রিনি যে একেবারেই রাঁধিতে জানে না, রিনির মতে ইহা কেবল অর্ধসত্যই নয়, সত্যের অপলাপ মাত্র। সত্যটি হইলো এই যে, তাহার মাতা তাহাকে কিছুতেই রাঁধিতে দেন না! রাঁধিতে না পারা এবং রাঁধিতে না দেবার মধ্যে যে বিস্তর প্রভেদ, চৌদ্দ বৎসরের রিনি তাহা বিলক্ষণ জানে। সে এইবৎসর রাণী দাক্ষায়ণী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে বাৎসরিক পরীক্ষায় প্রথম হইয়া অষ্টম শ্রেণীতে উঠিয়াছে৷ তাহার জ্ঞানবুদ্ধি সম্পর্কে তাহার বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের যাহা ধারণা তাহার সম্পুর্ণ বিপরীত ধারণা পোষণ করেন তাহার মাতা। রিনির বিরুদ্ধে তাহার অভিযোগের অন্ত নাই।
রিনি অমনোযোগী, বই হাতে পাইলে সে মাতা পিতার পার্থক্য বুঝে না। মুখে গল্পের বই লইয়া খাইতে বসে, ফলতঃ মাছের ঝোলের পরে সুক্তানি খায়, চাটনি ডালনা দিয়া মাখিয়া খায়। মাঝে মাঝে বইপত্রও খাদ্যের অংশ পায় বই-কি!
নিরপেক্ষভাবে দেখিতে গেলে মায়ের দোষ খুব বেশি দেওয়া যায় না। মা তাহাকে রান্নার সহকারী হিসেবে যতবারই লইয়াছেন, রিনি প্রতিবারই শূন্য পাইয়া অকৃতকার্য হইয়াছে।
প্রথমবার রিনি চা করিতে গিয়া চা পাতার পরিবর্তে কালোজিরা দিয়াছিলো। দুধের বর্ণ পরিবর্তনের পরিবর্তে বর্ণবিপর্যয় হইতেছে দেখিয়া সে সমস্ত কালো জিরা ছাঁকিয়া ফেলিয়া পুনরায় চা পাতা দিয়াছিল বটে, কিন্তু কালোজিরার স্বাদগন্ধবিশিষ্ট চা পান করা সহজ ছিল না। ফলে যে দুধটুকু বাঁচাইতে সে চেষ্টা করিয়াছিল, সে সঙ্গে করিয়া চিনি এবং চা পাতাকেও নর্দমায় লইয়া গেলো।
দ্বিতীয়বার রিনি বেসনের পরিবর্তে বাসন মাজার ডিটারজেন্ট বেশ করিয়া গুলিতেছিলো বেগুনি ভাজিবার জন্য। কিন্তু বেসনের মতো আঙুলের সাথে মাখামাখি হইবার পরিবর্তে কেবলই ফেনা উৎপন্ন হওয়ায় তাহার সন্দেহ হয়, বেসন খারাপ কিনা! সেই ঘটনাতেও রিনির মুখ যথেষ্ট পুড়িয়াছিলো। কিন্তু রিনি ভাবিয়াই পায় নাই মাতারাণী বেসনের তাকে ডিটারজেন্ট কেন রাখিয়াছিলেন! দোষ এক্ষেত্রে একা রিনির ছিল না বলিয়াই তাহার দৃঢ় বিশ্বাস।
এ ঘটনারও ছয়মাস অতিক্রান্ত হইয়াছে। গ্যাসের উনানে ভাতের জল বসাইয়া চাল ছাড়িতে বলিয়া মাতাদেবী পূজার ঘরে গিয়াছিলেন। পরেরদিন লক্ষ্মীপূজা, তাই তাঁহার কিছু বিলম্ব হইতেছিল। তাঁর বিশ্বাস ছিল মিনিট পনেরো কুড়ি রিনি নির্ঘাত সামলাইয়া লইবে। কিন্তু বিধি বাম হইলে রিনির কি কিছু করিবার আছে? হাঁড়িতে জল কিছু কম ছিলো, সে ঢাকনা খুলিয়া রাখিয়া জলের উত্তাপ স্ফুটনাঙ্ক অবধি পৌঁছায়নি দেখিয়া চিন্তিত হইয়া থার্মোমিটারের সন্ধানে যাইলো। মনের বাসনা এই যে জলের বর্তমান উত্তাপ পরিমাপ করিবে, স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছিতে আর কত বিলম্ব তাহাও মাপিবে।
থার্মোমিটারের নিমিত্ত রিনিকে কিছু খোঁজাখুঁজি করিতে হইল, কারণ বস্তুটি মাতাদেবী লুক্কায়িত রাখেন। বাল্যকাল হইতেই এই জিনিষটির প্রতি তাহার আসীম কৌতুহল। সাড়ে তিন বছর বয়সে সে থার্মোমিটার ভাঙিয়া দেখিতে গিয়াছিলো, ভিতরের পদার্থটি “জল না কালি?”
তাহার পর বৎসরে গড়ে একটি করে হইলেও প্রায় দশটি থার্মোমিটার নষ্ট করিয়াছে, কোনটি পোষা বিড়ালের জ্বর মাপিতে, কোনটি বা লম্ফের ভিতর ঢুকাইয়া কাচের প্রসারণশীলতা দেখিতে।
থার্মোমিটার খুঁজিয়া না পাইলেও সে পাইলো টিনটোরেটোর যীশু বইটি। এটি তাহার ভাইফোঁটার প্রাপ্তি, পরীক্ষা শেষ হইলে পড়িতে পারিবে এই শর্তে মাতা লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন।
তৎক্ষনাৎ রিনি ফেলুদা তোপসের সহিত রহস্যভেদে নামিলো। টিনটোরেটোর যীশুর আসল চিত্র আর নকল চিত্রের রহস্য ফেলুদা ভেদ করিয়াছেন, রিনি তাহাদের সহিত চীন ভ্রমণে রওনা হইবে হইবে, এমন সময় হাঁউ মাঁউ খাঁউ করিয়া মাতৃদেবীর রান্নাঘরে প্রবেশ! রিনি ছুটিয়া রান্নাঘরে গিয়া এক বিজাতীয় গন্ধ পাইলো। মায়ের ভর্ৎসনা অতিরিক্ত।
“এই মেয়ে নিয়ে কী করি আমি? জল শুকিয়ে হাঁড়ি পুড়ছে, মেয়ে গল্পের বই গিলছে! আমি ঠাকুরঘর থেকে পোড়া গন্ধ পাচ্ছি, ইনি পাশের ঘরে বসে জানে না! বলি হুঁশ কবে হবে? আর কতদিন কচি খুকি সেজে থাকবি? কখন ভাত চড়াবো, কখন খাওয়া দাওয়া মিটবে? পুজোর কাজ শেষ হয়নি এখনো....”
নেহাৎ ঠামির মত ভালোমানুষ এসে উদ্ধার করিলেন, নইলে সেইদিন বুঝি রিনিরই মাথা সিদ্ধ খাইবার তাল করিতেছিলেন মা জননী।
সেই অবধি রান্নাঘরের যাবতীয় কার্যে রিনির সহযোগিতা সর্বাঙ্গীনভাবে ত্যাগ করিয়াছেন মাতা তাহার। অথচ রিনি দূরদর্শনে ‘রান্নাঘর’ অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক। রংবেরঙের নব নব স্বাদের নতুন রান্না আবিষ্কার করা তাহার জীবনের লক্ষ্য। সে জানে, শুভ কাজে বাধা আসা চিরকালীন সমস্যা। এবং এই বাধা ঘরের লোকের কাছ হইতেই আসিয়া থাকে। তাই সে দমিল না। সে ঠামিকে প্রায় কব্জা করিয়াই ফেলিয়াছিল তাহার প্রস্তুত খাদ্যবস্তু গলঃধকরণ করিবার নিমিত্ত। কিন্তু রিনির প্রতি ভাগ্যদেবী সত্যই সুপ্রসন্ন নহেন। একবার আদার পরিবর্তে গাঁটিকচু থেঁচিয়া দেওয়া চা পান করিয়া আরেকবার নুন বিহীন আধপোড়া আধকাঁচা আলুভাজা গলঃধকরণের পরে ঠামিও দ্রুত জার্সি বদল করিয়া মাতৃদেবীর দলে নাম লিখিয়াছিলেন।
এহেন রিনির ভাগ্যে জুটিল বিদ্যালয়ের বনভোজনের দায়িত্ব। বাড়ি হইতে তীব্র আপত্তি উঠিয়াছিল বটে কিন্তু বনভোজন বিদ্যালয় প্রাঙ্গনেই হইবে আর রিনি আর দুই একমাস পর নবম শ্রেণীতে উঠিয়া শাড়ি পরিয়া বিদ্যালয়ে যাইবে, তাই ‘যথেষ্ট বড়’ রিনি ঠামির সহায়তায় অনুমতি পাইলো। তবে তাহাতেও পীরবাবাকে সোয়া টাকার খুরমা ঘুষ দিতে হইয়াছিল বইকি!
পূর্বেই বলিয়াছি বিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের সুবর্ণা চক্রবর্তী ওরফে রিনির ওপর অগাধ আস্থা। রিনির নিজের উপরেও আস্থা কিছু কম নহে। কিন্তু বনভোজনের সকাল বেলায় এই আস্থায় চিড় ধরাইলো বন্ধুনীরা যখন তাহারা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইয়া সারি সারি তালাবন্ধ ফটকের সম্মুখীন হইলো। ছুটির দিনে বিদ্যালয় তালাবন্ধ থাকিবে তাই চাবির ব্যবস্থা করা সর্বপ্রথম প্রয়োজন, এই প্রয়োজনীয় কথাটি রিনি ভাবে নাই। প্রায় সোয়া মাইল দূর হইতে চাবি আনিয়া ফটক খুলিতে বিলম্ব হইলো কিছু। তবু রিনির আনন্দ দেখে কে!
রোজকার কোলাহল মুখরিত বিদ্যালয়টি কাহার যেন যাদুকাঠির ছোঁয়ায় সম্পূর্ণ মুক হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। শ্রেণিকক্ষের দরজাগুলি তালাবন্ধ। তাহারা ছাড়া আর জনপ্রাণী নাই। সেইদিনের জন্যে পুরো বিদ্যালয়ের মালিকানা তাহারাই যেন পাইয়াছে। নিজেদের কন্ঠস্বর নিজেদেরই কাছে অপরিচিত লাগিতে লাগিলো।
পুলকিত চিত্ত রিনি এবং তাহার বন্ধুনীরা দ্রুত তিনটি দলে বিভক্ত হইয়া কাজ শুরু করিলো। একদল মাংস কিনিতে বাজারে গেলো, আরেকদল উনান খুঁড়িয়া কাঠে কেরোসিন সহযোগে উত্তুরে বাতাসকে ফাঁকি দিয়া উনান জ্বালাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলো। বাকিরা রান্নার জোগাড় করিতে শুরু করিলো।
রিনির ভারি মজা। আজ সে অকুতোভয় হইয়া রান্না করিবে! মায়ের বাধা বা সাবধানবাণী এখানে নাই। সে আজ সবার জন্য ম্যাগি বানাইবে!
ম্যাগি বস্তুটি তখনো এত খোলামকুচি হয় নাই। তাহার আভিজাত্য কিছুটা হলেও বজায় ছিল। পাঁচ টাকার ম্যাগির প্যাকেটে বায়ুর সহিত যথেষ্ট পরিমানে খাদ্যবস্তু থাকিত। রিনি এগারোজনের জন্য আটপ্যাকেট ম্যাগি চল্লিশ টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করিয়াছিলো। তাহার কিছু অভিজ্ঞ বন্ধুনী বারংবার কচুরি জিলিপি এবং মুড়ি ঘুগনির পক্ষে সওয়াল করিয়াছিল বটে কিন্তু নতুন কিছু করিবার আশায় রিনি বদ্ধপরিকর। কিছুতেই সে তাহার পরিকল্পনা হইতে বিচ্যুত হইলো না।
উনুন জ্বলিবামাত্র রিনি কড়াইতে জল বসাইলো। কাঠের কেরোসিনের অংশ জ্বলিবার পরে উনুন নিভিলো। আবার কেরোসিন, আবার আগুন এই করিয়া বার পাঁচেকের চেষ্টায় আগুন জ্বলিলো। এক গামলা জল বসাইয়া জল ফুটিবার তর সয় না রিনির। কতক্ষণে সকলকে এই স্বর্গীয় স্বাদ আস্বাদন করাইবে!
জল ফুটিবার পূর্বেই আটটি ম্যাগি জলে সাঁতার কাটিতেছিলো। রিনি হাতা দিয়া প্রতিটি সুতোকে পৃথক করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু সুতলিগুলি বোধকরি হাতার হাতাহাতিতেই ভীত হইয়া এমনভাবে পরষ্পরকে আঁকড়াইয়া ধরিলো, রিনি হার মানিলো!
তাহার আর পর কি? প্রতিটি বন্ধুনীর পাতে একটি করে ম্যাগির মণ্ড পরিবেশিত হইলো। তাহারা বহু চেষ্টা করিয়াও গিলিতে পারিলো না। তাই ‘জীভে প্রেম’ ছেড়ে তাহারা ‘জীবে প্রেমে’ মন দিলে। কিন্তু ভাগ্য রিনির। কাক পক্ষীতেও ঠোঁট ফিরাইয়া চলিয়া গেলো। এ স্বাদের ভাগ কেউ লইতে রাজী হইলো না!
বলাই বাহুল্য, ইহার পরে টিউবওয়েল হইতে জল আনা এবং উনানে কাষ্ঠ খন্ড গুঁজিয়া দেওয়া ছাড়া রিনিকে কোন কাজ করিতে দেওয়া হইলো না।
রিনি মনে মনে বহু অভিশাপ দিয়াছিল। তাহার অভিশাপ ফলিলে রান্নাগুলি জ্বলিয়া পুড়িয়া খাক হইয়া যাবার কথা। কিন্তু ঘোর কলিকাল! গান্ধারী বা দুর্বাসা, কাহারোও শ্রাপের ফল মেলে না।
নির্বিঘ্নে চাটনি, বাঁধাকপি, মাংস নামিলো। ভাত হইলেই পাঁপরভাজা হইবে। বসিবার বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব রিনির ওপর দেওয়া হইলো। ভাতের জল ফুটিতেছে। হঠাৎ বিদ্রোহী রিনি! ভাতের মত এমন ‘জলভাত’ বস্তুটিও সে রাঁধিতে পারে না!
সে বহু তর্কবিতর্ক করিলো। সমালোচকরা অবশ্য তাহা কাকুতিমিনতি বলিয়া ভুল করিয়াছিলেন। অবশেষে রাঁধুনি বন্ধুনী তাহাকে ভাতে নজর রাখিবার দায়িত্ব দিয়া টিউবওয়েলে হাত মুখ ধুইবার নিমিত্ত গেল। বারংবার রিনিকে সাবধান করিয়া দিল, সে ভাত নামাইবার চেষ্টা না করে!
রিনি তাহাকে আশ্বস্ত করিলো। ভাত ফুটিতেছে বগবগ করিয়া। কাঠের উনুনের জ্বাল হাঁড়ির চারিপার্শে ছড়িয়ে পড়িয়াছে। হঠাৎ করিয়া রিনির মাথায় জলের তাপের কুপরিবাহিতার তত্ত্ব আসিলো। জল তাপের কুপরিবাহী, সে জানে। জলের কণাগুলি নিজেই উত্তপ্ত হইয়া উপরে ওঠে। কাহাকেও তাপ দেয় না। উপরে উঠিলে উপরের জলের কণাগুলি নীচে নামিয়া যায় উত্তাপের নিমিত্ত। রিনি ভাবিতেছিল ব্যাপারটি বড়ই সময় সাপেক্ষ। সে যদি হাতা দিয়া জলের উঠানামায় কিছু সহায়তা করে, ক্ষতি কী? ভাবিবামাত্র কাজ! সে ক্রমাগত হাতা দিয়া জল নাড়িতে লাগিলো।
তাহার বন্ধুরা তাহার উপর নজর রাখিতেছিল। সে ভাতে হাতাহাতি করিতেই রে রে করিয়া ছুটিয়া আসিল। কী করিতেছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে অকুতোভয় বিজ্ঞানমনস্ক রিনি জানাইলো, ‘তাপের সমবন্টন’।
কিন্তু সকলেই রিনির মত বিজ্ঞানের পুজারী নহে। স্পষ্টতই তাহারা জানাইলো, ম্যাগির পিণ্ড খাইতে পারেনি তাহারা। এক্ষণে ভাতের ইডলি খাইতে কাহারো মন নাই। রিনি যদি রান্না হইতে দূরে থাকে, তবেই তাহারা মধ্যাহ্নের পেটপুজো সারিতে পারে!
অভিমানে রিনি দূরে গিয়া ভাবিতেছিল, হায় রে ক্ষুধা! বিজ্ঞান অপেক্ষাও বড় হইয়া যায় কখনো!
সেইদিন যাহারা সোৎসাহে বাজার করিয়াছিল, আজ তাহারা অনলাইন বাণিজ্যে থিতু হইয়াছে। যাহারা মাংস রান্নার দায়িত্বে ছিল আজ হাঁড়িভর্তি বিরিয়ানি পোলাও অনায়াসে নামাইতে পারে। কিন্তু ভাত রাঁধিতে থার্মোমিটারের প্রয়োজন অনুভব করা রিনি আজ বিজ্ঞানের গোলকধাঁধায় কোথায় হারাইয়া গেছে, তাহার আর খোঁজ পাওয়া যায় না।
……………
অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment