কুয়াশা ঠেলে ঠেলে এগোতে থাকে অভীক। সামনের পথ তার অজানা। কিন্তু পা তাকে ফেলতেই হবে। দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। হোটেলের রিসেপশন থেকে বলেছে, তিন কিলোমিটার মত হাঁটলেই পাহাড়ের চূড়া দেখা যাবে। তবে বেলা বাড়লেই যাওয়া ভালো। কুয়াশা কেটে রোদ উঠে যাবে ততক্ষণে। অভীক শোনেনি। সকালের ঘন কুয়াশার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে।
কাজল বলেছিল- “পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস অভীক, তুই ক্ষমা করলে তবেই আমি জীবনে শান্তি পাব। আর তুইও সব ভুলে আবার নতুন করে শুরু করিস সবকিছু।”
পুরোনো সবকিছু ভুলে কী করে নতুন করে শুরু করতে হয়, জানে না অভীক। বেশ কিছুদিন ধরেই সে কাজলের ব্যবহারে টের পেয়েছিল যে কাজল পালটে যাচ্ছে। এড়িয়ে যাচ্ছে অভীককে। কলেজে থার্ড ইয়ার থেকে সারাক্ষণ একসাথে ওঠাবসা ওদের। নন্দনে নতুন সিনেমা, অ্যাকাডেমিতে নাটক, শহর কলকাতায় একসাথে হৈ-হৈ করে ঘুরে বেড়ানো, দিনগুলো এখনও স্বপ্নের মত মনে হয় অভীকের। কাজলের প্রথম থেকেই ভয় ছিল, বাড়িতে এ সম্পর্ক মেনে নেবে না। অভীক ওকে বুঝিয়েছিল, ওরা দুজন একসাথে থাকলে কোন সমস্যাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তবু শেষ পর্যন্ত কাজলকে সাথে রাখতে পারল না অভীক। কাজল চলে গেল।
সেদিন কালো কালো মেঘ বৃষ্টির দানা হয়ে যখন অভীক আর কাজলকে জাপটে ধরেছিল, কাজল বলেছিল “বিশ্বাস কর অভীক, সব তছনছ হয়ে যাবে। শর্মিলার বিয়ে হবে না। নিজের জন্য নিজের ছোট বোনটার এতবড় ক্ষতি আমি করতে পারব না।”
“আর আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবি?” অভীক কাজলের কাঁধে হাত রেখে বলেছিল।
“জানি না, তবে চেষ্টা করব। চাকরি খুঁজছি কলকাতার বাইরে। পেলে চলে যাব। বাবা, মা, শর্মিলা সবার জন্য এই ভালো।” আর কিছু বলেনি অভীক। চুপ করে কাজলকে ধরে দাঁড়িয়েছিল ফুটপাথের ধারে অন্ধকারে। বৃষ্টি ধরে আসছিল। কাজল ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল ফেরার জন্য। পাশ দিয়ে দুটো ছেলে যেতে যেতে ওদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারপরেই শিস দিয়ে নোংরা মন্তব্য।
অভীক ঘুরে ওদের দিকে তাকাতেই, কাজল ওর হাত চেপে ধরল- “ছেড়ে দে। বাড়ি চলে যা। আমিও এগোব।” রাসবিহারী থেকে মেট্রো ধরে ধর্মতলায় নেমে বেশ কিছুক্ষণ একা-একা হেঁটেছিল সেদিন অভীক উদ্দেশ্যহীন ভাবে। চেনা শহরটা কেমন যেন রূপ পালটে নিচ্ছিল রাত বাড়ার সাথে সাথে। “কী ভাই একা একা আর কতক্ষণ ঘুরবে? ঘরে যাবে নাকি?” কে যেন তার কানে ফিসফিস করে উঠল। চড়া পারফিউমের গন্ধ নাকে ভেসে এল। চমকে উঠল অভীক। কোনও দিকে না তাকিয়ে হনহন করে পা চালাল।
শর্মিলা সব জানতে পেরে গেছিল অভীকের কাছে। অভীককে ও ছোটবেলা থেকেই চেনে। কাজলের সাথে অভীকের সম্পর্কটা ও প্রথমে মেনে না নিলেও কখনও কিছু বলেনি। কিন্তু তার জন্য সে সম্পর্কে ছেদ পড়েছে শুনে দৌড়ে গেছিল কাজলের কাছে - “আমার জন্য কেন তুই এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিলি?”
দুপুরের চড়া রোদ এসে পড়ছিল ঘরে। জানলাটা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়েছিল কাজল। ঘরের শান্ত ছায়ায় বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল- “তোর জন্য নয়, ঘরের জন্য। বাবার ঘর, মায়ের ঘর, সবার ঘর!”
“আর তোর ঘর? সেটার বুঝি কোনও দাম নেই?” শর্মিলা কেঁদে ফেলেছিল।
“আমার এখন সময় নেই। ইন্টারভিউ আছে। পড়তে হবে। তুই যা।” ল্যাপটপ খুলে শর্মিলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল কাজল। ‘Love being yourself!’- ল্যাপটপের হোমপেজে সেভ করা কোটেশনটা ভেসে উঠেছিল কাজলের চোখের সামনে।
হঠাৎ কানের কাছে গাড়ির হর্নে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যায় অভীক। ড্রাইভার জানলা থেকে মুখ বের করে খিঁচিয়ে ওঠে “এত কুয়াশার মধ্যে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটছেন! তাও আবার মাঝখান দিয়ে? সুইসাইড করার ইচ্ছা হয়েছে নাকি? যত্ত সব!”
ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে এল। কামরা থেকে নেমে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় শর্মিলা। “ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে ভালো করে সবকিছু জানাস কিন্তু দাদা।” বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সিটে ফিরে যায় কাজল।
হাঁটতে থাকে অভীক। কুয়াশার মধ্যে বারবার হারিয়ে গিয়ে আবার বেরিয়ে আসে, আবার হারিয়ে যায় কুয়াশায়। পাহাড়ের চূড়াটা যতক্ষণ না দেখতে পাচ্ছে, ততক্ষণ এভাবেই চলতে হবে তাকে।
……………..
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
খুব সুন্দর, চমৎকার মোচড় শেষে!! আদর্শ অণুগল্প।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDelete