রম্যরচনাঃ মিষ্টিরিয়াসঃ গৌতমেন্দু রায়








সারাজীবনে মিষ্টি মিষ্টি কথা অনেকই বলেছেন কিন্তু আগ বাড়িয়ে কেউ মিষ্টি খাওয়াতে আসেননি। এমন কখনও হয়নি যে কেউ এসে বলেছেন, ‘চলুন আপনাকে আজ মিষ্টি খাওয়াই’। চাকরিতে প্রমোশন হোক অথবা সন্তানের ভালো রেজাল্ট, শুভানুধ্যায়ীরা ছেঁকে ধরে দাবি তুলেছেন ‘আজ আপনাকে ছাড়ব না, মিষ্টি খাওয়াতেই হবে’। প্রতিটি জন্মদিন অথবা বিবাহবার্ষিকীতেও সেই একই ঘটনা ঘটেছে। আজ পর্যন্ত এই ইতিহাসের পরিবর্তন হয়নি। অথচ মিষ্টি নিয়ে মানুষ কত কটূ কথাই না বলে! মিষ্টি খাওয়া মানেই বিষ খাওয়া, মিষ্টি খেলে মধুমেয় হতে পারে। রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। দাঁতের সাংঘাতিক ক্ষতি হতে পারে, এইরকম হাজার তেতো কথা আজীবন শুনে এসেছি। অথচ তাঁদের যে কোনও একজনকে আপনি মিষ্টি খাওয়াবেন বলে একটিবার ডেকে দেখুন, তিনি তৎক্ষণাৎ সমস্ত কাজকর্ম ফেলে আপনার পিছু নেবেন।

এক এক সময় আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এমনও তো একটা দিন ছিল যখন আমাদের দেশে মিষ্টি নামক এই বস্তুটিই ছিল না। তখন মানুষ কী খাওয়ানোর জন্য আবদার করত? প্রশ্নটা আমার মনে অনেকদিনের। আজও তার উত্তর পাইনি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি দিল্লিকা লাড্ডুর অনেক আগে এই দেশে মতিচূরের লাড্ডু আবিষ্কৃত হয়েছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই মিষ্টির বয়স আড়াই হাজার বছর হলেও সন্দেশ রসগোল্লা সে তুলনায় নেহাতই বাচ্চা। তাদের বয়স কিছুতেই দু’শো আড়াই’শো বছরের বেশি নাকি নয়। ধর্মীয় কারণে ছানা থেকে তৈরি মিষ্টি এ দেশে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ ছানা হল দুধের কৃত্রিম পরিণাম। দুধ ফুটিয়ে তাতে লেবুর রস টস দিয়ে একটা ফাটাফাটি দাঙ্গা বাধিয়ে দিলে তবেই ছানা হয়। দেবতারা শান্তিপ্রিয়। এরকম ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে মিষ্টি তৈরি করলে তা তাঁদের পছন্দ হওয়ার কথাই নয়। একারণেই শাস্ত্রানুসারী দেবপূজায় ছানা দেওয়ার মোটে বিধান নেই। ক্ষীর, মাখন, দই অথবা ঘিতে আমাদের দেবতাদের আপত্তি নেই। কারণ এর সবগুলিই দুধ থেকে সরাসরি তৈরি, বাইরের কোনও এজেন্টকে সেখানে ঢুকে দালালি করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমরা তো আর দেবতা নই, তাই কৃত্রিম বা স্বাভাবিক সে যাই হোক না কেন মিষ্টি মিষ্টি দুধের প্রোডাক্ট দেখলেই আমাদের নোলা লকলক করে।

বঙ্গজীবনে মিষ্টি আসলে একটা খুব মিষ্টি ব্যাপার। বাঙালিদের কাছে মিষ্টি মোটেই মিস্ট্রি নয়। বরং এতটাই প্রাঞ্জল যে তাদের মিষ্টি করে বলা উপমায় প্রাণে জল আসে। যেমন জলভরা তালশাঁস। তাকে শো-কেসে দেখলেই জিভে দয়া করতে ইচ্ছে করে। অমুকের বউটা দেখতে খুব মিষ্টি, বাড়িওলা আমাকে আজ মিষ্টি মিষ্টি করে দু’কথা শুনিয়ে দিল-এ ধরণের কথাবার্তা কার না কানে ভেসে আসে? খবরের কাগজে, রবিবারের পাতায়, মিষ্টি প্রেমের গল্প পড়ে মন উড়ুউড়ু হয়ে যায়। মিষ্টি আমাদের কাছে এক অনন্য সৃষ্টি, এই সৃষ্টি এখন আমাদের কাছে কৃষ্টি হয়ে উঠছে। বৃষ্টির মতো তার করুণাধারা আমাদের ওপর বর্ষিত হচ্ছে অবিরাম। একথা ভাবতে গেলেই দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে আসে। চোখে জল ভরে যায়।

আমার বন্ধু দীপঙ্করের প্রাণাধিক প্রিয় হল মিষ্টি। ইদানিং ডায়াবেটিস ধরেছে বলে প্রকাশ্যে, পরিবারের লোকজনের সামনে, সে মিষ্টি খেতে পারে না। তাই সে অজুহাত খুঁজে বেড়ায়। এমনিতেই বাঙালিদের তিনটে হাত। ডান হাত, বাঁ হাত আর অজুহাত। তো সেই অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে বন্ধুবরটি প্রায়ই মিষ্টি সাঁটায়। সিগারেট বা মদ খেলে লুকোনো যায় না। গন্ধই তার ইতিহাস বয়ে বেড়ায়। কিন্তু মিষ্টি খেয়ে বাড়ি এলে তা ধরে ফেলবে সে সাধ্য বন্ধুপত্নীরও নেই। মিস মারপেল বেঁচে থাকলে তাঁর পক্ষেও হয়তো ধরা সম্ভব হত না। 

এই বন্ধুটির যখন ব্লাড-সুগার ধরা পড়ল তখন বাড়ির সবাই একটু বিষণ্ণ  হয়ে পড়েছিল। ও মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে, এবারে কী হবে–এই কথা ভেবে তারা স্বাভাবিক কারণেই একটু মুষড়ে পড়েছিল। কিন্তু দীপঙ্করের মধ্যে আমি ভাবান্তর দেখিনি। রিপোর্টে চিনির পরিমাণ অত্যন্ত বেশি রয়েছে বলে ডাক্তার দেখানো হল। বন্ধুপত্নীর অনুরোধে আমি সঙ্গে গেলাম। ডাক্তার বললেন, ‘আপনাকে এবার থেকে একটু রেস্ট্রিকশনে থাকতে হবে। সকালে মাখন ছাড়া দু’পিস টোস্ট খাবেন। সঙ্গে দুধ। দুপুরে পঁচাত্তর গ্রাম চালের ভাত, কচি মুরগির ঝোল অথবা ছোটমাছ, রাতে খাবেন দু’টো রুটি আর ভেজিটেবলস, ব্যাস’। এই পথ্যের তালিকা শুনে আমার মুখ শুকিয়ে গেলেও ওকে বেশ নির্বিকার মনে হল। সে সুবোধ বালকের মতো প্রশ্ন করল, ‘তা এইসব ডায়েট কখন খাব ডাক্তারবাবু? মিষ্টি খাওয়ার আগে না পরে?’ আমার অবস্থা তো ছেড়েই দিন, এবার সেই ডাক্তারের মুখের অবস্থাটা অনুমান করুন।   

মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে হলে আমার এই বন্ধুটি বিষ্ময়কর ভাবে একটা না একটা অজুহাত ঠিক জুটিয়েই ফেলে। অজুহাতের ভ্যারাইটি দেখে আমরা সবাই যারপরনাই অবাক হয়ে যাই। তা একবার হল কী, এই খাওয়াদাওয়া নিয়েই স্ত্রীর সঙ্গে তার বেদম ঝগড়া বেঁধে গেল। বন্ধুটি ভাত টাত না খেয়েই ব্যাগ গুছিয়ে অফিসে চলে গেল। গিন্নির মন খারাপ। সে সারাদিন ধরে মোবাইলে অনেকবার তাকে ট্রাই করল। বন্ধুটি কিছুতেই কল রিসিভ করছে না। বাড়িতে সবারই ভীষণ চিন্তা। সারাদিনে সে কিছু খেল নাকি খেলই না এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বন্ধুর স্ত্রী আমাকেই ফোন করে বসল। তার অনুরোধ, একটিবার যেন তাদের বাড়িতে যাই। এই পরিস্থিতিতে আমিও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম বন্ধুটির জন্য। তাড়াহুড়ো করে তাদের বাড়িতে গিয়ে বন্ধুটিকে আমার ফোন থেকে কল করলাম স্পিকারটাকে লাউডে দিয়ে। ওপারে রিং হচ্ছে, বাড়ির সবাই উদগ্রীব। কয়েকবার রিং হতেই বন্ধু ফোন ধরে স্বাভাবিক গলায় বলল ‘শোন, আমি এখন সুইসাইড করছি। আমাকে ডিসটার্ব করিস না। আমি আর বাঁচতে চাই না’। আমি আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠে বললাম ‘মানে?’ ও জবাবে বলল, ‘আমি এখন কে সি দাসের দোকানে ঢুকছি। গোটা পাঁচেক বড় সাইজের রসগোল্লা খাব। সঙ্গে কয়েকটা রাজভোগও। খাওয়া নিয়ে এত খোঁটা? মিষ্টি যদি আমার ক্ষেত্রে বিষ হয় তবে আমি আজ এই বিষ খেয়েই মরতে চাই। তবে একা মরব না, তোদেরও মারব। অপেক্ষা কর। আমি একহাঁড়ি রসগোল্লা নিয়েই বাড়িতে যাচ্ছি। কোথাও যাস না’। ফোনটা কেটে দিল বন্ধুবর। তার এই মিষ্টিরিয়াস আচরণ আমার মাথায় ঢুকল না। আমি শুধু বন্ধুপত্নীর দিকে তাকিয়ে একটু মিষ্টি করে হেসে অভয় দিলাম।


…………


অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী


2 comments: