বিশেষ রচনাঃজরুরি অ-জরুরি গপ্পোঃঅম্লানকুসুম চক্রবর্তী

 জরুরি অ-জরুরি গপ্পো


অম্লানকুসুম চক্রবর্তী



সেক্টর ফাইভের যে ঘুপচি দোকানের সামনের গরম তাওয়াটা প্রায় সারাদিনই ঝাঁ ঝাঁ করে আওয়াজ করত চালের গুঁড়ো বাটা ছড়িয়ে পড়ার সোহাগে, সেখানে আজ কয়েকটা আরশোলা তাদের নিজস্ব জগিং ট্র্যাক বানিয়ে নিয়েছে। ধোসার ব্যবসা ধ্বসে যাওয়ার পরে দোকানি এখন গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশায়। বহু বছর ধরে দেখে আসা নর্মাল যখন পালটে গিয়ে নিউ নর্মাল হয়ে যায়, এমন দোকানিদের কপালে ত্রিকোণমিতি চরকির মত নাচে। গমগম করা ডেকার্স লেন আজ কেমন যেন গা ছমছম, দিনের বেলাতেও। কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনের ফুটপাতে যে বিরিয়ানিওয়ালা সামান্য কয়েক প্লেট বেঁচে যাওয়া বিরিয়ানি হাফ দামে বিক্রি করতেন সন্ধে পাঁচটা বাজলেই, তিনি হয়ত আজ ওই সময়ে বাড়ি গিয়ে শীতঘুম দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দু চোখের পাতা এক করতে পারেন কিনা জানি না।

‘শ্মশানসিদ্ধ হতে গেলে আর নিমতলা কেওড়াতলা যেতে হবে না, আমাদের এই হাইটেক অফিসপাড়ায় একদিন ঘুরে যান দাদা’, আঙুল কামড়াতে কামড়াতে বলছিলেন শহরের তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র সেক্টর ফাইভের এক রোল-চাউমিন বিক্রেতা। দেখেছিলাম, আঙুলে ক্রমাগত দাঁত দিয়ে কামড় বসানোর ফলে তর্জনীর নখটা আর তেমন অবশিষ্ট নেই। দোকান খুলে এক দৃষ্টে চেয়েছিলেন, সব হারিয়ে ফেলা এক দুঃখী ভূতের মতো। কয়েকমাস আগেও লোক সামলাতে যাঁকে হিমশিম খেতে হত, তিনি আজ হাপিত্যেশ করে বসে থাকেন একটা লোকের আশায়। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন, ‘আর কত দিন ক্যালেন্ডারের পাতা আহাম্মকের মতো, এক বেজন্মার মতো এমন ভাবে উলটে যেতে হবে জানি না।’ 

লোকগুলো সব গেল কোথায়? করোনাকালীন ওয়ার্ক ফ্রম হোম সংস্কৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এভাবেও কাজ করা যায়। দেশজোড়া লকডাউন সরকারিভাবে উঠে যাওয়ার পরে একটি ম্যানেজমেন্ট ফার্ম এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। ৮৮ শতাংশ কর্মীই এক কথায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন, বাড়িতে বসে কাজ করাতেই তাঁরা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছেন। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষই বলেছিলেন, নিভৃত গৃহকোণে কাজ করার ফলে তাঁদের প্রোডাক্টিভিটি, অর্থাৎ কর্মদক্ষতা বেড়ে গিয়েছে। এমন তথ্যে ‘রূপকথা’ বাস্তব হয়েছিল বহু বহুজাতিকের ক্ষেত্রে। সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা বুঝতে পারলেন, অফিস চালানোর খরচা বাঁচিয়েও কর্মদক্ষতা বাড়ছে যখন, তখন আর অফিসটুকু রেখে দিয়ে মাসে লক্ষাধিক টাকা ভাড়া দেওয়াটা আসলে এক মূর্খামি। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। অ্যাকাউন্টিংয়ের ভাষায় ওভারহেডস ও ফিক্সড কষ্ট বাঁচানোর এই সোনার সুযোগটা ছাড়তে চাইল না বহু সংস্থা। সাধের ভাড়া নেওয়া অফিসগুলোর লিজ কনট্রাক্ট আর পুনর্নবীকরণ করা হল না। থোক টাকা বাঁচল। সেই বেঁচে যাওয়া টাকা সরাসরি সংস্থাগুলোর লাভের খাতায় সোনার সিংহাসনে বসল। তবে একটা বড় অফিসকে কেন্দ্র করে যে অনুসারী ব্যবসাগুলো গড়ে ওঠে, তারা পড়লেন মহা আতান্তরে। দোকান বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যারা এখনও টিকে আছে, কী ভাবে আছে তা নিয়ে বিস্ময় জাগে।

একশটি সংস্থার বার্ষিক এক কোটি টাকা অতিরিক্ত লাভ ও সেই লাভজনিত ট্যাক্স রাজ্য ও কেন্দ্রের রাজকোষে যে সুখ ভান্ডার নিয়ে আসে, হাজারটা অসংগঠিত, ক্ষুদ্র ব্যবসার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেলেও সেই আনন্দ-ঝরনা থেকে এক বিন্দু জল কমে না। কর্মী সুরক্ষার সঙ্গে কোনও আপোষ না করার কথা জানিয়ে, মহানুভবতার মোড়কে কয়েক কোটি টাকা বাঁচানোর জন্য বহু সংস্থা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছে, তাদের কর্মীদের একটা বড় অংশ এবারে পাকাপাকিভাবে বাড়ি থেকেই কাজ করবেন। কর্মীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এককালীন পনেরো কুড়ি হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, এবারে সুন্দর দেখতে একটা কম্পিউটার টেবিল আর একটা আরামকেদারা কিনে নাও। অফিসমুখো হয়ো না আর। আমার পরিচিত এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার এইচআর প্রতিনিধির কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, একজন কর্মীকে অফিসে আসতে না দিলে কফিবাবদই নাকি মাসে বেঁচে যায় আটশ টাকার কাছাকাছি। সোজা হিসেব। মগে এক কাপ কফির দাম যদি ৮ টাকা হয় আর এক জন যদি দিনে ৪ কাপ কফি খান, তাহলে মাথাপিছু দৈনিক কফি খরচ ৩২ টাকা। মাসে ২৫টি কাজের দিন থাকলে হিসেবটা তেমনই দাঁড়ায়। এই পুরো টাকাটাই নিট লাভ। ৯০ শতাংশ কর্মীকে বাড়ি থেকে কাজ করিয়ে নিলে বাৎসরিক সাশ্রয়ের এই হিসেব কষতে বসলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

এত দিন ধরে দেখে আসা এইচ আর রুলবুক আবার নতুন করে লিখতে বাধ্য করেছে এই করোনাকাল। তথাকথিত ব্লু কলারের কাজ করেন যাঁরা, ভাল কাজ করলে পিঠে বসের আদরমাখা চাপড় পান যাঁরা, বাড়িবন্দি কাজে তাঁরা এই প্রশংসা যে মিস করছেন খুব, এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। বিশ্বের তাবড় সংস্থার মানবসম্পদ আধিকারিকরা এর বিকল্প ব্যবস্থা বার করে ফেলেছেন। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে হচ্ছে থ্যাংকসগিভিং সেশন। স্ক্রিনে, অফিসের সহকর্মীদের সামনে বেলুনের মতো উড়ে যাচ্ছে উপরওয়ালার থাম্বস আপ দেখানো হাত। ‘ক্ল্যাপ টিম ক্ল্যাপ’ বলার সঙ্গে সঙ্গে হাততালির আওয়াজ কানে ঢুকে যাচ্ছে ব্লুটুথ স্পিকারে। ভাইস প্রেসিডেন্টের ডিজিটাল সই-সহ সার্টিফিকেট ট্রিং করে চলে আসছে আউটলুক এক্সপ্রেসের ইনবক্সে। কেক কাটা, ককটেল পার্টির খরচ বাঁচছে। ভার্চুয়াল অভিনন্দনের বাইনারি হাসি ছড়িয়ে পড়ছে স্ক্রিন জুড়ে।  

নিয়োগপত্র লেখার ধরণটাও বদলে যাচ্ছে ক্রমশ। কয়েকমাস প্রবেশন পর্বের পর যখন কোনও কর্মী কনফার্মেশনের চিঠি পান, চাকরি থেকে ছাঁটাই হওয়ার বেশ কিছু শর্ত তাঁর জন্য আরও একটু তরল হয়ে যায়। প্রবেশনে থাকা এক কর্মীকে ‘কাল থেকে আসতে হবে না’ বলাটা যতটা সহজ, কনফার্ম হয়ে যাওয়া কোনও কর্মীকে এ কথা বলা তত সোজা নয়। যদি তা হয়ও, সংস্থাবিশেষে দু মাস কিংবা তিন মাসের বেতন ওই কর্মীকে মিটিয়ে দিতে বাধ্য থাকে সংস্থা। এখন যাঁরা নিয়োগপর্ব চালাচ্ছেন, ই-অফারের শেষে জুড়ে দিচ্ছেন দু-তিন লাইন। বলছেন, অতিমারী-সহ কোনও জরুরি কারণে এই কনট্রাক্টের নিয়মাবলী অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে বাধ্য থাকবে না সংস্থা। বাক্যটি দুবার পড়লে শব্দের ভিতরের অর্থগুলো কোনও বিষ-ফুলের কুঁড়ির মতো কালো পাপড়ি মেলে। যে সংস্থাগুলো কর্মী ছেঁটে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে গত কয়েকমাসে, এই ভুল ভবিষ্যতে আর না করার জন্য তারা সচেতন হওয়ার চেষ্টা করছে একেবারে প্রথম দিন থেকে। একই সঙ্গে প্রায় প্রতিটি সংস্থার মানবসম্পদ আধিকারিকই এর মধ্যে তৈরি করে রেখেছেন এক লম্বা চওড়া এক্সেল ফাইল। কোম্পানির রেস্ততে টান পড়লেই পয়সা বাঁচানোর জন্য যেন ওই তালিকা থেকে নিশ্চিন্তে নাম বেছে নেওয়া যেতে পারে। এই এক্সেল ফাইলটা এক বিরাট খড়গের সামনে রাখা মুরগীর খাঁচার মতো। ফাইলের প্রতিটা নাম যেন অন্যটাকে আড়চোখে দেখে।

যাঁরা চাকরি করে খান, চারদিকে তাকালে বুঝতে পারি, তাঁদের মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে এক স্পষ্ট বিভাজন। এক দল পাকাপাকি ভাবে বাড়ি থেকে কাজ করার জন্য প্রস্তুত। কাজ নিয়ে বাড়িতে বন্দি থাকার জন্য তাঁরা ছদ্ম-দুঃখ প্রকাশ করেন টেলিফোনে। যেন বাড়ি থেকে বেরোতে পারলেই মোক্ষলাভ। আর অন্য দলের প্রতিটি মানুষকে নিয়ম করে বাড়ি থেকে অফিসমুখো হতে হচ্ছে প্রতিদিন। এক এইচআর ‘সেফটি ফার্স্ট, ফ্যামিলি ফার্স্ট’ বলে আট ঘণ্টার জায়গায় বারো ঘণ্টা পরিয়ে রাখছেন ল্যাপটপ শেকল। আর অন্য এইচ আর বলে, লকডাউনে বাড়িতে মস্তি হয়েছে অনেক। এবারে অফিসে হাজিরা দাও রোজ। ঠিক সময়ে আসতে হবে। কী ভাবে আসবে, হেঁটে না ট্রেনে বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে তা তোমরা নিজেরা বুঝে নাও। শনিবার হাফ ছুটি? ও সব নিজের পকেটে রাখো। লকডাউনের সময় প্রাইভেট গাড়ির কাচ আমাদের একটা শব্দ চিনিয়েছে—এসেন্সিয়াল সার্ভিস। এর মানে এঁরা ছাড়া বাকি সবাই নন-এসেন্সিয়াল চাকুরিজীবি! এসেন্সিয়ালদের রোজ বাধ্য হয়ে কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। আর এসেন্সিয়াল নন যাঁরা, তাঁরা দিব্যি বাড়িতে বসে কাজ করে যান। এসেন্সিয়াল ভাবে, ইশ্, যদি নন-এসেন্সিয়াল হতাম, ঘরের মধ্যে পেতাম অনন্ত সুখ। আর এসেন্সিয়াল নন যাঁরা, তাঁদের মাথায় কম্পিউটার মনিটররের স্ক্রিন সেভারের মতো হুটোপাটি করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে। কাজের ফাঁকে সহকর্মীদের সঙ্গে দশ মিনিটের চা-ব্রেকের জন্য তাঁদের বড় লোভ হয়।

সমস্যাটা হল জরুরি ও অ-জরুরি সংস্থাগুলো আমাদের এই শহরে ক্লাস্টারের মতো অবস্থান করে। নন-এসেন্সিয়াল সংস্থাগুলো একজোট হয়েছে শহরের যে প্রান্তে, সেখানকার অনুসারী ব্যবসাগুলো আর কতদিন কালো ত্রিপলে ঢাকা থাকবে জানি না। সময়ের কাছেও এর উত্তর কি আছে? মাছ ভাত কিংবা ডিমটোস্টের ছোট্ট দোকানমালিকরা মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পরেও মাথা তুলে পঁচিশ তলা অট্টালিকাগুলোকে দেখতে থাকেন। সেগুলোতে নিয়ন আলোর ফোয়ারা দেখার জন্য দিন গুনে যান। দিনের পর দিন। ওখানে নিয়ন জ্বললে তাঁদের ঘরে জোনাকি আসে। 

অ-জরুরি পরিষেবার লোকগুলো তাঁদের কাছে আজ ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। মানবসম্পদের নয়া রুলবুকগুলো এ খবর রাখে না।







চিত্রসূত্রঃ- আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment