১
আবার অ্যালার্মটা বেজে উঠল। মাথার পাশের টেবিলে রাখা ঘড়িটায়। আজও, ঠিক সেই অমোঘ সময়ে। ঘুমটা ভেঙেই সুদীপ বুঝল, এখন রাত ঠিক দুটো বাজে। তার মানে সময় হয়ে গেছে। এবার আবার সেই নির্মম, ভয়াবহ ঘটনা শুরু হতে চলেছে, যা এই গত একমাস ধরে তার জীবনে ঘটে চলেছে। আর প্রতিদিনের মতোই সেই ভয়ানক ঘটনার শুরুটা আজও হচ্ছে ঘড়িটার অ্যালার্ম বেজে ওঠা দিয়েই।
অথচ সুদীপ নিজে জানে যে ঘড়িটায় সে অ্যালার্ম দেয়নি। শুধু সে কেন, কেউই ঘড়িটায় কোনদিন অ্যালার্ম দিতে পারবে না। অথচ কী আশ্চর্য, প্রতিদিন ঠিক রাত দুটোয় ঘড়িটায় অ্যালার্ম বেজে উঠছে!
সকালের দিকে ঘড়িটা হাতে নিয়ে খুব ভালো করেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছে সুদীপ। না, এই ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই, কারণ সেটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তবু কী করে যে রাতের বেলা ঘড়িটা হঠাৎ সচল হয়ে উঠে বাজতে শুরু করে, অনেক ভেবেও এর কোনও সমাধান খুঁজে পায়নি সে। গত একমাস ধরে রাত দুটো বাজলেই ঘড়িটা জ্যান্ত হয়ে যায়, আর একটানা ক্রি-ই-ই-ই-ইং শব্দ করে তাতে অ্যালার্ম বাজতে থাকে। সেই বিরক্তিকর শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে সুদীপ, আর তার পরেই ঘটে সেই ভয়ানক কান্ডটা। প্রত্যেক রাতে। একই পদ্ধতিতে।
সুদীপ বহু চেষ্টা করেছে এই জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে। বারবার নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বের করতে চেয়েছে এই জ্যান্ত স্বপ্ন থেকে। কিন্তু পারেনি। বারবার চেষ্টা করেছে, আর বারবারই চরম হতাশায় ভেঙে পড়েছে, আর ওর সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ওর জীবনের প্রতিটি রাতে এই অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটে চলেছে।
হ্যাঁ অদ্ভুত। আবার একইসঙ্গে সাংঘাতিক ভয়াবহ আর অবিশ্বাস্য। সুদীপের নিজের জীবনে সেটা না ঘটলে সে নিজেও কখনো বিশ্বাস করত না এরকম হতে পারে বলে। এ কখনও হয়? একটা জ্যান্ত মানুষ প্রতি রাত্রে মমিতে রূপান্তরিত হতে পারে?
কিন্তু তাই হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ইদানীং প্রত্যেকদিন ঠিক রাত্রি দুটোর সময় সুদীপ মমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
প্রথমদিকে দু-একটা রাত সুদীপ ভেবেছিল এটা একটা দুঃস্বপ্ন, তাই গায়ের জোরে উঠে বসতে চেয়েছিল বিছানায়। জোর করে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল গায়ের ব্যান্ডেজগুলো, কিন্তু পারেনি। হেরে গেছে। সেই অলৌকিক শক্তির কাছে পরাজয় মানতে বাধ্য হয়েছে সুদীপ। কারণ সেই মুহূর্তে সে লক্ষ্য করেছে, তার মন সম্পূর্ণ সচেতন থাকলেও তার শরীর আড়ষ্ট হয়ে আছে। যেন গোটা শরীর তার পক্ষাঘাত রোগে পঙ্গু হয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছাতে সে হাত পা নাড়াতেই পারছে না। মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ঠিক যেমন হয়, সমস্ত শরীরটা নিশ্চুপ হয়ে যায়, ঠিক তেমন।
আর সেই অবসরে কোনও এক অলৌকিক শক্তির অলংঘ্য নির্দেশে তার সারা গায়ে কেউ যেন ব্যান্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধছে। পা থেকে শুরু করে কোমর, পেট, বুক হয়ে সেই ব্যান্ডেজ উঠে আসছে তার গলায়। তারপর ধীরে ধীরে তার মুখ আর নাক বেড় দিয়ে সেই বাঁধন যখন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে তার কপাল থেকে মাথা পর্যন্ত, যখন দম বন্ধ হয়ে গিয়ে আকুলিবিকুলি করে উঠছে সুদীপের শরীর, প্রবল একটা কষ্টে যখন উথালপাথাল করে উঠছে তার প্রাণের ভেতরটা, তখন এক মুহূর্তের মধ্যে চেতনা হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে সুদীপ। আর তারপর সেই অচেতন অবশ শরীরে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ে রোজ, তা সে নিজে জানতে পারে না। সেই ঘুম তার ভাঙে পরের দিন সকালে। ঘুম ভেঙে উঠে সে দেখে, ঘামে ভিজে গেছে গোটা শরীর, আর বিছানায় আগের দিনের সেই ব্যান্ডেজের চিহ্নমাত্র নেই। সত্যিই যেন সে এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছে আগের রাতে।
অনেক ভেবেছে সুদীপ। বারবার নিজের মনের কাছেই প্রশ্ন তুলেছে, কেন এটা হচ্ছে? হঠাৎ এমন অলৌকিক কান্ড ওর জীবনে ঘটছে কেন? তাহলে কি ও মরে যাবে? তারই পূর্বাভাষ হিসেবে এসব ঘটছে? নাকি এর পেছনে কোনও ষড়যন্ত্র আছে? কেউ কি অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে ওকে ভয় দেখিয়ে ওর ওপরে জমে থাকা কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাতে চায়? অনেক ভেবেও কোনও কূলকিনারা করতে পারেনি সুদীপ। শুধু একটা ভয়, প্রবল একটা ভয় রোজ ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। চিন্তায় ভাবনায়, ক্রমশই শুকিয়ে যাচ্ছে সুদীপ। নানারকম অসুখ ওকে চেপে ধরছে ক্রমাগত।
আজও ঠিক সেরকমই হল। ঘুম ভেঙে উঠে বসেই সুদীপ শিউরে উঠল। এবার তো আবার সেই মমি হয়ে যাবার পালা! ওর চেতনা ঠিকই থাকবে, কিন্তু ও কিছুই করতে পারবে না। বোবার মতো শুয়ে শুয়ে দেখবে ওর দেহটার মমিতে রূপান্তর।
কিন্তু না, আর নয়। আজ যা হবার হয়ে যাক, কাল সকাল থেকে ছবিটা বদলে যাবে। সুদীপ ওর অফিসে নানাজনের সঙ্গে কথা বলে কোনও একজন সাইকিয়াট্রিস্টের খোঁজ করছিল কয়েকদিন ধরে। আজই দুপুরে মিহির তেমন একজন মনোবিদের সন্ধান দিয়েছে। তাঁর ফোন নম্বর আর চেম্বারের ঠিকানাও পেয়ে গেছে সুদীপ। কালই ও সেই ডাক্তারের চেম্বারে যাবে। খুলে বলবে সবকিছু। দেখা যাক সেই ডাক্তার কী বলেন। কোনও সমাধানের রাস্তা বাৎলে দিতে পারেন কিনা।
২
পরের দিন বিকেলের দিকেই অফিসে ছুটি করে বেরিয়ে পড়ল সুদীপ। ডাক্তার তাঁর চেম্বারে বসবেন বিকেল পাঁচটা থেকে। তখনই পৌঁছে যাবে সুদীপ। ডাক্তারকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়ে গেছে তার।
ডাক্তার অমলেন্দু সরকার। সৌম্য চেহারা, ভরসা যোগানোর মতোই। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল সুদীপের। ওর আগে একজনই রুগী ছিল চেম্বারে। তাকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তার সুদীপকে ভেতরে ডাকলেন। ঠান্ডা ঘরটার মধ্যে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। সুদীপ ভেতরে যেতেই ডাক্তার সরকার একটা আর্মচেয়ার দেখিয়ে দিলেন। বসতেই কী শান্তি। দুর্ভাবনাগুলো যেন একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে চাইছে।
ডাক্তার সুদীপকে একটু সময় দিলেন। তারপর স্মিত হেসে শুরু করলেন জিজ্ঞাসাবাদ। সুদীপ প্রথমে একটু অবাক হচ্ছিল, কারণ ও শুনেছিল এইসব সাইকিয়াট্রিস্টরা রুগীদের হিপ্নোটাইজ করে একটা অচেতন অবস্থায় নিয়ে গিয়ে যা কিছু জানবার তা জেনে নেন। কিন্তু ইনি তার কিছুই করলেন না। বরং নিকট আত্মীয়ের মতোই ঘনিষ্ঠ সুরে বললেন, “বলুন সুদীপবাবু, আপনার সমস্যাটা কী খুলে বলুন। দ্বিধা করবেন না, কিছু বাদ দেবেন না। যেটা আপনার মনে হচ্ছে বলুন।”
ডাক্তারের কথায় ভরসা পেয়ে সুদীপ সবই বলতে শুরু করল একে একে। মাসখানেক আগে থেকে তার জীবনে হঠাৎ এসে পড়া এই উপদ্রবের কথা, প্রতিটি রাতে ঘুম ভেঙে যাবার পরেই তার শরীরটার অলৌকিকভাবে মমিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবার কথা, সবকিছুই নিখুঁত বিবরণে সে তুলে ধরল ডাক্তারের কাছে। এমনকি প্রতিদিন যে ঠিক রাত দুটোর সময় তার ঘুমটা ভাঙে, আর সেটা হয় ওই ঘড়িটায় অদ্ভুতভাবে অ্যালার্ম বেজে ওঠার কারণে, সেটাও সে বলতে ছাড়ল না।
সবকিছু শোনার পর ডাক্তার সরকার একটু অবাক হয়েই বললেন, “তাই তো! আপনি বেশ ভাবিয়ে তুললেন দেখছি! দেখুন … ইয়ে, সুদীপবাবু … প্রথম কথা, কোনও কোনও মানুষের জীবনে এমন ঘটে। এমন অনেক হ্যালুসিনেশন আছে, যার ফলে মানুষ ঘুমের মধ্যেই এমন দুঃস্বপ্ন দেখে যে, মনে হয় সেটা সে জাগ্রত অবস্থাতেই দেখছে। পরের দিন সকালেও সেই ঘোর তার কাটে না। কিন্তু আপনার ব্যাপারটা দেখছি তার থেকে একটু আলাদা। কারণ সেরকম ঘটনাগুলো সাধারণত একদিন, কিংবা বড়োজোর পরপর দুদিনের জন্য হয়। এরকম দিনের পর দিন, এক মাস ধরে ঘটাটা একটু অস্বাভাবিক। আর তার ওপর ওই ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে ওঠা, এটা তো সত্যিই … আচ্ছা, আপনার ওই ঘড়িতে আপনি কখনও অ্যালার্ম দেন না বলছেন?”
সুদীপ হেসে উত্তর দিল, “না স্যার। সেটা সম্ভবই নয়। কারণ ওই ঘড়িটা হল একটা সূর্যঘড়ি।”
“কী!! সূর্যঘড়ি! মাই গড!”
“হ্যাঁ স্যার। ছোট্ট একটা সূর্যঘড়ির মডেল। পুরোনো দিনের ছবিতে যেমন দেখা যায়, ঠিক সেইরকম। পাথরের একটা গোল প্লেটের একটা ধারে পাতলা একটা ডান্ডা দাঁড় করানো, অনেকটা মাছের পাখনার মতো দেখতে। আর তাকে গোল করে ঘিরে প্লেটটার ওপর আঁকা আছে এক এক করে মোট বারোটা চিহ্ন, প্রাচীন মিশরীয় ভাষায়। ফাঁকা জায়গায় রাখলে সূর্যের আলোয় ওই ডান্ডার ছায়া যেখানে পড়বে, সেটাই তখনকার সময়।”
“ইয়েস। এরকম ঘড়ির ছবি তো বইতে দেখেছি। কিন্তু লেখাগুলো কী ভাষায় বললেন? মিশরীয় ভাষায়?” ক্রমশই বেশি করে অবাক হচ্ছেন ডক্টর সরকার।
“হ্যাঁ স্যার,” মাথা নেড়ে মৃদু হেসে সুদীপ বলল, “কারণ ঘড়িটা আসলে মিশরীয় ঘড়ি, আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। সেইজন্যেই তো নীলামের ঘর থেকে প্রায় জোর করেই এটা বাগিয়ে এনেছিলাম, বেশি দরাদরি না করেই। কিন্তু যে ঘড়িটা দিনের আলো ছাড়া অচল, রাতের বেলা সেই ঘড়ি সচল হয়ে যায় কী করে বলতে পারেন? আর এই পাথরের ঘড়িতে অ্যালার্মই বা কী করে বাজতে পারে?” বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ চুপ করে যায় সুদীপ।
ঘরটা নিস্তব্ধ। শুধু মাথার ওপর পাখা ঘোরার একটা মৃদু শোঁ শোঁ আওয়াজ। ডক্টর সরকার চুপ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন সুদীপের মুখের দিকে। এরকম অলৌকিক ঘটনার কথা তিনি এর আগে কোনদিন শোনেননি। তাই বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছেন তিনি। সুদীপও কোন কথা বলছিল না, কেটে যাচ্ছিল নিঃশব্দ মুহূর্তগুলো।
এইভাবে কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর সাময়িক বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে কথা বলে ওঠেন ডঃ সরকার, “আচ্ছা সুদীপবাবু, একটা কথা বলুন। এই ঘড়িটা আপনি কোথায় পেয়েছেন? কার কাছ থেকে?”
সুদীপ বলল, “ওই যে বললাম, একটা নীলাম ঘর থেকে। দেখুন স্যার, আপনাকে খুলেই বলি। আমার আসলে একটু কিউরিও কালেকশানের শখ আছে। কলকাতার পুরোনো নীলামের দোকানগুলোয় মাঝেমাঝেই আমি যাই, বিশেষ করে নীলামের খবর পেলে। সাধ্যে কুলোলে সেসব জায়গা থেকে পুরোনো জিনিষ কিনে আনি। তবে অন্য দেশের কোনও ঐতিহাসিক জিনিষের সন্ধান পেলে ছাড়ি না। যেভাবেই হোক সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। মাসখানেক আগে এরকমই একটা দোকানে নানা জিনিষের মধ্যে এই ঘড়িটা দেখে আর চোখ সরাতে পারিনি। তারপর যখন শুনলাম এটা নাকি আড়াই হাজার বছরের পুরোনো খাস ঈজিপ্টের জিনিষ, তখন আর কোনকিছু না ভেবেই এটা কিনে নিই। তবে …”
“তবে?” সুদীপের কথা শুনতে শুনতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল ডঃ সরকারের মুখচোখ।
সুদীপ বলল, “তবে দোকানের মালিক চট করে এটা বিক্রী করতে চাইছিল না। বারবার কী যেন বলতে চাইছিল, কিন্তু ওসব কথায় কান না দিয়ে প্রায় জোর জবরদস্তি করেই আমি ঘড়িটা নিয়ে আসি।”
ডঃ সরকার ব্যগ্রভাবে সুদীপের মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে ওঠেন, “সুদীপবাবু, ভালো করে মনে করে দেখুন তো, ঘড়িটা আপনি ঠিক কবে কিনেছেন, আর তার ঠিক কতদিন পর থেকে আপনি এই মমি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা দেখছেন?”
সুদীপ অবাক হয়ে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকায়, “হ্যাঁ … এটা তো আগে আমার মনে হয়নি! তা ধরুন ঘড়িটা আমি কিনেছি গত মাসের ১৩ তারিখ, আর ১৫ তারিখ, মানে তার দুদিন পর থেকেই … তার মানে … আপনি বলতে চাইছেন এই ঘড়িটার সঙ্গেই আমার মমি হয়ে যাওয়াটা…”
“ইয়েস ইয়েস, আমি ঠিক সেটাই বলতে চাইছি সুদীপবাবু। ওই ঘড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আপনার মমি হয়ে যাওয়ার ঘটনা। শুনুন সুদীপবাবু, আমাদের জীবনে এমন অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে যার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার ধারণা, এটাও ঠিক তেমনই একটা ঘটনা। আমার পরামর্শ যদি শোনেন তো বলব, আপনি আজই ওই নীলামের দোকানে যান। দোকানের মালিক কী বলতে চাইছিল সেটা শুনুন। কে বলতে পারে, হয়তো তার মধ্যেই খুঁজে পেয়ে যাবেন এই অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা!”
৩
মার্কুইস স্ট্রীট আর মির্জা গালিব স্ট্রীটের ক্রশিংয়ে আদ্যিকালের দোকানটা দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। সামনের দরজাটা খোলাই, কিন্তু তার ভেতর ভুতুড়ে অন্ধকার। সুদীপ আগে যতবার এখানে এসেছে, সবই দিনের বেলায়। তাই সন্ধের অন্ধকারে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে কেমন যেন গা ছমছম করছিল। দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর চোখ সয়ে এলে দেখতে পেল, ভেতরটা পুরো অন্ধকার নয়। টিমটিমে একটা লন্ঠন জ্বলছে ঘরটার ঠিক মাঝখানে একটা টেবিলের ওপর। আর তার মিটমিটে আলোয় ঘরের পুরোনো জিনিষপত্রের ছায়াগুলো দেয়ালে পড়ে কাঁপতে কাঁপতে আরও বিভীষিকার সৃষ্টি করছে। কিন্তু মিঃ ইলিয়াস কোথায়? এই দোকানের মালিক?
“কেউ আছেন? ভেতরে কেউ আছেন? মিঃ ইলিয়াস?” জোরে জোরে হাঁক পাড়ল সুদীপ।
সুদীপের ডাক শুনে এবার পেছনের ঘরটা থেকে যেন একটা অস্পষ্ট গলার স্বর ভেসে এল। পা ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসছে কেউ। লন্ঠনের আবছা আলোয় সুদীপ দেখতে পেল, মিঃ ইলিয়াস-ই এসে দাঁড়িয়েছেন পেছনের দরজায়।
আশ্চর্য, সুদীপকে দেখেই মিঃ ইলিয়াসের মুখে যেন অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল। সুদীপ শুনতে পেল, তাঁর সেই ভাঙা ভাঙা বাংলায় ইলিয়াস বলছেন, “আসুন স্যার আসুন। আপনার আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন, সেটাই ভাবছিলাম।”
সুদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে? আপনি জানতেন আমি আসব?”
ইলিয়াস ততক্ষণে আর একটু এগিয়ে এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছেন। টেবিলের ওপর রাখা লন্ঠনটার আলোয় তাঁর জোব্বা পরা চেহারাটা কীরকম অশরীরীর মতো দেখাচ্ছে। সুদীপের কথায় একটু হেসে মিঃ ইলিয়াস বললেন, “অবশ্যই জানতাম স্যার। জানতাম যে ওই ঘড়ি যখন আপনি নিয়ে গেছেন, তখন আপনাকে আমার কাছে আবার আসতেই হবে। না এসে আপনার উপায় নেই যে।”
“কী আবোলতাবোল বকছেন মিঃ ইলিয়াস? না এসে উপায় নেই মানে?” প্রায় ধমকের সুরেই কথাটা বলতে গেল সুদীপ, কিন্তু পরক্ষণেই ভীষণভাবে চমকে উঠল। সুদীপের মুখ থেকে কথাটা বেরোতে না বেরোতেই ধকধক করে যেন জ্বলে উঠেছে ইলিয়াসের চোখদুটো। নিমেষের মধ্যে এগিয়ে এসে সুদীপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার চোখে চোখ রেখে ভয়ংকর হিংস্র একটা গলায় বলে উঠলেন তিনি, “হ্যাঁ স্যার। না এসে আপনার উপায় নেই। কারণ আমি জানি, রোজ রাতে মমি হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে আপনি শেষ পর্যন্ত আমার কাছেই ছুটে আসবেন। এতদিন সবাই তাই এসেছে।”
সুদীপের ঘাম দিচ্ছে, গলা শুকিয়ে উঠেছে। কপাল জুড়ে ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা। সেইসঙ্গে অজানা এক আতঙ্ক চেপে বসছে সুদীপের মনে। এ কোন রহস্য? কাদের কথা বলছেন মিঃ ইলিয়াস? আর সুদীপের মমি হবার খবরই বা তিনি জানলেন কী করে?
সুদীপের মুখের ভাব দেখে এবার মৃদু হাসি ফুটে উঠল ইলিয়াসের ঠোঁটের কোণে। বলে উঠলেন, “কী স্যার? ভয় পেলেন নাকি? না না, ভয় পাবেন না। এই নিন, আরাম করে বসুন।” একটা চেয়ার সুদীপের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি।
সুদীপ চেয়ারটায় বসতে পেরে যেন আশ্বস্ত হল খানিকটা। পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছতে মুছতে দেখল, আর একটা চেয়ার টেনে মিঃ ইলিয়াস নিজেও বসে পড়েছেন, আর সুদীপের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন। সুদীপ মুখ তুলে তাকাতেই ইলিয়াস বলতে শুরু করলেন, “দেখুন স্যার। সেদিন ওই ঘড়িটা নেবার আগেই আমি আপনাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আমার কথা শুনতেই চাইলেন না। আসলে আমি সেদিন আপনাকে বাধা দিতেই চেয়েছিলাম, যাতে ঘড়িটা আপনি না নেন, কারণ ওই ঘড়িটার সঙ্গে ভয়ংকর এক অভিশাপ লেগে আছে।”
সুদীপ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মিঃ ইলিয়াসের দিকে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝে দোলাচল অবস্থা তার। কম দিন তো এই কিউরিও লাইনে যাতায়াত করছে না সে। তাই ভাল করেই জানে যে এইসব প্রাচীন জিনিষের দাম বাড়াবার জন্যে অনেক সময়েই এর সঙ্গে একটা করে আজগুবী গল্প যোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু এখন সেটা করে মিঃ ইলিয়াসের লাভ কী? জিনিষটা তো অলরেডি বিক্রী হয়েই গেছে!
ইলিয়াস-ও বোধহয় বুঝতে পারছিলেন সুদীপ কী ভাবছে। বললেন, “কী ভাবছেন স্যার? আজগুবী গল্প? ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফর্মেশন, আপনার আগে চারজন ওই ঘড়িটা আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর একে একে সকলেই আবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে ওই ঘড়ি। কারণ কী জানেন? প্রত্যেকেই মাঝরাতে ওই ঘড়িটার অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে দেখত যে, তারা জ্যান্ত মমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ক্যান ইউ বিলিভ ইট?”
সুদীপ হতবাক। নিজের কানে শুনেও যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না ব্যাপারটা। তার মানে সে-ই প্রথম নয়! এর আগেও তার মতোই আরও চার হতভাগ্য এই দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হয়েছে! আর তার মূলে আসলে এই ঘড়ি! কিন্তু কীভাবে? আর কেন? কীসের অভিশাপ লেগে আছে এই ঘড়িটার সঙ্গে?
প্রশ্নটা করার আগেই সুদীপ দেখল, মিঃ ইলিয়াস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তারই দিকে। সেইভাবে থেকেই বললেন, “আসলে স্যার, ঘড়িটা যে-পথে এখানে এসেছে, সেটা ঠিক সোজা পথ নয়। হ্যাঁ, যদিও আমাদের বিজনেসে অনেক চোরাই জিনিষই হাতফেরতা হয়ে চলে আসে, তারপর একবার এখান থেকে বেরিয়ে গেলে আর তার নাগাল পায় কার সাধ্যি! এটাও সেভাবেই এসেছিল, আর বিলিভ মী, তখন এর অভিশাপের ব্যাপারটা আমিও জানতাম না। কিন্তু প্রথমবার … সে প্রায় বছর খানেক আগে হবে ... এই ঘড়িটা প্রথম যে কিনেছিল, কেনবার দশদিনের মধ্যেই সে ছুটে এল আমার কাছে। প্রতি রাতেই সে নাকি ঘুম ভেঙে দেখে, সে মমি হয়ে যাচ্ছে। ভয়ে, আতঙ্কে সে যে কী অবস্থা হয়েছিল তার!”
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ইলিয়াস আবার বলেন, “সেইদিনই সে আমার ঘড়ি আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে গেল। আর তারপরেই আমি যোগাযোগ করলাম আমার এজেন্টের সঙ্গে। চেপে ধরলাম তাকে, কী ব্যাপার ঠিক করে বলো তো আমায়! তখনই সে ভেতরের কথাটা ফাঁস করল আমার কাছে।”
“কী কথা, কী কথা মিঃ ইলিয়াস?” আগ্রহে, উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসে সুদীপের।
ধীরে ধীরে মিঃ ইলিয়াস বলেন, “কয়েক বছর আগে ঈজিপ্টের সাক্কারাতে একটা প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে একসঙ্গে বেশ কিছু মমির সন্ধান পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, তাদের বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর, আর সেগুলো ছিল ঈজিপ্টের একদল পুরোহিতের মৃতদেহ। সেই মমিগুলোর সঙ্গেই পাওয়া যায় সেই সময়ের বেশ কিছু জিনিষ, যার মধ্যে একটা ছিল এই ঘড়িটা। সেটা ওখান থেকেই কেউ চুরি করে পাচার করে দেয়, আর তারপর হাতফেরতা হতে হতে সেটা এসে পড়ে কলকাতায়, আমার এই নীলামের দোকানে। কিন্তু শুধু ঘড়িটা তো এল না, তার সঙ্গে এল এটার মালিক যে, সেই পুরোহিতের অভিশাপ। আজ আড়াই হাজার বছর পরেও তার সেই অভিশাপ জীবন্ত হয়ে আছে, যার ফলে এই ঘড়ি যার সঙ্গে থাকবে, তারই ভাগ্যে ঘটবে এই অমোঘ বিপর্যয়। প্রতি রাতেই তার শরীরটা একটু একটু করে মমিতে পরিণত হতে থাকবে, আর ভয়ে আতঙ্কে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে।”
অন্ধকার ঘরের মধ্যে, নিভু নিভু লন্ঠনের আলোয় মিঃ ইলিয়াসের কথাগুলো কেমন এক ভবিষ্যৎ বাণীর মতো শোনায়। শিউরে শিউরে ওঠে সুদীপের সারা শরীর। তাহলে কি তার ভাগ্যেও নাচছে ওই নিশ্চিত মৃত্যু? মনে হয় একছুটে এই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলে ভালো হয়। কিন্তু তাতে তো ওই অভিশাপ তার পিছু ছাড়বে না। ওই অভিশপ্ত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একটাই উপায় আছে তার হাতে।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে সুদীপ বলল, “মিঃ ইলিয়াস, আমি কাল সকালেই আপনার দোকানে আসছি। ওই ঘড়িটা আমি ফিরিয়ে দিয়ে যাব আপনার কাছে। ওই অভিশপ্ত ঘড়ির হাত থেকে দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন।”
বলেই প্রায় ছুটে নীলামঘর থেকে বেরিয়ে যায় সুদীপ। অন্ধকারের মধ্যে ইলিয়াস একা দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর মুখে অদ্ভুত এক হাসি।
………………….
অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment