গল্পঃ ব্যর্থঃ অঙ্কন মিত্র





অফিসে থাকতেই হঠাৎ দেবমাল্যদার ফোনটা এল। বলল “এই শোন না, তুই কাল সন্ধেবেলা ফ্রি আছিস? কাল আমাদের বাৎসরিক সাহিত্য সভার অনুষ্ঠান হবে অঙ্কুরণ-স্মৃতি-সদনে। তুই কি আসতে পারবি? আসলে…এবারে শশীকলা-স্মৃতি-ছোটোগল্প পুরস্কার বিভাগে, আমাদের পুরস্কার কমিটি তোর নামটা সিলেক্ট করেছে। ওই সাড়ে-ছ’টা নাগাদ অনুষ্ঠান শুরু হবে।” 

মোবাইলটা কান থেকে নামাতেই, একটা অদ্ভূত আনন্দে শরীরটা শিহরিত হয়ে উঠল স্নিগ্ধর। কতদিন এমন একটা সম্বর্ধনা-সন্ধ্যার কথা মনে-মনে স্বপ্নে বুনেছে ও!

সারাদিন আজ আর বিশেষ ফাইল-পত্তরে মন লাগল না। খালি মনে হতে লাগল, বাড়ি ফিরেই এ বার হাফ ফিনিশড্ উপন্যাস দুটোর একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতেই হবে। এই জাতীয় উপন্যাস একবার যদি ছাপা হয়ে বের হয়, তাহলে তো…! 

স্নিগ্ধ সল্টলেকের একটা সরকারি অফিসে ডেস্ক-জব করে। সাদা বাংলায়, কলম-পেষা কেরাণী। বাবার মৃত্যুর পর, ডায়েড-ইন-হারনেস কোটায় চাকরিটা পেয়েছিল। ওই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করবার পরে-পরেই। তারপরই বিয়ে-থা হয় এবং এখন সে এক কন্যার পিতাও বটে। কিন্তু হায়ার-এডুকেশন থেকে চাকরি, কোনোটাই স্নিগ্ধর ঠিক মনঃপূত হয়নি। ও চেয়েছিল সাহিত্যে এমএ করতে; কিন্তু রাশভারী বাবা ওকে ঘাড় ধরে বি-কম-ই পড়িয়েছিলেন। আর এই চাকরিটা… সবাই-ই সম্ভবত পিছনে বলে বেড়ায়, ‘বাপের দয়ায় পাওয়া’। নিজের চেষ্টায় চাকরি করবার গৌরবটাও স্নিগ্ধর আর এ জীবনে পাওয়া হল না।

মানসিক এইসব ছোটো-বড়ো দুঃখগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-করতেই, স্নিগ্ধ বছর-কয়েক আগে ফেসবুকে নিজস্ব একটা ব্লগ লিখতে শুরু করে। তারপর এই লেখবার প্রবণতাটাই ক্রমশ পাকতে-পাকতে, বছর-তিনেক হল, শহর ও মফস্বলের বহু ছোটো-বড়ো সাহিত্য-পত্রিকায় স্নিগ্ধ উপাধ্যায়ের ছোটোগল্প-উপন্যাস ছাপা হচ্ছে। শহরের প্রথম শ্রেণির বাংলা ম্যাগাজিনগুলোয় আর ফোর্সড লেখা পাঠাতে হচ্ছে না ওকে; গত-বছর পুজোর-সংখ্যা থেকেই এডিটোরিয়াল-অফিস থেকে লেখবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে, ফোন আসছে ওর কাছে।

তাই স্নিগ্ধ এখন যাকে বলে, রীতিমতো ব্যস্ত লেখক। নিজস্ব ভাষা, গল্প বলবার বিশেষ স্টাইলাইজেশন, পত্রিকার ডিমান্ড অনুযায়ী শব্দ-সংখ্যার লিমিটেশনের মধ্যেই নিজের আখ্যানের বক্তব্যটাকে প্রাঞ্জল করে ফুটিয়ে তোলা, এ সবে ও এখন রীতিমতো এক্সপার্ট। 

স্নিগ্ধর নিজের ধারণা, এই ফিল্ড-এর টেম্পারামেন্টটা ও ভালোই বুঝতে পারে। মধ্যবিত্ত পাঠকের রুচি, ম্যাগাজিন-হাউসগুলোর ডিমাণ্ডের সঙ্গে লেখকের নিজস্ব মননের তাল-মিল, বা ভাবনা-চিন্তা বেশিরভাগ সময়ই টিউনড্ হয় না বলেই, বহু লেখকই শেষ পর্যন্ত ‘ব্যর্থ কবি’ হয়ে ওঠেন। ও ঠিক সেই জায়গাটাতেই নতুন লেখকদের থেকে দু-স্টেপ এগিয়ে আছে।

এই সব মনমুগ্ধকর ভাবনাগুলোকে নিয়ে মনের মধ্যে গুনগুন করতে-করতে, স্নিগ্ধ আজ দুটো সিগারেট বেশিই খেয়ে ফেলল। তারপর ফুরফুরে মেজাজে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে, সাড়ে-পাচটার সময় অফিস থেকে বেড়িয়ে, ধীরে-সুস্থে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। বাসে উঠেও আজ জানালার ধারেই সিট পেয়ে গেল। গুমোট গরমের মধ্যে এক-ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে এসে লাগল। আজ মনে হচ্ছে, বৃহস্পতি তুঙ্গে উঠেছে ওর রাশিতে! 

ঠাণ্ডা হাওয়ায় চোখ দুটো আরামে বুজিয়ে, স্নিগ্ধ আবার ঢুকে পড়ল নিজের ভাবনা-স্রোতে। দেবমাল্যদা আরও বলল “শোন না, তাড়াহুড়োয় তোকে কার্ড দিয়ে ইনভাইট করতে যেতে পারছি না। কিছু মনে করিস না, ভাই। কার্ড-টা তোকে বরং আমি হোয়্যাটস্-অ্যাপ করে দিচ্ছি।” 

মোবাইলে এই একটু আগেই এসে গেছে সেই কার্ডের ছবি। স্নিগ্ধ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বেশ কয়েকবার দেখেছে। বাঁধা গতের আমন্ত্রণ-পত্র। তবে আমন্ত্রণে সম্মান প্রকাশের কোনও খামতি নেই। তা ছাড়া এই ফোনে-ফোনে ইনভাইট করাটাকেও বিশেষ কিছু সেন্টিমেন্টালি নিচ্ছে না স্নিগ্ধ। একে দেবমাল্যদাদের পত্রিকার পরিসর ছোটো, সারকুলেশনও যথেষ্ট কম। তা ছাড়া ও তো কোনওদিন কোনও সো-কলড্ ভালো গল্প এই সব ছোটো পত্রিকায় পাঠায়ইনি। স্নিগ্ধ গত দু-বছরে বড়ো-পত্রিকার দপ্তরে যখনই দু-তিনটে করে লেখা পাঠিয়েছে, প্রতিবারই ওর একটা-না-একটা লেখা ঠিক সিলেক্ট হয়েছে। তখন বাকি এইসব বড়ো-পত্রিকার থেকে রিজেকটেড হওয়া লেখাগুলোই স্নিগ্ধ দিয়ে দিয়েছে দেবমাল্যদাদের ছোটো পত্রিকার জন্য। তাও ওরা এতো গুণগান, সুখ্যাতি করছে ওর; যেচে আধুনিক কথাশিল্পকার হিসেবে ওকে সম্মানিত করতে চাইছে!

বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেও, এখুনি ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছে করল না স্নিগ্ধর। বাড়ি ঢুকলেই এখন মেজাজটা খাট্টা হয়ে যাবে। হয় দেখতে হবে, মায়ের ঘরে গাঁকগাঁক করে টিভিতে সিরিয়াল চলছে, না হলে স্ত্রী আর মেয়ে মিলে পড়াশোনার নামে বিশ্বযুদ্ধ করছে! 

এই জন্য ওর লেখালিখিতেও যথেষ্ট ডিস্টার্বেন্স হয় বাড়িতে। হয় তো একদিন খুব মুড্ এল রাত্রে, অমনি স্ত্রী রীতা এসে বলল “কী গো, এখন আবার তুমি লিখতে বসলে? শোবে না? মেয়েটার তো কাল ইস্কুল আছে সকালে, নাকি!” ব্যাস হয়ে গেল মুডের দফা-রফা! 

আসলে রীতা ঘরোয়া, সাধারণ মেয়ে। ওর মধ্যে ও সব ইন্টালেকচুয়ালিটি-ফিটি নেই। এটা স্নিগ্ধর একটা প্লাস-পয়েন্টও বটে; কারণ স্ত্রী যদি খুব এক-চোট আঁতেল হত, তাহলে এতদিনে ইগো-ক্ল্যাশ হয়ে, ওর সাহিত্যিক সত্তার সলিল-সমাধি হয়ে যেত। সেটা একটা বাঁচোয়ার দিক তো বটেই। তবে ওই… নেগেটিভ ব্যাপার হল, ছুটির দিনে লেখবার মুড এলে, হয় শুনতে হবে কাজের-লোকের ঝামেলার পাঁচালী, না হয় বউ-এর বাপেরবাড়ির কিছু ওয়ার্থলেস্ পরচর্চার কথা!

কিন্তু এটাও ঠিক, ইদানিং স্নিগ্ধর লেখা-টেখা বড়ো-পত্রিকায় নিয়মিত ছাপছে, পুজোর সংখ্যায় ওর নাম স্বর্ণাক্ষরে বড়ো-বড়ো হরফে দেখা যাচ্ছে, বইমেলায় ওর নতুন বই-এর পেপারব্যাক কোনও প্রথিতযশা প্রবীণ সাহিত্যিক উদ্বোধন করছেন, এ সব দেখে, ঘরে-বাইরে, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশির মধ্যে স্নিগ্ধর একটা আলাদা সম্মান তৈরি হয়েছে। স্নিগ্ধ উপাধ্যায় এখন আর মরা-বাপের কোটায় চাকরি পাওয়া, সাধারণ মাছি-মারা কেরাণিটুকু নয়; নিজের একটা ঠিকঠাক আত্মপরিচয়, এতোদিনে ও তৈরি করতে পেরেছে।

এই পরিচয়টাকেই তো পুরস্কার-টুরস্কার দিয়ে, আরও গ্লোরিফাই করে তুলতে চাইছে দেবমাল্যদারা। আজ এটা দেবমাল্যদার অনামা পত্রিকার তরফ থেকে আসছে, দশবছর পর হয় তো এটাই সরকারি কোনও ভূষণ-সম্মান হয়ে, খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে আসবে! এই আশাটাকেই তো মনে-মনে লালন করছে স্নিগ্ধ! যদিও এ সব কথা ও কারো সঙ্গে শেয়ার করে না। লেখককে ইন্ট্রোভার্ট, মুখচোরা হতে হয় নিজের স্বার্থেই, এটা ও মানে। তা ছাড়া ফালতু হ্যাজালে, ভীতরটা সহজে ওপেন, নিঃস্ব হয়ে যায়; তখন আর লেখবার জন্য ভাব-ভাষার গাঢ়ত্বটা থাকে না। যদিও অনেক বিখ্যাত লেখকই চরম আড্ডাবাজ ছিলেন বলে ও শুনেছে, কিন্তু ওটা স্নিগ্ধর ধরণ নয়। একটু চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে থাকলে, লোকে সাহিত্যিক বলে একটা আলাদা সম্মানও করে। এটা অফিসের পার্টি, বা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়েও, স্নিগ্ধ লক্ষ্য করে দেখেছে। মদ, রাজনীতি, খেলা, আর কেচ্ছার চেনা গজল্লায় তেলে-জলে সব একাকার হয়ে গেলে, ও আর সাহিত্যিক বলে আলাদা হবে কোনখানে? 

তবে ফেসবুকে স্নিগ্ধর বেশ কিছু সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু আছেন, বেশিরভাগের সাথেই ওর এই অন্তর্জালেই আলাপ। এখানেই ও মন খুলে, সাহিত্যের বিভিন্ন জঁর্, উত্তর-আধুনিক সাহিত্য, প্রোটাগানিস্ট ও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, সমান্তরাল ইতিহাসের বিনির্মাণ, সাহিত্যের ডি-কনস্ট্রাকশন – এই সব অত্যন্ত সিরিয়াস ও তাত্ত্বিক ব্যাপার নিয়ে, নিজের মত আদান-প্রদান করে। 

চায়ের দোকানের সরু বেঞ্চটায় বসে, এই সব কথাই আপন-মনে ভাবছিল স্নিগ্ধ। কব্জি উল্টে দেখল, ঘড়িতে ন’টা বেজে গেছে। চায়ের দাম মিটিয়ে, বাড়ির পথ ধরতে-ধরতে ভাবল, আজ বাড়ি ফিরেই ফেসবুকের সাহিত্য-মহলে এই আগামীকালের পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যাপারটা শেয়ার করতে হবে। 

তা ছাড়া এই পুরস্কারটা পাওয়ার পরই, ও আবার ফেসবুকে নতুন একটা ব্লগ লিখবে বলে ভাবছে। ওর যে গল্প-উপন্যাসগুলো ইদানিং এদিকে-সেদিকে প্রকাশিত হচ্ছে বা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে নানা মহলে যেমন আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, সেটা একটা দিক; তেমনই এই গল্পগুলো গড়ে ওঠবার পিছনের ইতিহাসটাও তো একটা ছোটোখাটো গল্পের মতোই। কোন ভাবনা থেকে হঠাৎ কোন প্লট মাথায় এল, কোনও পার্টিকুলার আখ্যানের বয়ানে কেন ও হঠাৎ সরাসরি সাধুভাষা ব্যবহার না করেও প্রচুর তৎসম শব্দ ব্যবহার করল, কেনই বা একটা লেখাকে ও উত্তম-পুরুষ কথক দিয়ে লিখল, কোনও উপন্যাসের কোনও একটা বিশেষ চরিত্রকে নির্মাণ করতে ওকে ইনটারনেট ঘেঁটে কী, কী বিষয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছিল – এই সব আর কী! এই ব্লগ-টার মধ্যে দিয়ে স্নিগ্ধ আসলে নিজের লেখক জীবন, লেখক হয়ে ওঠবার পর্যায়গুলো, নিজের প্রতিটা গল্প, তাদের স্টাইলাইজেশন ও তাদের আঁতের কথা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতে চায়। ওর সাবকনশাস সম্ভবত বলে, ও যে কেন লক্ষ-লক্ষ ‘ব্যর্থ-কবি’-দের ভিড়ের মধ্যে একজন হয়ে উঠল না, বাকিদের থেকে শেষ পর্যন্ত আলাদা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়তে পারল, এই লেখাটা তারই একটা পরোক্ষ ফর্মুলেশান হবে!

সিগারেটটা গেটের বাইরে পা দিয়ে পিশে, বাড়ি ঢুকল স্নিগ্ধ। ক্লান্ত পায়ে দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে, দোতলার ডাইনিং থেকে মেয়ের মিহি গলা শুনতে পেল “মা, মা, সেই গল্পটা বলো আগে! তারপর আমি খাব!” 

স্নিগ্ধর পাঁচবছরের মেয়েকে নিয়ে ডাইনিং-টেবিলে রাতের খাবার খাওয়াতে বসেছে রীতা। মেয়ের মুখে এখন সবে খই ফুটেছে; সারাদিন অসম্ভব বকবক করে। ওকে এক যায়গায় ধরে বসিয়ে খাওয়ানোটাই ওর মা-র কাছে একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ। রীতা বলল “কোন গল্পটা রে, ফুরফুর?”

মেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে উঠল “ওই যে গো, ভাইয়া-র গল্পটা!”

‘ভাইয়া’ যে মেয়ের একটা পছন্দের পুতুলের নাম, এটাই শুধুমাত্র স্নিগ্ধ জানত। 

রীতা বলে উঠল “আচ্ছা, বলছি। আগে তুমি এই গ্রাসটা মুখে নাও… হ্যাঁ, তারপর তো, আয়রনম্যান এসে ভাইয়াকে বলল, তুমি ছাড়া আমাদের গতি নেই!”

মেয়ে এক-মুখ খাবার নিয়ে, আবারও চিৎকার করে উঠল “কেন, আয়রনম্যান ভাইয়াকে ডাকল কেন?” 

রীতা বলল “উঁহ্, চিৎকার কোরো না, ফুরফুর। বিষম লাগবে!” তারপর গলাটা পালটে বলল “আসলে ক্যাপ্টেন-আমেরিকা তো তখন বুড়ো হয়ে গিয়েছিল, আর… আয়রনম্যান তো টাফা-গ্রহের ভাষা জানত না। তাই…”

মেয়ে প্রশ্ন করল “টাফা-গ্রহটা কোথায়, মা?”

রীতা বলল “সে অনেক দূরে। সাত কোটি আকাশগঙ্গা, আর তেরো লক্ষ আলোকবর্ষের পাড়ে। অনেকদিন আগে শুধু একবার রকেটে চেপে, প্রোফেসর শঙ্কু সেখানে যেতে পেরেছিল।”

মেয়ে তার শিশু-সুলভ চাপল্যে চঞ্চল হয়ে বলল “টাফা-গ্রহে কী হয়েছিল, বলো না তারপর?”

বোঝাই যাচ্ছে, গল্পটা শ্রোতার বহুশ্রুত। তবু সে আবার শুনতে চায় চরম আগ্রহে। কথক-মাতা বলল “আগে ভালো করে চিবিয়ে-চিবিয়ে খাও…”

মেয়ে অধৈর্য হয়ে বলল “আহ্, খাচ্চি তো! তুমি বলবে তো… টাফা-গ্রহে রাক্ষস-থ্যানস সব পক্ষীরাজ ঘোড়াগুলোকে ভয়ানক উড়ুক্কু-ডাইনোসোর বানিয়ে দিয়েছিল, তাই না? কী করে ও পক্ষীরাজদের সঙ্গে অমন করতে পারল?” 

মা, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল “থ্যানস তো খুব দুষ্টু ছিল, ও না একদিন রাত্তিরে চুপি-চুপি রাবণের চিতাভস্ম চুরি করেছিল!”

মেয়ে নাটুকে গলায় বলে উঠল “রাবণ! সেই যে ডেমন-কিং-কে রাম যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল? মা-মা, চিতাভস্ম কী?”

মা বলল “রাবণের চিতা তো এখনও জ্বলছে।… চিতাভস্ম হল ওই পোড়া কাঠ থেকে বেরোনো ফ্লাই-অ্যাশ!”

মেয়ে হাততালি দিয়ে, নিজেই গল্পের খেইটা ধরে ফেলল “ওই ফ্লাই-অ্যাশের মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক রকম রেডিয়ো-অ্যাকডিভ ব্যাকটেরিয়া! থ্যানস ওগুলো যেই এক-ফুঁয়ে উড়িয়ে দিল, অমনি ব্যাকটেরিয়াগুলো চেপে ধরে, সব ক’টা পক্ষীরাজকে ডাইনোসোর বানিয়ে দিল! তাই না?...জানো মা, আমাদের সায়েন্স-ক্লাসে বলেছে, ব্যাকটেরিয়ারা এতো ছোটো যে, ওদের খালি-চোখে দেখা যায় না।”

রীতা হেসে বলল “ঠিক বলেছিস। গুড গার্ল!”

মেয়ে আবার মায়ের হাত ধরে টানল “তারপর কী হল? বলো না, মা!”

চিরকালিন মায়েদের প্রতিভূ হয়ে, মেয়ের মুখে অন্ন তুলে দিতে-দিতে, রীতা বলল “তারপর আর কী! প্রোফেসর শঙ্কুর কাছ থেকে অ্যানাইলিহিন বন্দুকটাকে চেয়ে নিয়ে, আয়রনম্যানের পিঠে চেপে, ভাইয়া তো পৌঁছল গিয়ে টাফা-গ্রহে। তারপর বন্দুকটা টিপতেই…”

মেয়ে দু-হাত তুলে চিৎকার করে উঠল “সব ক’টা রাক্ষুসে ডাইনোসর একসঙ্গে ভ্যানিস হয়ে গেল! থ্যানসও ভ্যানিস হয়ে গেল। তারপর কী হল, মা?”

রীতা মেয়ের পেটে কাতুকুতু দিয়ে বলল “ভাইয়া এত্তো বড়ো একটা পক্ষীরাজের ডিম সঙ্গে করে নিয়ে এল। তার থেকে আবার নতুন ধবধবে সাদা ডানাওয়ালা পক্ষীরাজ জন্মাল।… নাও, এ বার জলটা ঢকঢক করে খেয়ে নাও, দেখি।”

সিঁড়ির মুখেই বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল স্নিগ্ধ; মা-মেয়ের আজগুবি, মুখে-মুখে বানানো গল্পটা শুনতে-শুনতে। কিন্তু… গল্পটা, এই যেটা মুখে-মুখে এখুনি রচিত হল, সেটাকে কি আদৌ আজগুবি বলা যায়? আজন্মকাল ধরে এমনই মুখ-চলতি কাহিনিতে শিশু-মনে কী প্রথম কল্পনার আলো বপণ করে আসছেন না চিরকালের মায়েরা? এই আবহমান কাহিনিগুলোর জ়ঁর কী? কোন উত্তর-আধুনিক সাহিত্য সমালোচনা একে ক্যাটেগোরাইজড্ করবে? কোন পাঠক-শ্রেণির টেম্পারামেন্ট বুঝে, ছক কষে, প্লট পাকিয়ে, এ সব আখ্যান রচিত হয়েছে? কেউ তো কোনওদিন কোনও পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেনি এইসব আশ্চর্য প্রতিভাধর কথাকারদের! তা হলে?

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে, মুখটা ক্রমশ কালো হয়ে গেল স্নিগ্ধর। ওর মনে হল, দোতলাটা যেন অনেক-অনেক উপরে; যেখানে আজীবনের আবহমান গল্প প্রবাহ নিয়ে বসে আছেন এক মা ও তার মেয়ে। 

আর নিচে, অন্ধকারের মধ্যে, ক্রমশ সীমাহীনতার সিঁড়ি ভেঙে চলেছে স্নিগ্ধ… একদল অদৃশ্য ব্যর্থ-কবিদের ভিড়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে।  


………………..

অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


 

No comments:

Post a Comment