অণুগল্পঃমোগলীঃবিমল লামা

                                                    





মাঝে মধ্যে এমন হয় শোভিতার। বাড়ির ভেতর কেমন পাগল পাগল লাগে। প্রতিষেধক, তখুনই বেরিয়ে পড়া। সোজা রাস্তায়, মাঠে অথবা কোনও খোলা জায়গায়।

কিন্তু এখন রাত বারোটা বাজে। দোকান পাট বন্ধ হয়ে গেছে। যানবাহন প্রায় নেই। পথচারি কদাচিৎ।  

একবার ছাদে গিয়ে দেখল সে। সুবিধা হল না। উলটে ভেপার জ্বলা মায়াবী রাস্তা দেখে রাস্তার প্রতি টান আরও গেল বেড়ে। আর সে পারল না নিজেকে সামলাতে। ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে নেমে এলো নিচে।

ওদের সেকেলে আবাসনে ঝামেলা নেই একদম। নাইট গার্ড নেই। গেটে একটাই তালা যার চাবি সবার কাছে। সুতরাং বিনা বাধায় রাস্তায়। সেখানে তখন জনমানবের চিহ্ন নেই। দেখে দারুণ আনন্দ হয় শোভিতার। এমনটা তো শহরে দেখা যায় না তেমন। রাতভর লোক চলে রাস্তায়। কোনও অজানা কারণে আজ অন্যরকম। যাই হোক রাতটা তারই মনের মতো।   

বেরিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিল শোভিতা। ওদিকে একটা পার্ক আছে। আছে পুকুর। সেখানেই গিয়ে জলের ধারে একটু বসার ইচ্ছা। যদি মশারা বসতে দেয়। অন্য কেউও যে বসতে না দিতে পারে সে কথা সে ভাবেই না। যেন বা তেমনই আজব কোনও শহরে সে বাস করে। কেউ নেই পরোয়া করার মত। চোর পুলিশ সহনাগরিক...। কেউ না।     

বোকা মেয়ে! ওর মা বলে। আজ মা বাড়ি নেই। থাকলে ওকে কিছুতেই বেরোতে দিত না। নয়ত নিজেই আসত সঙ্গে।  

সে অবশ্য নিজেকে বোকা ভাবে না। মায়ের সঙ্গে তর্ক জুড়ে বলে, “বন কর্মীরা কাজ করে কী ভাবে? ওরাও তো জানে শ্বাপদেরা ওত পেতে আছে চারিদিকে।” 

“ওদের বন্দুক আছে।” 

“আমারও বন্দুক আছে।”  

আসলে অনলাইনে কেনা স্টান্ট গান। ব্যবহার করেনি কখনও। জানেও না দরকারের সময় কাজ আদৌ দেবে কিনা। ইচ্ছে থাকলেও নিজের ওপর প্রয়োগ করার সাহস হয়নি। সেটাই হাতে নিয়ে বেরিয়েছে। আসলে দেখতে তো সাধারণ টর্চ। আলোও ভাল।  

পার্কের গেট হাট করে খোলা। অযত্নের ছাপ চারিদিকে। ভেতরে ঢুকতেই যাচ্ছিল শোভিতা হঠাৎ পিছনে খসখস শব্দ। ঘুরে দাঁড়াল সে। কিন্তু কেউ নেই। পাশেই বাতিস্তম্ভ। মাথার ওপর বিরাট বৈদ্যুতিক চাঁদ। তারই হলুদ আলোয় উদ্ভাসিত ফুটপাত।  

আলোর ঝর্নায় দাঁড়িয়ে শোভিতা ভাবল, ভুল শুনলাম! তারপর আবার পার্কে ঢুকতে গেল। আর পিছন ফিরতেই আবার সেই শব্দ- খসর্ খস্...।  

আবার সে ফেরে শব্দের দিকে। তেমনই শূন্য ফুটপাত। কিন্তু শব্দ এবার থামেনি, তখনও কানে আসছে- খসর্ খস্...। 

সামনেই একটা ময়লা ফেলার ভ্যাট। প্লাস্টিকের তৈরি। উজ্জ্বল নীল তার রং। মনে হল শব্দ আসছে তারই ভেতর থেকে।  

হয়ত কুকুর। কিন্তু অতটা উঁচুতে ভ্যাটের মুখ। ঢুকল কী করে! অবশ্য বেড়ালও হতে পারে। হতেই পারে। এরাই তো গৃহপালিত শিকারি জীব রাতের মহানগরে। অবশ্য এখনও টিকে আছে কিছু শহুরে বন্য প্রাণ। শেয়াল নেউল ভাম সাপ…। 

ভাবতে ভাবতে ভ্যাটের কাছে চলে আসে শোভিতা। উঁচু হয়ে উঁকি দে ভ্যাটের ভেতর। আর আঁতকে উঠে দেখে ভেতরে এক মানব শিশু। একটা বাচ্চা ছেলে। কিন্তু কেমন পোষ না মানা ভাবভঙ্গি। উলোঝুলো নোংরা ছেহারা। জটপড়া লম্বা চুল। যেন নাগরিক মোগলি।  

কিন্তু শোভিতাকে দেখে সে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। যেন কোনও শিকারির সামনে পড়ে গেছে বেকায়দায়। প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে শোভিতার দিকে। বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আছে একটা সাদা ক্যারি ব্যাগ। ভেতরে কিছু আছে বোধ হয়।  

খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে শোভিতা। তারপর হাত বাড়িয়ে বলে, “আয়। উঠে আয়।” 

যেন প্রচণ্ড আক্রোশে ছেলেটা ঘড় ঘড় করে বলে, “না! দেব না! আমি আগে পেয়েছি।”

আরও জোরে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে প্যাকেটটা। 

শোভিতা বলে, “আমি নেব না। ওটা তোরই। আয় উঠে আয়।” 

“না তুই কেড়ে নিবি!”  

অনেক চেষ্টা করেও সে ছেলেটাকে বোঝাতে পারে না। তার ভয়ার্ত আক্রোশ আরও তীব্র হতে থাকে। শেষে তাকে বেরোনোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য শোভিতা সরে যায়। পার্কের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। 

কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে ছেলেটার মাথা ভেসে ওঠে ভ্যাটের মুখে। সতর্ক চোখে তাকায় চারিদিকে। শোভিতার ওপর চোখ পড়তেই কেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সে। একরোখা চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। শোভিতাও দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। বেশ কিছুক্ষণ চলে এই অচলাবস্থা। শেষে শোভিতা নরম সুরে বলে, “ভয় পাসনা। আমি তোর জিনিস নেব না। আয়, বাইরে আয়।” 

বলে সে হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটার দিকে এগোনোর উপক্রম করে। অমনি ছেলেটা লাফ দিয়ে পালাতে যায়। আর ভ্যাট সুদ্ধ উলটে পড়ে রাস্তার দিকে। ঠিক তখনই কোত্থেকে আচমকাই একটা গাড়ি চলে আসে তীব্র বেগে। আর বাচ্চাটাকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যায় চোখের নিমেষে। একটুও গতি না কমিয়ে। বাচ্চাটা ছিটকে পড়ে রাস্তার ওপর। 

শোভিতা দৌড়ে যায় বাচ্চাটার দিকে। তখন তার আর পালানোর শক্তি নেই। অসহায় ভাবে পড়ে থাকে স্থির হয়ে। শোভিতা তার মাথাটা তুলে নিজের কোলে নেয়। ছেলেটা ঘোলাটে চোখে তার দিকে চেয়ে বিড় বিড় করে বলে, “আমি আগে পেয়েছি।” 

শোভিতা অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করতেই যাচ্ছিল, একটা পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হয়। দেখে শুনে ওরাই বাচ্চাটাকে গাড়িতে তুলে নেয়। শোভিতার নম্বর নিয়ে বেরিয়ে যায় দ্রুত বেগে। 

গাড়িটা চলে যেতেই আবার সুনসান চারিদিক। ফিরে আসে আবার সেই থমথমে নৈঃশব্দ্য। নির্লিপ্ত ভেপার আলোকিত করে রাখে উলটে পড়া ভ্যাট ছড়িয়ে পড়া আবর্জনা। 

শোভিতার চোখে পড়ে সেই প্ল্যাস্টিকের ক্যারি ব্যাগটা। নিচু হয়ে সে কুড়িয়ে নেয় সেটা। বেশ ভারি। তখনও হালকা গরম। খুলে দেখে ভেতরে সাদা গোল প্লাস্টিকের কন্টেনার। তার ঢাকনার ওপর লেখা “ছোটুর বিরিয়ানি!”  

 

…………………


অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত


No comments:

Post a Comment