প্রবন্ধঃ নবারুণের হারবার্ট : রাষ্ট্র ও বিদ্রোহ বিস্ফোরণের সম্ভাবনা প্রভৃতি নিয়ে দু চার কথা - সৌভিক ঘোষাল

নবারুণের হারবার্ট: রাষ্ট্র ও বিদ্রোহ বিস্ফোরণের সম্ভাবনা প্রভৃতি নিয়ে দু চার কথা


সৌভিক ঘোষাল



সেটা ১৯৯২। প্রমা সাহিত্য পত্রিকার শারদ সংখ্যায় তখন ছাপা হয়েছে হারবার্ট। সেটাই নবারুণের প্রথম উপন্যাস। এর আগে তাঁর পরিচিতি ছিল ‘মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ নামে আলোড়ন তোলা কবিতার বইয়ের রচনাকার হিসেবে। হারবার্ট এর আগেই অবশ্য প্রকাশিত হয়েছে নবারুণের গল্পের একটি সংকলন – ‘হালাল ঝান্ডা’, তবু ‘হারবার্ট’ এর মধ্য দিয়েই বৃহত্তর পাঠক সমাজ কথাকার নবারুণের সঙ্গে পরিচিত হলেন। পরবর্তী দু দশক জুড়ে সেই পরিচয় ক্রমশ ব্যাপ্ত হয়েছে। নবারুণ জনমনোরঞ্জনী রচনা না লিখেও এক বলিষ্ঠ কথাকার হিসেবে নন্দিত হয়েছেন, বহুপঠিত হয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট ফ্যাতাড়ু চরিত্রগুলি সাম্প্রতিক সময়ের সাহিত্যের মিথ হয়ে উঠেছে। চলচ্চিত্রর পর্দা থেকে নাটকের মঞ্চ – ছোট পত্রিকার আড্ডা/লেখা থেকে সিরিয়াস রাজনৈতিক ভাবনা – সবেতেই নবারুণ এর লেখালেখি ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা গুরূত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে।

১৯৯২ সালে নবারুণের হারবার্ট এর প্রথম প্রকাশের কিছুদিন আগে ভেঙেছে সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থা। সোভিয়েত সমাজবাদ ও তার চরিত্র নিয়ে অজস্র বিতর্ক এমনকী বামপন্থীদের মধ্যেও আগের তিন চার দশক জুড়েই বহমান ছিল। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও সোভিয়েতের পতনকে গোটা দুনিয়ার মতো আমাদের এখানেও আমরা একটা বিরাট ধাক্কা হিসেবেই আসতে দেখেছি। বিশেষতঃ সোভিয়েত সমাজবাদের পতনের সঙ্গে ভারতের অর্থনীতির চরিত্র পরিবর্তনের সময়সীমা সমীকৃত হয়ে যাওয়ার ফলে এই ধাক্কা শুধু চেতনা স্তরে নয়, দৈন্যন্দিন জীবনপ্রবাহেও অনুভূত হতে থাকে। নবারুণ নিজে এই ধাক্কাকে কীভাবে দেখেছেন আর তার মধ্যে থেকে কীভাবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন তাঁর সাহিত্য রচনাকে, তা জানিয়ে তিনি একটি গল্প সংকলনের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন " মানুষের এগিয়ে চলার, শোষণমুক্তি ও সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর মডেল, পুঁজি ও প্রতিক্রিয়ার আঘাতে ও বামপন্থীদের আবশ্যিক আত্মসমীক্ষার অভাবের কারণে অনেকটাই তছনছ হয়ে গেছে। যে শতক সবচেয়ে আশা জাগিয়েছিল সেই শতক শেষ হচ্ছে অবসাদে বিষাদে যন্ত্রণাজর্জর অবস্থায়। আমি দৈনন্দিনতায়, প্রত্যহ নিকটে ও দূরে, নিয়ত যা দেখতে পাই তা হল পরতে পরতে স্তরে স্তরে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন বর্গের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শোষণ, নতুনতর ঔপনিবেশিকতা ও সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদের অমানুষীকরণের দেখা না দেখা হাতকড়া ও চোখভুলোনো ঠুলির ভার। সামন্ততন্ত্র বা পুঁজিবাদের বালক বয়সের প্রত্যক্ষ নিষ্ঠুরতার চেয়েও এ যেন অধিকতর মারাত্মক, জঘন্য ও অপমানজনক। এই দলিত মথিত মানুষ ও তাদের জীবনের এক বিচিত্র ক্যালেইডোস্কোপের মধ্যে আমার জীবন কাটছে। চারপাশে তাই আমি দেখি। কিন্তু চূড়ান্ত নিরিখে এই বাস্তবকে আমি চিরস্থায়ী বলে মানি না। বাস্তবকে পাল্টাতে হবে। হবেই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চেতনা তৈরি করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের অবশ্যই একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।"

নবারুণের লেখা এই কাজটা কীভাবে করতে চেয়েছে সেটা আমরা তাঁর বিভিন্ন রচনায় – উপন্যাসে, গল্পে, কবিতায়, প্রবন্ধে খুঁজতে চাইবো। শুরু করা যাক ‘হারবার্ট’ দিয়েই।

আমাদের চোখ এড়াতে পারে না যে দিনটির অনুপুঙ্খ কিন্তু ছেঁড়া ছেঁড়া বর্ণনা দিয়ে এই উপন্যাস শুরু হচ্ছে সেটি ১৯৯২ এর ২৫ মে। ২৫ মে তারিখটি বিশেষ গুরূত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে এর আড়াই দশক আগের এক ঘটনার সূত্রে। উত্তরবঙ্গের তখনো অবধি প্রায় অচেনা অজানা এক এলাকায় ক্রমশ জঙ্গী হয়ে উঠতে থাকা কৃষক সংগ্রামের ওপর সেদিন গুলি চলেছিল। সেই ঘটনা জন্ম দিয়েছিল দেশজোড়া এক উত্তুঙ্গ বিপ্লবী আন্দোলনের। সেই এলাকার ও এলাকা সূত্রে আন্দোলনের নাম নকশালবাড়ি। উপন্যাসের ভেতরে ঢুকে আমরা জানতে পারি হারবার্ট এর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল তার ভাইপো বিনু। সে কলেজে পড়তে পড়তে তার সমবয়স্ক ও সমমনস্ক আরো অনেকের মতো জড়িয়ে পড়ে সমাজ বদলের এই নাছোড় লড়াইয়ে আর শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রশক্তির হাতে নিহত হয়। উপন্যাসের শেষে এসে আমরা হারবার্ট এর দাহকার্যের সময় ঘটে যেতে দেখি এক বিরাট বিস্ফোরণ। আসলে হারবার্টকে পোড়ানো হয়েছিল তার বিছানা সমেত ই, যে বিছানায় লুকানো ছিল বিনুর গোপনে রেখে দেওয়া ডিনামাইট স্টিক, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহারের অস্ত্র। বিনু সে অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পায় নি, কিন্তু আড়াই দশক পর তা ঠিকই ঘটালো এক বিস্ফোরণ, যখন নব্য উদার অর্থনীতি তার আগমনী গান শুনিয়ে বিনুদের হারবার্টদের পাড়াতে পাড়াতে, বাড়ির ছাদে ছাদে বসিয়ে দিচ্ছে ডিস অ্যান্টেনা,  ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে স্টার টিভির মনোরঞ্জন। যাকে নবারুণ বলবেন ‘সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদের’ এক নিশান, যা তখন সদ্য এদেশে তার ডানা মেলছে।

কৈশোর পরবর্তী হারবার্ট এর ব্যক্তিজীবন ও তার সমকালীন জীবনের প্রায় দীর্ঘ সারহীন অধ্যায়ের মধ্যে দুটি চমকপ্রদ পর্ব আমাদের সামনে নবারুণ হাজির করেছেন। প্রথমটি অবশ্যই সত্তরের ঝোড়ো দিনগুলি, যখন বিনুর সূত্রে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সংগে তার পরোক্ষ সংযোগ। দ্বিতীয়টিও পরোক্ষভাবে বিনুর ডায়েরী সূত্রেই শুরু হওয়া হারবার্টের ‘মৃতের সহিত কথোপকথন’ এর অধ্যায়, যখন ব্যর্থ বিপ্লব প্রচেষ্টার পর দু দশকের স্থিতাবস্থা কাটিয়ে এদেশে এসে পৌছচ্ছে নয়া উদারবাদের জমানা।

নবারুণের বিভিন্ন লেখাতেই হারবার্ট এর মত চরিত্ররা, যারা প্রথাগত অর্থে ব্যর্থ এবং ফলত সমাজে পরিবারে ব্রাত্য, ভীড় করে আসে; আখ্যানে কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে নেয়। এটা আমরা নবারুণের প্রথম উপন্যাস হারবার্ট থেকেই লক্ষ্য করতে শুরু করি। ১৯৬৯ এ বিনু যখন জিওলজি পড়তে কলকাতায় আসছে, তখন থেকেই পরিবারে ব্রাত্য হারবার্ট কাকার সঙ্গে কিন্তু তার এক আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর আগে অবশ্য বিনুর বাবা, কৃষ্ণদাদার সূত্রে হারবার্টের সোভিয়েত জমানার চলচ্চিত্রের সঙ্গে একটু আধটু পরিচয় হয়েছিল। “কমিউনিস্ট পার্টির অনুষ্ঠানে কৃষ্ণদাদার সঙ্গে গিয়ে হারবার্ট ফল অব বার্লিন, আরও কি সব যুদ্ধের ডকুমেন্টারি দেখেছিল। একবার দেখেছিল বরফের চাঙড় উল্টে যোদ্ধাদের অতল জলে তলিয়ে যেতে। হারবার্টকে কেউ বলে নি ওটা আইজেনস্টাইনের আলেকজান্ডার নেভস্কি”।

কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে হারবার্ট এর আরো খানিক প্রত্যক্ষ ও দীর্ঘ সংযোগ বিনুর হাত ধরে। বিনুর বাবার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ততদিনে তিন ভাগ হয়েছে। সি পি আই ভেঙে প্রথমে সি পি আই (এম) তারপর সেই ‘নয়া সংশোধনবাদ’ ভেঙে সি পি আই (এম এল)। হয়ত বাবার থেকেই শেখা একটা ছড়া বিনু তার ছেলেবেলাতেই শিখিয়েছিল কাকা হারবার্টকে। ‘পুলিশের লাঠি ঝাঁটার কাঠি/ ভয় করে না কমিউনিস্ট পার্টি’। সেই বিনু কলেজ জীবনে এসে কাকা হারবার্টকে শোনায় মাও সে তুং এর আহ্বান – “আমাদের সামনে হাজার হাজার শহীদ মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের কথা মনে পড়লেই আমাদের প্রতিটি জীবিত লোকের হৃদয় বেদনায় ভরে ওঠে, এমন কী স্বার্থ আছে যা আমরা ত্যাগ করতে পারব না অথবা এমন কী ভুল আছে যা আমরা শুধরে নিতে পারব না ?”

নকশালবাড়ি আন্দোলন পর্বের অনেক ছবিকেই আশ্চর্য বাস্তবতায় হারবার্ট উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন নবারুণ, এনেছেন নির্মোহতার আড়ালে থাকা একটা ব্যক্তিগত টানকেও হয়ত বা। রাষ্ট্র ও তার আগ্রাসী দমনমূলক চরিত্র নিয়ে নবারুণ আদ্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭০ এর ১৯ নভেম্বর বারাসাতের হত্যাকাণ্ড বা ৯ মে ১৯৭১ এর কাশীপুর বরানগর হত্যাকাণ্ডর প্রসঙ্গ এ উপন্যাসে সরাসরি এসেছে। বারাসাত হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে সি পি আই (এম এল) এর সাধারণ সম্পাদক চারু মজুমদারের লেখা ২২ নভেম্বর ১৯৭০ এর ইস্তাহারটি পর্যন্ত তিনি তুলে এনেছেন এ উপন্যাসে। “আজ প্রত্যেকটি ভারতবাসীর পবিত্রতম কর্তব্য এইসব কাপুরুষ বিদেশীদের আজ্ঞাবহ খুনেদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করা। এটা আজ দেশবাসীর দাবী, দেশপ্রেমিকদের দাবী। প্রত্যেক বিপ্লবী কর্মীকে এই বীর শহীদদের হত্যার বদলা নেবার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে। এই জল্লাদরা ভারতবাসীর শত্রু, প্রগতির শত্রু এবং বিদেশীর অনুচর। এদের শেষ না করলে ভারতবর্ষের মুক্তি নেই।”

চারু মজুমদারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিনু আর মাঝে মাঝে সে যুক্ত করে নেয় হারবার্টকেও। ‘হারবার্টকে একদিন বেশ কিছু টাকা আর মাও সে তুং – লিন পিয়াও এর ছবি ছাপা রশিদ বই দিয়ে বিনু পাঠাল লেক মার্কেট এলাকায় কোনও এক বিজয়কে পৌঁছে দেবার জন্য’। বিজয় হারবার্টকে উষ্ণ স্বরে জানিয়েছিল ‘ অভিনন্দন কমরেড। বিনয় আপনার কথা অনেক বলেছে। আপনার মতো বিশ্বস্ত বন্ধুর আমাদের দরকার’। পুলিশের আওতা থেকে গোপন দলিল পত্র সরানোর কাজেও হারবার্ট ছিল বিনুদের সহায়ক। ‘বিনুর কথামতো চিলছাদে হারবার্ট অনেক কিছু পুড়িয়েছে। দেশব্রতী, দক্ষিণ দেশ, চট্টগ্রামে ছাপানো একটি গেরিলা যুদ্ধের বাংলা ম্যানুয়াল, কিউবার ট্রাইকন্টিনেন্টাল পত্রিকা থেকে সংগৃহীত মলোটভ ককটেলের নকশা, রেডবুক, কিছু চিঠি’।

পুলিশের গুলিতে বিনু মারা গেল। মৃত্যুর আগে তার করা কবিতার শেষ উচ্চারণ শুনেছিল হারবার্টই, শুনেছিল লুকানো ডায়েরী সংক্রান্ত অস্পষ্ট শেষ জবানী। এই ডায়েরীর সূত্র ধরেই স্থিতাবস্থার সময় হারবার্টও নেমে পড়ল মৃতের সঙ্গে কথোপকথনের লোক ঠকানো ব্যবসায়। বিষয়বুদ্ধিও জাগ্রত হল। চলল ফূর্তির আসর, সঙ্গী পাড়ার সাব অলটার্নরা। নকশালবড়ি আন্দোলনের পরের একটা দীর্ঘ অধ্যায় জুড়ে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রশক্তির দমনমূলক স্বৈরতন্ত্র ও তারপর বামপন্থার আর এক নয়া নিরীক্ষা, যেখানে রাষ্ট্রশক্তির মধ্যেই বামপন্থা অনেকটা অন্বিত হওয়ার দিকে এগিয়েছে। স্থিতাবস্থার এই পর্বে বিপ্লবী বিনুর নির্দেশকে আধা চেতনে ব্যবহার করে হারবার্টকে অনেকটা মানসিক যন্ত্রণা ও মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসা অনুতাপ সহ আমরা দেখি ‘কিছু করে খাওয়া’র রাস্তায় চলে যেতে। অবশ্যই শেষপর্যন্ত তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, আপাতত শান্তিকল্যাণ এর মাঝেও হারবার্ট নিজের অজান্তেই শুয়ে থাকে ডিনামাইট স্টিক ভরা বিছানায়, এক মহা বিস্ফোরণের সমস্ত সম্ভাবনা নিয়েই।

নবারুণ এর সমস্ত উপন্যাসে, পরিস্থিতির নানা ভিন্নতার মধ্যেও এই বিদ্রোহ বিস্ফোরণের সম্ভাবনা আমরা লক্ষ্য করতে থাকি, হারবার্টে যার বলিষ্ঠ সূচনা।


লেখক পরিচিতি



সাহিত্যের শিক্ষক। আগ্রহের বিষয় ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি।

No comments:

Post a Comment