেঁসেল বলে একটি হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে। ওখানেই বলে দিয়েছি। সমস্যা নেই।” 

“বাহ! ভালো। আমার ডাইনিং কাম ড্রইংরুমটা খুব বড়ো। তিন দিকে কাচ। খুব সুন্দর ভিউ।” 

“তাহলে তো বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায়?” 

“ভারী পর্দা দেওয়া আছে। ঢাকা-খোলা ইচ্ছে অনুযায়ী। আমার বাগান লোকে দেখতে আসে জানিস! হেন ফুল নেই যা আমার বাগানে নেই!”

“ওরেত্তারা! তার মানে দারুণ সুন্দর হবে।”

“আমার অবসরের অর্ধেক সময় কাটে বাগানে। নিজের হাতে পরিচর্যা করি। রাতের রানি ফুলের নাম শুনেছিস?”  

“হ্যাঁ, শুনেছি রে!”

“তিনিও আছেন আমার বাগানে। ফোটার মরসুমে রাতে বাগান আলো করে থাকে। খুব আতুকি ফুল। ভাবছি গোয়াতে যে গ্লোয়িং মাশরুম পাওয়া যায়, সেটা আনাব। অন্ধকারে আলো করে থাকবে আমার বাগান।”

“বাব্বা, তোর বাগান তো স্বর্গের বাগানের মতো মনে হচ্ছে!”

মুখ টিপে হাসল সুরঞ্জন।

“আচ্ছা সুরঞ্জন, তুই এখনও আঁকিস?”

“আমার ড্রইংরুমের একটা দেওয়াল জুড়ে কোলাজ করা। যারা দেখে, অনুরোধ করে তাদের দেওয়াল সাজিয়ে দিতে। তাছাড়া, বাগানটাকে আরোও দৃষ্টিনন্দন করার জন্য কিছু স্কাল্পচার করে বসিয়েছি।” 

“তুই তো যা বলছিস, তাতে দেখার লোভ হচ্ছে। ছবি নেই তোর মোবাইলে? দেখা না রে।”

“আরে আর বলিস না। অনেক ছবি ছিল। মোবাইলটাই চুরি হয়ে গেল। ব্যাক আপ কিছু নেওয়া ছিল না বলে সব হারিয়ে গেল। এই মোবাইলটাতে আর ছবি তুলিনি।” 

“বাকি ঘরগুলোতে নতুনত্ব কী করেছিস?”

“একটা জিনিস শিখেছি এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে, লেস ইস মোর, বুঝলি?”

“না রে, বুঝলাম না!”

“মানে হল, যত কম জিনিস, তত বেশি সুন্দর! আমার বেডরুমে খাট হল শেলফের ঢাকনা। নামিয়ে পায়া সোজা করে নিলে খাট। সকালে আবার তুলে দাও।” 

“শেলফে কী আছে?”

“বেশিটাই বই। কিছু ছোটোখাটো আর্টিফ্যাক্টস আছে। সব ফার্নিচারই আমার স্পেস সেভিং। মেঝের অনেকখানি খালি থাকে, আমার ওটাই পছন্দ।” 

“আর তোর বউ?” 

“কালো পাথর কুঁদে তৈরি মূর্তি দেখেছিস? কোমর ভেঙে দাঁড়ানো ভঙ্গিমায়?” 

“সে তো কতই দেখেছি।” 

“আমার পরম প্রিয় কালো নারী। মুখখানা পানের মতো। ভাসা ভাসা একজোড়া চোখ। ঘন ভুরু। একটু চাপা নাক। ফোলা ঠোঁট। কোঁচকানো চুলে আলগা খোঁপা।” 

দীপন ঠিক বুঝতে পারল না যে সুরঞ্জনের বউ কীরকম দেখতে, এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করল না। 

“জব্বর লাইফ এখন তোর তাহলে বস! আমি তো নেহাতই ছাপোষা লোক। তোর অসুবিধে হবে আমার এখানে থাকতে।” 

“এই কথাটা আর একবারও উচ্চারণ করবি না বলে দিলাম দীপু। আজকের দিনে নিজের লোকেরাই পাত্তা দেয় না সেখানে তুই আমাকে থাকতে দিচ্ছিস। এটা অনেক বড়ো মনের পরিচয় রে!”

