বাংলাদেশের রাধানগর গ্রাম। গল্পের শুরু হচ্ছে এখানকার এক অতি দরিদ্র পরিবারের ঘটনা নিয়ে। তাদের বাড়ির উঠোনটি বেশ বিস্তৃত। হত দরিদ্র হলেও এক সময় এদের পরিবারের অবস্থা ভালো ছিল। এদের নিজস্ব ঘরদোর আছে। উঠোনে আছে বাঁধানো কুয়োতলা। এই বাঁধানো কুয়োতলা দেখেই অজন্তার একদিন মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পছন্দ হয়ে গেছিল। তবে শ্বশুর শাশুড়ি আর বেঁচে নেই। ছেলেরা দুই ভাই। বড়ো ভাইটি গ্রামে থাকে না। ছোটোটিই বাড়ির মালিক হয়ে বসবাস করছে। বিঘে দুই জমিও আছে ছেলের। সময় হাতে পেলেই সেই ছেলে রাজমিস্ত্রির কাজও করে। এমন ভালো পাত্র পপির জন্য আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ছেলের বয়স একটু বেশি। তা হোক গিয়ে। অজন্তা সম্বন্ধ পেয়ে দেখেশুনে তো খুশিতে আত্মহারা! মাস ঘুরতে না ঘুরতেই পপির বিয়ে হল সুজয় মিস্ত্রির সঙ্গে।
মেয়ে চলে যেতে অজন্তার খুব মন খারাপ হয়েছিল। কী আর করবে! সে মেয়ের মা! অজন্তা চোখের জল মুছে আবার সংসারে মন দিয়েছিল। সে কাঁথা সেলাই করে যা দু পয়সা জমিয়েছিল মেয়ের বিয়ে দিয়ে তার সবই শেষ হয়েছে। সারা সকাল দুটো ভাত রেঁধে সে কাঁথা সেলাই করতে থাকে। দিনের আলোয় সেলাই করতে সুবিধা হয় তার। মেয়ে চলে গেছে বেশ কয়েক মাস হয়েছে, তবুও অজন্তার বুকের ফাঁকা ভাবটা এতটুকুও কাটেনি। খালি তার বুকের ভেতর শীতের হাওয়া সর সর করে। নিজেকে ধমকে ওঠে অজন্তা। এমন মন কেমন করা কি ঠিক? মেয়েটার এতে ভালো হবে না। না না সে এবার কিছুতেই পপির কথা আর ভাববে না। আবার তার পপির ছলছলে চোখদুটো মনে পড়ে যায়। অজন্তা ভাবে মেয়েটা তার সুখে আছে তো?
উঠোন ঘিরে ঘিরে রাংচিতার বেড়া। খুব ছোটো ছোটো ফুল ধরেছে গাছে। পপি ঘরের ভেতর বিছানায় শুয়ে শুয়েই ওই লাল ফুলগুলো দেখতে পাচ্ছে। ঘরের ভেতরে আলো কমে এসেছে। শেষ বিকেলের আলোয় বাইরেটা কেমন হলদে হয়ে গেছে। পপির খুব জ্বর। আজ দুদিন ধরে জ্বর আসছে মাঝে মাঝে। একবার জ্বর এলে কিছুতেই সহজে কমছে না। আজ রান্না করার সময় উনুনের পাশে বসতে বসতে মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল পপি। কোনও রকমে ভাত নামিয়ে রেখে হাঁড়িতে জল ঢেলে দিয়েছে সে। রান্না করতে পারেনি বলে সে খুব ভয়ে ছিল। সুজয় কাজ থেকে এসে ভাতে জল দেওয়া দেখলে রাগ করে। চীৎকার করে গালাগালি করতে থাকে। ঘরে রান্নার আনাজ না থাকলে পপি তাই পড়শিদের বাড়ি থেকে আনাজপাতি চেয়ে আনে। না হলে গ্রামের মাঠে ঘাটে এদিক ওদিকে ঘুরে শাকপাতা জোগাড় করে এনে রান্না করে।
আজ তার শরীরটা খুব খারাপ। ঘরে এসে শুয়ে পড়তেই তার গা হাত পা কেমন থরথর করে কাঁপতে লাগল। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল অজ্ঞানের মত। ঘুম ভাঙতেই দেখল দিনের আলো নিভে এসেছে, কেমন এক ম্লান আলোয় চারদিক ছেয়ে আছে। তবে কি এতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? সুজয় কুয়োতলায় শব্দ করে আঁচাচ্ছে। তাহলে নিশ্চয় ওর চান খাওয়াও হয়ে গেছে। সুজয় রাজমিস্ত্রির কাজ করে। কাজ থেকে ফিরলে প্রথমেই সিমেন্ট বালি ধুয়ে ফেলতে ভালো করে তেল মেখে স্নান করে।
পপি দেওয়াল ধরে ধরে কোনও রকমে উঠে বসল। উঠতেই আবার তার মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। সুজয় উঠোন থেকে কোমল গলায় বলল,
“উঠো না, শুয়ে থাকো। দেখলাম তোমার গায়ে মেলা জ্বর। জল খাবে?”
সুজয়ের নরম গলার স্বর শুনে মুহূর্তেই পপির চোখে জল এসে গেল। অসুখ করলে মা খুব আদর করত তাকে। পপির বয়স মাত্র ষোলো। তার বেশিদিন বিয়ে হয়নি, এই মাসটা গেলে ছ’মাস হবে। এ বাড়িতে এসে প্রতিটা পদক্ষেপে, মায়ের কথা খুব মনে পড়ে ওর। জ্বর হলে পপির খুব তেষ্টা পায়। মা জ্বরের সময় ওর মাথার কাছে সবসময় জলের ঘটি রাখত। আর মাথায় জল ঢেলে মাথা ধুয়ে দিত। সুজয় কলতলা থেকে ফিরে ওর জন্য গ্লাসে করে জল এনে দিল। পপির গ্লাসটা হাতে ধরে কেমন যেন গরম মনে হল। সে চেয়ে দেখল, জলের রং হলদে। জল হলুদ কেন হবে? তার কি ন্যাবা হয়েছে? অবশ্য বাইরে বিকেলের আলোও একটু আগে হলদে মত মনে হয়েছিল। তাদের পাড়ার ননীখুড়ো বলত ন্যাবা ধরলে জ্বর কিছুতেই সারে না, আর তার চোখের সামনে যাবতীয় জিনিস তখন হলুদ মনে হয়। ন্যাবা হলে খুড়োর দেওয়া মালা পরলে সেরে যায়। এক ধরণের গাছের লতা পাকিয়ে গলা দিয়ে গলিয়ে পৈতার মত পড়ে থাকলে সেই মালা ধীরে ধীরে বড় হয়ে একসময় পা গলে পড়ে যায় আর ন্যাবাও অমনি সেরে যায়। ন্যাবার পথ্য হল বাতাবি লেবু। প্রতিদিন বাতাবি লেবু আর অড়হঢ় পাতার রস খেতে হয়। ভাবতে ভাবতে খানিক থমকে যায় পপি।
পপি গ্লাস হাতে ধরে আছে দেখে সুজয় বলল, '”কই জল খেয়ে নাও! ভালো লাগবে।”
সুজয়ের ব্যাবহার হঠাৎ এত ভালো লাগে পপির! তার বুকের ভেতরটা শান্তিতে ভরে ওঠে। পপির বেশি কিছু চাহিদা নেই। খালি পেটে থাকলেও তার দুঃখ নেই, সে শুধু চায় একটু ভালবাসা। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস পর থেকেই সুজয় যেন কেমন বদলে গেছে। তার মা কিছু টাকা দেবে বলেছিল, তা ধার দেনার জন্য দিতে পারেনি। দিনমজুর মা ছাড়া পপির আর কেউ নেই। সুজয়ের দাবি না মেটাতেই কি সে পপির সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করে আজকাল? সুজয় পান থেকে চুন খসলেই পপিকে এখন গালমন্দ করে। একবার তো মারতেই এসেছিল! পপি যেন তখন বিশ্বাস করতে পারছিল না। সুজয় একেবারে অচেনা এক মানুষে পরিণত হয়েছে অনেকদিন ধরে। হঠাৎ আজ সুজয়ের নরম গলার স্বর শুনে পপির মনে হয়, ভগবান! তার জ্বরটা যেন কিছুতেই না সারে!
পপি এবার তাড়াতাড়ি বড়ো করে হাঁ করে গ্লাসের অনেকটা জল আলগোছে ঢেলে দিল গলায়। দিয়েই মনে হল জ্বলন্ত আগুন যেন হঠাৎ তার গলা দিয়ে নেমে গেল। পপি তির বেঁধা পাখির মত ছিটকে পড়ল বিছানা থেকে। মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তার মুখ থেকে ঘন থকথকে রক্ত বেরিয়ে এসেছে সঙ্গে দলা দলা মাংসের টুকরো। পপি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গেল।
“তোমার নাম কি?”
মেয়েটি উত্তর দিল না। কিন্তু ডঃ রাবেয়া খাতুন বললেন, “ওর নাম পপি। মেয়েটি অস্পষ্ট স্বরে এখন একটু একটু কথা বলতে পারে। ওর গলার স্বর বিকৃত হয়ে গেছে। অ্যাসিড ভিক্টিমদের মধ্যে এই মেয়েটির বয়স সব থেকে কম। মেয়েটি যখন এখানে ভর্তি হয়েছিল তখন ওর বয়স ছিল ষোলো। প্রায় সাত বছর ধরে এই বার্ন ওয়ার্ডেই ভর্তি আছে। এই সাত বছর রোজ একমাত্র ওর মা আসে ওকে দেখতে। মেয়েটির স্বামী ওকে জলের বদলে অ্যাসিড খেতে দিয়েছিল। তাতে ওর শরীরের পাকস্থলী, খাদ্যনালী, ইসোফেগাস সব পুড়ে দলা পাকিয়ে গেছে। ও এখন খায় তরল খাবার। ভাত, ডাল, মাছ সব গলিয়ে ছেকে সরাসরি ইনটেস্টাইনে নলের সাহায্যে দেওয়া হয়। ওদের বাড়িতে এসব করা সম্ভব নয়, ওদের অবস্থা খুব খারাপ, তাই এখানেই থাকার একটা ব্যবস্থা হয়েছে ওর। তবে এভাবে বেশিদিন চলবে না বোধহয়। পেটে ইনফেকশন ছড়িয়ে যাচ্ছে বারে বারে। এই কেসটা খুবই ক্রিটিক্যাল। অথচ মেয়েটি খুবই শান্ত, আর অসম্ভব সহ্য শক্তি ওর। দেখে এত কষ্ট হয়!”
টনি জং পপির দিকে তাকালেন। মেয়েটি অস্বাভাবিক রোগা। মনে হয় ওজন অসম্ভব রকমের কম। এভাবে খেলে এমনটাই স্বাভাবিক। কালো দুটো চোখ, আর ঢলঢলে মুখ। সে সেলাইয়ের ফ্রেম আটকে সূঁচ সুতো দিয়ে কাপড়ের উপর একটা নকশা করছে। টনির কথা শুনে একবার মাত্র চোখ তুলে চাইল, তারপরেই চোখ নামিয়ে নিল।
জগত বিখ্যাত ডার্মাটোলজিস্ট এবং কসমেটিক সার্জন টনি জং পপির মুখটা দেখে চমকে উঠলেন। আশ্চর্য! মেয়েটির মনে কোনও আশা নেই। সে যেন একটি জীবন্ত লাশ। টনি রাবেয়াকে বললেন,
“মেয়েটির স্বামী এখন কোথায়? শাস্তি হয়েছে তো তার?”
“হ্যাঁ। আট বছরের জেল। বছর সাতের মাথায় জামিনে মুক্তি পেয়েছে। শুনেছি আবার বিয়েও করেছে!” কথাটা বলতে বলতে রাগে রাবেয়ার মুখ লাল হয়ে উঠল।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে টনি রোগী দেখছে। মারাত্মক রকম পুড়ে গেছে যেসব রোগীরা কিংবা অ্যাসিড আক্রান্ত অন্যান্য রোগীদের দেখল সে। কিন্তু কিছুতেই পপিকে ভুলতে পারছে না টনি। পপিকে কানাডা নিয়ে গেলে কেমন হয়? কিন্তু তার জন্য অনেক খরচ। টনি ভাবতে লাগল। তার মনে হল মেয়েটা মানুষকে ভালোবেসে আর বিশ্বাস করে ঠকেছে। মানুষের উপরে ওর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। মেয়েটির চোখে যেন মা মেরির সারল্য। কালো চোখের মেরি!
টনি পপির মায়ের সঙ্গে কথা বলল। টনির ভাষা সে বোঝে না। রাবেয়া তাদের দোভাষী হয়ে কাজ করল। সব শুনে অজন্তা কাঁদতে লাগল। এরপর নানা উদ্যোগের শেষে পপি আর পপির মা অজন্তার পাসপোর্ট তৈরি হল। টনি কানাডা ফিরে যাবার আগেই সব ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে চায়।
পাসপোর্ট দুটো হাতে করে টনি হাসপাতালে এসেছে। তার হাতে একটা বড় শাড়ির প্যাকেট। পপি আর তার মায়ের জন্য শাড়ি কিনে এনেছে। টনি পপির মুখে স্বাভাবিক আশার আলোর দীপ্তি দেখতে চায়। মেয়েটা শাড়ি পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়নি। তার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতেও তাকায়নি। পপির দৃষ্টি নির্লিপ্ত। টনির বয়স চুয়াল্লিশ। সে জীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত সয়েছে। মানুষের এমন নির্লিপ্ত দৃষ্টি তাকে পীড়িত করে। টনি পাসপোর্ট দেখিয়ে পপিকে বলে চলে অনেক কথা।
‘তোমাকে সুস্থ হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে’। হঠাৎ মনে পড়ে যায় তার পপি তার ভাষা বোঝে না। টনির খুব কষ্ট হয়। ভাষা একটা দুস্তর ব্যবধান! আজ তাদের মাঝে রাবেয়া উপস্থিত নেই। শাড়ি দুটো নিয়ে সে অজন্তার হাতে দিয়ে হাত দুটো চেপে ধরে তার। অজন্তা হাউ হাউ করে কাঁদে। অজন্তা বলতে থাকে,
“মাইয়াডা জম্মের মতন পঙ্গু হইয়ে গেল। শরীলের ভেতরডা পুড়িছে অর সায়েব! অই পুড়া তো চোক্ষে দেখা যায় না, আসোলি পুড়িছে ওর অন্তরডা! মাইয়াডার পানে চাওন জায় না! য্যান একখান মড়া! ওর অবিচার দেহি ভগমান তুমারে পাঠায়ছে সায়েব, ভগমান নিজির হাতে তো কিছ্ছু করে না! মানষেরে পাঠায়ে দেয়!”
টনি ওর অন্তর দিয়ে কথাগুলো কিছুটা উপলব্ধি করেছে। একটু পরে সব ব্যবস্থা করবে বলে আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিল টনি।
দীর্ঘ একবছর ধরে ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকে প্রচার করে টনি বেশ একটা ভালো পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে ফেলল পপির জন্য। এ ছাড়া পপির কথা শুনে বাকি ডাক্তার ও হাসপাতাল কতৃপক্ষও টাকা মকুব করতে রাজি হয়েছে।
অবশেষে কানাডার টরেন্টোর পিয়ারসন এয়ারপোর্টে এসে নামল পপি আর তার মা। পপি কথা খুব কম বলে। বেশি কথা বলতে তার গলায় কষ্ট হয়। এতটা পথ আসতেও তার খুব কষ্ট হয়েছে। পপি স্বাভাবিকভাবে খাবার খেতে পারে না। গোটা রাস্তাতে সে গুঁড়ো দুধ জলে গুলে বাথরুমে ঢুকে পেটের নলের ভেতর তা ঢুকিয়েছে। এতটা পথ একা আসতে পারবে না মনে করে টনি তাদের নিতে এসেছে।
পপি এয়ারপোর্টে নেমে অবাক হয়ে যায়, সত্যিকারের তাদের নিয়ে এতদূরে এসেছে লোকটা! সত্যিই বিদেশের মাটিতে নেমেছে তারা! এত খরচ করেছেন এই লোকটা! পপির অবিশ্বাস্য লাগে পুরো ব্যাপারটা। কেন এই ডাক্তারবাবু তাদের জন্য এতটা করছেন? পপি তো সুন্দর নয়! কালো, রুগ্ন, শুকনো চেহারার একজন মৃতপ্রায় মানুষ! পৃথিবীতে তাহলে এখনও এত ভালো মানুষ আছেন? যিনি বিনা স্বার্থে পরের জন্য জীবনপণ করে কাজ করেন? পপির যেন কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না।
পপির থাকার ব্যবস্থা করেছেন কানাডার বাংলাদেশ কমিউনিটির মানুষেরা। একটা বেশ বড় ফ্ল্যাট ঠিক করে দিয়েছেন তারা। পপিকে সুস্থ হতে এখন অনেকদিন কানাডায় থাকতে হবে।
নিজের দেশের লোকজনেরা যখন সবাই মিলে এসে তার কাছে টনির প্রশংসা করতে লাগল তখন গর্বে পপির বুক ভরে উঠল। ইতিমধ্যে টনি নাকি একটা ফান্ডও গড়ে তুলেছেন। ফান্ডের নাম ‘পপি ফান্ড’। তাতে এখনও পর্যন্ত সাত লক্ষ ডলার জমা পড়েছে। এ ছাড়া জার্মানির মিউনিখের একজন অ্যানাস্থেসিস্ট ডঃ হোলস্টেইনার ও তাঁর বোন এই মহান কাজের জন্য দিয়েছেন আরও সাতাশ হাজার ইউরো। এত টাকা পয়সার হিসেব পপি বোঝে না। বুঝতেও চায় না। কানাডায় এসে তার টনির প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা হয়েছে। এতদিন সে টনির বলা কোনও কথা বিশ্বাস করেনি। পপি অনেকদিন পরে কাউকে এখন বিশ্বাস করতে পারছে। তার খুব ভালো লাগছে। এত বছর পরে হঠাৎ তার মনের ভেতর আনন্দের অনুভূতি জেগে উঠেছে। তাকে ঘিরে চারিদিকে যেন সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। গরিব দেশের সামান্য মেয়ে এখন নায়িকার ভূমিকায়। তবে এইভাবে পাদপ্রদীপের তলায় নায়িকা হওয়া এক দুঃসহ অভিশাপ। অভিশপ্ত পপির শাপ মুক্তি কি ঘটবে? সে কি সুস্থ জীবন ফিরে পাবে?
এখানে আসার পর রোজ হাসপাতালে যেতে হচ্ছে পপিকে। চারপাশটা এখানে দারুণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চমৎকার নীল আকাশ। কোথাও এতটুকু ধুলো নেই। গোটা দেশটা যেন সাবান জলে ধোওয়া। ভারী পছন্দ হয়েছে পপির। প্রতিদিনই নানা রকম পরীক্ষা চলছে তার। ডাক্তার হেলথ ড্রিঙ্ক খেতে দিয়েছেন পপিকে। সে বড়ো রোগা। এত বড়ো অপারেশনের ঝক্কি সামলাতে তাকে একটু ওজন বাড়াতেই হবে।
শীতের দেশের নরম বিছানায় মায়ের পাশে শুয়ে শুয়ে পপি রোজ স্বপ্ন দেখে। এক অপরূপ লম্বা পুরুষ এসেছেন তার কাছে। তার শরীর আলোয় ভরা। পপি জোড় হাতে প্রণাম করে সেই আলোকিত ঈশ্বরকে। হঠাৎ সব আলো নিভে যায়, পপি দেখে তার সামনে ঈশ্বরের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ডাঃ টনি জং।
একমাস কেটে গেল। অবশেষে পপিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। হাসপাতালের নীল পোশাকে তাকে আরও অসহায় আর রুগ্ন দেখাচ্ছে। পপির চুলগুলো শক্ত করে বেঁধে দিয়েছেন নার্স। পপি একবার অসহায় ভাবে টনির দিকে তাকালো। টনি হাত নেড়ে তাকে সাহস দিল। পপির পরনে ওটির নীল রংয়ের পোশাক। ডঃ গিলবার্ট আর গোল্ডস্টেইনের সঙ্গে ওটিতে এসেছেন টনিও। এখানে প্রথমে লোকাল অ্যানাসথেশিয়া করে পপির বাঁ হাতের খানিকটা চামড়া কেটে নেওয়া হবে। সেখান থেকে কোষ নিয়ে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে খাদ্যনালী, পাকস্থলী, শ্বাসনালী এইসব আবার তৈরি করা হবে। চারদিকে ফর্সা আর উজ্জ্বল মানুষের ভিড়ে পপি কেমন যেন ভয় পায়। পপির হাতে অ্যানাস্থেশিয়া করা হল। পপি এতদিন একটুও ভয় পায়নি, আজ তার হঠাৎ খুব ভয় করছে। সে বাঁচতে চায়। পপি তার পাশে দাঁড়ানো টনির হাতটা ডান হাতে শক্ত করে ধরে রাখে।
টনি পপির চোখে চোখ রাখে। টনি বোঝে মেয়েটা ভয় পেয়েছে। টনি পপির হাতে রাখে তার ভরসার হাত। হঠাৎ পপির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয় টনি। আশ্চর্য! কয়েকদিনেই মেয়েটার মুখে এসেছে জীবিত মানুষের মতো দীপ্তি! যা এতদিন টনি কখনও খুঁজে পায়নি। টনি শপথ করে এই সুন্দর দীপ্তিকে সে বাঁচিয়ে রাখবে, কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে না। সুস্থ হলেও যাতে পপি দেশে ফিরে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে সেই ব্যবস্থাও এবার তাকে করতে হবে। টনি পরম মমতায় পপির মাথায় হাত রাখে, ভালোবাসা আর আশ্বাসের হাত। অনেক বছর পর পপির দু চোখ জলে ভরে ওঠে। সে নীরবে কাঁদতে থাকে।
……………………..
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment