মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিক
সায়ক সেন
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে তিলে তিলে এক অসামান্য মুক্তির গাঁথা গড়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষের এই মহাবিপ্লবের সন্ধিক্ষণে বাংলার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নতুন প্রভাতে বাংলার অগ্নিযুগের সূচনা। আর সেই অগ্নিযুগের যে সব অসামান্য ব্যক্তিত্ব বিপ্লবের এক নতুন ধারাকে বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদের নাম আজকের ভারতবর্ষ আর মনে রাখেনি। এমন-ই এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ডঃ পবিত্র মোহন রায়। আজ তাঁর নাম কেউ মনে না রাখলেও , ভারতবর্ষের প্রতি নিবিড় প্রেমে প্রায় ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছিলেন এই অসামান্য যোদ্ধা। না, স্বাধীন ভারতবর্ষ তাঁর খোঁজ ও রাখেনি।
১৯০৮ সালের ২-রা জুলাই পবিত্র মোহন রায় ঢাকার বিক্রমপুর পরগনায় জন্ম গ্রহণ করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই ব্যক্তিত্ব ঢাকা ন্যাশানাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। কলেজে পড়াশোনা চলাকালীন নানা বৈপ্লবিক কাজে জড়িয়ে পড়েন, তাই তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সেখান থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সোজা মালয় পৌঁছন। সেই থেকেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। মালয়তে তাঁর সংসার বলতে ছিলেন স্ত্রী ও পুত্র। সেখানে ইংরেজদের একটি রবার বাগানে কর্মরত ছিলেন তিনি।
এরপর এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালের ৮-ই ডিসেম্বর জাপানি সৈন্যরা আক্রমণ করে বসল কোটাবারু বলে মালয়ের একটি শহরকে। এই কোটাবারুতেই ছিল পবিত্র মোহন রায়ের সংসার। ইংরেজ সৈন্যরা যখন বুঝল জাপানিরা কোটাবারু দখল করবেই, তখন সব আনাজ, অফিস-কাছারি, বাড়ি-ঘর ইত্যাদি পুড়িয়ে দিয়ে কয়েক হাজার ভারতীয়, চীনা ও মালয়ীকে ফেলে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ছুটল। জাপানিরা এসে কিছুদিনের মধ্যেই পেনাং, হংকং, কোটাবারু ইত্যাদি দখল নিল। নতুন শাসক কেমন হবে, এই পরিকল্পনা তে যখন দিন কাটছে তখন পবিত্রর মনের এক অবচেতন কোণে একটা ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়। পরাধীন ভারতের দাসত্ববন্ধন কি কাটবে না? এশিয়ায় তো ইংরেজ শক্তি ম্লান হয়ে আসছে। ভারত থেকে কি তারা বিতাড়িত হবে না? স্বাধীনতা সংগ্রাম তাঁর জীবনে এক নতুন প্রভাতের রশ্মি নিয়ে আবির্ভূত হল। সমগ্র পূর্ব এশিয়া নবজীবনের প্রাণের স্পন্দনে মূর্ত হয়ে উঠল।
পবিত্র মোহন রায় দেশ ছাড়বার বেশ কিছু বছর আগে আরেক অগ্নি যুগের নেতা রাসবিহারী বসু নিজের গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে সিঙ্গাপুর পৌঁছে ছিলেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ। জাপান যখন মালয়ের দায়িত্ব নিল, পবিত্র এই সুযোগে লিগে যোগদান করলেন। আর সেই থেকে নানা সাংগঠনিক কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে তুলেছিলেন। তাঁর মনের কোনও এক নিভৃত কোণে স্বাধীন ভারত দেখবার এক অসামান্য জেদ যেন তাঁর অজান্তেই জেগে উঠেছিল।
১৯৪৩ সালের ৩ জুলাই। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সিঙ্গাপুর এসে পৌঁছলেন। সেই সাথে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে স্বাধীনতার এক ঢেউ খেলে গেল। প্রত্যেক ভারতীয়র মনে হতে লাগল স্বাধীনতা যেন এক দূরের লক্ষ্য নয়। বরং হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। নেতাজি আসার পর পর আজাদ হিন্দ বাহিনী এবং আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের কাজে মনোযোগ দিলেন। তিনি জানতেন একমাত্র একটি সশস্ত্র সংগ্রাম-ই ভারতবর্ষ কে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে পারবে। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে পবিত্র মোহন রায় যোগদান করলেন। আর সেই থেকে তাঁর জীবনের গতিপথ কেবলমাত্র নেতাজির দ্বারাই নির্ধারিত হতে থাকল। দীর্ঘ সময় ধরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন আজাদ হিন্দের বিভিন্ন শিবিরে। নেতাজি তাঁকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর গুপ্তচর বিভাগে যুক্ত হওয়ার কথা জানালে পবিত্র সানন্দে তা গ্রহণ করলেন। গুপ্তচর বিভাগের বিশেষ প্রশিক্ষণ যখন চলছে, তখন নেতাজি নিজে পবিত্র ও তাঁর সঙ্গীদের সাথে দেখা করতে আসতেন। কথা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
১৯৪৪ সালের ৪ মার্চ, পবিত্র মোহন রায়, মহেন্দ্র সিংহ, অম্রিক সিং গিল এবং তুহিন মুখার্জিকে নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের মেজর স্বামী একটি সাবমেরিনের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেজর স্বামী আগে থেকেই বলে দিয়েছেন কী করতে হবে তাঁদেরকে। উদ্দেশ্য ভারতবর্ষ পৌঁছে বাংলায় গিয়ে একটি বেস তৈরি করা এবং সেই বেস থেকে দেশে কী চলছে তা বেতার মাধ্যমে জানানো। এ ছাড়া ও দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরা আজাদ হিন্দ ফৌজের অসম্ভব বিক্রম এবং বলিদানের কথা।
দীর্ঘ দশ দিনের সাবমেরিন যাত্রার পর শেষ পর্যন্ত কোনার্কের মন্দিরের সামনের নামার চেষ্টা করল এই বিপ্লবী দল। কিন্তু উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ তাঁদের বেলাভূমি থেকে বহুদূরে ডিঙি সমেত ছিটকে ফেলল। সারারাত সাঁতার কেটে শেষ রাতের ঠিক আগে তাঁরা বেলাভূমিতে এসে পৌঁছলেন। পুরী পর্যন্ত একসাথে চলে দলটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদিকে তুহিন মুখার্জি আর মহেন্দ্র সিং এবং অন্য দিকে পবিত্র মোহন রায় এবং অম্রিক সিং গিল। কিছুদিন পরে পুরী তে তাঁরা আলাদা হয়ে গেল, পবিত্র চলে এলেন কলকাতায়। কলকাতায় নিজেকে এক জমিদার বলে পরিচয় দিয়ে একটি হোটেলে উঠলেন। এই সময় তিনি বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে আলাপ করে তাঁর সাহায্য করতে বলেন, কিন্তু প্রায় কেউ-ই রাজি হল না। একদিন পবিত্র দেখলেন অম্রিক সিং কে। তাঁর কাছ থেকে নেতাজির দাদা সুরেশ চন্দ্র বসুর মেয়ে বেলা মিত্র এবং তাঁর স্বামী হরিদাস মিত্রের কথা শুনলেন। বেলা মিত্র যখন শুনলেন পবিত্রদের স্বয়ং নেতাজি পাঠিয়েছেন, তখন তাঁর আনন্দের বাঁধ ভাঙল। হরিদাস মিত্র যথাসম্ভব সাহায্য করলেন এই গুপ্ত বিপ্লবী দলটিকে। এদিকে একটা বিষয়ে পবিত্রদের ভাবিয়ে তুলল। তুহিনের দেখা করার দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সে আসেনি। তবে কী সে ব্রিটিশ গোয়েন্দার হাতে ধরা পড়ল? মহেন্দ্র সিং ও এর মধ্যে কলকাতা এসে পৌঁছেছেন। কিন্তু তুহিনের দেখা নেই।
অনেক খোঁজ করে শেষ পর্যন্ত বেহালার একটি বাড়ি কে নির্বাচন করা হল আজাদ হিন্দ ফৌজের বেতার স্টেশন রূপে। নানা রকম খাটাখাটনি করে শেষ পর্যন্ত নেতাজির আদেশ পালন করলেন পবিত্রদের দল। বেস তৈরি হয় নিয়মিত খবর যেতে লাগল আজাদ হিন্দ সরকারের হেড কোয়ার্টারে। কিন্তু সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। কিছু দিনের মাথায় হরিদাস মিত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করল গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে। ফলে পবিত্রকে সেই মুহূর্তে কলকাতা ত্যাগ করে পুরী তে গিয়ে আবার উঠতে হল। ইতিমধ্যে অম্রিক সিং গিল এবং মহেন্দ্র সিং ও ধরা পড়লেন পুলিশের কাছে। পুরীতে গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন একমাত্র পবিত্র। সেখানেও এবার পুলিশের নজর গেল। এক হোটেলের মালিকের সন্দেহ হওয়াতে পুলিশ নিয়ে সোজা পবিত্রর কাছে হাজির হন। আর সেখান থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে যান ভারতবর্ষের এই বাস্তব জীবনের জেমস বন্ড। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। কিছু দূর গিয়েই ধরা পড়লেন পবিত্র মোহন রায়।
আদালতে কেস উঠল। কিন্তু বিচারের নামে প্রহসন হত সেটা আলাদা করে বলে দিতে হয় না। আদালতে সরকার পক্ষের প্রথম সাক্ষী দেখে পবিত্রর মাথা ঘুরে গেল। তুহিন মুখার্জি! বিশ্বাসঘাতক!
আদালতের সেই প্রহসনে পবিত্র মোহন রায়, হরিদাস মিত্র এবং অম্রিক সিং গিলের ফাঁসির সাজা হল। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হল জেলখানার ভিতর ফাঁসির ঘরে। কিন্তু পবিত্রর মনে তখন অপার্থিব শান্তি। কারণ ততদিনে আজাদ হিন্দ ফৌজের নামে দেশে ঝড় বয়ে গেছে। সবাই জেনেছে নেতাজি ঐ মালয়, সিঙ্গাপুর আর জাপানের মাটি থেকে ভারতবর্ষের জন্যে কী অসামান্য কাজ করে গেছেন। ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি এক সহানুভূতি দেখা দিয়েছে।
মৃত্যু যখন অবধারিত জেনে নিয়েছেন, ঠিক তখন -ই পবিত্রর জীবনে আরেকটি মোড় এল। বেলা মিত্র (যার নামে বেলানগর স্টেশন) নিজের স্বামী ও তাঁর বৈপ্লবিক বন্ধুদের ছাড়াতে উদ্যত হলেন। তিনি সোজা ছুটলেন গান্ধিজির কাছে। গান্ধিজি কে রাজি করিয়ে সোজা ভাইসরয় কে চিঠি লেখালেন। একবার নয়, বহুবার। বেলা মিত্রের অকাট্য যুক্তির সামনে দাড়িয়ে ব্রিটিশ সিংহ মাথা নত করল। ফাঁসির সাজা মকুব হয়ে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশে পরিণত হল। তখন দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় দ্রুত বদল ঘটছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার প্রত্যূষে দাড়িয়ে। সেই আবহাওয়ার সুরেই তাল মিলিয়ে পবিত্র মোহন রায় এবং তাঁর সঙ্গীরা ছাড়া পেলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে পবিত্র মোহন রায়ের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি তাঁর ‘লিডার’–এর খোঁজ পেয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের এক অখ্যাতনামা জায়গায়। কিন্তু সে অন্য কথা। শুধু এইটুকুই বলা চলে, পবিত্র মোহন রায় নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নেতাজির জন্যে কাজ করে গেছেন।
………………
No comments:
Post a Comment