দু'দিন অনেক গল্প হল ছোটোবেলার দুই বন্ধুর। তারপর সুরঞ্জন ফিরে গেল রাঁচি। 



দু'দিনের ছুটিতে সুরঞ্জনের কাছে ঘুরে আসবে ঠিক করল দীপন। যখন থেকে বাড়ির গল্প শুনেছে, দেখার জন্য মনটা আকপাক করছে। ঠিকানাটা অফিস থেকে কনফার্ম করে নিয়েছে ও। জায়গাটা পাহাড়ি মন্দিরের কাছে। 

সুরঞ্জনকে চমকে দেবে বলে ওর যাবার কথা দীপনকে ফোন করে জানাল না। 

ঠিকানায় দেওয়া রাস্তাটা পেলেও দীপন ওই নম্বরের কোনো বাড়ি পেল না। সুরঞ্জন কী অখেয়ালে নম্বর ভুল করেছে! একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে নামধাম বলে বাড়ির হদিস করার চেষ্টা করেও বিফল হল দীপন।

ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগল সে। মনে মনে ভাবল, “ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দেব, এখন মনে হচ্ছে ফোন করতেই হবে।” মোবাইলে সুরঞ্জনের নম্বরে আঙুল ছোঁয়ায় দীপন।

“আপ জিস নম্বর পর কল কর রহে হ্যায় ও ইস ওয়ক্ত উপলব্ধ নেহি হ্যায়।” বার বার একই কথা বলে যেতে লাগল ভয়েস রেকর্ডার।

রাস্তাটা ধরে বেশ খানিকটা চলে এসেছে দীপন। এলাকাটা উচ্চবিত্তদের বলেই মনে হয়। বাড়িগুলো প্রত্যেকটাই সুন্দর। বাঁদিকের একটা বাড়ির দিকে নজর পড়তেই একটু থমকে গেল সে। আর্চ করা গোলাপের গেট। 

রাস্তাটা পেরিয়ে গেটের সামনে যেতেই ফলকে লেখা নাম চোখে পড়ল ওর-- গোপীচন্দ গুপ্তা। গেট ছাড়িয়ে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই দেখল অপূর্ব বাগান। মাঝেমাঝে চমৎকার সব ভাস্কর্য। সুরঞ্জনের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে অনেকটাই। ভেতরের ব্যপারটা তো না ঢুকলে বোঝা যাবে না।

ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছে মোটা গোঁফওয়ালা লাঠিধারী এক জন। 

“জি বোলিয়ে, কিসসে মিলনা হ্যায় আপকো?”

“সুরঞ্জন হালদার নামকা কোই রেহতা হ্যায় ইধর? ম্যায় উনকা দোস্ত হুঁ।”

“জি নহি। উস নামকা তো কোই নহি রহতা ইধর।” 

তারপর একটু চিন্তা করে বলল, “আপ কাঁহাসে আয়ে হ্যায়?”

“কলকাত্তা।”

“কঁহি আপ রঞ্জনবাবু কি বাত তো নেহি কর রহে হ্যায়? ও ভী কলকাত্তা সে হি থে।” 

“হাঁ, হাঁ। উসিকো ঢুন্ড রহা হুঁ। কাঁহা হ্যায় ও?” 

“রঞ্জনবাবু ইঁয়াহা কা কেয়ার-টেকার থা। থোড়া পাগল সা থা। অভি কাম নহি করতা ইঁয়াহা। ছুড়ওয়া দিয়া।” 

“কঁহা মিলেগা বাতা সকতে হ্যায়?”

“জি নেহি। কলকাত্তা চলে গ্যায়েথে ইতনা পতা হ্যায়। ব্যস, অর কুছ নেহি পতা।”

“আচ্ছা। সুকরিয়া।” 

ফেরত আসার পথে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যে মাধ্যমের সূত্রে দুই বন্ধুর দেখা হয়েছিল, সেই সোশাল মিডিয়ায় ঢোকে দীপন। সুরঞ্জনের প্রোফাইল খুলতে গিয়ে দেখে ইউজার ডিঅ্যাক্টিভেটেড। 


……………….

অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


1 comment: