মালতিবালার বিষণ্ন চোখ দুটো পুবের জানলা দিয়ে সুদূরে দৃষ্টি মেলে শূন্যে ঘোরা ফেরা করছে। সেই দৃষ্টিতে একটা চাপা স্তব্ধতা। কখনও অনন্ত কখনও প্রধানকাকা সেই শূন্যতায় উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বাহান্নর মালতিবালার বুকের ভেতর থেকে।
গুঁড়ি বাজার গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান রাধনাথ মান্না এই মুহূর্তে মালতিবালার সামনে মাদুরে বসে আছে।
“অনন্ত কাকা এখন খুব অসুস্থ। তার ওপর এই বয়সে সঙ্গিবিহীন ওই বাড়িটায় একা দিন কাটাচ্ছে। সোমা এখন উপযুক্ত হয়েছে। কাকাকে নিয়ে আসুন এখানে। আপনাদের......”
মালতিবালা শীর্ণ হাত নাড়িয়ে নীরবে তার অপমানের জবাব দেবার জন্য বিষাদ মাখা চোখ দুটো তুলে ওর দিকে চাইলো, “রাধনাথ, আমার হাতে তো কিছু নেই। উনি আমাদের যে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা দিয়েছেন আজ তার ফল পাচ্ছেন। ছোট্ট সমুকে নিয়ে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি তখন উনিতো বাধা দেন নি! আমার কথা বাদ দাও ওঁর ভালোবাসা তো মেয়েকেও বেঁধে রাখতে পারেনি। মেয়ের খোঁজ পর্যন্ত কোনোদিন নিলেন না। আমাদের কীভাবে চলছে জানতেও চান নি। প্রধান কাকাকে মনে আছে নিশ্চই। উনি অনেক বুঝিয়েছিলেন। তখন তোমার কাকা বলেছিলেন, “বাড়ির মেয়েছেলে যখন তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেছে তখন ঝিগিরি করুক কী অন্যের বিছানায় শুয়ে রোজগার করুক আমার কিচ্ছু এসে যায় না। মেয়ে নিয়ে মরলেও দেখতে যাবো না”--এর পর ও কি ও বাড়ি যাওয়া যায় রাধনাথ?”
মালতিবালার বুক নিংড়ানো এক কষ্টের অনুভূতি রাধনাথকে বোধ হয় ছুঁয়ে গেল। মাথা নিচু করে বসে রইল। মালতিবালা অপাঙ্গে রাধনাথকে দেখলো তারপর করুণ চোখে বলল, “রাধনাথ, তোমরা শুধু এখনকার অনন্তকে দেখলে আর আঠারো বছরের মালতিবালা যখন নিরাশ্রয় হয়ে এক ফোঁটা মেয়েকে নিয়ে অপমানের বোঝা মাথায় করে বাড়ি ছেড়েছিল তার বিচার করলে না তো!”-- দুই চোখ দিয়ে রাগ, অভিমানের জল ঝর ঝর করে পড়ছে---- আঠারোর মালতিবালার অপমান বাহান্নতে এসে সত্যি কী ম্লান হয়ে যেতে পারে!
নীরবতার ও একটা ভাষা আছে। সেটা বুঝতে পেরেই বোধকরি রাধনাথ ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
গোধূলি পার হয়ে সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। মালতিবালা চুপ করে নিঃসাড়ে বসে আছে। মনটা অবসাদে বিবশ হয়ে রয়েছে। কতকাল কেটে গেল....এখনও মনে হয় সেদিনের ঘটনা.....
“দুই এককে দুই”
“দুই এককে দু......ই”
“দুই দুগুণে চার”
“দুই দুগুণে চা.....র”
একফালি বারান্দায় উনুনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে মালতিবালা মেয়ে সমুকে মুখে মুখে নামতা শেখাচ্ছিল।
“বৌমা....অ বৌমা!!”
“বলুন মা”-নিরাসক্ত গলায় মালতিবালার কথা ভেসে এল।
“বলি মেয়ে কে কি জজ বারিস্ট বানাবে?”
উনুনের গনগনে তাপে মালতিবালার মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল। শাশুড়ির বাক্যবাণে মাথাটাও তপ্ত হয়ে গেল।
“কপালে থাকলে হবে। আপনাদের আশীর্বাদ তো জুটবে না। চেষ্টা করি যদি হয়।”
শাশুড়ির গজরানির মধ্যেই মালতিবালা মেয়েকে নামতা শেখানোয় মন দিল।
মেয়ে আজ “জজ বারিস্ট” না হলেও ঠাকুমা, বাবা, পিসিদের অফুরান অভিসম্পাত ওকে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। সোশিওলজিতে মাস্টার্স করে সমু থিসিস করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ সমুর নারী হয়ে উঠার বীজমন্ত্র মালতিবালা। মায়ের সংগ্রাম ওকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। কত যন্ত্রণা সহ্য করে আজ মালতিবালা জয়ী। মালতিবালার মনে পড়ে সেই দুঃসহ স্মৃতি, তার সেই অন্ধকারময় জীবনকে।
পনেরো বছর বয়সে মালতিবালার বিয়ে হয়। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে পনেরো বছর বয়সটা নারীত্বের ঘোষণা করে। তাই ফুলশয্যার রাতেই মালতিবালা বুঝে গিয়েছিল যে তার স্বামীর কোনও গোপন অসুখ আছে যা বিয়ের সময় লুকোনো হয়েছিল। অষ্টমঙ্গলাতে বাপের বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি নিয়ম নেই বলে।
“মা আপনার ছেলে কী অসুস্থ?”--রান্নাঘরে ঢুকে মালতিবালা সরাসরি শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করেছিল।
“অসুখ? না-নাতো!”--শাশুড়ির কথার ধরণে পনেরোর বালিকাবধূটি বুঝে গিয়েছিল তাকে কিছু গোপন করা হচ্ছে।
“তবে রোজ রাতে কিসের ওষুধ খায় সে? জিজ্ঞেস করলে বলে ভিটামিন।”
“ওর দুর্বল লাগে তাই ডাক্তার ভিটামিন দিয়েছিল। এ আবার কী এমন গুরুতর কথা বৌমা।” শাশুড়ির মুখে এই কথা শুনে মালতিবালা চুপ করে যায়। কিন্তু গল্পচ্ছলে ডাক্তারের নাম জেনে সেখানে গিয়ে সব শুনে স্তম্ভিত। ওর স্বামী সঙ্গম ও সন্তানধারণে অক্ষম। একটা যন্ত্রনা ওর সারা শরীরে বিঁধতে থাকে। মেয়ে সন্তান হলেই বিয়ে অনিবার্য আর কোনও পুরুষকে অবলম্বন না করে বাঁচা যাবে না বাবার এই ভাবনার জন্যই জীবনটা আজ ওর ওলটপালট হয়ে গেল।
এই বিয়ের চরম নিষ্পত্তির পর মালতিবালা নিজেকে সমাজের কাছে পরিবারের কাছে স্বাবলম্বী প্রমাণিত করতে অনেক বাকযুদ্ধ করে তবে বিধাননগরে রমণীমোহন দাদুর বাড়ি কাজে লেগেছিল। সে ও মাস ছয়েক পর আবার বাবার চাপে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
“মা, সমাজ বড় কঠিন জায়গা। মেয়েরা একা থাকলে শ্বাপদরূপী মানুষ ছিঁড়েখুড়ে শেষ করে দেবে। তোর বিয়ে না দিলে আমি যে মহাপাতক হবো। আর সবাই তো এক নয়। এবার ভালো হবে।”
বাহান্নর মালতিবালার ঠোঁটের কোণে এক বুক অভিমান, কষ্টের হাসি ফুটে উঠল। বাবার সেই কথাটা কানের ভেতর বেজে উঠছে, “এবার ভালো হবে।”
গুঁড়িবাজারের ছেলে অনন্ত পালিত। স্টেশন চত্বরে মুদিখানার দোকান। সম্পন্ন না হলেও অভাবীও নয়। দোকানটা বেশ তরতরিয়ে চলে। বরের বয়সটা একটু বেশি। কিন্তু বিয়ের পর মালতিবালা বুঝেছিল এবারেও ভালো হল না। বাবার আশীর্বাদের জোরটা জোরদার নয়। রমণী দাদুকে অন্য লোক দিয়ে চোখের জল নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। শাশুড়ির কটকটি মালতিবালার জীবন আঠারোতেই খরখরে করে দিয়েছিল। স্মৃতির মালা গাঁথতে গাঁথতে মালতিবালার হাসি পেল।
সমুর শ্লেট পেন্সিল শাশুড়ি উঁচু তাকে তুলে রাখত। এরকমই একদিন সমুর হাত থেকে শ্লেট পেন্সিল ছিনিয়ে নিতেই চিৎকার করে উঠল সমু।
“মা...ওমা... ঠাকমা আমার শ্লেট পেন্সিল নিয়ে নিল।”--বলে সমু কাঁদতে শুরু করল।
মালতিবালা এক ঝটকায় উনুনের সামনে থেকে উঠে শাশুড়িকে বলেছিল, “মা... শ্লেট পেন্সিল এখানে নামিয়ে রাখুন। নামান।”
“শোনো বৌমা, এসব নেকা পড়া আমার সংসারে কোনও মেয়ে করেনি সমুও করবে না। এই অনাছিসটির কাজ করতে গিয়ে সংসারের কাজের ঘাটতি পরচে দেখতে পাচ্চ নি। এ আমি হতে দেব না।”
“আপনার সংসারের কোন কাজটা অসার হয়েছে শুনি। আর একটা কথা শুনে রাখুন, মেয়ে পড়াশুনা করবে না, মেয়ে এই করবে না দ্বিতীয় দিন যদি শুনি আপনার সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দেব।”--যত না শাশুড়ির গলা তার দ্বিগুন জোরে মালতবালার শাসানি শোনা গেল।
“আসুক ছেলে বাড়ি। দেকব কে কার সংসারে আগুন জ্বালায়!”--বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
সত্যি ভদ্রমহিলার অভিশাপের জোর ছিল আর ছেলেও তার জোরেই চলতো। নয়ত কী আর....সমু মশারির ভেতর ঘুমে আচ্ছন্ন। মালতিবালা ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু এঁকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল।
তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “একটা কথা বলার ছিল।”--সেই কথার মধ্যে একটা নির্লিপ্তি জড়িয়ে আছে। মা ছেলে ক্রূর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল।
“বিনোদিনী প্রাইমারি বালিকা বিদ্যালয়ের বড়দিমনির সঙ্গে কথা বলে এসেছি। তিনি সমুকে ভর্তি নেবেন বলেছেন। ফিস লাগবে না কিন্তু ভর্তির সময় অল্প কিছু দিতে হবে। টাকাটা দিলে ভালো হয়। আর দেবে না যদি পণ করে থাক তবে আমি বিয়ের দুল বেচে দেব। কী করতে চাও জানিও। আর মা সমুর শ্লেট পেন্সিল যেখানে রেখেছেন সেখান থেকে নামিয়ে রাখবেন। কাল সকালেই বড়দিমনি যেতে বলেছেন। সমুকে পড়াবেন।”--খুব শান্ত ভঙ্গীতে কথাগুলো বলে ঘরমুখো হতেই শাশুড়ি বলে উঠল, “আমাকে হুকুম করচ। তোমার সাহস তো বড় মন্দ নয়!”
শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আরও শান্ত ভঙ্গিতে মালতিবালা বলল, “হুকুম করতেও একটা সম্পর্ক লাগে যার জোরে শাশুড়ি হলেও তাকে হুকুম করা যায়। সেক্ষেত্রে সম্পর্ক টা মা মেয়ের মত হয়। এখানে তো তা সম্ভব নয় তাই হুকুম নয়। শুধু শ্লেট টা নামিয়ে দিতে বলেছি।”
আজ এই জীবনের সায়াহ্নে এসেও মালতিবালা সেদিনের অনন্তর ক্রূর কুটিল মুখভঙ্গি মনে করে শিউরে ওঠে।
সেই মুহূর্তে অনন্ত হিসহিস স্বরে ওর সামনে এসে বলেছিল, “আস্পদ্যা কম তো নয় তোর মাগী!! আমার দেবীর মতো মায়ের মুখে মুখে ঝাঁজানো হচ্ছে! শুনে রাখ, এ বাড়িতে মেয়েরা লেখাপড়া করেনা। সমু আমার মেয়ে। ও পালিত বাড়ির মেয়ে। তাই পড়াশুনা করবে না।”
অনন্তর কদর্য মুখ এবং মুখনিঃসৃত ভাষা শুনে সেদিন মালতিবালার রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল। ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিল, “আমি যে সংসারের ঘানি টানছি মেয়েকে তা করতে দেব না। এটাও শুনে রাখ, সমু আমারও মেয়ে। ও পড়বেই। ওকে আমি রক্ত জল করে হলেও পড়াব। দেখি তোমরা কী করতে পারো। আর একটু আগে বললে তো যে ও তোমার মেয়ে সুতরাং ওর লেখাপড়া বাবদ টাকা তোমাকে দিতেই হবে।”
“না.....”-- অনন্ত চিৎকার করে উঠেছিল।
মালতিবালা ক্লান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিল, “বেশ!!!”
গুঁড়ি বাজারের পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন স্বপন জানা। এলাকায় প্রধানবাবু বলেই পরিচিত ছিলেন। মালতিবালার মনের আয়নায় প্রধানকাকার স্মিত সৌম্য চেহারাটা ভেসে উঠল। সেই ঘটনার পরের দিন সকালে সমুকে নিয়ে মালতিবালা বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে যে বেরিয়ে এসেছিল তারপর থেকে স্কুলের বড়দি আর এই মানুষটার স্নেহছায়াকে সঙ্গী করে প্রতিটা দিন যাপন করেছিল। ওদের বাড়ি গিয়ে প্রধানকাকা অনন্তকে অনেক বুঝিয়েছিলেন।
শাশুড়ি মন্তব্য করেছিল, “আপনি হঠাৎ বউয়ের হয়ে ওকালতি করতে এসেচেন কেন জানতে পারি কি?”
“ওকালতি করতে আসব কেন? ছেলের ঘর ভেঙে গেলে কি আপনিও স্বস্তি পাবেন? আমরা গুরুজনেরা যদি এর বিহিত না করতে পারি তবে কি ভালো হয়?”
“ও বউ নিজের দাপট দেকিয়ে বেরিয়ে গেচে। তার জন্য তো আমার বেটা দায়ী নয়! ও আভাগির বেটি কে আমি আর ঘরে তুলব না। আর আপনার সঙ্গেই বা তার কিসের এত ভাব তা তো বুঝতে পারছিনা।”--শাশুড়ির কু-ইঙ্গিতটা সেই দেবতুল্য মানুষটা ধরতে পেরে হালকা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “আপনি যোগ্য মা ই বটে! না হলে মেয়ের মত সম্পর্ক যার সঙ্গে তাকে নিয়ে নোংরা ইঙ্গিত দিতে মুখে বাঁধল না।”
এরপর প্রধানকাকা উঠে পড়েছিলেন। অনন্ত ওর মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলেছিল, “বাড়ির মেয়েছেলে যখন তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেছে তখন ঝিগিরি করুক কী অন্যের বিছানায় শুয়ে রোজগার করুক আমার কিচ্ছু এসে যায় না। মেয়ে নিয়ে মরলেও দেখতে যাব না।” প্রধান কাকা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।
মালতিবালাকে বলেছিলেন, “বৌমা, সংসার বড় কঠিন ঠাঁই। নিজের জনের মধ্যে যখন সন্দেহ প্রবেশ করে তখন ভালোবাসার ইতি ঘটে যায়। মা নিজে যদি পাথর হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে এই ছোট্ট দিদিভাইকে মানুষ করতে পার আমি না থাকলেও সেদিন বুঝবে তুমি জয়ী হয়েছ, পঙ্কিল সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পেরেছ।”
হাতের উপর নিজের অজান্তে চোখের জল পড়ল মালতিবালার। নিঝুম সন্ধেটা আরও বিষণ্ন হয়ে উঠল। অনন্ত কি কোনদিনও ওর নিজের জন হতে পেরেছিল!! নাঃ। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
লোহার গেট খোলার আওয়াজটা কানে এল। কিন্তু বুকের যন্ত্রণাটা মনের এমন গভীরে ছুঁয়ে রয়েছে যে উঠতেও ইচ্ছা করল না।
“মা... মা .... তুমি আলো না জ্বালিয়ে বসে আছ??” -- সমু ঘরে ঢুকে মায়ের নিশ্চল মূর্তি দেখে থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। মেয়ে ঘরের আলো জ্বালাতেই মালতিবালা নিজের গর্ভের সন্তানকে নির্নিমেষ চোখে দেখছিল। ঝকঝকে তারুণ্যের লালিমা গাল বেয়ে চিবুকে আভা ছড়াচ্ছে। চলনে কথনে এক অসামান্য ব্যাক্তিত্ব ঝরে পড়ে। চোখটা মালতিবালার ঝাপসা হয়ে এল। মেয়ের কথায় সম্বিৎ ফিরল।
“এমনি বসে আছি। আয় মা দু’দণ্ড বোস আমার পাশে। সারাদিন কত ব্যস্ত থাকিস। ঘরেতেও ঘাড় গুঁজে খাতা দেখিস, পড়াশুনা করিস! একটু গল্প করি তোর সঙ্গে।”--মালতিবালা ধরা গলায় মেয়েকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল।
সমু হেসে মাকে জড়িয়ে ধরল। আজ যে মা বেসুরে বাজছে বিচক্ষণ মেয়ের বুঝতে এক সেকেন্ড ও লাগল না।
“মা, নিজের কাছেই নিজে ধরা পড়ে গেলে।” মালতিবালা মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। “কালকেই বললে যে আমাকে মন দিয়ে রিসার্চের পেপার ওয়ার্ক করতে। আর আজ অন্য কথা। মা, তোমার মনটা ভালো নেই। তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছ। কী হয়েছে মা?”--একটা নরম আদুরে ছোট্ট মেয়ের গলা যেন মায়ের কানে ভেসে এল।
“রাধনাথ এসেছিল।”
মুহূর্তে আদুরে মেয়েটা কঠিন বাস্তবে ফিরে এল। “আসার কারণ?”
“কারণ তো জানিস।”
সমু কিছুক্ষণ মায়ের হাতটা নিজের কোলে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তারপর বলল,
“মা তুমি কী ঠিক করলে?”
মালতিবালা গভীর চাউনি দিয়ে বলল, “না। সে আর হয় না সমু। যৌবনের নেশা কাটিয়ে যখন এতটা পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছি আর এখন সে ভুল করব না। জানিস মা, আজ রাধনাথ চলে যাওয়ার পর সেই অতীতের পাতা থেকে এক এক করে পর্দা সরে যেতে লাগল। প্রধানকাকাকে মনে পড়ে গেল। কী বেইজ্জতি না হয়েছিলেন! সে কি তুচ্ছ ঘটনা সমু? আমার জন্য সেই অপমান তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আমাকে চলার পথ বাতলে দিয়েছিলেন। সেই দিন কি আমার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে! তোর বাবা, ঠাকমার প্রতি দিনের অপমান, গঞ্জনা আজ ও আমার স্মরণে আছে। শুধু বুক বেঁধেছি তোর জন্য। তুই যে আজ মস্ত বড় হয়েছিস, এতেই আমার সব কষ্ট দুঃখ জল হয়ে গেছে।”
“মা, আমার রিসার্চের বিষয় সিলেক্ট করেছি। সেই ব্যাপারে ঈশানিদির সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম।”
“তুই আরও পড়বি?”--মালতিবালার চোখ বড় হয়ে গেছে।
“মা, এই পড়াটা না করলে আমি কোনদিনও ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাব না। শোনো না আমি কী বিষয় ভেবেছি। এই সমাজের সে গ্রামের হোক বা শহরের সেখানে পরিবারের বাঁধা তুচ্ছ করে যে সব নারী বিশেষ করে মায়েরা সমাজকে প্রাধান্য না দিয়ে সন্তান অর্থাৎ মেয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন তাদের নিয়ে আমার রিসার্চ। তাঁরা যে কেঁদে ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকেন নি এবং এই জেহাদ যে তাঁরা ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের নিয়েই আমার কাজ। অনেক ঘুরতে হবে, জানতে হবে, ডেটা সংগ্রহ করতে হবে। আর মা, আমাদের কথা ও দিদিকে জানিয়েছি আর উনি বলেছেন, “সোমা, তুমি নিজের ঘর দিয়েই কাজ শুরু কর। সফল হবেই।”
এরকম বিষয় নিয়ে রিসার্চ আমি প্রথম করছি। “মা তুমি পাশে থাকবে তো?”
মালতিবালা চোখে জল নিয়ে হেসে উত্তর দিল, “আমি তো পাশেই আছি। আমার জীবনের ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত সবটাই জানবি, লিখবি। গ্রাম শহরের প্রতিটি আনাচে কানাচে জানুক এই সমাজের মেয়েদের সঙ্গে কী হয়! তবুও তারা নারী হতে জানে।”
সমু নিঃশব্দে কাঁদছে। রিসার্চ করবে কিন্তু মায়ের সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছিল তার কি সমাধান করতে পারবে!! পারবে মায়ের বিগত জীবন যৌবন ফিরিয়ে দিতে! তবু......
ভোরের সূর্য রাত্রির মালিন্য কাটিয়ে নতুন একটা দিনের সূচনা করছে। সূর্যের লাল আভায় আকাশ, বাতাস সবকিছুকে কী পবিত্র মনে হচ্ছে! রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি নিমেষে অন্তর্হিত হয়ে গেল। মালতিবালা যেন পুরোনো দিনের জীর্ণতাকে পরিত্যাগ করে নতুনের আবাহনে সূর্য প্রণাম করছে। কী স্নিগ্ধ অনুভূতি!
সমু এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে।
“সমু, জীবনে কি কোনো অন্যায় করেছি? মেয়েমানুষ থেকে নারী হতে চেয়েছিলাম। পারিনি। কিন্তু তোর সোমা হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই স্বাদ আমি অনুভব করছি। হ্যাঁরে মা, পয়ত্রিশের অনন্ত কি সাতষট্টির অনন্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে! পারে না। সে থাক তার মত।”
মালতিবালা সমুর হাত ধরে বলল, “তুই এগিয়ে যা। পেছন ফিরে তাকাস না। সেখানে জমে আছে শুধু জমাট অন্ধকার।”
মা মেয়ে সদরের চৌকাঠ পেরিয়ে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে গেল। সূর্যের আলো ঝিকমিক করে হেসে তাদেরকে স্বাগত জানাল।
……………….
অলঙ্করণঃ- সায়ন্ন্যা দাশদত্ত
No comments:
Post a Comment