হাল ছেড়ো না বন্ধুঃ সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কঃ অতনু প্রজ্ঞান

হাল ছেড়ো না বন্ধু



সাহিত্যের কাছে আমরা বার বার ছুটে আসি বাঁচার আশা নিয়েই। জীবন থেকে আমরা যা পেতে পারতাম, সেই ওম অনুভব করতে চাই নানা অক্ষরে। কখনো আবার আমরা যে জীবনটাকে দেখিনি সেই অদেখা রোমাঞ্চের স্বাদ খুঁজে বেড়াই।  কখনো আবার আমাদেরই মতো কোনো চরিত্রকে যখন সাহিত্যের পাতায় স্বপ্নের মতো জিতে যেতে দেখি, যা হয়ত আমাদের অধরা রয়ে গেছে, তখন তা নিজেদেরই জয় মনে হয়। আবার সে হেরে গেলে আমাদের মনকুঠুরিতে যে অশ্রুপাত হয় অঝোরে, তা আসলে আমাদের নিজেদেরই জন্যে কেঁদে ওঠা। আসলে সাহিত্যে আমরা বেঁচে থাকার ভরসা খুঁজি, বন্ধুর মানবিক হাত খুঁজি। কখনো ফিকশন, কখনো বা নন ফিকশনের পাতায় পাতায় আমরা খুঁজে চলি হাত বাড়ানো সেই বন্ধুদের যারা শত বিপদেও পাশে থেকে বলে... ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’। পঞ্চালিকা একটি নতুন বিভাগ খুলেছে এই নামে, সেই বন্ধুদের খুঁজতে। পাঠক পড়তে পড়তে তার সেই বন্ধুদের খুঁজে পাক, ভেঙে পড়া হৃদয়ে ভরসার বৃষ্টি নামুক, হতাশার হেরে যাওয়ার দড়ি ছিঁড়ে জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আলো খুঁজে পাক... এইই তো বেঁচে থাকার একমাত্র আশা।



সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক


অতনু প্রজ্ঞান



“তুমি এটা করতে পারলে সুপ্রতীক? তুমি?” উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলাম। নিভু নিভু বাল্ব এর আলোর নিচে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে থাকা আলম চাচা চমকে তাকাল এই সহসা উচ্চকিত কন্ঠে। অস্বস্তি লাগল আমার। অফিস থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝেই চা খেতে আসি চাচার এই চা-গুমটিতে। অফিস ক্যানটিনের ঝলমলে পরিবেশে গাদা গুচ্ছের দাম দিয়ে চা খাওয়ার চেয়ে ঝুপড়ির এই ভাঁড়ের চা খাওয়ার মজাই আলাদা। 

“আমরা একটু এগিয়ে গেলে হয়না প্রজ্ঞান?” সুপ্রতীকের চোখের ইশারায় বুঝে যাই, ওর অস্বস্তি হচ্ছে এখানে। রাত আটটা বেজে গেছে এখন। আজকাল দুপুর বারোটা থেকে রাত দশটা অবধি আমাদের অফিস। টেলিকমের তথ্যপ্রযুক্তি অফিসে বিদেশি ক্লায়েন্টদের ঘড়ি মেনেই কাজের গতি। এই মুহূর্তে দোকানটা ফাঁকা হলেও যে কোনও সময়েই অন্য কেউ চা খেতে চলে আসতে পারে। অন্য কারো সামনে এসব কথা আলোচনাটা ঠিক হচ্ছে না সত্যিই।       

সুপ্রতীক আর আমি বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে। হাঁটতে লাগলাম রাস্তার ধারের ফুটপাথ দিয়ে। আমাদের ডানপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রাজারহাট থেকে নিউটাউন যাওয়ার দ্বিমুখী পিচরাস্তা। আর বাঁদিকে আমাদের বিরাট এগারোতলা অফিস বিল্ডিং। ঝাঁ চকচকে সে কাঁচবাড়ির আলোকজ্জ্বল ফ্লোরগুলোতে লোকজনের নড়াচড়া এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। ইউরোপের এক বিখ্যাত বহুজাতিক টেলিকম-তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থার কলকাতা-শাখা এটি। এই কলকাতা অফিসেই হাজার দুয়েকের বেশি মানুষ চাকরি করে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সংস্থায় হুটহাট করে চাকরি থেকে ছেঁটে ফেলা হয় না লোকজনকে। বাৎসরিক মাইনে বৃদ্ধি, বিদেশভ্রমণের সুযোগ ইত্যাদির সুযোগ সুবিধাও বেশ ভালোই। একটা স্বচ্ছ নিয়মনীতি আছে সবকিছুরই। তাই খুব বেকায়দায় না পড়লে এই বাংলার মানুষেরা এই চাকরি ছাড়তে চায় না। এমন একটা অফিসে কলকাতায় নিজের বাড়ি থেকে চাকরি করার সুখ যারা পায় তাদের ভাগ্যবান বলতে হবে বইকি। 

আর আমার অভিমানটা তো এইখানেই। সুপ্রতীক দীর্ঘদিন ধরে ছিল তো সেই ব্যাঙ্গালোরে। এই বছর খানেক হল আমিই ওকে নিয়ে এলাম এখানে। তার একটা কৃতজ্ঞতা নেই ওর! তাছাড়া ও কী আমার আজকের চেনা? ব্যাঙ্গালোরে টেকট্রনিক্স কোম্পানিতে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে বছর খানেক একসঙ্গে কাজ করার সময়ে কী দারুন সব সময় কাটিয়েছি আমরা! একসঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছি, ওদের ফ্ল্যাটে আড্ডা মারতে গেছি কতদিন, ওর বউয়ের হাতে রাঁধা নানা বাঙালি রান্না চেটেপুটে খেয়েছি ছুটি ছাঁটার দিনে। বাঙালি সহকর্মী হিসেবে আলাদাই সম্পর্ক ছিল আমাদের। অবশ্য বছর দুয়েক পরে আমিই ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে দিই। টেকট্রনিক্স তখন নড়বড় করছিল। কানাঘুষোয় শুনছিলাম অনেকের চাকরি যেতে পারে। আমি তাড়াতাড়ি ও নৌকো ছেড়ে চেন্নাইয়ের একটা কোম্পানিতে জয়েন করে নিয়েছিলাম। ও অবশ্য ছাড়েনি। হাজারো ঘ্যানঘ্যানানি নিয়ে থেকে গিয়েছিল সেখানেই। শেষ অবধি চাকরি যায়নি ওর, তবে প্রোমোশন বা মাইনে বৃদ্ধি কোনওটাই খুব বেশি হয়নি ওর ওখানে।

কিন্তু চেন্নাই ছেড়ে বছর দুয়েক আগে কোলকাতায় এসে আমি যখন এই অফিসে জয়েন করলাম, তখন যেন মনে হলো ও একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে। মাঝে মাঝেই ফোন আসতে লাগল ওর, “এই প্রজ্ঞান, একটু দেখো না, কোলকাতায় আমার যদি কিছু হয়। জানো তো সবই…।” 

জানতাম, ওদের দমদমের বড়সড় বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা বেশ অসুস্থ। ওঁদের দেখার কেউ নেই। ও এক ছেলে, চাকরির প্রথম থেকেই প্রবাসী। তারওপর ওর বউও বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে। উত্তর পাড়ায় ওর বাপের বাড়িতেও বৃদ্ধ বৃদ্ধা বড় একাকিত্বে ভোগেন। ফলে সুপ্রতীকরা বাড়ি ফিরে এলে দুদিকেই খুব সুবিধে হয়। আর ও নিজেও কোলকাতায় ফিরে সবাইকে নিয়েই থাকতে চায়। 

কিন্তু চাইলেই তো হবে না। চেষ্টা একেবারেই করেনি তা নয়, কিন্তু প্রবল উদ্যমে লেগে থাকা যেটাকে বলে, সেইটা কোনওদিনই ওর মধ্যে নেই। কলকাতায় আসা এত সহজ? একটু সিনিয়ার হয়ে গেলে বাঙালিদের যারা একবার এখানে ঢোকে, সহজে ছাড়তেই চায় না। তেড়েফুঁড়ে লেগে না থাকলে কলকাতার টেলিকম-আইটি অফিসগুলোতে মাথা গলানো বেশ কঠিন। 

আমি যখন চেন্নাইয়ের কোম্পানি ছেড়ে কলকাতায় ঢুকে পড়লাম, ও হালে পানি পেল যেন! আর আমিও বন্ধুকৃত্য করতে গত বছর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওকে কলকাতায় আমাদের অফিসে নিয়ে চলে এলাম। যদিও ও যদি টেকনিক্যালি দক্ষ না হতো আর মানুষটা সৎ না হতো, তাহলে ওর জন্য এত চেষ্টা মোটেই করতাম না। চেনাশোনা হলেও মানুষটা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও ধারণা না থাকলে কেউ এভাবে রিস্ক নেয় না।  

যাই হোক, কলকাতায় ফিরে আমারই টিমের সিনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করে সে কী আনন্দ ওর! কিন্তু আমার একটু খারাপই লেগেছিল। আমার মতো ওরও ম্যানেজার হয়ে যাবার কথা এতদিনে। নিদেনপক্ষে একটা বড় টিম সামলানো টিম-লিডার। কিন্তু ওর কোনও প্রোমোশনই হয়নি ব্যাঙ্গালোরে। যদিও ও ওসব নিয়ে তদ্বিরও করেনি। আর আমাদের কোম্পানির এইচ-আরও ওর পুরোনো অভিজ্ঞতা দেখে হায়ার কোনও র‍্যাংক দিতে চায়নি। তাই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, এক বছরের মধ্যে প্রোমোশনের মতো করে গড়ে নেবো। যতই হোক, বন্ধু বলে কথা, এটা তো নিজেরই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।  

কিন্তু এত কিছু ওর জন্যে করেও এই প্রতিদান দিল ও! এই যে প্রতি সপ্তাহে গাড়ি চালিয়ে বউ মেয়েকে নিয়ে উত্তর পাড়াতে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে যায়, এটা হতো কলকাতায় না ফিরলে?  এই যে ওর বাবা-মা ছেলে-বৌমা-নাতনীর সঙ্গে থেকে শেষ বয়েসটায় এত তৃপ্তি পাচ্ছে, এসব হতো? অথচ এসব কিছু সুপ্রতীকের মনেই এলো না আমার এই ক্ষতিটা করার আগে! আমার সঙ্গে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করল ও!  

চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলেই একটা সিমেন্টের ওভারব্রিজ। তলা দিয়ে ময়াল সাপের মতো একটা খাল চলে গেছে এঁকেবেঁকে। ফুটপাথের ওপর দিয়ে ষ্ট্রীট লাইটের হলুদ আলো মাখতে মাখতে খানিকটা হেঁটে আমরা দুজনে গিয়ে দাঁড়ালাম সেতুর মধ্যিখানে। 

“তুমি পালটে গেছ। ব্যাঙ্গালোরে তোমাকে যা দেখেছি, তার সঙ্গে বিস্তর তফাৎ এখন। আমাকে এভাবে অপমান করতে পারো তুমি, এটা কোনওদিনও ভাবতে পারিনি প্রজ্ঞান।”

সুপ্রতীক একটা সিগারেট ধরাল। দেখলাম, টুকটুকে ফর্সা রঙ হলুদ আলোয় মাখামাখি হয়ে চকচক করছে। খুবই সুন্দর দেখতে ও, তবে পুরুষালি নয়, নরম সরম পেলব প্রকৃতির। চায়ের ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ব্রিজের ওপর থেকে খালের ধারে, একটু আগে। আমার ভাঁড়টা হাতেই এখনও। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, “অপমান! কী ভুলভাল বলছ সুপ্রতীক?”

“বাহ, ম্যানেজার হয়ে তাহলে ভুলেও যাচ্ছ এসব! নাকি এটাও একটা চাল? ভুলে গেলে তোমরা যেদিন অফিস পিকনিকে যাচ্ছিলে ডায়মন্ডহারবারেরর বাগান বাড়িতে, কী অপমানই না করলে আমাকে! আমি যে কী ভাবে সেদিন সব ম্যানেজ করেছিলাম… সে যদি জানতে। বলেছিলাম তোমায়, দেখলাম গুরুত্বই দিলে না তেমন।” 

আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম মাস কয়েক আগের এক রৌদ্রজ্জল শীত-সকালে। আমার টিমের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সেদিন চলেছি ডায়মন্ডহারবারেরর এক বাগান বাড়িতে। বহু প্ল্যান প্রোগ্রাম করে ঠিক হয়েছে টিমের বাৎসরিক পিকনিকের আসর ওখানেই হবে এবারে। সেইমত শনিবারের সকালে আমরা তখন পর পর কয়েকটা গাড়িতে, পথের ধূলো উড়িয়ে এগিয়ে চলেছি হৈ হুল্লোড় করতে করতে। টিমের দুজন যেতে পারেনি সেদিন। একটি মেয়ে তার প্রেগনেন্সীর জন্য রিস্ক নিতে চায়নি। আর একজন হল সুপ্রতীক। বলেছিল, “না গো, আমার যাওয়া হবে না, বাড়িতে কাজ আছে।” 

খুব রাগ হয়েছিল ওর ওপরে। বছরের এই একটা দিনও আমাদের সঙ্গে এলো না! টিমের লোকজনও বিরক্ত হয়েছিল। এমনিতেই অফিসের কোনও জমায়েতে ওকে পাই না। সে সপ্তাহশেষের টিম-ডিনার হোক, টিমের সবাই মিলে একসঙ্গে সিনেমা দেখা হোক, নিউ ইয়ার্স বা বড়দিনে পার্কষ্ট্রীতে ঘুরতে যাওয়া হোক… কোত্থাও সুপ্রতীক আমাদের সঙ্গে নেই। অসামাজিক যাকে বলে। শুধু কাজ করার জন্য অফিসে আসে। ব্যাস। আমি চেয়েছিলাম ওকে টিম-লিডার হিসেবে প্রোমোশন দেব বছরের শেষে। সিনিয়ার ছেলে, আমারই মত কাজের অভিজ্ঞতা। ওর তো পাওয়া উচিতই। কিন্তু টিমের দলপতি যদি বলিয়ে কইয়ে না হয়, টিমের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলে মিশে থেকে কাজটা না করে, তাহলে কী করে হবে? আর কাস্টমারকে ও এত ভয় পায় যে বলার নয়। কাস্টমার একটু ঝাঁঝিয়ে কথা বললেই ওর মুখ চুন হয়ে যায়। কিছুতেই সামনে এগিয়ে গিয়ে নিজের কথাটুকু স্পষ্ট করে বলতে পারে না। আরে এসব তো মানুষ যখন কম অভিজ্ঞতার ইঞ্জিনিয়ার তখন হয়। এত সিনিয়ার ছেলে, এত অভিজ্ঞতার পরেও যদি এত মুখচোরা হয় তাহলে তো খুবই মুশকিল। টিম-লিডার করে দিলে তো কেউ মানবেই না ওকে! ফলে বিরক্ত হই ওর এসব আচরণ দেখে। 

যদিও অস্বীকার করব না, ওর প্রযুক্তি মেধা টিমের সবার চেয়ে ভাল। জটিল কিছু এলে, শেষ অবধি ওর কাছেই আসতে হয় ছেলে মেয়েদের। কিন্তু এই কর্পোরেট জগতে থাকতে গেলে প্রযুক্তি মেধাই যে সব নয়, সাহসী হয়ে মুখ চোখ খুলে সবাইকে নিয়ে চলতে হয়, এইটা কিছুতেই বুঝতে চায়না ও। 

যদিও ও চিরদিনই এইরকম। ব্যাঙ্গালোরে থাকতেও জোশ ব্যাপারটা কোনওদিনই যেন পাইনি ওর মধ্যে। বড্ড বেশি শান্ত আর ভীতু প্রকৃতির। আমি বাঙালি বলে যেটুকু মিশত আমার সঙ্গে। বাকি টিম মেম্বারদের সঙ্গে কোনওদিনই মেশেনি তেমন। কোনওমতে অফিসটা করে বাড়িতে গিয়ে বউয়ের সঙ্গে সময় কাটাত। আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিয়ে অফিসের বড়কর্তাদের কাছে অপরিহার্য্য হয়ে যাওয়ার চেয়েও ওর কাছে নিজের বাড়িতে বউ এর সঙ্গে বসে গল্প গুজব করা, রান্নায় হাত লাগানো, একসঙ্গে বাজার হাট করা এসবেই বেশি আগ্রহ ছিল। এত বছর পরেও নিজেকে একটুও পালটাতে পারল না। 

আমরা যখন ডায়মন্ডহারবারেরর দিকে এগোচ্ছি, তখনই কামালের ফোনটা এলো। কামাল আফগানিস্থানের ক্লায়েন্ট-পক্ষের এক ঝাঁঝালো মানুষটা। এমনিতে লোকটা ভালো, আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে আফগানিস্থানে ওর গ্রামের বাড়ির ছবি দেখিয়েছে, সেখানকার জঙ্গলে পাখি শিকার করার বন্দুকের ছবি দেখিয়েছে, একবার কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে টইটই করে ধর্মতলায় ঘুরে অনেক জামাকাপড়ও কিনেছিল বাড়ি ফেরার আগে। এমনিতে খুব দিলখোলা মানুষ। কিন্তু কোনও আর্জেন্সি হলেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। পাগলের মতো চ্যাঁচামেচি আর বকাবকি করতে থাকে তখন। যতক্ষণ না আমাদের টিম টেকনিক্যাল কোনও সমাধান দিতে পারছে, ও টেনশনে বার বার কল করে, বার বার বকাঝকা করে বিরক্ত করে দেয় টিমকে। সেদিন গাড়িতে, ওর কল দেখেই বুঝে গেলাম, আমাদের কপাল পুড়তে চলেছে আজ। শনিবারের দিন দেখে পিকনিক ঠিক করেছিলাম। ভেবেছিলাম, হয়ত নির্বিঘ্নে দিনটা কেটে যাবে। কিন্তু পোড়া কপাল আর কী!  

“শোন, তাড়াতাড়ি তোমাদের কোনও টিম মেম্বারকে কাজে লাগাও। আমি মেল করে দিচ্ছি ডিটেইলস। ইনটারনেট সার্ভিসে গণ্ডগোল হচ্ছে। মোবাইলে নেট চলছে না। লোকে রেগে মেগে কল করছে কাস্টমার কেয়ারে। তাড়াতাড়ি কিছু কর।” কামাল উত্তেজিত বলে উঠল। 

কিন্তু কে করবে এখন! যারা করার সবাই তো গাড়িতে। যদিও আমরা নিজের নিজের ল্যাপটপ নিয়েই পিকনিকে যাচ্ছি, এবং ঠিক করাই ছিল, হঠাৎ কোনও ইস্যু এলে বাগানবাড়ি থেকেই কেউ কাজ করবে। কিন্তু তা বলে রাস্তাতেই এটা হতে হবে! মোবাইলের ইনটারনেটে তো কাজ করাই যাবে না এখন গাড়িতে। পৌঁছতেও তো এখনও ঘন্টাখানেকের ওপরে দেরি। তাহলে? 

“স্যার, অর্পিতা বা সুপ্রতীকদাকে বলুন না। ওরা তো বাড়িতেই” রেশমী বলল। 

হ্যাঁ তাই তো, ওদের না যাওয়াটাই আমাদের আশীর্বাদ হতে পারে এখন! যদিও অর্পিতাকে ওর প্রেগনেন্সির সময়ে হঠাৎ এভাবে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। অতএব সুপ্রতীকই একমাত্র ভরসা। 

সঙ্গে সঙ্গে ওকে ফোন করলাম। সবটা শোনার আগেই ও বলল, “আরে প্রজ্ঞান, আমি তো এখন হসপিটালে। মেয়ের চোখ দেখাতে এসেছি। ল্যাপটপ নিয়ে আসিনি গো। এখান থেকে বেরিয়ে আরও কয়েকটা কাজ আছে বাইরে। বাড়ি ফিরতে কয়েক ঘন্টা লেগে যাবে। আমি কী করে করব বল? তুমি প্লিজ ওখানে পৌঁছে কাউকে লাগিয়ে দাও কাজটায়। আমি বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে কথা বলে নেব তোমার সঙ্গে। তখনও না সলভ্ হলে আমি দেখে নেব।” ও যখন এই কথাগুলো বলছে, দেখলাম বার বার কামালের কল আসছে। 

হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল। একে তো পিকনিকে যাচ্ছে না, তারওপরে এই এমার্জেন্সি দরকারের সময়েও ওকে পাওয়া যাবে না! বন্ধু বলে ভেবেছেটা কী? টিমের অন্য ছেলেমেয়েরাই বা কী ভাববে? এমনিতেই তো কেউ কেউ বলে আমি নাকি ওকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিই। কিন্তু সেদিন ওর কথাটা আর মেনে নিতে পারলাম না। বলে উঠলাম, “ওসব আমি বুঝিনা সুপ্রতীক। মেয়েকে বউ এর জিম্মায় রেখে বাড়িতে চলে যাও ড্রাইভ করে। ল্যাপটপে লগ-ইন কর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। প্রবলেমটা সল্ভ কর। এটা একটা এমার্জেন্সি সিচুয়েশন।” 

“প্রজ্ঞান, তুমি বুঝতে পারছ না কেন! আমি সত্যিই পারব না এখন।” 

আমি দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, “তুমি যদি এখনই না যাও, আমি তোমার নামে হায়ার ম্যানেজমেন্টের কাছে কমপ্লেইন করে কলকাতা টিম থেকে সরিয়ে দেব। টিমের কোনও ব্যাপারে থাকবে না, আর্জেন্ট দরকারে ফ্যামিলি দেখাবে, এক্সট্রা কোনও দায়িত্ব নেবে না, ক্লায়েন্টের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে কথাবার্তা বলবে না, কী ভেবেছটা কি? কতদিন সেভ করব তোমাকে? আর তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি বললে তোমাকে নয়ডাতে ট্র্যান্সফার করতে কোনও সময়ই লাগবে না। দেখব এসব গেঁতোমি কী করে কর তখন।” 

বুঝতে পারছিলাম, আমাকে এই ভাবে চিৎকার করতে দেখে গাড়ির সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে। সুপ্রতীককে আমি এভাবে কথা বলছি, ওরা বোধহয় ভাবতেই পারছেনা!

ও আর কোনও কথা বলল না। পরের ঘটনাগুলো মোটামুটি প্রত্যাশা মতই ঘটল। আমরা বাগানবাড়িতে পৌঁছনোর বহু আগেই সুপ্রতীক নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছে কাজ শুরু করে দিল। আমি হোয়াটসঅ্যাপে আপডেট পেতে থাকলাম ওর কাছে থেকে। কামালকে বললাম সুপ্রতীককে সরাসরি ফোন করে নিতে। পিকনিকের দিনটা আমাদের আর কোনও চিন্তা করতেই হল না সুপ্রতীকের কল্যাণে। 

এবং তার পর থেকে আমারও যেন ওর প্রতি কেজো আড়ষ্টতাটা কমে গেল। যখনই দেখতাম ও দায়িত্ব নিতে গাঁইগুঁই করছে কিংবা কোনও বিষয় নিয়ে টিমের সঙ্গে চলতে চাইছে না, খানিকটা চাপ দিয়ে করিয়ে নিতে লাগলাম। মনে মনে জানতাম, এসব ওর ভালোর জন্যই করছি। আমি ওর বন্ধু বলেই এভাবে চাপ দিয়ে ওর আলসেমিগুলোকে ঝাঁকিয়ে দিতে চাইছি। 

মাঝে মাঝেই একটু ফ্রি হলে ওকে ডেকে নিয়ে চা খেতে চলে আসতাম আলম চাচার দোকানে। ওর বাড়ির লোকজনের কথা জিজ্ঞেস করা, ভবিষ্যতে আরও ভালো কেরিয়ার কী করে করতে পারে, কোন দিকে যেতে পারে এসব নিয়ে নানা আলোচনা চালিয়ে যেতাম। জানতাম, ওর যা মেধা কলকাতায় সেই মত কাজ বেশিদিন পাবে না। এখানে টেলিকম-তথ্যপ্রযুক্তি জগতের তেমন সুযোগ কোথায়? ব্যাঙ্গালোর, নয়ডা, পুণে, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ… এসব জায়গায় ভালো ভালো কাজের ছড়াছড়ি। অনেক নতুন নতুন কোম্পানি আসছে। ওর মত মেধা পেলে লুফে নেবে। কিন্তু ওকেও তো তৈরি হতে হবে তার জন্য। উচ্চাকাঙ্খা না থাকলে কী করে হবে! আরও বলিষ্ঠ হতে হবে, ভয় পেলে চলবে না, বলিয়ে কইয়ে হতে হবে, অনেককে নিয়ে কাজ করাতে শিখতে হবে। এসব বলে নানা ভাবে ওকে মোটিভেট করার চেষ্টা করতাম। মনে মনে ভাবতাম, যতদিন আমি এই কোম্পানিতে আছি, কখনও নরমে কখনও গরমে ওকে যদি তাতিয়ে দিতে পারি, তার চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! 

কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই পালটে গেল যখন আমার ‘রেজাল্ট’ এলো! আসলে বছরের শেষে আমাদের  হিউম্যান-রিসোর্স দপ্তর ‘ম্যানেজার’ দের বার্ষিক টিম-ম্যানেজমেন্ট পারফরমেন্সের একটা পরীক্ষা করে। টিমের ছেমেমেয়েদের কাছে কিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়, যেখানে তারা মন খুলে লিখতে পারে ম্যানেজারের সারা বছরের কাজ কম্মো নিয়ে। সেই উত্তরপত্রে কোনও টিম মেম্বারের নাম থাকে না, ফলে ম্যানেজারকে কে ‘বাজে’ বা ‘ভালো’ নম্বর দিচ্ছে তা জানার উপায় নেই। কিন্তু ওই স্কোর দেখে হিউম্যান রিসোর্স টিম ‘পারফরমেন্স রিপোর্ট’ বানায়। যদি কেউ খুব কম পায়, ধরে নেওয়া হয় সেই ম্যানেজার টিম-মেম্বারদের চাহিদা ঠিকমতো পূর্ণ করতে পারছেনা। তখন  সেই ম্যানেজারকে কড়া নজরে রাখা হয়, দফায় দফায় তার সঙ্গে আলোচনা করা হয়। 

আমি তো নিশ্চিত ছিলাম আমার স্কোর ভালো হবে। টিমকে নিয়মিত নানা অফিস-পার্টি, হৈ হুল্লোড়, পিকনিক এসব আয়োজনের মধ্যে রেখেছি ফাঁক পেলেই। হেড অফিস থেকে যা টাকা এসেছে টিমের কাছে স্বচ্ছ ভাবে হিসেব দেখিয়ে খরচ করেছি। টিমের কেউ ভুল করলে ক্লায়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে নিজে দায়িত্ব নিয়ে কথাবার্তা বলেছি যাতে কারো গায়ে আঁচ না লাগে। আবার টিমে কেউ ভুল ভ্রান্তি করলে চাপ দিয়ে বকে ঝকে কাজও করিয়ে নিয়েছি। কিন্তু সেগুলো তো প্রফেশনাল দিক, করতেই হবে। কাজেই টিম নিশ্চয়ই সারাবছর ধরে আমার এই পরিশ্রমকে মূল্য দেবে। 

কিন্তু গতকাল রেজাল্ট বেরোতেই চক্ষুরুন্মীলন হয়ে যায়। স্কোর হয়েছে ৭০% এর সামান্য বেশি। একী! আমি তো ভাবলাম নিদেনপক্ষে ৯৫% পাবই। ৭০% মানে তো নিতান্ত সাধারণ স্কোর। আমার হায়ার ম্যানেজমেন্টের কাছে মাথা নিচু হয়ে গেল তো! সারা বছর এত খেটেও এই রেজাল্ট কী করে হতে পারে! কে বা কারা এত কম দিল আমায়!  

টিমকে নিয়ে বসলাম বিশাল মিটিং রুমে। বিমর্ষ হয়ে বললাম, “কী হল বল তো? কোনওখানে আমার ফাঁকি ছিল? প্লিজ বলবে তোমরা? না একবারও ভেবো না যে আমার ভুল ধরিয়ে দেবে তার কোনও ক্ষতি করব। নিশ্চিন্তে থাক। আমি শুধু জানতে চাই কে কে কম দিয়েছ আমায়। আর কেনই বা কম দিলে। আমি শুধু নিজের ভুলটা জানতে চাই, যাতে শোধরাতে পারি, যাতে পরের বছর একই ভুল না হয়। তোমরা হেল্প কর প্লিজ।” 

দেখলাম সবার মুখ থমথমে। মিন মিন করে যারা মুখ খুলল তাদের বক্তব্য তারা কেউই খারাপ দেয়নি। এই স্কোর হতেই পারে না। কিন্তু তাহলে কে বা কারা করেছে ওটা? কোনখানে গণ্ডগোল হল? কী করে জানতে পারব আমি?    

অবশেষে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোলো আলম চাচার দোকানে চা খেতে এসে। 

মন মেজাজ ভালো ছিল না। তাই রাতের দিকে চা খেতে নামলাম সুপ্রতীককে নিয়ে। মনের মধ্যে সারাক্ষণ ঘুরছিল স্কোরটা। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। 

“কী হল বল তো সুপ্রতীক? বুঝতেই পারছি না আমি!” উত্তপ্ত চায়ের ভাঁড়টা পাশে রেখে বললাম।  

একটু চুপ করে থেকে লাল চায়ে চুমুক দিয়ে খুব ধীর স্থির গলায় ও বলে উঠল, “আমিই তোমায় কম দিয়েছি প্রজ্ঞান। তোমায় ২০% নাম্বার দিয়েছি তোমার দক্ষতার জন্য। কিন্তু ৮০% কেটে নিয়েছি ব্যবহারের জন্য।” 

“মানে! কী বলছ সুপ্রতীক! আমি কী খারাপ ব্যবহার করলাম তোমার সঙ্গে? এত এক্সট্রা কেয়ার নিই তোমার ব্যাপারে, আর তুমি বলছ একথা? তুমি এটা করতে পারলে সুপ্রতীক? তুমি?”

কিন্তু সে উত্তরগুলো পেলাম চা দোকান থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকের ফুটপাথ দিয়ে খানিকটা হেঁটে ফুটব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে। 

“এছাড়া আমার কোনও উপায় ছিল না প্রজ্ঞান। আমার অভিযোগগুলো জানাবার এইটাই একমাত্র রাস্তা ছিল। কাজের ব্যাপারে তুমি যা দায়িত্ব নিয়ে সবকিছু কর আমি কোনও অভিযোগ জানাতেই পারব না। আমি ছাড়া টিমের অন্যরা মনে হয় না কেউ অখুশি তোমার ওপরে। নিজে সামনে এগিয়ে এসে কাজ কর। টিমের হয়ে লড়াই কর অন্যান্য টিমের সঙ্গে, এমনকি কাষ্টমারের সামনেও টিমকে খুব সাহস যোগাও। আমি যদি তোমার নামে ম্যানেজমেন্টকে অভিযোগ করতাম, আমাকেই লোকে সন্দেহ করত। অতএব এই একটাই উপায় ছিল, যেখানে নিজের পরিচয় লুকিয়ে নিজের কথাগুলো বলা যেত।” 

“কিন্তু কেন করলে এটা সুপ্রতীক!” আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম ওর কথা শুনতে শুনতে। 

“প্রজ্ঞান, তোমার বেশ কিছু কথা আমি কোনওদিনই মেনে নিতে পারিনি। অথচ দিনের পর দিন তুমি জোর করে গেছ আমার ওপরে। ব্যাঙ্গালোরে আমার কোনও উপায় ছিল না। ওখানে না চাইলেও বসের চাপে অনেক কিছু করতে হত। কিন্তু এখানে এটা করতে হবে আশা করিনি। তুমি তো বন্ধু। ভেবেছিলাম তুমি বোঝো আমায়…” ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিয়ে অবলীলায় নিজের একান্ত মনের কথাগুলো বলে চলেছিল সুপ্রতীক। 

“কিন্তু আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি চাইনি সুপ্রতীক…। তুমি তো ভুল বুঝলে আমায়!” 

“তুমি কী আমায় বুঝতে চেয়েছ প্রজ্ঞান?” বিমর্ষ হাসি মুখে এনে আমার দিকে তাকাল। দেখলাম ওর চোখের ধারালো সে দৃষ্টি যেন ধারালো ছুরির মতো ছিড়ে দিচ্ছে আমার হৃদয়। ভেসে আসছে ওর কথাগুলো অলৌকিক শব্দের মত। 

“আমি তো কোনওদিনই তোমার মতো হতে চাইনি প্রজ্ঞান। ব্যাঙ্গালোরে পাঁচ বছরেও আমার প্রোমোশন হয়নি ভেবে তোমার হয়ত খুব খারাপ লেগেছিল, কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কিছুই মনে হয়নি। আমি তো এসব চাইইনি।”

ব্যাঙ্গালোরে থাকাকালীন এসব টুকরো টাকরা কথা যে ওর কাছে শুনিনি তা নয়। ওর নাকি আমাদের এই চাকরি জগতটাকে একেবারেই ভালো লাগে না, হয়ত এই কর্পোরেট জগতে ঢোকাই ওর ভুল হয়েছিল। ও যদি হায়ার স্টাডিস করে শিক্ষা জগতে গিয়ে পড়াশোনা রিসার্চ এসব নিয়ে থাকত তাহলে হয়ত আনন্দে থাকতে পারত। ওর কিছু বন্ধু বান্ধবদের উদাহরণও দিত ও। কেউ সরকারি কলেজে পড়ায়, কেউ বা বেসরকারি। ওর বক্তব্য ছিল, ওদের জীবন অনেক শান্তিপূর্ন; দিনরাত কাস্টমারের ঝাঁঝালো মেল নেই, টেলিফোনিক মিটিং-এ বসে উগ্র উদ্ধত রাগারাগি শুনতে হয় না, বসের চাপের মুখোমুখি হতে হয় না। একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি কলেজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে নিজের লাইফ। কর্পোরেটে সে সুযোগ কোথায়? সবসময়েই টেনশন থাকে এই বুঝি ফোন এসে গেল! এই বুঝি আবার কোনও ঝামেলা হল! 

বলেছিলাম, “কিন্তু কর্পোরেট জগত তো এমন হবেই সুপ্রতীক। এটা ব্যাবসা জগত। কত কত টাকার ইনভেস্টমেন্ট আছে এখানে। যারা আমাদের মাইনে দিচ্ছে তারা তো নিংড়ে নিতে চাইবেই। আর ব্যবসায় কখন কী হবে তা বলা যায়? তাও আবার টেলিকমের ব্যাবসা। মানুষ সারাক্ষণ মোবাইল ফোন হাতে ধরেই আছে। সারাক্ষণ সে চায় ফোন-সার্ভিসে যেন কোনও অসুবিধে না হয়। প্রতিমুহূর্তেই যেখানে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। এগুলো তো মেনে নিতেই হবে সুপ্রতীক। কিন্তু তোমার যদি এইটাই ভাবনা তাহলে এলে কেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে? দশটা বছর এভাবে কাটিয়ে দিলেই বা কেন! হায়ার স্টাডিস করলেই পারতে!” 

“উপায় ছিল না প্রজ্ঞান। সরকারি কলেজগুলোতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পাইনি তো। সল্টলেকের যে কলেজটায় পেলাম সেটাও খুব ভালো, কিন্তু প্রাইভেট কলেজের যা খরচ, বাবা এত পাবে কোথায়? বাবাদের ফ্যাক্টরি তো এমনিতেই ধুঁকে ধুঁকে চলছিল, আমাকে লোন নিতে হয়েছিল বাড়ি দেখিয়ে। তাই ক্যাম্পাসের চাকরিটা পেয়ে মনে হয়েছিল হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছি। লোনটা এবারে মেটাতে পারব। তারওপর সঙ্গীতার সঙ্গে স্কুল থেকেই সম্পর্ক ছিল। ওরও বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসছিল। ফলে বছর দুয়েকের মধ্যেই বিয়ে। তারপর যা হয় আর কী…।” 

বুঝতে পারছিলাম আমি ভুল মানুষের জন্য এসব চেষ্টা করছিলাম। আমি ভাবছিলাম ওকে চাপ দিয়ে কাজ করিয়ে ওর কম্ফোর্ট জোন ভাঙতে চাইছি, ওকে বার বার মোটিভেট করে ওর নিজের ভেতরের সম্ভাবনাকে উসকে দিতে চাইছি, ওকে আরও বেশি করে দায়িত্ব দিয়ে প্রোমোশনের জন্য তৈরি করতে চাইছি। কিন্তু গোড়াতেই তো গণ্ডগোল। ও তো এসব বলেনি কখনও আমায়। আমিই নিজের মতো করে ধরে নিয়েছি এসব। যে মানুষটা নিজেই দৌড়াতে চাইছে না, আমি কে তাকে জোর করে দৌড়োতে উৎসাহ দেবার? ও তো এই বেশিবয়েসেও কম মাইনের ইঞ্জিনিয়ার হয়েই জীবন কাটিয়ে দিতে চাইছে। তার চেয়ে বেশি প্রোমোশন তো ও নিজেই চাইছে না! ওর তো সে নিয়ে অভিযোগও নেই কিছু। ম্যানেজার হিসেবে আমার এইটুকু দায়িত্বই ছিল ওর নিজের কাজটুকু ঠিকমতো করছে কিনা সেটা দেখা। ও টিমের সঙ্গে ডিনার করতে গেল কী গেল না, খুব মেলামেশা করল কী করল না, বলিয়ে কইয়ে হয়ে কাস্টমারের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে পারল কী পারল না, সেটা দেখার আমার তো দায়িত্ব ছিল না! প্রত্যেকের নিজের নিজের জীবন দর্শন থাকে। হ্যাঁ, ওর দর্শন আমার সঙ্গে একেবারেই মেলে না, এটা ঠিক। কিন্তু আমি কে তাকে নিজের মতো করে চালিত করার? ও যদি উচ্চাকাঙ্খা বাদ দিয়ে ওর ফ্যামিলি জীবনটাকেই প্রাধান্য দিয়ে কোনওমতে চাকরি করে জীবনটা চালিয়ে দিতে চায়, আমি কে সেটা নিয়ে ভাবার? এমনকি ডায়মন্ডহারবারের বাগানবাড়ি যাবার পথে হাসপাতাল থেকে ওকে জোর করে তুলে নিয়ে আসাটাও আসলে ম্যানেজমেন্টের দিক থেকে তো আমারই ব্যর্থতা। আমি কেন প্রত্যাশা করেছিলাম গাড়ির ওই সময়টুকুতে কোনও এমার্জেন্সি আসবে না? তার বদলে আগে থেকে প্ল্যান করে যদি কাউকে সকাল সকাল বাগানবাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারতাম আর আমরা পরে যেতাম, তাহলে তো হুড়মুড় করে সুপ্রতীকের ওপরে চাপ দেওয়ার দরকার পড়ত না! শনিবারের দিনে ওর পরিবারের এক এমার্জেন্সি মেডিক্যাল দরকারের মুহূর্তে আমি কেন অফিসের কাজ করিয়ে নিলাম জোর করে! এটা তো একেবারেই ঠিক হল না।   

বুঝতে পারছিলাম নিজের ভুলগুলো। খুব কষ্ট হচ্ছিল মনের ভেতরে। মনে হচ্ছিল, কর্পোরেট নামক এই যে দ্রুতগতির ‘সিষ্টেম’ চলছে এই পৃথিবীতে, কত মানুষ তার মনের আবেগকে পিষে পিষে ছিবড়ে হয়ে যেতে দেখেও মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে উপায় নেই বলে। সুপ্রতীকও সেই শ্রেণিরই মানুষ। বন্ধু হিসেবে আমাকে ভরসা করেছিল যে আমি অন্যদের মত না হয়ে ওকে ওর মত করে থাকতে দেব। অথচ সেই আমিও কষ্ট দিলাম ওকে। মনে হল ম্যানেজার হিসেবে এ আমার এক বড়সড় ব্যর্থতা। সিঁড়ি ভাঙার অঙ্ক কষতে ভুল করে ফেলেছি যেন। 

বুঝতে পারছিলাম এভাবে বাইরে থেকে জোর করে কাউকে মোটিভেট করা যায় না। সে চেষ্টা করাটাই বোকামি। কাউকে মোটিভেট করতে গেলে, বা কারো ভালো করার জন্য গঠনমূলক সমালোচনা করতে গেলে সবার আগে টোকা মেরে দেখা দরকার, আদৌ সে সেটা চাইছে কিনা। যদি তার মন সেসব  না নেওয়ার জন্য তৈরি থাকে, হাজার বকবক করলেও কিছু লাভ হয়না। বরং এতে তিক্ত হয়ে যায় সম্পর্ক। মানুষকে ম্যানেজ করার এই প্রাথমিক শর্তটায় আমি ভুল করে ফেলেছি। প্রতিটি মানুষের মনই যে আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি, প্রত্যেকের চাহিদাই যে আলাদা, সেটা আমি ভুলেই গেছিলাম। ম্যানেজার হিসেবে টিমটাকে ম্যানেজ করা, কাজগুলোকে ঠিক মত করিয়ে নেওয়া … এইগুলোই আমার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল। আর টিম লিডার হিসেবে তাকেই তৈরি করার কথা ভাবা উচিত ছিল, যে মনে মনে তা চাইছে। কিন্তু সুপ্রতীক আমার বন্ধু, বয়েসে ও অভিজ্ঞতায় অন্যদের চেয়ে বড়, টেকনিক্যালি অনেক দক্ষ হলেও ও মন থেকে তৈরি নয় ওই দায়িত্বটার জন্য। কিন্তু তাও আমি এসব বার বার বলে ওকে বিরক্ত করে দিচ্ছিলাম। টিম লিডারের জন্য প্রয়োজনীয় দায়িত্বের কাজগুলোতে ওর খামতিগুলো বার বার ওকে দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। ভাবছিলাম, এভাবেই ও নিজেকে শুধরে নেবে। 

অথচ ও যে দায়িত্ববান নয় তা তো নয়, নিজের পরিবারকে যথেষ্ট দায়িত্বের সঙ্গে দেখাশোনা করে। অনেকটা সময় দেয় বাড়ির লোকেদের। আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় ও খুবই দায়িত্বশীল। কিন্তু কেরিয়ার নিয়ে ওর যখন উচ্চাশা নেই, তখন আমার কোনও অধিকারই ছিল না ওকে বার বার খুঁচিয়ে যাওয়ার। এইটাই তো আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। আর সত্যি বলতে কী, এই ভুলগুলো তো আমরা ব্যক্তিগত জীবনেও করে ফেলি। আমাদের পরিবার বা বন্ধুবান্ধবকেও আমরা বহু সময় তাদের ভুলগুলো দেখিয়ে দিয়ে বার বার খুঁচিয়েই চলি। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না, যে সেই মানুষটা এসব ‘মোটিভেশন’ কিংবা ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ চাইছে কিনা। যে ‘চায় না’ তাকে এসব জোর করে গেলানোর চেষ্টা করা তো আসলে তার মনের ‘শান্তিকে’ নষ্ট করা। আর আমাদের কারো অধিকার নেই সেটা করার। তার আচরণে যদি আমার কোনও ‘ক্ষতি’ না হয় এবং যদি তার সেই আচরণ সে পালটাতে না চায়, আমার কী দরকার আছে তাকে পালটানোর কথা বার বার বলে যাওয়ার? অথচ এই বোকামিটাই করে ফেলেছি সুপ্রতীকের সঙ্গে গত এক বছর ধরে। 

উন্মুক্ত তারা ভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনে মনে বললাম, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে শোধরাতেই হবে। ম্যানেজারির এই পরীক্ষায় স্কোর ভালো না করাটা এই বিশাল জীবনের কাছে খুব তুচ্ছ একটা ব্যাপার। কিন্তু একজন মানুষের আবেগের গোড়ায় গিয়ে তাকে ভেতর থেকে উপলব্ধি করা ও তাকে মন থেকে সম্মান দেওয়াটাই যে আসলে সেই মানুষটাকে প্রকৃতভাবে উদ্বুদ্ধ করার উপায় এই শিক্ষাটাই যেন এই ঘটনাটা থেকে পেয়ে গেলাম।   

মনটা হালকা লাগছিল। গত কয়েকঘন্টা ধরে চলা আনচানানিটা চলে গিয়ে মনে ফুরফুরে ভাব দেখা দিচ্ছিল এবার। 

একচিলতে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে সুপ্রতীকের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বলে উঠলাম “কিন্তু তুমি যে বলে দিলে আমার রেজাল্ট তুমিই খারাপ করেছ, আমি যদি এটার প্রতিশোধ নিই?” 

ও নির্লিপ্তভাবে বলল, “মনে হয় নেবে না তুমি। কেন জানি না বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল তোমায়। সকাল থেকে এতবার সবাইকে অনুরোধ করছিলে, নিজেকে শোধরাতে চাও বলছিলে, মনে হল তোমাকে একটা চান্স দিই। আমি তো তোমার বন্ধু। তাই না বলে থাকতে পারলাম না।” 

হেসে ফেললাম আমি। বললাম, “চলো, ফেরা যাক এবার।”




 ছবিসূত্র- আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment