“শীত আর বর্ষার এমন যোগ দেখলেই সেদিনের কথাটা মনে পড়ে।
ক্যাম্পাস ইনটারভিউতে চাকরি জুটেছিল। কিন্তু জয়েনিং লেটার দিতে পাক্কা ছয়মাস নিলেন তাঁরা। পোস্টিং সেই সুদূর বাড্ডিতে। ভাবছেন এই ‘বাড্ডি’-টি আবার কোথায়? ওষুধের স্ট্রিপ কিংবা টুথপেষ্ট টিউবের পিছনটা দেখে নেবেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। হিমালয়ের গায়ে হিমাচলপ্রদেশের অন্যতম ইকোনমিক জোন এই বাড্ডি। প্রায় সাড়ে ছ’শোর ওপর ফার্মাসিউটিক্যাল আর এফএমসিজি ইউনিটের আঁতুড়ঘর বাড্ডি। সেখানেই যেতে বলা হল আমাকে।
ডিসেম্বর মাস, তায় আবার হিমাচলপ্রদেশ— অবস্থাটা ভাবুন! তার উপর যাওয়া থেকে শুরু হয়েছে নাছোড় বৃষ্টি। সকালে ঘুম থেকে উঠলে জল ছুঁলে হাত-পা বেঁকে যাবার জোগাড় হত। এরই মধ্যে শুরু হল ট্রেনিং।
প্রথম ক’দিন গেস্ট হাউজে রাখার পর কোম্পানি থাকার জন্য পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করল। গাড়ি চেপে সেই কোয়ার্টারে গিয়ে আমি তো অবাক! যে সে নয়, একেবারে অফিসার্স কোয়ার্টার— আমার সিনিয়রদের-ই নিচের ফ্লোর। আমার মতো জুনিয়রের জন্য এমন ব্যবস্থা! ব্যাপারখানা কী?
নিজেকে বোঝালাম, এত ভেবে কাজ নেই। কথায় আছে, সবুরে মেওয়া ফলে। আমারও হয়তো তাই হয়েছে। কিন্তু তখন তো আর বুঝিনি যে বিধাতা পুরুষ মুচকি-মুচকি হাসছেন।
সেই কোয়ার্টারে প্রথম রাত কাটানোর কথাই বলছি এখন।
কোয়ার্টারে ঢোকার পর টানা একহপ্তা নাইট গেল। কিন্তু সেদিন আমার ফ্লোরে প্রোডাকশন ছিল না—ব্রেকডাউন ছিল। উপরের ফ্লোরের সব সিনিয়ররাই ট্রাবলশুটিঙে বেরিয়ে গেছেন। একা আমারই ছুটি! শীতের রাত, তায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি। সন্ধ্যাবেলাতেই রুটি তরকারি আর ঈষৎ সাধুসঙ্গ করে জোড়া লেপের তলায় ঢুকে পড়লাম।
কীসে ঘুম ভাঙল জানি না। তবে একটা অস্বস্তি হচ্ছিল—যেন কিছু একটা ঠিক নেই। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। তেড়ে গর্জাচ্ছে মেঘ। ঘরের ভেতর নাইটল্যাম্প আর বাইরের স্ট্রিট লাইটের পরিস্রুত হয়ে আসা আলো— দুয়ে মিলে অদ্ভুত এক আলো আঁধারি।
টয়লেটে যাব বলে খাট থেকে পা নামাতে যেতেই ধড়াস করে উঠল বুকটা। জানালার সার্সির বাইরে ওটা কী?
একটা অন্ধকারের স্তুপ যেন নাড়াচাড়া করছিল সার্সির ঠিক বাইরে!
খাট থেকে নেমেই আলো জ্বালিয়ে দিলাম। প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তারপরেই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল দৃশ্যটা।
একটি নারী অবয়ব ঠেস দিয়ে আছে আমারই জানালার কাছে!
এই শীতের ঝড়বাদলের রাতে কে আসবে? একটা ভয় দানা বাঁধছিল। তারপরেই মনে হল, হয়তো কোনও অফিসারের পরিবারের কেউ হবেন। রাত-বিরেতে অসুবিধায় পড়ে সাহায্যের জন্য নির্ঘাত নেমে এসেছেন নীচে। কিন্তু… পিছনের সাফাইওয়ালার সিঁড়ি দিয়ে নামলেন কেন? এদিকটা তো কাঁচে মোড়া; ডাকলেও আওয়াজ পাওয়া যাবে না। দরজায় এসে টোকা দিতে পারতেন!
এইসব চিন্তা করতে করতেই এগিয়ে গেছিলাম দু’পা। পরমুহূর্তেই লাফ দিয়ে পিছিয়ে এলাম। পারলে সোজা খাটের তলাতেই আশ্রয় নিতাম। কিন্তু দারুণ ভয়ে সেই খেয়ালও ছিল না বলে একজায়গায় গেঁথে গেলাম একেবারে।
এ কাকে দেখলাম আমি!
সার্সিতে হাত আর নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি নারী-অবয়ব। তার দু’পাশ দিয়ে মোটা ধারায় নেমে আসছে জল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার নাক, ধপধপে ফর্সা হাত। আর ঠিক এখানেই অসঙ্গতিটা … তার হাতের তালু কাগজের মতো সাদা! তাতে একটিও রেখা নেই! আর তার ফাটাফাটা রেখাময় ঠোঁট দু'খানা টকটকে হলুদ বর্ণের..... যেন গাঁটগাঁট কাঁচা হলুদ চিবিয়ে এসেছেন এখুনি।
বর্ণনা শুনে জানি না, বুঝবেন কিনা। কিন্তু এরকম বীভৎস-দর্শন মুখ কল্পনাতেও আনা কঠিন।
যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গিয়েছিল। ঠকঠক করে কাঁপছিলাম বটে, কিন্তু তার সঙ্গে শীতের কোনও সম্পর্ক ছিল না। মনে হচ্ছিল, হৃদপিণ্ড যেন এখুনি উঠে আসবে গলা বেয়ে।
আমার সাহায্য দরকার! এভাবে এই ঘরে থাকলে ওই… ওইটা ভেতরে ঢুকতে না পারলেও একা আমি হার্টফেল করেই মারা পড়ব। কিন্তু কাকেই বা ডাকব? এত রাতে কে শুনবে আমার ডাক?
সিনিয়ররা ফ্যাক্টরিতে। তাঁদের পরিবাররা আছে, তবুও লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সেই কোয়ার্টারের দরজায় গিয়েই আছড়ে পড়তাম। কিন্তু তার জন্যও তো আমাকে ঘর থেকে বেরোতে হবে। সেটাই বা করি কী করে?
এইবার শুরু হল নতুন উপদ্রব। সার্সির ওপার থেকে শুরু হল অস্থির গোঁ গোঁ আওয়াজ আর ঘনঘন করাঘাত। নিশ্ছিদ্র কাঁচের ওপার থেকেও সে আওয়াজ যেন সরাসরি এসে কানের মধ্যে তপ্ত শলাকার মতো প্রবেশ করছিল। ভয়ে শরীরের ভিতরটা পাক দিচ্ছিল। তখনই মনে পড়ল, রান্নাঘরের জানালাটা ভালো করে বন্ধ হয় না। যদি সেখান দিয়ে ঢুকে পড়ে ওই…! প্রচন্ড ভয়ে বুকের ভেতর একটা ব্যথাই উঠতে শুরু করল।
মানুষের যখন সব জানালা বন্ধ হয়ে যায়, তখন কেবল একটিই জিনিস খোলা থাকে— তাঁর দরজা। তিনি, মানে যিনি সবকিছুর মালিক। মনে-মনে তাঁকেই জপতে লাগলাম।
আমাদের অফিস আর লাগোয়া বসতি নিয়ে একটা ছোটোখাটো টাউনশিপই ছিল ওখানে। সেই এলাকার মধ্যে একটি বড়ো শিব মন্দির ছিল। শিবরাত্রি, পার্বণ সবই তাতে হয় বলে শুনেছিলাম। আমি আসার পর থেকে প্রতি সোম আর শুক্রবার বাবা’র মাথায় জল ঢালতে যেতাম। এটা আমার বহুদিনের অভ্যাস।
ওই চত্বরে নিয়মিত ডিউটি করত আরও একজন— ‘ভোলা’ নামের একটা ষাঁড়। ওর কথা ভেবেই বোধহয় ‘ধর্মের ষাঁড়’ শব্দবন্ধের উৎপত্তি। ভোলা পুরো টাউনশিপ জুড়ে ঘুরে বেড়াত। সবার হাত থেকে কলাটা-মূলোটা খেত। কিন্তু রাত্রে ভোলা শুতে আসত মন্দিরের চাতালেই।
আপনারা হাসবেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার ভোলা’র কথাও মনে হচ্ছিল! ভাবছিলাম, যদি ভোলাও এদিকপানে আসে, তাহলে হয়তো বেঁচে যাব!
তখন আমার চেতনা জবাব দেওয়ার আগের অবস্থায় পৌঁছে গেছে। শরীর এলিয়ে আসছে, এদিকে সেই গোঁ গোঁ আওয়াজ আর করাঘাতের জোর ক্রমেই বাড়ছে। এবার যেন রান্নাঘরের দিকে সরে যাচ্ছে আওয়াজটা। আমার মাথার ভেতরটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম, চোখের সামনে অন্ধকার নামা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ঠিক তখনই আওয়াজটা পেলাম।
হাম্বাআআ…!
মনে হল, যেন কেউ আমায় ঝাঁকিয়ে সিধে করে দিল। মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সেই গোঁ গোঁ আওয়াজ কিন্তু পরমুহূর্তেই আরও জোরে, আরও আক্রোশের সাথে শুরু করল, এবারে গোঁ গোঁ নয় রীতিমতো গরগর করছে যেন।
কিন্তু এবার আমি আর অত ভয় পেলাম না।
কেন জানেন? কারণ আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম, এত রাতেও মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে। সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে মুহূর্মুহু হাম্বা রব।
কোয়ার্টারে প্রথম ঘরটা আমার— গেট দিয়ে ঢুকেই। এবার গেটের কাছেই খসখস করে একটা আওয়াজ পেলাম। সেই সঙ্গে আমার দরজার ঠিক পাশটাতেই ডাক উঠল— হাম্বা! সে ডাকের তীব্রতায় কেঁপে উঠল আমার দরজা। কিন্তু অদ্ভুত এক শান্তি, একটা নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার অনুভূতি নেমে এল আমার শরীর জুড়ে। বুঝতে পারছিলাম, আমি তলিয়ে যাচ্ছি—কিন্তু এবার সেই অন্ধকারের রঙ কালো নয়, বরং একটা নীলচে আভা যেন ফুটে উঠে আমাকে পরম শান্তিতে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে!
কাচের ওপাশ থেকে আর কোনও আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। তার বদলে একটা মৃদু হাম্বা রব কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
ঘুম যখন ভাঙল, তখন ছেঁড়াছেঁড়া রোদ উঠেছে। চোখ মেলেই জানালার দিকে তাকালাম। না! কিচ্ছু নেই ওখানে। সব শান্ত।
দরজা খুলে বাইরে আসতেই স্যারের সঙ্গে দেখা হল। স্যার সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত দেরি যে! কী ব্যাপার? ভোলার ভয়ে দরজা খোলোনি নাকি?’
আমতা আমতা করে বললুম, ‘ভোলার ভয়ে… কেন স্যার?’
‘বুঝতে পারনি তাহলে।’ স্যার বললেন, ‘ভোলা কাল সারারাত তোমার দরজার বাইরে শুয়েছিল। আমরা সকালে ফিরে দেখি বাবু শুয়ে আছেন। আমরা আর ওঠাইনি। এই খানিক আগে ব্যাটা নিজেই উঠে গেল।’
আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। বাবা, আর তাঁর পাঠানো নন্দী মহারাজের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় তখন আমার চোখ ভিজে উঠেছিল!”
২
আমরা এতক্ষণ দমবন্ধ করে শুনছিলাম। রঞ্জনদা, মানে সঞ্জীবের বড়ো জামাইবাবু’র ঝুলিতে যে বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে—এটা মোটামুটি সম্বন্ধ হওয়ার সময় থেকেই শুনেছিলাম। তাই সঞ্জীবের বাসর ঘরে রাতজাগাটাকে স্বাদু করতে ওঁকেই ধরা হয়েছিল। উনিও নিরাশ করেননি।
“এরপরেও ওখানে ছিলেন?” নতুন বউদি জিজ্ঞেস করলেন দাদাকে।
“না।” একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললেন রঞ্জনদা, “সেদিনই জি.এম স্যারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। স্যার সব শুনে চুপচাপ বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে ওঁর কোয়ার্টারেই দিন পাঁচেকের জন্য উঠে আসতে বলেছিলেন। স্যারের বিশাল কোয়ার্টার। তাছাড়া মানুষটাও দরাজদিল। নইলে নতুন যোগ দেওয়া এক জুনিয়র অফিসারের জন্য এত কেউ ভাবে না। ওই ক'দিন স্যারের পরিবারের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া সারলাম। ডিনার টেবিলেই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা জানতে পারলাম।
‘এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ফাইনান্স ডিপার্টমেন্টের এক মহিলা কর্মচারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেই সময়।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যার বলেছিলেন, ‘ওই ডিপার্টমেন্টের লেডিজ কোয়ার্টার তোমাদের, মানে ইঞ্জিনিয়ারদের কোয়ার্টারের পিছন দিকটায়। ওদের নৈশ অভিসার চলত পিছনের দরজা দিয়ে— সবার নজর এড়িয়ে।
সেও ছিল এক ঝড়জলের রাত। ছেলেটির ক’দিন নাইট ডিউটি আছে— এমনই জানত মেয়েটি। তাই সেই কয়েক রাতে সে অভিসারের প্রত্যাশী ছিল না। কিন্তু মাঝরাতে কোনও দরকারে বাইরের ঘরে এসেছিল সে। তখন ছেলেটির কোয়ার্টারে ক্ষীণ আলো দেখে ওই ঝড়জলের মধ্যেও তার কৌতূহল মাথাচাড়া দিয়েছিল। মেয়েরা এসব বিষয়ে এমনিতেই একটু সন্দেহবাতিক হয়। বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে মেয়েটি দেখেছিল, তার প্রেমিক অন্য একজনের কন্ঠলগ্ন হয়ে শুয়ে আছে। কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে নিজের কোয়ার্টারে ফিরে সে ভেঙে পড়ে। তারপর অন্যদের সঙ্গে কথায়-কথায় জানতে পারে, ছেলেটি বিবাহিত। তার স্ত্রীই ক’দিনের জন্য এসেছিল স্বামীসঙ্গের আশায়।
তারপর এক রাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে…!
তারপর থেকে ও ঘরে আর কেউই বিশেষ টিকতে পারে না। আমি জেনেশুনেও রেখেছিলাম তোমায়। সরি বেটা! আসলে কোম্পানি ক্রমাগত বলছিল ঘরটাকে ব্যবহার করতে। তাই একটা চেষ্টা করেছিলাম। ভাগ্যিস তোমার কোনও বিপদ হয়নি। না হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।’
কয়েকদিন পর নতুন কোয়ার্টার পেলাম। ব্যাচেলার্স কোয়ার্টার। ওয়ান বেডরুম ফ্ল্যাটের মতো। আশেপাশে সব ঘর ভর্তি। ভয় পাওয়ার কোনও সুযোগই নেই। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ঘর গোছাতে গিয়ে দেখি, চার্জারটা স্যারের বাড়ি ফেলে এসেছি।
স্যারের বাড়ি গেলাম। স্যার তখনও ফেরেননি। ম্যাডাম বসালেন। কেমন যেন উশখুশ করছিলেন। আমি কোনও সমস্যা বুঝে চার্জারটা নিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার হাত ধরে, একরকম টানতে-টানতে স্যারেদের বেডরুমে আমাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন ম্যাডাম।
ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই চমকে গেছিলাম যে আশেপাশে তাকাইনি। এবার দেখলাম, ঘরের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে অজস্র ফটোফ্রেম। কোনওটায় একটি মেয়ে একা। কোথাও সে তার বাবা-মা, অর্থাৎ স্যার আর ম্যাডামের সঙ্গে। কোথাও সে ঘোড়ার পিঠে।
‘মেয়েটা কস্ট একাউন্টেন্সি করার পর ওর বাবা এখানেই নিজের আন্ডারে ট্রেনি হিসাবে ঢুকিয়ে নিলেন।’ ম্যাডাম ফুঁপিয়ে উঠলেন, ‘আমাদের দেশ কাছেই, ফরিদাবাদ। ইচ্ছা ছিল, ওঁর রিটায়ারমেন্টের পর ওখানকার বাড়িঘর বেচে দিল্লি গিয়ে সেটল হব। ততদিন মেয়েটা ভালো করে কাজ শিখুক। তাহলে দিল্লিতে চাকরি পাওয়ারও সুবিধা হবে। কিন্তু হল না! মেয়ে ওই মনহুস কুমারের প্রেমে পড়ল।
আমি তখন লম্বা ছুটি নিয়ে ঘরে গেছিলাম। শাশুড়ি অসুস্থ ছিলেন। ওর বাবাও এদিকে ব্যস্ত থাকেন। মেয়ে’র পুরো ঝাড়া হাত-পা। সেই সময়েই এ-সব করল মেয়েটা। কুমারের ঘরে ওর জরু ছিল। তাও যদি আমাদের সঙ্গে থাকত, হয়তো মেয়েটাকে বাঁচানো যেত। কিন্তু স্বাধীনচেতা মেয়ে বলে আমাদের সঙ্গে না থেকে বাকি ট্রেনিদের সঙ্গে ওই কোয়ার্টারে থাকত।
তার ওপর সেই রাতে ওর বাবাকে ফ্যাক্টরি যেতে হয়েছিল। যতক্ষণে সব জানা গেল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছিল!’
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘কুমারকে ধরলেন না কেন? এ তো পরিষ্কার ধোঁকা দেওয়ার কেস!’
‘কুমার নিচু জাত।’ প্রায় শোনা যায় না এমন গলায় বলেছিলেন ভদ্রমহিলা, ‘জানাজানি হলে এমনিতেই বেরাদরিতে আরও নাক কাটা যেত। ওর বাবা তাই সরাসরি কিছু করেননি। পরে কায়দা করে কুমারের চাকরিটা খেয়েছিলেন শুধু।’
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে এই ট্র্যাজেডির চেহারাটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তখনই উনি কান্নাজড়ানো গলায় বলে উঠলেন, ‘তুমি আমাদের মাফ কর বাবা। আমরা তোমার সঙ্গে বড় অন্যায় করেছি। আমরা জানি, এরকম ঝড়জলের শীতের রাতে নিচের ঘরে কেউ এলেই ও আসে। তাই একটিবার মেয়েকে দেখার আশায় আমরা বাপ-মায় নতুন রিক্রুট এলে ওই ঘরে থাকতে দিই। আমাদের ঘর থেকে কোনাকুনি স্পষ্ট দেখা যায় নীচের ওই কোয়ার্টারটা। তবে ও কারও ক্ষতি করে না বাবা। আমরাও তোমার ক্ষতি হতে দিতাম না।’
মহিলা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল। চিৎকার উঠে আসতে চাইছিল গলা চিরে। কিন্তু এক মা’র কান্নার সামনে কিচ্ছু বলতে পারিনি সেদিন।
শুধু, ওই ঘটনার পর থেকে আমার বিশ্বাস নিয়ে কেউ কিছু বললে, তাকে ছেড়ে কথা বলিনি!”
………………
অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment