খেলাঃ ভালো থেকো ঈশ্বরঃ ঈশিতা চক্রবর্তী




 ভালো থেকো ঈশ্বর


ঈশিতা চক্রবর্তী



১৯৯৪ সাল। ডিসেম্বর মাস। গ্রামের দিকে একটু বেশিই ঠান্ডা পড়ে। এর মধ্যেই সারা পাড়া বসে হাঁ করে খেলা দেখছে টিভির দিকে তাকিয়ে। সেই সাদা কালো ছোট টিভিগুলো, মনে পড়ে? গ্রামের দিকে পাড়াতে একটা বাড়িতেই এরকম টিভি থাকত আর গোটা পাড়া মিলে খেলা দেখত। দেশটা যখন ভারত তখন খেলাটা যে ক্রিকেট হবে সেটা খুব স্বাভাবিক। এসব আমি চোখে দেখিনি, শুনেছি মাত্র। খেলা পাগল বাড়ির মেয়ে হয়ে আমিও যে কিছুটা খেলা পাগল হবো সেটা কিছুটা স্বাভাবিক নয় কি? দাদার সাথে গ্রামের বাড়ির উঠানেই খেলা শুরু। পুতুল খেলা আমার ধাতে সয়নি। সেই সময়ে মেয়েদের পুতুল বা কিতকিত খেলার বাইরেও যে দুনিয়া থাকতে পারে সেটা হয়ত তখনও হজম করতে পারেনি মানুষ। কিন্তু দাদুকে পাশে পেয়েছিলাম। 

ক্রিকেট আমাদের মজ্জাগত হলেও বিশ্বকাপের সময় সব বদলে যেত। শচীনের ছবি চাপা পড়ত নীল সাদা বা হলুদ সবুজ কাপড়ে। বোধ যখন হল তখন ২০০২ বিশ্বকাপ। দাদুর কোলে বসে খেলা দেখা আর হল না আমার। দাদু ক’বছর আগেই আমায় ছেড়ে চলে গেছেন “চাঁদের দেশ” -এ। খেলা বোঝা আর শেখার সব দায়িত্ব তাই দাদার কাছে সপে দিলাম। সে আবার শর্ত এনে হাজির, “দেখ যদি তুই ব্রাজিলকে সাপোর্ট করিস তবেই আমি তোর সাথে খেলা দেখব বা আমার সাথে তোকে খেলা দেখতে দেব।” রক্তে যখন ড্রাগের মত খেলা বইছে তখন আর উপায় থাকে না। রাজি হয়ে গেলাম। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝেছিলাম হলুদ সবুজটাই আমার মনের রঙ। আর পিছন ফিরিনি। অবশ্য গোটা বাড়ি যখন হলুদ সবুজ, তখন আর চয়েজ কি কিছু থাকে? 

লেখাটা যখন লিখছি ততদিনে আমাদের কাছে খারাপ খবরটা এসেই গেছে। মারাদোনা আর নেই আমাদের মধ্যে। এর পর অনেকেই লিখেছে মারাদোনার নাড়ি নক্ষত্র নিয়ে, কোথায় জন্ম, কী খেত, কী পড়ত, আরও কত কী! এসব অনেক পড়েছেন, গুগুল করলেই পাওয়া যায়। আমি বরং একটা অন্য গল্প বলি।

২০১০ সালে দক্ষিন আফ্রিকার বিশ্বকাপে একটা আলাদাই উত্তেজনা ছিল। ব্রাজিল ঘন পাড়া দেখি রাতারাতি আধা-আধা ভাগ হয়ে গেছে! আধা নীল সাদা, আধা হলুদ সবুজ। আমার কাছে বেশ অবাক করা ব্যাপার আর কী! আর আমার ভালো মনে আছে কারণ মাধ্যমিকের পর এই বিশ্বকাপ হওয়ায় চুটিয়ে খেলা দেখেছিলাম সেই সময়। বছরের শুরু শুরুতে অতটা চাপ থাকে না বলেই! উত্তেজনার কারণ মেসি আর সাথে মারাদোনা। মারাদোনা কোচ আর মেসি প্লেয়ার। এতদিনে মেসি নাম করে নিয়েছে খেলার জগতে, ঝুলিতে চাম্পিয়ান্স লিগ আর ব্যালন-ডি-ওর এসে গেছে ততদিনে। সবার মুখে খালি জয় জয়কার। মারাদোনা আমার কাছে তখনও আনন্দমেলার পাতায় লেখা সেই চরিত্রটা আর কিছু খেলার ক্লিপিং। তখন তো এতো ইউটিউব ছিল না যে ইচ্ছা করলে দেখে নেব। সদুত্তরের আশায় বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম

“বাবা, এই মারাদোনার জন্যে জগাই কাকা তো বাড়িতে নীল সাদা পতাকা তুলে দিল গো! দেখেছ?”

“আরে আর বলিস না, তুই জানিস না ও কীরকম খেলা পাগল। আগে তো টিভি ছিল না তখন আমরা একসাথে রেডিওতে খেলা শুনতাম বুঝলি। মানে তুই তো দেখিসনি, তুই ওই ব্যাপারটাই ফিল করতে পারবি না!”

“সে তো বুঝলাম, কিন্তু তুমিই তো বলেছ আমাদের গোটা পাড়া ব্রাজিল ছিল…”  

“হ্যাঁ, জগাটাও ছিল। মারাদোনার জন্যেই মূলত ফ্লিপ করে গেল।”

“বাবা! বলো কী! এরকম ইম্প্যাক্ট!”

“হ্যাঁ, বলে বোঝানো যাবে না, সারে সারে লোক তখন হলুদ সবুজ ছেড়ে নীল সাদা হয়েছিল।”

“এরকম ক্রেজ! এখন তো দেখি না!”

“দেখবিও না, মারাদোনা অন্য জিনিস রে!”

এসব বলেই বাবা সিলিং এর দিকে চেয়ে কী সব ভাবতে শুরু করল, বুঝলাম কিছু গল্প বলবে! 

“বলো না বাবা, মারাদোনা কেমন খেলত? ওসব টিভি দেখে কী বোঝা যায়!”

“বলে বোঝানো যাবে না রে! মাঠে বল নিয়ে ছবি আঁকত।”

“তুমি ব্রাজিল হয়ে এই কথা বলছ?”

“ভালো খেলার আর কী ব্রাজিল আর্জেন্টিনা! সমর্থন করি ব্রাজিলকে ঠিকই, কিন্তু এখনও পুজো করতে বললে মারাদোনাকেই করব!”

“বলো কী? এতো ভালো প্লেয়ার?”                                

“প্লেয়ার মানে? ভগবান রে ভগবান!”

“এরকম ভালো প্লেয়ার তো এখনও আছে। মেসি, রোনাল্ডো! কত আছে!!”

“তোদের জেনারেশনের এই এক প্রবলেম জানিস!”

“কী?”

“সব সময় তুলনা করা। এটা বাজে অভ্যাস! ছাড় এটা। মেসি খুব ভালো, খুবই ভালো। কিন্তু মেসি মারাদোনা না।”

“(বেশ অবাক হয়েই) কেন বলছ এরকম?”

“কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে একটা দল হারছে ১ গোলে, বিপক্ষ দলের গোলকিপার তখন বিশ্বের সব থেকে ভালো গোলকিপার, ডিফেন্ডারগুলো বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে এসে পড়ছে একটা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মানুষের উপর। টিমে বাকি প্লেয়ারও তাকিয়ে আছে ওই একজনের দিকে, এরম অবস্থায় ৬-৭ জনকে কাটিয়ে একজন গোল দিয়ে বেরিয়ে যায়। কার বুকের অত পাটা আছে রে?”

“আচ্ছা।”

“মারাদোনা একটাই। আর গোলটাও সেরা ছিল, আছে, থাকবে।”

কয়েক বছর পরে মেসিও কিছুটা সেরম গোল করার পরে বাবাকে আমি ইউটিউবে দেখাই সেই গোল। পাশে মারাদোনারটাও। অর্ধেক দেখল কী দেখল না মুখ ঘুরিয়ে নিল,

“(কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম) কী হলো? মুখ ঘুরিয়ে নিলে কেন? ভালো না?”

“আলবাত ভালো গোল। দারুণ গোল!”

“তবে? কী হলো?”

“তোকে বলেছিলাম না? মারাদোনা মারাদোনাই হয়!”

“দুটোই তো একই রকম গোল! তাহলে কী তফাৎ হলো?”

“তফাৎ এটাই যে একটা বিশ্বকাপ আর আর একটা লিগের খেলা। আইআইটিতে ফার্স্ট হওয়া আর ক্লাস টেস্টে ফার্স্ট হওয়ার মধ্যে তো তফাৎ থাকবেই মা!”

সেদিন আমি যুক্তিতে আর কাটতে পারিনি বাবাকে, বলা ভালো কাটতে চাইনি। কারণ হল হলুদ সবুজে নিবেদিত প্রাণ যখন তার ভগবান বেছেছে অন্যদলে তার তো কারণ আছেই! আমিই হয়ত সেটা ছুঁতে পারিনি; হয়ত পারাটা সম্ভবও না। কিন্তু ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাটা অনুভব করেছিলাম। এই অনুভূতিটাই মারাদোনা। 

আজকাল যদিও চল কমেছে কিন্তু অন্যদলের প্লেয়ারকে সম্মান দেওয়ার থেকে গালাগাল দেওয়ায় বেশি মজা পাই আমরা। মেসির সমর্থক রোনাল্ডোকে, রোনাল্ডোর সমর্থক মেসিকে; এভাবেই এগিয়ে চলছে। একজনের সাফল্য পরিমিত হচ্ছে অন্যজনের সাফল্যে দিয়ে; সমানে চলছে খাটো করার খেলা। আর এখানেই জিতে গেছে মারাদোনা। শুনেছিলাম পেলের খেলার দেখার জন্যে দুই দেশের যুদ্ধ থেমে গেছিল; মারাদোনাকে দেখতেও সারাবিশ্ব থমকে দাঁড়িয়েছিল। ভগবানও হাত বাড়িয়েছিলেন। 

সময় সব ক্ষতই ভুলিয়ে দেয়। হয়ত তুমিও একদিন মুছে যাবে। হয়ত। থাকবে না মেসি, থাকবে না রোনাল্ডোও। ফুটবল আবার স্বাভাবিক হবে। মানুষ হয়ত তখন খেলা ছেড়ে বিশুদ্ধ হাওয়ার খোঁজে পাগল হবে। ইনটারনেট ক্লাউডে তখন হুহু করে কয়েক লক্ষ কোটি ডেটার মাঝে হঠাৎ করেই একদিন সেই ৭ জনকে কাটিয়ে গোলটা চলে আসবে আর্কাইভ থেকে। মানুষ দেখবে, আবার ভাইরাল হবে সে ভিডিও। মানুষ আবার দেখবে, আবার ভালোবাসবে। সব নর্ম্যাল হয়ে যাবে আবার। আর কাণ্ডারী হবে কে? মারাদোনা! আবার কে! সবাই তো আর মারাদোনা হয় না!                              

ভালো থেকে ঈশ্বর! ভগবানের যে হাতে গোল করেছিলে সেই হাতেই এখন শান্তিতে জিরোও। আবার দেখা হবে। আদিওস… 


……………

অলঙ্করণঃ- সাবর্ণ্য চৌধুরী


No comments:

Post a Comment