গল্পঃ ওগো বন্ধু আমারঃ দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়






মিলনের সঙ্গে চঞ্চলের দেখা হল মিলনের মারা যাবার দশ বছর পরে। চঞ্চল এই দশ বছরে দশ দেশ ছুঁয়ে এসেছে। কিন্তু এবার দেশে, বিশেষ করে গ্রামে ফেরার প্রয়োজন ছিল। কারণ চঞ্চলদের বাড়িটা বিক্রি হচ্ছিল। আর বাবার অবর্তমানে চঞ্চলদের অংশটা বিক্রির জন্য চঞ্চলের সই দরকার। ছোটবেলার মন খারাপের রঙ ছড়িয়ে ছিল আকাশে। ধূসর। কোদালে কাটা মাঠের মতো মেঘ। মেঘলা আকাশের নিচে ছেড়ে যাওয়ার বিষণ্ণতা মাখা দীর্ঘশ্বাসের মতো হাওয়া। 

উকিলবাবু আসতে দেরি করছেন দেখে চঞ্চল নিজেদের বড় পুকুরটার ঘাটে গিয়ে বসল। পুরোনো ইট বেরিয়ে যাওয়া বাঁধানো সিঁড়ি। শ্যাওলার শরীর ছুঁয়ে গাঢ় সবুজ নিচের কয়েকটি ধাপ। বর্ষায় পুকুর ভরাট হয়েছিল তার প্ৰমাণ ছেড়ে গেছে। পিছলে যাবার ভয়ে চঞ্চল জলের কাছে গেল না। উপর দিকে বসে উদাস চোখে ওপর পারের দিকে তাকাল।

ওপরের শাল বন আগের ঘনত্ব হারিয়েছে। কিন্তু আছে। পাতা কুড়োতে এসেছে কয়েকজন ছোট ছেলে মেয়ে। হইচই করছে নিজের মতো। চঞ্চলদের ছোট বেলার মতো। ওই শালবন একসময় সরগরম করে রাখত মিলন, চঞ্চলরাই। মনে পড়ে গেল। বড় প্রাণের বন্ধু ছিল মিলন। 

সেই সময়ই চঞ্চল পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করল। প্রথমে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে চমকে উঠেছিল। অতঃপর আশ্চর্য হয়ে গেল। 

“তুই! তুই মরে গিয়েছিলি না?”

মিলন মুখ তুলে চঞ্চলের দিকে তাকাল। চোখে চোখ রেখে পড়ে নিল ভয়, বিস্ময় কিংবা বিস্মৃতি। কিছু উত্তর দিল না। চেয়ে থাকতে থাকতে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দিল পরিবেশে। না থাকার শূন্যতায় কেমন হুহু করে উঠল বাতাস। পাতায় পাতায় আওয়াজ উঠল। মৃদু।

“কতদিন পর দেখা হল। তোর মনে আছে? এই পুকুরে আমরা ছোট বেলায় কত সাঁতার কেটেছি?”

মিলন ঘাড় নাড়ল। দেখে মনে হল তাঁর আর মনে নেই কিছু। 

চঞ্চল থমকে থমকে প্রশ্ন করল, “আশ্চর্য। ভাবছিলাম শেকড় উপড়ে ফেলতে এসেছি। শেষে তোর সঙ্গে দেখা হল! এখানে কী করতে এসেছিস?”

“কিছু না। সকালে এসে বসি। সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত বসে থাকি। দেখি কী ভাবে সময় বয়ে যায়। ওপরের শাল বনে যাই। পাতা ঝরার মরশুমে। সময়। শুধু সময়কে দেখি।”

চঞ্চল বিস্ময় কাটিয়ে নরম হয়ে বলল, “কী সময় ছিল আমাদের! মনে পড়ে। এখন কী খবর তোর?”

“ওই একটাই খবর । মরে যাওয়ার। বরং তোর খবর বল।”

চঞ্চলের ভেতরে জমা কথাগুলো ভাষা খুঁজতে শুরু করল। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া কাজের সন্ধানে। প্রথমে সুরাট সেখান থেকে মুম্বাই হয়ে ম্যাসকটে। তারপর দশটা দেশ। জানিস আমি মিশর গিয়েছিলাম। পিরামিড দেখেছি। কেমন করে প্রাচীন মিশরীয়রা মমি বানিয়ে রাখত।”

মিলন বিমর্ষ স্বরে বলল, “এখানে কেউ রাখে না। নাহলে হয়তো আমার শরীরটাও থাকত। কত যত্ন নিতাম একসময় শরীরের। মাথার চুল কুচকুচে কালো রাখার জন্য জবজবে করে তেল মাখতাম। ডন বৈঠক মারতাম দিনে পঞ্চাশটা করে। মুখে ফর্সা হবার ক্রিম, গায়ে হলুদ আর নিমপাতা। সবই মালার জন্য। তুই মালাকে বিয়ে করেছিলি চঞ্চল?”

মিলনের কথায় চঞ্চল কুঁকড়ে গেল। ভয়ে কেঁপে উঠল বুকটা। তাহলে কী মিলনের প্রেতাত্মা প্রতিশোধ নিতে এসেছে? চঞ্চল চারপাশে তাকিয়ে দেখল অন্য কোনও মানুষের আবির্ভাবের আভাস পাওয়া যাচ্ছে কিনা। 

মিলন চঞ্চলের চোখের ভাষা পড়ে নিয়ে বলল, “এই সময় এখানে কেউ এসে না । একে একে আমাদের বন্ধুদের সবাই চলে গেছে শহরে, মফস্বলে। তোদের বাড়িটাও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তুই ও আর আসবি না। হয়তো এই শেষবার।”

চঞ্চল প্রথমে ভয় থেকে কথাটার একরকম মানে করল। পরে শিকড়ের সবটুকু উপরে যাচ্ছে এই বিষাদে ডুব দিয়ে বলল, “হুঁ। আসব। এই গ্রামকে ভুলতে পারব না। ভুলে গেলে তো নিজের ছেলেবেলাকেই ভুলে যাওয়া হবে।”

“ভুলে যাওয়া তো বিস্মৃতি নয় চঞ্চল। ভুলে যাওয়া মানে ক্ষমা করা। বেঁচে থাকার জন্য তোর আমাকে ভুলে যাওয়া উচিত। তোর নিজের ছোটবেলাকেও ভুলে যাওয়া উচিত। কারণ সব একসঙ্গে জড়িয়ে আছে। যেমন আমি তোকে ভুলে গিয়েছি।”

চঞ্চল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। এরপর ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়। “আমায় তুই ক্ষমা করিস। আমার মালাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। তুই যে ওই ঘটনার জন্য জীবন শেষ করে দিবি, আমি বুঝতে পারিনি। তখন অল্প বয়স। সবটাই অপরিণত আবেগ।”

মিলন শান্ত গলায় বলল, “তা কেন? মনের কথা শুনেছিলি। মনের কথা তো শুনতেই হবে। এতে অপরাধবোধের কী আছে?”

চঞ্চল নিজেকে সামলে নিয়ে ভিজে গলায় বলল, “কিন্তু তারপর কী হল মিলন। মালা তো আমার মনের কথা সব শুনতে পাচ্ছে বলে পাগলামি শুরু করল। গ্রাম থেকে পালিয়ে প্রথমে আমাদের সোনারপুরের বাড়িতে তুললাম। মন্দিরে বিয়ে করে সুরাটে আমার দাদার কাছে নিয়ে চলে গেলাম। দাদা সংসার পেতেছি দেখে একটা কেমিক্যাল কারখানায় কাজ জুটিয়ে দিল। মর্নিং, ইভিনিং, নাইট এই তিন শিফটে নিজেকে নিংড়ে কাজ করতাম। বাড়ি ফেরার পর মালা আমাকে নিংড়ে নিতে চাইত। আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। মালা বলত, আসলে ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে আমার মন চাইছে না। ওকে পুরোনো লাগছে আমার। ও শুনতে পাচ্ছে আমার মনের কথা। বলত, আমি নাকি ফেরার সময় রাস্তায় মনে মনে ওকে গালাগাল করতে করতে ফিরি।

মালা ওই সময় সব মনোযোগ ওর ওপর থাকবে এটাই চাইত। বলত, সব ছেড়ে এই পরবাসে কেন আছে? যাতে শুধু ও আর আমি দুজন দুজনের বাইরে আর কিছুতে মনোযোগ দেবার মতো কিছু না পাই। এক কামরার ভাড়া ঘরটা মালার বেশ পছন্দ ছিল। বলত, ঘরটা সাদামাটা থাকা ভাল। অ্যাটেনশন দিতে হয় না পরিপাটি রাখার জন্য। আমার কোনও পোশাক বেশি পছন্দের হলে নষ্ট করে দিত। হয়তো ইস্ত্রি করে পুড়িয়ে দিল। কোনও খাবার পছন্দের হলে, তাকে বিস্বাদ করে রান্না করে অপছন্দের দিকে ঠেলে দিত। কোনও গান, কোনও সিনেমা কিছু না। শুধু এবং শুধু মালাকে ছাড়া আর কিছু যাতে না থাকে আমার ।

ওইটুকু ঘর আর মালার ওইটুকু মনের মধ্যে আটকে পড়ে মুক্তির জন্য হাঁসফাঁস করছিলাম। তখন তোর কথা খুব মনে পড়ত। তোর আত্মহত্যার খবরটা পেয়েছিলাম। মনে হত ইস মিলনটা বেঁচে থাকলে মালাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতাম। ছেলেটা বিয়ে ভেঙ্গে যাবার অপমানে সুইসাইড করল। সব আমায় জন্য। আমিই দায়ী। দু দিক থেকে ভেঙ্গে পড়ছিলাম মিলন। একবার মনে হচ্ছিল আমি মালাকে নিয়ে না পালালে তোর ওই অবস্থা হত না। আবার মাঝেমাঝে মনে হত, তুই আমার প্রিয় বন্ধু। মালাকে নিয়ে পালিয়ে হয়তো আমি তোকে অজান্তে বাঁচিয়েছি। সত্যিই যদি তুই বেঁচে থাকতিস মিলন!”

চঞ্চল বলতে বলতে বিহ্বল হয়ে পড়ল। চোখে জলের রেখা ফুটে উঠল। পাশে মিলনের ছায়ার মতো উপস্থিতি স্থির নির্বাক।

চঞ্চল ধীরে ধীরে বলল, “জানিস এরপর এটা ভাবতে খুব ভাল লাগত যে মালা অন্য কারো সঙ্গে পালাচ্ছে। যেমন করে তোকে বিয়ে করতে রাজি হবার পরেও আমার সঙ্গে পালিয়েছিল। কোনও সুপুরুষ যুবকের সঙ্গে আলাপ হলে বাড়িতে ডেকে আনতাম। যদি মালার মনে ধরে। কিন্তু ফল হল উলটো। এইসব দেখে মালার মনে হতে লাগল ওর কবল থেকে আমি নিজে বাঁচার জন্য ওকে মেরে ফেলব। ও রাত্রে স্বপ্ন দেখে চমকে উঠত আমি ওকে খুন করেছি। বলত, এই ছোট এক কামরার ঘর, বদ্ধ খুপরির মতো রান্নাঘর। আমি গ্যাস খুলে রেখে ওকে পুড়িয়ে মারব। একদিন নিজের ভুলে গরম জলে হাত পুড়িয়ে ফেলল। এরপর রোজই মালার মনে হত আমি গ্যাস খুলে রেখে যাব। আমি যতক্ষণ বাড়িতে থাকতাম পিছন পিছন ঘুরত।”

“তারপর?”

“তারপর একদিন সবে মর্নিং শিফটে কারখানায় ঢুকেছি। হঠাৎ খবর এল গ্যাস সিলেন্ডার লিক করে আমার ঘরে আগুন লেগে গেছে। যখন পৌঁছলাম তখন মোটামুটি শেষ। মালা স্পটেই মারা গিয়েছিল।”

চঞ্চল কথা থামালো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলল, “এরপর সুরাটে থাকার মতো মনের অবস্থা ছিল না। আমি একটা এজেন্সি মারফত মিডিল ইস্ট চলে গেলাম। ম্যাসকট, ওমান। এরপর মিশর, কাতার, জর্ডন, ইয়েমেন, সৌদি, দুবাই, কিছুদিন ইস্তানবুলে কাটল। দশ বছর। দশ বছর পর তোর সঙ্গে দেখা হল।”

“হুঁ সময় বয়ে যায়। ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে দিলে সময়কে আর আলাদা করে চেনা যায় না। তখন তা একটা নিরবিচ্ছিন্ন তরঙ্গের মতো হয়ে যায়। সময়কে অনুভব করতেই এখানে আসি, এই জলের নড়াচড়ার দিকে চেয়ে বসে থাকি অপলক।” 

বলতে বলতে মিলন ভাবাচ্ছন্নতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সেদিন মর্নিং শিফটে কারখানায় যাবার আগে তুই কি নিজের চা নিজে বানিয়ে খেয়েছিলি?”

মিলনের প্রশ্নে চঞ্চলের বুক কেঁপে উঠল, চোখে মণি চঞ্চল হল, সে মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল, “মনে পড়ে না। অনেক বছর আগের কথা। ভুলে গেছি।”

“ভুলে যাওয়া মানেই ক্ষমা করা নিজেকেও। ভাল থাকিস।” মিলন আরও ফিকে হয়ে গেল হওয়ায়। পুকুরের জলে মৃদু তরঙ্গ উঠল। চঞ্চলকে কেউ ডাকছে। উঠার সময় নিজেকে বেশ হালকা বোধ হতে লাগল চঞ্চলের।


…………………..

অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী


No comments:

Post a Comment