পালা কুন্তলা
রজত দাস
[এটি ‘নাটক’ নয়, পালা।পালায় গান, বাজনা, নৃত্য একাকার হয়ে থাকে। পালা কুন্তলা’ও তেমনই। একজন কথক আছে, সে বাংলা ভাষার যে রূপটি ব্যবহার করে কথা কয়, সেটি ঠিক কোন অঞ্চলের তা বলতে পারি না। কলকাতা বা কলকাতাঘেঁষা শহরতলীতে এই রকম ভাষায় কথা শোনা যায় না।কথক বা অন্য অভিনেতারা যখন চরিত্র হয়ে ওঠে তখন তাদের ভাষার মাতৃকাভূমিটিকে স্পষ্ট করে চেনা যায়। বিক্রমপুর।
আসর। আসরের চারদিকে, উপরে সুতো আর কাগজের রঙিন ঝালর টাঙানো আছে। গান বাজনার দল বসে আছে পিছনদিকে, কালো পর্দার সামনে। আসরের মাঝখানে একটা লাল কাপড় পড়ে আছে। গায়েনবায়েনরা পরে আছে লাল আর সাদা রঙের পোশাক। কনসার্ট বাজল।প্রবল থেকে প্রবলতর হল। প্রবলতম হলে কথক এলো নাচতে নাচতে। তার পোশাকের রং সাদা। গান শুরু হল।]
গান
(হেই) প্রথমে বন্দনা করি যত গুনীজনে।
মা বাবা বোন ভাই বসেছে আসনে।
(যারা) এসেছে আসরে (যারা) বসেছে আসনে।।
তারপরে বন্দনা করি মাটির প্রদীপে।
আলো এসে চুমা দিক (আহা) ঘরে দশদিকে ।।
উত্তরে পাহাড় আর সাগর দক্ষিণে ।
মাটি জল বন বায়ু (করি)প্রণাম সবখানে ।।
আর যা যা বাকি আছে পশু পাখি পোকা ।
মৌমাছি কেঁচো ক্যারা (আহা) ঝিঁঝিঁ শুঁয়োপোকা ।।
প্রণাম তাঁদের যাদের চোখে দেখি নাই।
পৃথিবী ধরার গড়ে (সবে) প্রণাম জানাই।।
কথক।। কিন্তু শুন হে মায়েরা কাকারা, দিদি দাদারা, মাসি মেসো পিসি পিসোরা – এ দুনিয়ার
সবখানে সবার চরণে মাথা নত করা প্রণাম জানাবার পরেও আমি এখনও কোন
গাছকে প্রণাম করি নাই। এই যে দুনিয়া জুড়া আছে শুধু সবুজ আর সবুজ, পাতা আর
ফল, বীজ আর রস, মূল আর কন্দ – সেই সকল শ্যাওলা পানা লতা গুল্ম বিরুৎ
বৃক্ষ – এঁদের কারোকে প্রণাম করি নাই। এ কথাটা কি বুঝাছ তোমরা? সামান্য একটা
মানুষ হয়া, একটা তিন পয়সার পালার কথক হয়া এ কাজটা আমি ভুলা
গালাম কী করা – তা কি তোমরা বোঝো? বোঝো না। শুনো তবে আমার কাহিনী-
[কথক বায়েনদের কাছ থেকে একটা শাঁখ নিয়ে আসে। বাজায় তিন বার। গান শুরু হয়।]
গান
শোনো এ মেয়ের কথা পুরাতন কথা
কাহিনী।
এ দেশেরই কথা আমাদেরই কথা
(তবু) জানিনি ।
অশ্রু আঁখি বিধুমুখী ভাসিছে প্লাবনে ।
কী জানি কী ভাগ্যদোষে ঘটিল ঘটনা
এমনই ।
মেয়েটা ভীষণ জ্বালা বিয়া দিয়া দাও বিদায়
এখনই ।
উঠানেই পাত্র ছিল বৃদ্ধ এক নিমগাছে
এ কন্যার হইব বিয়া
ফাগুনে/শ্রাবনে*।
(ফাগুনে বা শ্রাবণের মধ্যে আসন্ন মাসটির কথা বলা হবে।)
কথক।। তা এ কন্যার বিয়া হবে গো মায়েরা। এই ফাগুনে/শ্রাবণে বিয়া হবে। বিয়া হবে
উঠানের ওই নিম গাছটার সাথে। আর তো মাত্র কটা দিন। মেয়ে তাই ঘরে বসা
আছে। সে কি ঘরে বসা বসা কান্দে? যার বিয়া হবে গাছের সাথে, তার চোখে
কিজল আসে? তার বিধুমুখ আঁখি তে কি পানি? কী গো বলো না মায়েরা –
আমার চোখে কি পানি? আরে ধুর! আমার চোখে পানি আসবে কেনো গো? আমি
তো উ মেয়েটা নই। আমি তো সামান্য কথক। প্রতি পালায় বারে বারে কথা দিয়া
গল্প বলা যাই। মেয়েটা কেনো গাছেদের প্রণাম করে নাই তা আমি জানি না। তবে –
আমি করব প্রণাম। কথক হয়া গাছেদের ভুলা গেলে যে পাপ হবে গো –
গান
(আরে) বন্দনা করি গো শোনো বটপিপুল গাছে ।
অক্সিজেন দিলে তোমরা ধরিত্রী এ বাঁচে ।।
ঘাস খেয়ে বাঁচে গরু বাঁচে তৃনভোজী ।
ধান যেন ঘাস এক খাই হররোজই ।।
ঘুম থেকা উঠা শেষে ঘুমে দিই ডুব ।
বীজ থেকা সব খাদ্য পেয়া যাই খুব ।।
ক্ষেত জঙ্গল আগুন মেঘ গাছে ভুবন ভরা ।
গাছেআর দুনিয়ায় (আহা)বাঁধা গাঁঠছড়া ।।
সেই গাছে আর কন্যায় রচিবে বাসর ।
প্রণাম জানায় তাঁদের এ পালার আসর।।
কথক।। এ মেয়ে তখন ছোট গো, খুব ছোট। এত ছোট যে পায়ে চটি না গলায়ে চলা যায়
খেলার মাঠে, গায়ে গামছা না জড়ায়ে চলা যায় পুকুর ঘাটে। এত ছোট যে গাছের
মগডালে চড়া যায়, ভয় পায় না। পাড়ার ছেলেবুড়াকে দেখে শরমে মরা যায় না
তখন। তা সেই মেয়া একদিন সন্ধ্যাকালে ঘরের পিছনে এসা দাঁড়ায়াছে। ঘরের পিছনে
মাঠ, মাঠের পরে মাঠ, আর সেই মাঠ ছাড়ায়ে আরো দূরে চাঁদ উঠাছে এক। মেয়া
খুব ছোট তখন, বালিকা। ও দেখে এই এত্ত বড় চাঁদ টাকে। গোলপানা। আকাশের
গায়ে ঝুলা আছে। আর ঘরের ভিতর থেকা উলু দিচ্ছিল কেউ। লক্ষ্মীর পূজা হচ্ছিল।
তখন ওর পাশে এসা দাঁড়ায়াছিল এক বালক। বিশু। ওর বন্ধু। খেলের সাথী। দূর
গাঁয়ের পূজা মন্ডপে গান বাজছিল। সেই গানের সুর ভেসা আসছিল হাওয়ায় দুলে
দুলে। এ মেয়া তখন বালিকা। এ মেয়ার সখা তখন বালক। বালিকা কখন যেন
আপন মনে তার সখার, ঐ বিশুর হাতটা চেপা ধরাছিল। জড়ায়ে ধরাছিল তার
আঙুল। পূব আকাশে কোজাগরী আলো। ওরা দেখে চাঁদটা বড় আদরে, বড়
ভালোবাসায় চেয়া আছে ওদেরই পানে। আর ওরাও চলা গেছে তখন কোথায়। ভেসে
ভেসে। ঐ চাঁদের দেশে। তখন বুঝি চাঁদ গান গায় -
গান
এমন সুন্দর পাখি
হৃদয়ে হৃদয়ে রাখি।
(এগো) ছুটলে পাখি ধরা দিবেনা।
কথক।। তা এমন করা দুই সখা খেলে। ছুটে গিয়া ঝাঁপান দেয় পুকুরে। পাঠশালায় গিয়া
পাশাপাশি দুই আসনে বসা লেখাপড়া শেখে। ছুটি হলা ফিরতি পথে গাছে উঠা কাঁচা
আম পাড়ে। কখনো আমের ভাগাভাগি নিয়া লড়াই বাঁধে। তখন মেয়া কাঁদে –
।। তর লগে আমি কথা কমু না যা।
।। কথা কবি না কি রে কুন্তলা, আমি যে তর নিজের মানুষ রে।
।। হ, নিজের মানুষ না ছাই! তুই আমার নিজের মানুষ হইতে যাবি কোন দুঃখে?
ঘরে কি আমার কেউ নাই? মায় আছে বাপে আছে।
।। তুই জানস না রে কুন্তলা, মায়েবাপে তো আমারো আছে।
।। তারা কেউ আমারে ঠকাইয়া আমার আম কাইড়া লয় না। তুই আমার নিজের
মানুষ না।
।। ঠিক আছে, তাইলে আমি আসল কথাটা কমু না।
।। কইস না যা।
।। তুই শুনতে চাইলেও কমু না।
।। শুনতে চাই না আমি। ভাগ।
।। আমি কইলে তো তুই শুনবি। হঃ। আমি কি তরে কইতে যামু নাকি আমার বাপের
লগে তর বাপের সেদিন কী কথা হইছে? তর বাপে সাইকেল নিয়া ফিরতাছিল,
পঞ্চবটী তলায় আমার বাপে তারে দেইখা দাক দিলো – ও কুন্তলার বাপ! আমি
তখন বট গাছের ঐ দিকে গুল্লি খেলতাছিলাম, বাপে আমারে দেখে নাই।তর বাপে
তখন সাইকেল থিকা নাইমা বিড়ি ধরাইয়া আমার বাপেরে একটা বিড়ি দিয়া কথা
কইতে লাগিল। কিন্তু কী কথা সেইটা তো আমি কমু না।
।। কইবি কী, তুই শুনছস নাকি! তুই তো তখন গুল্লি খেলায় মশগুল। এক পকেটে
পঁচিশ খানা গুল্লি, আর এক পকেটে সাতাশ খানা গুল্লি নিয়া তুই টলোমলো। তর
মাথায় তখন গুল্লির টিপ, চোখে গুল্লির কোটা – তুই শুনছস বাপেগো কথা! থো
তর কথা।
।। দ্যাখ কুন্তলা, এই সব কুযুক্তি দিয়া তুই পাড় পাবি না কইলাম। বাপেগো কথা শুইনা
আমি খেলা থামাইয়া দিলাম না? রমজানরে কইলাম, রমজান তেষ্টা পাইছে খুব,
পানি লইয়ায় বাসা থিকা। ও গেল পানি আনতে – বুজঝিস?
।। বুজঝি বুজঝি। বুজঝি তরে বিশ্বাস কইরা কাম নাই। খেলতে খেলতে তর নাকি
তেষ্টা পাইসে!
।। হ হ পাইছিলই তো।
।। আমি বিশ্বাস করি না।
।। রমজান রে জিগাইস।
।। রমজান রে জিগাইমু ক্যান? জিগাইলে তুই জিগাইস।
।। তাইলে কী করলে বিশ্বাস করবি তুই?
।। বিশ্বাস করতে আমার বইয়া গেসে।
।। আরে শোন শোন কুন্তলা, আমি পষ্ট শুনলাম, আমার বাপে কইল – কুন্তলার বাপ,
তোমার মাইয়াটারে ভারি পসন্দ করি গো। পোলার মায়ে কইতাছিল, আমাগো
ছোটজনের লিগা তোমার মাইয়াটারে আমরা নিমু।
গান
বন্ধু বিনা নাই যে গতি
কিবা দিবা কিবা রাতি
(এগো) জ্বলছে আগুন আরতো নিভে না।
কথক।। তা এই কুন্তলার সাথে সেই বালকের বিয়া ঠিক হয়াই ছিল। ওরা খেলতে
খেলতে বড় হবে। বড় হতে হতে বড় হবে, লায়েক হবে। উপযুক্ত কালে বিয়া
করা ঘর বান্ধবে তারা। বালিকাবালকের দুই সহজ সরল মাবাপের এইটুকুই ছিল
ইচ্ছা। ছোট্ট একটুকু আশ। হাতের মুঠায় ধরা যায় – এত্তটুকু সাধ। কিন্তু
এমন এত্তটুকু সাধও যে পূরণ হয় না গো মানুষের। দুই বালিকাবালকের
শিশুকালীন খেলা শৈশবেই শেষ হয়া যায়। কুন্তলার কুঞ্জ ভেঙা যায়।
সুর
কথক।। দেশের রাজধানী শহরে, সেই কতদূরের কোন সুদূরের এক বইয়ের পাতায় পড়া,
দিল্লীতে খুন হয়া যায় দেশের প্রধানমন্ত্রী। তারই দেহরক্ষকেরা – প্রধানমন্ত্রী,
দেশের সর্বময় কর্তার দেহরক্ষকেরা – বন্দুক উঁচায়ে গুলি করা মারে তাঁদের
মনিবকে। মুহূর্তে রেডিওতে সারা দেশে ছড়ায়ে যায় – প্রধানমন্ত্রী নিহত।
ঘাতক তারই শিখ দেহরক্ষীরা। দেশে দেশে শহরে শহরে দাঙ্গা বেধে যায়। যত
শিখছিল ঘরে ঘরে তাদের টেনে এনা মারা হয়, ঘর জ্বালায়ে দেয়া হয়, এমনকি
খুন করা হয় নির্বিচারে। দেশ তখন অগ্নিগর্ভ। সেই আগুনের আঁচ এসা লাগে
কুন্তলাদের গাঁয়েও। এক রাত্রে দাঙ্গা বাধে সেখানে, যেখানেছিল কুন্তলার বাপের
দোকান। কুন্তলা জানতেও পারে না, সেই রাতে পুড়া যাচ্ছিল ওদের দোকানটা
– ও বালিকা তখন ঘুমে কাদা।
গান
কথক।। পরেরদিন সকালে ওরা দেখে গাঁ ছেড়া পালাচ্ছে সব বুড়িবুড়া, নারীপুরুষ,
শিশুপোষ্য। কুন্তলার বাপে তার পোড়া দোকানের সামনে গিয়া দাঁড়ায়, ভিতরে
যেতে পারে না – সব ছাই। কুন্তলার মা কাঁদে – উনানে রান্না চড়ে না।
কুন্তলা ছুটে যায় বিশুদের ঘরে। বিশুর মা ছুটে আসে কুন্তলার মায়ের কাছে।
।। আমাগো তোমরা ক্ষমা কইরো গো দিদি। আমরা চললাম দ্যাশে। আর কি
কখনো দেখা হইব? আমার পোলাটা বড় হইব। আমার কুন্তলা বড় হইব। কিন্তু
আমাগো আর দেখা হইব না।
।। কুন্তলার বাপে সত্তর সালে গুন্ডাগো তাড়া খাইয়া আইছিল এইখানে। তিন বছর
বাদে দ্যাশ থিকা বিয়া কইরা নিয়া আইল আমারে। কুন্তলা হইল। তোমরা ছিলা।
সক্কলে ছিল। আইজ পুইড়া গেল সব। আমাগো যা কিছু সম্বল, সব জ্বইলা গেল।
অর বাপে কয় – দ্যাশেই ফিরা যামু শ্যাষম্যাশ? আর কী করার আছে কও
দিদি? কী কওয়ার আছে? কারে কী কমু? আমরাও যাইতাছি আজ রাত্রে। দ্যাখা
হইব না আর দ্যাখা হইব না।
সুর
কথক।। সেই রাতে কুন্তলার ছোট্ট হাতদুটা ধরা ওর মা বাবা ফিরা আসে নিজের দেশে।
যে দেশ থিকা একদিন ওর বাবা পালায়ে গেছিল ভয়ে। ওরা প্রথমে আশ্রয় নেয়
এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তারপর বহু কষ্টে একটা ভাড়া করা ঘর মেলে।
আনাজসব্জির জোড়াতালি দেয়া দোকান দেয় বাপে। মা সেলাই করে। ফের
লড়াই শুরু হয় তাদের – টিকা থাকার লড়াই, মেয়াকে মানুষ করার লড়াই।
মেয়া – ওদের বড় আদরের। মেয়া – কুন্তলা।
সুর
কথক।। ছোট্ট মেয়া পাঠশালায় ভর্তি হয় ফের। বন্ধু জোটে। মাথার দুই দিকে বড় যত্নে
দুটা বেনী বেঁধা দেয় মা। পাড়ার লোকে কয় – কী যে মিষ্টি মাইয়া এই কুন্তলা।
মাষ্টারমশাই কন – কুন্তলা বড় লক্ষ্মী। পাশের বাড়ির জেঠিমা কয় – তোর
চোখ দুইটা অমন মায়াবী ক্যান রে লো? কুন্তলা এই সব শোনে কিনা জানা যায়
না। শুনলেও বোঝে কিনা তা বোঝা ভারি দুষ্কর। মেয়া ভিজা ভিজা সকালে,
হলুদ রোদ পিঠে মেখা নিয়া পাঠশালায় যায়। বেড়ার ধারের দক্ষিণ কোণাটায়
বসে। সেই কোণায়, বেড়ার গায়ে, কুন্তলার ডান পাশে একটা ফোঁকর আছে –
বড়। কুন্তলার এইটুকুন চোখ সেই এত্তবড় ফোঁকরটা দিয়া বাইরে চেয়া থাকে।
বাতাস দেয়। ধানক্ষেতে ঢেউ ওঠে – সবুজ। সেই ঢেউইয়ের ঐপারে দীঘি আছে
এক – মেয়া ভাবে, যেতে পারে না – শুধু জল দেখতে পায়। ও জানে জলের
ঐপারে একটা গ্রাম আছে। নিশ্চয়ই আছে। সে গাঁয়েও বুঝি আছে এমনই এক
পাঠশালা। সেই পাঠশালাতে কি এখন কোনায়, বেড়ার গাঁয়ের ফোঁকরে বসা আছে
সেই বালক? সেই বিশু– যে আম কেড়া নিয়া কাঁদায়। সেই বিশু– যার
পকেট ভরা থাকে গুল্লি। যে আচমকা ডেকে ওঠে – কুন্তলা –
গান
সোনা বন্ধুরে আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি
কথক।। সেই বালকের কথা ঐ বালিকার আর ভোলা হয় নাই। সেই বালিকা অনেক
কোজাগরীর উজ্জাপনে বালিকা নয় আর। তবু তার চোখে সেই বিশু আজও
বালকই। সেই বালক আজও –
গান
সোনা বন্ধুরে...
কথক।। তারপর অনেক দিন কেটা যায়। কুন্তলার বাপের আনাজপাতির দোকান থিকা
আয় হয় খানিক। সংসার খানিক গুছায়া আনা যায়। একটা ঘর হয় নিজেদের।
এক চিলতা উঠান। গাছ কয়েকটা দুটা হাঁস। বেড়ার ধারে মাধবিলতা নয়নতারা
গাছে ফুল। একটা নেড়ী কুত্তা শুয়া থাকে দাওয়ায়। তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে
সন্ধ্যাকালে। সকালে চড়াইপাখি এসা বসে ঘরের চালে –কুন্তলা খুদ ছিটায়া দেয়
–ওরা খায়। মা কয়–কুন্তলা যা বাপেরে খাওয়ার দিয়ায়; - কুন্তলা জল ঘাটিস
ক্যান পুকুর ঘাটে বইয়া; - কুন্তলা মুকখান অমন কালা হইসে ক্যান তর? বাপেরে
খাবার দিতে যাবার পথে, স্কুলে যেতে গিয়া মাঠে, পথে, বাঁকে, কথা কয়
কুন্তলা। মানুষের সাথে – ভিখারি, পাগল, কানা, বুড়া, এমনকি বোবাদের সাথে।
কথা কয় যারা মানুষ নয়- গাছ, গরু, ছাগল, কেঁচো, প্রজাপতি, ধুলা, আকাশ,
পুকুরের জলের সাথেও। এমনই একদিন এক অন্ধ ভিখারিনী আর তার মেয়া
গান গাইছিল বাজারের জটলায়।
গান
পরের জাগা পরের জমিন ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো সেই ঘরের মালিক নই
।। এত দেরি হইল ক্যান কুন্তলা? বাপেরে খাওন দিয়া কই গেসিলি তুই? অ্যাঁ?
।। মাগো, এক অন্ধ ভিখারী আর তার মাইয়া গান গাইতাসিল বাজারের মধ্যে। কী
অপরূপ তাগো গানখান। আমি মুগ্ধ হইয়া শুনতে থাকি। আর সেই ছোট্ট মাইয়াটা
গানের তালে তালে কইতাসিল – দে দে টাকা দে। শ্যাষে অরা চইলা যাইতাছিল, আমি
পিছে পিছে গিয়া দেখি অরা বইছে বিশ্রাম নিতে। আমি জিগাই – এই গান তোমরা
পাইস কই?
।। কী জানি, মনে নাই।
।। অর বাপ?
।। নাই।
।। সারাদিন ভিক্কা করো, মাইয়ার কষ্ট হয় না?
।। আমরা ভিক্কা করি না তো, গান গাই। সারাদিন না, ক্যাবল এই দুপুরবেলাটুকু।
।। এতে তোমাগো চলে?
।। এর বেশি হইলে আর চলব না রে মা।
সুর
।। এর পরে অরা চইলা গেল। আমি পিছে পিছে গেলাম। দেখি অরা বাজার ছাড়াইয়া
মাঠে নাইমা গেল। মাঠের ঐপারে গাঁয়ের দিক গেল। আমি দাঁড়াইয়া দেখতা ছিলাম
মা।
।। তা তুই অগো পিছে পিছে গেলি ক্যান?
।। জানতে মা।
।। কী জানতে?
।। ঐ যে অন্ধ ভিখারী কইল – অরা ভিক্ষা করে না গান গায়, সত্যি মা? কও না?
অরা যে কইল – এর বেশি হইলে আর চলব না – এই কথার মানে কী? আমি
অগো পিছে গেলাম। কিন্তু অরা যে মাঠে নাইমা গেল। মাঠে, পাটক্ষেতের মধ্যে
মিলাইয়া গেল। অখন কও এই উত্তর আমি পামু কই?
।। কোনো উত্তর পাইতে লাগব না রে মুখপোড়া মাইয়া, সন্ধ্যাবাতি দে গিয়া, আলো জ্বাল।
সুর
কথক।। তা এই মেয়া বড় হচ্ছিল। মেয়া বাপেরে ভাত মেখা খাইয়ে দেয়, বাপের মন আর
বুক ভরে ওঠে। মেয়া কথা কয় কী সব – মা বোঝে না। কয়–
।। সন্ধ্যাবাতি দে গিয়া। আলো জ্বাল।
সুর
কথক।। তারপর অনেক কাল কেটা যায়। কুন্তলা বড় হয়, বন্ধুদের সাথে কলেজে যায়। ছোট্ট
নদীর পারে বসা থাকে বন্ধুদের সাথে। বন্ধুরা অনর্গল কথা কয়। ঢিল মারে নদীতে।
একটা বাচ্চা ছেলে ছিপ ফেলা বসা থাকে দূরে । কুন্তলা কথা কয় না। তাকায় থাকে
নদীর পানে। বন্ধুরা কয়–
।। কি রে কুন্তলা, সেই থেকে নদীর দিকে মুখ করে বসে আছিস। কেন রে?
।। আমি না।
।। আমি না – মানে?
।। নদীর দিকে মুখ কইরা বইসা থাকে মানুষ। নদীও তা’ই। সেও চাইয়া থাকে মানুষের
পানে।
।। তাই বুঝি।
।। হ।
।। হ, না ছাই।
।। হ সত্যি! বইয়া চলে, ভিজাইয়া দেয় ডুবাইয়া দেয়, ভাসাইয়া নেয় – নদী। নদী
আর মানুষ। আলিঙ্গন করে, চুমা খায়। ছোট্ট হাত ছুঁইয়া দেয় নদীজল। তখন শব্দ
হয় – ছলাৎ।
।। তাই বুঝি! তা কেমন শুনি সেই ছলাৎ শব্দ?
।। নদীর দিকে চাইয়া থাকেন রামপ্রসাদ।
গান
পাড়ের আশায় নৌকা বাইয়া
রাইত পুহাইলে দেখি চাইয়াগো
আমার যেই খানের নাও সেইখানেই আছে
হায়গো, কী আশায় ঘুরিলাম কারো পাছে।
।। কবি তাই নদীতেই চইলা যান। নদীর ঘাটে সুর ভইরা দেন বিসমিল্লা খান। বিয়া
বাড়িতে আমরা যে সানাই শুনি সেই সানাই থাকে বিসমিল্লার ঠোঁটে। ঠোঁটে?
বেনারসের ঘাটে? নাকি জোনাকি আর প্রদীপের গঙ্গাজলে? নদীমুখে দাঁড়াইয়া থাকে
তাজমহল। একা। যে শিল্পীর নাম জানি নাই কেউ, যে কারিগর পিঠ পাইতা বইয়া
আনসে পাথর – আমাগো সেই প্রপিতামহগো – মনে রাখসে তাজমহল, সে তার
মার্বেলের গায়ে লেইপা দিসে অমরত্ব। যমুনা জানে সেই কথা।
গান
।। তারপর অনেক দিন কাইটা গ্যাসে। কারা যেন মুখ ফিরাইয়া নিসে কখন। শহরকে
শহর পায়খানার মুখ আর গুয়ের নালা ঘুরাইয়া দিসে নদীর দিকে। নদীর ঢেউয়ে
এখন আর শব্দ হয় না। ঐ যে ছেলেটারে দেখিস, ছিপ ফেইলা বইয়া আসে ঘাটে,
একদিন জিগাইসিলাম অরে – কী মাছ রে? ও হাসে। সুতা তুইলা আনে। সুতায়
বরশি নাই, আছে চুম্বক। চুম্বকে পয়সা ওঠে। ভগবানের ভক্তরা প্রণামী ছুইরা দেয়
– সেই। কখনো কিছুই ওঠে না। শুনছি জাল ফেললে প্লাস্টিক ওঠে। না, ছোট্ট হাত
আর ছুঁইয়া দেয় না নদীজল। নদী আর কক্ষনো কইব না – ছলাৎ।
গান
।। এই ভাবে কথা কয় কুন্তলা। নদীর সাথে। নদী, খাল, বিল, পুকুরের সাথে। কথা
কয় পয়সা কুড়াতে আসা ছেলেটার সাথে। সেই ছেলা, নৌকার মাঝি, জলের মাছ
আর গাঙচিলের সাথে। কুন্তলা কথা কয়। ওর বন্ধুরা বলে – কী কথা বলিস তুই
কুন্তলা? বুঝি না কিছু। কুন্তলা কথা কয় অন্ধ ভিখারিনীর সাথে, তার মেয়ার
সাথে। মা আর মেয়া হাত ধরা মিলায় যায় পাটক্ষেতে। কুন্তলা কথা কয় পাটক্ষেতের
সাথে। কুন্তলার মা কয় – তর কথা কিছু বুঝি না।
।। মা কও, এ উত্তর অখন আমি পামু কই?
।। কিস্যু উত্তর পাইতে লাগব না রে মুখপোড়া মাইয়া। সন্ধ্যাবাতি দে গিয়া, আলো জ্বাল।
সুর
কথক।। কুন্তলা একটা মাটির প্রদীপে তেল দেয়। সলতে সাজে। আলো জ্বালে তুলসীমঞ্চে।
শাঁখ বাজায়। সে শাঁখের ধ্বনি ছড়ায়ে পড়ে সারা পৃথিবী জুড়া। কুন্তলা ভাবে –
এই শাঁখের শব্দ বুঝি পৌঁছায়া যায় দূরের মানুষের কানে। দূরে। যতদূরে সে ফেলা
এসেছে বালিকাবেলার মানুষটাকে। কোজাগরীর রাতে। পাঠশালার ফোঁকর দিয়া
দীঘির ওপারে চেয়া থাকতে ভেবাছিল যে মানুষটার কথা, সেই মানুষের কানে,
সেই বালকের কানে কি এই শঙ্খধ্বনি পৌঁছাবে না?
গান
চিকন কালিয়া রাস্তা দেওরে ছাড়িয়া
রাস্তা দাওরে ছাড়িয়া রাস্তা দাওরে ছাড়িয়া।
দমকে দমকে শ্রীচরণকমলে
(হায়রে) শ্রীচরণের দাসী যদি হইতাম রে বন্ধুয়া।
ভাবি ভাবি রাধে কয়
প্রেম করা তো ভালো নয়।
প্রেম পিরিতি বিষম জ্বালা, জ্বালা রে বন্ধুয়া।
কথক।। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায়অভানীয় ফল করে কুন্তলা। মায়ের বাবার আনন্দ
আর ধরে না। প্রতিবেশীরাকয়– কুন্তলা বড় ভালো মাইয়া। বন্ধুরা কয়– ওর
কথা কিছু বুঝি না, তবু কী ভালো রেসাল্ট। কলেজের শিক্ষিকা কন – কুন্তলা
এবছর এক্সকারশনের জন্য তুমি সিলেক্টেড, আমরা আসাম যাচ্ছি।
।। শ্যাষ ডিসেম্বরের শীত। ভোর ছয়টায় বাস থিকা নামছি। করিমগঞ্জ। আসাম।
আসাম? নাকি বাংলাই? ব্যাগ, জিনিসপত্তর কোনোরকমে হোটেলের ঘরে রাইখা
কয়েকজন বাইর হইছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুইটা যাইতে চাই কুশিয়ারা নদীর
পারে। প্রচণ্ড কুয়াশা। নদীর ওইপার দেখা যায় না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হইব।
ততক্ষণ চা খাই। নতুন দ্যাশের মানুষজনের লগে আলাপ করি। এইভাবে আধঘণ্টা
কাইটা যায়।তারপর ধিরে কিন্তু নিশ্চিত কইরা কুয়াশার চাদর ফিকা হইয়া আসে।
গান
।। একটু একটু কইরা স্পষ্ট হইতে থাকে ঐপার। নদীর ঐপার। নদীর এই পারে
দাঁড়াইয়া আছি ঐপার দেখুম বইলা। অল্প চওড়া নদী। দেইখা মনে লয় ঢিল ছুঁইরা
নদী পার করা যাইব। ঐতো গাঁয়ের হাট। মেঠো পথ। ঐতো উঠানের তারে মেলা
ভিজা শাড়ি। একবার ঐখানে যাইতে চাই।
না। যাওয়া যাইব না। বড়গো বারণ! ইতিহাসের নিষেধ। তাইলে এইপারের ঘাটেই
নামি একটু। জল স্পর্শ করি নদীর। কাগজের নৌকা ভাসাইয়া দিই। আমার হইয়া
সে’ই যাক আমাগো পূর্বজন্মের ভিটায়।
ঘাটে নামতে লই। আর তক্ষুনি সেনাবাহিনীর রাইফেলধারী জওয়ান ছুইটা আসে।
ক্যান নামছি ঘাটে? জানি না ক্যান, এই ঘাটে নামার অধিকার কারো নাই! অগো
ধমকে পিলা চমকাইয়া যায় আমার। অগো ধমকে উইড়া পালায় গাছে বসা একটা
কাক। আমি ফ্যালফ্যাল কইরা চাইয়া থাকি। আর কাকটা উড়তে উড়তে ঐপারে
চইলা যায়। কুশিয়ারা নদীর ঐপারে। বাংলাদেশে।
মা, মাগো, আমি কাক হইতে চাই।
।। তুই অমন করিস ক্যান পাগলী মাইয়া আমার।
গান
কথক।। মা বুঝতে পারে – এ মেয়া আর পাঁচটা মেয়ার মতন না। বাপে বুঝতে পারে –
কোনো এক অদ্ভুত আলো এসা লেগেছে তার কুন্তলার গায়ে। পাড়া-প্রতিবেশীরা
বোঝে –
।। এ মেয়া পাগল। এত্ত ভালো লেখাপড়ায়, এত্ত লক্ষ্মী মাইয়া কুন্তলা, তবু তারই
মাথায় কিনা ছিট!
কথক।। ঘটক এসা বলা যায় –
।। মাপ করো কুন্তলার বাপ, এ মাইয়ার সম্বন্ধ হইব না কোনোখানে। শ্যাষে পাগলী
মাইয়ার বিয়া দিয়া জেলে যামু নাকি!
কথক।। সুতরাং কুন্তলা একা হতে থাকে। কলেজে যায় না আর – সহপাঠীরা বড় বিরক্ত
করে। উঠান পেড়ায়ে পাড়া ডিঙ্গায়ে মাঠে, দীঘিতে যায় না আর – গাঁয়ের
লোকেরা বড় টিটকিরি দেয়। রাতের বেলায় সে বাপেরে ভাত বেড়া দেয় – সেইটা
বাপের বড় আরাম। সন্ধ্যাকালে প্রদীপ জ্বালে - সেইটা মায়ের সুখ।
গান
কুন্তলারই মনের মাঝে গো, সইলো কী হইল না জানি,
বন্ধুরে হারাইয়া খোঁজেও তার বিরহী পরাণে।
এক যে অন্ধ ভিখারি কন্যা শুনিল তার কথা,
তার কথায় ছিল নাজানি কোন ছল
কন্যা কী পাইল বারতা ।
নদীর বুকে মানুষ বেঁচে থাক, নদীর এই ছিল ভরোসা
সেই মানুষ কখন গুটায় নিলো হাত
নদীর কেমন নালার দশা।
নদী রে দংশিয়া গেল গো সইলো কালো নাগিনী
কুশিয়ারা বন্দী হইল গো
তোমরা ছুঁইয়ো না তার পানি।
এসব জাগায় খোঁজে কুন্তলা, খোঁজে প্রাণ পরাণী সখা,
সেই অচিন গাঁয়ের মানুষ মেলেনা
তাদের হবে কি আর দেখা।
কথক।। একা কুন্তলা। কেউ নাই। বাপে আছে, মায়ে আছে। বন্ধু নাই কোনো। তারা কয়
কুন্তলা পাগল। প্রতিবেশীরা ছি ছি করে কয়– মাইয়ার মাথায় ছিট। নদী বড়
প্রিয় তার, সেই নদীর জলে স্রোত নাই, ঐপারে যাওয়ার তরী নাই। কুন্তলা একা
হয়া যায়। বাপের চিন্তা মায়ের চিন্তা – মাইয়ার বিয়া হইব না। ঘটক কয়-
সম্বন্ধ করাইয়া মরুম নাকি। কুন্তলা একা। দাওয়ার পাশে শুইয়া থাকে পোষা
কুকুর। উঠানে দাঁড়াইয়া থাকে বুড়া নিম গাছ। একা কুন্তলা কেবল কথা কয়
ওদের সাথে। ওরাও কয়। কুকুর, নিম গাছ কথা কয়, কুন্তলা বোঝে। যার কথা
মানুষে বোঝে না সে বুঝতে পারে – কুকুর, ছাগল, কেন্নো, ফুল, পাতা, গাছেদের
কথা। সত্যি কই – অনর্গল কথা বুঝতে বাধে না তাদের। তা’ই প্রকৃতির নিয়ম,
ধরিত্রীর বিধান। ধরিত্রী তো দুনিয়া জুড়া মানুষরেই বানায় নাই কেবল। তার
নিয়মে তাই হাওয়ায় হাওয়ায় খবর আসে, মেঘে মেঘে চিঠি চলে, আনন্দে উৎসবে
ফুল ফোটে পলাশ গাছে। তাই কুন্তলা কুকুর আর নিম গাছের সাথে কথা কয়।
কয় –
।। তরা আমার সখী। তগো লগে লগে বড় হইসি। শ্বাস নিসি একই বাতাসে। তর
শিকরে, তর চুমুকে ত্যাষ্টা মেটাইছে যে পানি সেই পানিতে গা ধুয়াইসি আমি। তুই
গাছ, তুই কুত্তা আর আমি মানুষ। কিন্তু বাঁধা পরসি এক নিয়মে। সে নিয়ম
পৃথিবীর নিয়ম। আমাগো তিনজনার নারির টান এক লগে লাইগা আছে। সক্কলে
আমারে পাগল কয়। ক্যান কয় জানস? শুনলে তরা হাসবি। অরা কয় আমি
ভূতেগো লগে কথা কই। অরা জানেই না, তরা ভূত না। তরাও এই পৃথিবীর
সন্তান। তগো ছাড়া মানুষের কোন কাম নাই। আমি তাই তাগো কথায় চুপ কইরা
থাকি। চুপি চুপি হাসি। কেবল সেই বিশুর কথা বড় মনে পরে রে। জানতে
ইচ্ছা করে – সেও কি আমার মতো? তারেও কি পাগল কয় লোকে? নাকি সেও
হইসে মানুষের মতো মানুষ – সেই মানুষ- যারা মানুষ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।
সুর
কথক।। সেদিন এমনই বৃষ্টি পড়তাছিল। মানিকপীরের ভাঙা পাঁচিলের গায়ে মাথা নিচু কইরা
বইসা ছিল বিশু। দূরে কারোর বাড়ির রেডিওতেগান গাইতাছিলেন কিশোর কুমার –
হাম কিসিকে না রহে, কোই হামারা না রহা।
বিশুর কানে সেই গান পৌঁছে গেছিল কিনা কেউ জানে না। বিড়ির সামনেটা মুখে
ধইরা উল্টাদিকে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছিল সে, দুইতিনবার। বিড়ি ধরেনি –
জোরে হাওয়া বইছিল। না-জ্বলা দেশলাই কাঠি অসহায় ভাবে ফেইলা দিয়া আকাশের
দিকে চাইয়া ছিল কান্না জড়ানো মানুষটা। ঠিক তক্ষুনি কয়েক মাইল দূর থিকা নাইমা
আসা দুইটা জলবিন্দু অর চোখের নীচে আইসা লাগছিল –
শাম তানহাই কি হ্যায়, আয়েগি মনজিল ক্যায়সে।
বিশু। ও পরিবারে ছিল, পরিবারে অর কেউ ছিল না।অর বড়দা বাসের
কন্ডাক্টর। কম বয়সে পাড়ারই এক মাইয়ারে বিয়া কইরা ঘর ছাড়ছিল। মেজদা
কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাইছিল। বিয়া কইরাছিল এক পরমা সুন্দরীরে। বছর
ঘুরতে না ঘুরতেই নিজের জন্য বড় বাড়ি তুইলা আলাদা হইয়া গেল সে। বিশুগো
টিনের চালার ছোট্ট ঘরদুইটা কোণায় পইড়া রইল। তারও কোণায় পইড়া রইল বিশু
তার মারে নিয়া। বিশু আর অর মায়ের সংসার থিকা আর্থিক নিরাপত্তার মেকি
আবরণটা খইসা গেল। অর মা, উনান ধরায়, ভাতের হাঁড়ি চাপায়, জল
ফুটতে থাকে। বিশু কোনোরকমে জোগাড় কইরা আইনা দিলে ফুটন্ত জলে দুমুঠা চাল
ঢাইলা দেয় মা। বিশু কয় –
।। সকালবেলায় হাঁড়ি চাপাও কেন মা? আমি যদি কিছু না আনতে পারতাম, কী
হইতো? জল শুকাইয়া যাইত না, কও?
।। হুটহাট কইরা ঘরে ঢুইকা পড়ে পাড়ার লোকে। হাঁড়ি চাপান না দেখলে ওরা বোঝে
– আজ আমাগো অন্ন জুটব না রে বিশু। সারা পাড়া সেই শুইনা হাসব, কইব –
সুবোধ পালের বৌয়ের গুমর ভাঙছে, দেখো দেখো ভাতও জোটে না এখন,
ছেলেগুলা তো মানুষ না – ও আমি শুনতে পারুম না বাপ।
কথক।। গামছা নিয়া ঘর থিকা বাইরহইয়া পুকুরঘাটে চইলা যায় বিশু। স্নান কইরা ফিইরা
আইসা খাইতে বসে। অগো ঘরে কিছু নাই কেবল অর বাবার রাইখা যাওয়া
টেপরেকর্ডারটা ছাড়া। মা আর পোলায়খাইতে বইসাগান শোনে। এই একমাত্র বিলাসিতা
অগো। গরীবের ঘরে রূপালী গান। গান বাজে –
অ্যায় নাজারো না হাসো, মিল না সাকুঙ্গা তুমসে।
বিশুর বুদ্ধিশুদ্ধি কম। লেখাপড়া হয় নাই। জগতের কোন কামে ওরে লাগে না।
পাড়ার লোকেরা কওয়াকয়ি করে –
।। বিশুর বাবা জলে ডুইবা মরে নাই,অর তৈরী করা কালীমূর্তীই অরে গঙ্গায় টাইনা
নিছিল ভাসানের দিন।
কথক।। বিশু তখন বালক। দাঙ্গায় তাড়া খাইয়া আইছিল অরা চুরাশি সালে। বাপের মৃত্যুরপরে
বিশু যেন কেমন হইয়া যায়। বিশুর মা কিন্তু তিন পোলার কাউরেই পারিবারিক
মূর্তিপুতুল তৈরির কামে ঘেঁষতে দেয় নাই। নিজে সেলাই কইরা কোনরকমে মেজোটারে
পড়াইছে – ও লেখাপড়ায় ভাল। বড়টা আর ছোটটা ভাইসা ভাইসাই গেছে একপ্রকার।
বড়টা বারো বছর বয়সে নিজের উদ্যোগে খালাসি হইয়া চইলা গেছিল এক পাঞ্জাবী
ড্রাইভারের সাথে, ছোটোটারে পাশের বাড়ির বাচ্চা গুলার লগেই স্কুলে পাঠানো হইতো,
ব্যস, ঐটুকুই। এহেন বিশু এখন সুবোধ পালের বৌয়ের এখন একমাত্র আশ্রয়। আজ
এর চায়ের দোকানে, কাল ওর ভ্যান ঠেইলা দুইদশ টাকা রোজগার করলে ওগো খাওয়া
জোটে। খাবার জুটলে সেইদিন গান বাজে টেপরেকর্ডারে –
কোই হামদাম না রহা, কোই সাহারা না রহা।
আমাদের এই বিশুর টুকটাক দুইদশ টাকার কাজ ছাড়া বাকী সময় কাটে মানিকপীরের
উঠানে। কবে কারা এই পীরবাবার সমাধি গড়ছিল জানা নাই। জানা নাই কোন সাধক
ফকির শুয়া আছে মাটির গভীরে। তবু প্রতি শুক্কুরবার পাড়ার কেউ কেউ সন্ধ্যাকালে
মোমবাতি আর ধুপ জ্বালাইয়া দেয়। রেকাবিতে বাতাসা রাইখা সমাধি প্রদক্ষিণ করতে
করতে প্রার্থনা করে তারা। মনে মনে আশা করে ঘুমায়ে থাকা অপর ধর্মের সাধু
লোকটা মিরাকেল ঘটায়ে দেবে জীবনে। ওদের হাজার না পাওয়ার বাঁইচা থাকায় একটু
খানি ভাল থাকা ছপ্পড় ফুঁইড়া নেমে আইব – তখন রোগে ভোগা মেয়েটা আরাম পাইব
একটুখানি, পরস্ত্রীর দিকে ঝুঁইকা পড়া বেহেড স্বামী সোহাগে ভরাইয়া দেবে একটা
রাত্তির, খারাপ হইয়া পইড়া থাকা টিউবয়েলে চাপ দিলে উইঠা আইব জল, জোড়াতালির
সংসারে একদিনের জন্য পুজা হইব সত্যনারায়ণের।
বিশু বইসা থাকে এইখানে। পীরের গায়ে গাছের পাতা পড়ে – ও পরিস্কার কইরা দেয়।
ভরদুপুরবেলা যখন কেউ কোত্থাও থাকে না আর – বিড়ি ধরায় উল্টা কইরা। হ্যাঁ,
উল্টাদিকে, বিড়ির পোঁদের দিকে আগুন ধরায় ও আর মুখের দিকটা মুখে দিয়া টানে।
যেদিন ওর সমবয়সীরা প্রথমবার বিড়ি দিছিল – কাশতে কাশতে অর জীবন বাইর
হইয়া যাইতাছিল। মুখ লাল হইয়া গেছিল, চোখদুইটা ঠিকরাইয়া বাইর হইয়া আইছিল।
ছেলেগুলা মজা কইরা হাসতাছিল। একজন মাথায় মাইরা ছিল চটাস কইরা –
।। ওরে বলদ, তুই জানস না তুই বলদ? তুই কিস্যু পারস না, বিড়ি খাইতেও না। যা
মুইত্তা আয়।
কথক।। ও কাশতে কাশতে চইলা গেছিল পীরবাবার কাছে। পিছন থেইকা একজন কইছিল –
।। বিশুরে, তুই তো মুখ দিয়া টাইনা চক্কু উল্টাইয়া দিলি, একবার পোংগা দিয়া টাইনা
দেখ কেমন লাগে।
।। খ্যাঁকখ্যাঁকে হাসিগুলা থেইকা পালাইয়া আইছিল ও। দুদিন পরে এক টাকার বিড়ি
কিনছিল। ভাঙা পাঁচিলের গায়ে লুকাইয়া – নিজের নয় – বিড়ির পিছনে আগুন দিছিল
বিশু। বিড়ি খাওয়া শিখতে হইব। অন্তত এই একটা কাজ শিখতেই হইব।
এমনি কইরা চলছিল। একদিন মা’টা মইরা গেল। আর কেউ রইল না অর। দাদারা
ঘটা কইরা মায়ের শ্রাদ্ধ করল। সাদা ধুতি গেঞ্জি, মাথা ন্যাড়া, কয়েকশো লোকের
নেমন্তন্ন, সন্ধ্যায় রামায়ন গান। বিশুকে ডাকার কথাকারো মনেই থাকল না। দুপুরবেলা
টিনের চালাঘর থেকা টেপরেকর্ডারে বাইজা উঠলেন কিশোরকুমার –
ও মেরে হো না সকে, ম্যায় ভি তুমহারা না রহা।
দুই দাদা আইসা টেপরেকর্ডার ছুঁইড়া ফেইলা দিল উঠানে। নির্বোধ ভাইরে নিয়া তাগো
সে কী লজ্জা।
।। ব্যাটাচ্ছেলে নতুন ধুতিটাও পড়ে নাই। নিমন্ত্রীত অতিথিরা দেখতাসে, সুবোধ পালের ছোট
পোলা মা’এর শ্যাষ কাজটাও না কইরা হিন্দি গান শুনতাসে, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। বাইর
হইয়া যা তুই ঘর থিকা। কুলাঙ্গার কোথাকার।
কথক।। গালে থাপ্পড় আইসা পড়ল একটা। বিশু তখন ছিটকাইয়া গিয়া পইড়াছিল উনানের
সামনে। মা থাকলে অখন একটা হাঁড়িতে জল ফুটতো টগবগ কইরা।
।। বাইর হইয়া যা তুই চোখের সামনে থিকা।
কথক।। ও চইলা গেল। যাওয়ার আগে ভাঙা টেপরেকর্ডারটা এবং শেষ না হওয়া গানটা
কুড়াইয়া নিতে ভুলল না। উঠান পেরাইয়া গেলে, একবার পিছনে তাকাইল, দাদার
বড়বাড়ির বারান্দায় হাসিমুখ মায়ের ছবি। মা কইল–
।। আর ফিরিস না রে বিশু। আমি আর নাই এইখানে।
সুর
কথক।। তখন বৃষ্টি নামছিল। মানিকপীরের ভাঙা পাঁচিলের গায়ে মাথা নিচু কইরা বইসাছিল
বিশু। বিড়ি বাইর করছিল একটা। পেছনে আগুন দিছিল। দুইবার, তিনবার। ধরেনাই।
অসহায় ভাবে আকাশের দিকে চাইয়াছিল কান্না জড়ানো মানুষটা। কইছিল – মা…
কয়েক মেইল দূর থিকা নেমে আসা দুইটা জলবিন্দু ওর চোখের নীচে আইসা লাগছিল।
আর একবার বিড়ি ধরাইবার চেষ্টা করল। এইবারে জ্বলল বিড়ি। বিড়ি শেষ। এইবার?
কি করবে ও? মানিকপীরের কাছে গিয়া জরায়ে ধরল ও ঘুমায়ে থাকা অপর ধর্মের
সাধু মানুষটারে। ডুকরাইয়া কাইন্দা উঠল ও। এবং অর হাতে ঠেকল একটা বস্তু।
কান্না চোখে ও দেখল – ঘোড়া। মাটির ঘোড়া। ছোট ছোট। পীরের ভক্তরা এসবও
রাইখা যায়, মানত করে। ও দেখলো সেই ঘোড়া গুলারে। মৃৎশিল্পী সুবোধ পালের
পোলা কখনো মাটির পুতুল গড়ে নাই। ও দেখল এবং হাতে তুইলা নিলো মাটির
ঘোড়া। বৃষ্টি পড়তাছিল। আর ছোট্ট মাটির ঘোড়াটা ওর হাতে আইসা ক্রমশ বড় হইয়া
উঠতে শুরু করল। লম্বা ঘোড়া লালচে গলা ওর হাতের স্পর্শে শিহরিত হইল। বিশুও।
সঙ্গে সঙ্গে ও শুনতে পাইল মাইল কতক দূর থিকা ভাইসা আইতাছেন কিশোরকুমার -
গান
কথক।। ঘোড়া হাতে নিয়া হাঁটতে শুরু করল ও। মানিকপীড় ছাইড়া বড় রাস্তা, বড় রাস্তা
ছাইড়া ঐদিকে বাজার, তারপর নিচু ঢালু পথ চইলা গেছে গঙ্গার দিকে। বিশুর ঘোড়া
টকবক কইরা ছুইটা চলছে অর হাতে, দৌড়াইতাসে বিশুও। ছুটতে ছুটতে, ছুটতে ছুটতে
গানের কাছে চইলা গেল ওরা। এবং গঙ্গার ঘাটে। মাঝ গঙ্গা থিকা ভাইসা আসতাছে
গান। বিশুর হাতে মানিকপীরের ঘোড়া। ঘোড়া কইল– চলো।
।। দাঁড়াও শ্যাষ বিড়িটা খাইয়া লই।
সুর
।। কুন্তলা –
কথক।। কে? কে ডাকে?
।। আমি, তর নিমগাছ। পাড়াপড়শি আমার লগে তর বিয়া দিব ঠিক করসে।
।। কুন্তলা –
।। কে? কে ডাকে?
।। আমি, তর পোষা কুত্তা। পাড়াপড়শি ঠিক করসেতর লগে আমারেও খ্যাদায় দিবো
গাঁও থিকা। একলা কাউরে তাড়াইতে নাই, তাই আমারে দিবো তর লগে।
।। কুন্তলা –
কথক।। কে? কে ডাকে?
।। বিশু। সেই বালক, যারে তুই খুঁইজা বেড়াস তর বালিকা বয়স থিকা।
কথক।। কই সে? তারে দেখতে পাই না যে।
।। সে মরতে বইসে। তবু মরণের আগে বিড়ি ধরায় নিসে। গান গাইতাসে শ্যাষবার।
কথক।। তারে আমি মরতে দিমু না। তারে ধইরা রাখুম আমি।
।। আর তর বাপে? তর মায়ে? পাড়াপড়শি তাগো টিকতে দিব না।
।। আর আমি, তর সোহাগের নিম গাছ? পাড়াপড়শি আমারে কাইটা ফেলাইব।
।। আর আমি, তর পোষা কুত্তা? পাড়াপড়শি আমারে খ্যাদায় দিবো।
কথক।। না, পারব না তারা। আমি বাঁইচা থাকুম।
।। কী কইরা বাঁচবি তুই?
কথক।। কী কইরা বাঁচুম? শোন তবে, শুনো তোমরা – সেই অন্ধ ভিখারী ভিক্কা করে নাগান
গায়, মাইয়ারে লইয়া। গঙ্গার ঘাটে পোলাটা জানে মাছ উঠবো না তবু ছিপফেলে
প্রতিদিন, এইপার ঐপার আলাদা দ্যাশ হইয়া গেছে জাইনাও নদীটা জলবওয়াইয়া দেয়
সব সময় আর আমার বিশু মরণের ডাক শুইনাও বিড়ি ধরাইয়া বইসে – অরা
জানে শ্যাষ বইলা কিস্যু নাই। আর আমি পারুম না? পারুম। আমি বাঁইচা থাকুম।
আমি ঠেকাইমু পাড়াপড়শিরে। আমার বালক, আমার বিশু বাঁইচা রইব। আমরা
দুইজনা মিইলা ঠেকাইমু। শ্যাষে তরা রুইখা দাঁড়াইবি। তুই, কড়াতের দাঁতরে দিবি
ভোঁতা কইরা। তুই, তরে যতবার তাড়াইব ততবার ফিইরা আইবি তুই। তারপর
সক্কলে মিলা ঠেকাইমু তাগো। ক পারুম না? কন আপনারা পারুম না?
গান
নিশা লাগিল রে নিশা লাগিল রে
বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে।
হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে
নিশা লাগিল রে।
(গান চলতে থাকে! তার মধ্যে কথক বলে চলে)
কথক।। নেশা লাগসে। নেশা আছে আমার নয়ানে। নেশা আছে সবখানে। ঐ অন্ধভিখারী আর
তার মাইয়া, ছিপ হাতে ঐ পোলা, কুশিয়ারা নদীখান, আমার এই নিমগাছ আর
পোষা কুত্তা, এই ধরিত্রীর সবখানে নেশা আছে। আর নেশা আছে সেই বালকবিশুর
মধ্যে। আমরা কেবল চাইয়া থাকি। বড় বেশি কইরা চাইয়া থাকতে হয়। বড় বেশি
দিন। তারপর দিনের প্রগাঢ় অপেক্ষা থাইমা গেলে এক অন্য আলো আইসা পড়ে। সেই
আলোয় মাধবীলতা আর আম্রকুঞ্জের মিলন হয়। মিলন হয় বাতাস আর পরাগের,
মৌমাছি আর মঞ্জরীর। এইসব দেইখা আমার বালক কইব – এরই নাম প্রেম।
গান
নিশা লাগিল রে নিশা লাগিল রে
বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে।
হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে
নিশা লাগিল রে।
সমাপ্ত
অলঙ্করণঃ স্মিতা দাশ ও সায়নী দাশ
নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার ছবি
লেখক পরিচিতি
রজত দাসের এযাবতকালে বেশ কয়েকটি নাটক ছাপা হয়েছে, কখনও কোনও পত্রিকায় আবার কখনও বই হিসেবে। প্রকাশিত নাটক, ১) বাঘারে, ২) নাটকের নাম হত্যা, ৩) খেলনানগর। ছায়াছবিতে প্রকাশিত নাটক 'জামলো মকদম'।
No comments:
Post a Comment