প্রাচীন এডিনবরা শহরের মূল রাস্তা রয়াল মাইল (এই রাস্তা এডিনবরা ক্যাসেল থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট অবধি বিস্তৃত। এর চারপাশেই আছে সমস্ত দর্শনীয় বস্তু) ধরে হাঁটতে গিয়ে হাই স্ট্রিট ও George IV ব্রিজের মোড়ে একটা দেওয়ালের গায়ে ব্রোঞ্জের ফলকে একটা নাম দেখে হঠাৎ করে আমি আটকে গেলাম। নামটা হল, George Bryce, The Ratho Murderer।
যেমন ইচ্ছা, লেগে গেলাম খোঁজ করতে। পাশেই একটা জামা কাপড়ের দোকান। সেখানকার দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলাম "The Ratho Murderer" শব্দের মানে। হাসতে হাসতে সুবেশী বৃদ্ধা মহিলা বললেন, ওটার মানে হল রাথো গ্রামের খুনী।
চোখ কপালে উঠল। বললাম, হ্যাঁ, সে তো বুঝলাম। লেখাই আছে জর্জ ব্রাইস নামক একজন অপরাধীর নাম। কিন্তু গল্পটা কী?
উনি বললেন, এখন দোকান ভর্তি। পারলে সন্ধ্যে সাতটায় এস।
এডিনবরা শহরের প্রথম অকেজো রবিবারে এই গল্পটা শোনার বাসনা ছাড়তে পারিনি। দোকানে আবার হাজির হলাম ঠিক সন্ধ্যে সাতটায়। বাঙালীর অনভ্যস্ত -5°C-এ আমার নকুড়মামাগোছের পোষাক দেখে মহিলা তো হেসেই বাঁচেন না। বললেন, সবে তো মাইনাস পাঁচ! এতেই যদি কম্বল (আদতে মোটা জ্যাকেট, মাঙ্কি ক্যাপ ও দস্তানা পরেছিলাম) গায়ে রাস্তায় বের হও, এরপর আরও ঠান্ডায় কী করবে? বাঙালী কায়দায় দাঁত বের করে হেসে কথাটা এড়িয়ে বললাম, গল্পটা বলুন।
এডিনবরা এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ৭ কিমি দূরের একটি গ্রামের নাম রাথো (Ratho)। জনসংখ্যা অনধিক ১৭০০ মাত্র। সেই গ্রামে প্রায় দুশো বছর আগে একটি সরাইখানার মালিকের ঘরে জর্জ নামক একটি অতি সাধারণ ছেলের জন্ম হয়। সেকালের নিয়মানুসারে খানিক শিক্ষার্জন করে সে একজন বড়লোকের বাড়িতে গাড়ি চালানোর কাজ পায়। জর্জ ছিল খুবই ভদ্র ও নিয়মানুবর্তী মানুষ। কিন্তু সন্ধ্যের সময় মদ্যপান করলে সে হঠাৎ করে দানবে পরিণত হত ও নিজের ঘরের জিনিস ভাঙচুর করত। তার এই স্বভাবের কথা গ্রামের মানুষের কাছে অজানা ছিল না। একটা সময় গ্রামে তার নাম হয়ে যায়, George, the drunkard।
বয়সের ও প্রকৃতির নিয়মানুসারে একদিন জর্জ ইসাবেলা নামক একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে। জর্জ যে ধনীর গাড়োয়ান ছিল, সেই বাড়ির রাঁধুনী ছিল ইসাবেলা। তাদের সম্পর্কের চাকা গড়াতে শুরু করে দ্রুত গতিতে। বাড়ির বাইরের বাগানে, নির্জন পার্কে, ঝর্ণার ধারে মাঝে মাঝেই তাদের যুগল পদচিহ্ন প্রকাশ হতে লাগল।
ধাক্কা এল কয়েক মাস পরেই। ইসাবেলার একজন বন্ধু, জেন সিটন (Jane Seton) জর্জের গ্রামের বাসিন্দা। ইসাবেলার কাছ থেকে তাদের প্রণয়ের খবর জানতে পেরে সে জর্জ সম্পর্কে ইসাবেলাকে সাবধান করে। জর্জের মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের খবর দিয়ে জেন জানায় যে, সে কিছুতেই ইসাবেলার সমকক্ষ হতে পারে না।
একদিন রাতে জেন ইসাবেলাকে নিয়ে জর্জের বাড়ির সামনে যায় ও জর্জের নেশাতুর তাণ্ডবের সাক্ষী হতে সাহায্য করে। ইসাবেলা পরেরদিন জর্জের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
আহত জর্জকে ইসাবেলার সাথে অতিবাহিত মধুর সময়ের স্মৃতি প্রতিনিয়ত আঘাত দিতে থাকে। তার মদ্যপানের মাত্রা ও হিংস্রতা বেড়ে যায় উত্তরোত্তর। একদিন রাতে মাতাল জর্জ জেনের বাড়ি হামলা করে। সুযোগ বুঝে সাহায্যের আশায় চিৎকার করতে করতে জেন পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জর্জের আসুরিক শক্তির কাছে হার মানে। জর্জ পিছন থেকে জাপটে ধরে ছুরি দিয়ে জেনের গলার নলি কেটে দেয়। জেনের আর্তচিৎকারে ততক্ষণে বাড়ির সামনে লোক সমাগম হতে শুরু করেছে। সুতরাং, জর্জের কাছে পালানোর কোন সুযোগ ছিল না।
আইনের চোখে এই হিংস্র খুনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কিছু না। সুতরাং আদালত "sentenced him to hang"।
প্রাচীন স্কটল্যান্ডে জনসমক্ষে ফাঁসির রীতি ছিল। অপরাধীকে প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে টেনে আনার সময় জনগণ তার দিকে ঢিল, পচা ফল বা ডিম ছুঁড়ে আক্রোশ মেটাতো। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই বর্বরোচিত ব্যবস্থায় ইতি টানতে রাজার কাছে আপিল করা হয়। রাজার আদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে একটি সংরক্ষিত এলাকায় গুপ্ত কক্ষ তৈরি হতে শুরু করেছিল। এমন সময় জর্জ ব্রাইস এমন জঘন্য অপরাধ করে বসে।
প্রাচীন নিয়মাবলী মেনে ২১শে জুন ১৮৬৪ সালের সকালে জর্জকে রয়াল মাইল ধরে টেনে আনা হয়। রাস্তার দুপাশের জনগণ তার দিকে পচা ফল ও ডিম ছুঁড়ে আক্রোশ মেটাতে থাকে। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে টমাস অ্যাসকার্ণ (Thomas Askern) নামক একজন কম মজুরির ফাঁসুড়েকে নিয়োগ করা হয়। লোকটির সমস্যা ছিল যে অনেক সময় সে ফাঁসির দড়ির দৈর্ঘ্য বুঝতে পারত না। তাই অধিকাংশ ভুলে দড়ির দৈর্ঘ্য কম হত ও অপরাধীর মৃত শরীরটা জনসমক্ষে ঝুলত।
প্রথা হল, ফাঁসি কাঠের নীচে একটি চারদিকে ঘেরা স্টেজ থাকবে। ফাঁসি হলে পায়ের নিচের পাটাতন সরে যাবে ও অপরাধী সেই স্টেজের মধ্যে ঢুকে যাবে। সুতরাং অপরাধীর আতঙ্কিত ও বাঁচার চেষ্টার জন্য ছটফট করা শরীরটা জনগণ দেখতে পাবে না।
অ্যাসকার্ণ জর্জের ক্ষেত্রেও একই রকম ভুল করে। এডিনবরা শহরের মেয়র জর্জের মৃত্যুকালীন ছটফট করা শরীরটা দেখে তৎক্ষণাৎ ঘোষনা করেন যে, সেই সময় আরও প্রায় দু'শো (200) টি বকেয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে সংরক্ষিত এলাকার গুপ্তকক্ষ তৈরি হবার পরেই। জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড সেই দিন থেকে বন্ধ।
জর্জ ব্রাইস এডিনবরা শহরে বেঁচে রইল The last public executed murderer হিসাবে।
গল্পটা শুনে রাস্তায় বেরিয়ে একটি অদ্ভূত অনুভূতি হল। ব্রোঞ্জের ফলকটার সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। তারপর একটা ছবি তুললাম। অদ্ভূত শহর এই এডিনবরা। রাস্তার একদিকে George Bryce, the Ratho Murderer-এর ফলক, আর উল্টোদিকে দার্শনিক ডেভিড হিউমের ব্রোঞ্জের মূর্তি।
স্যান্ডি স্টডার্টের তৈরি হিউমের মূর্তিটি ১৯৯৫ সালে উদ্বোধন হয়েছে। ডিউক অফ এডিনবরার স্থাপত্য অফিস থেকে এই মূর্তিটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে 'extremely grave and serious representation' বলে।
মূর্তিটির দিকে তাকালে নজর কাড়বে, নীল রঙের মূর্তির ডান পায়ের বুড়ো আঙুল চকচকে ব্রোঞ্জের আসল রঙের। পৃথিবীর সব নিপীড়িত মানুষ কম বেশী কুসংস্কারের শিকার। স্কটিশরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?
এরা অর্থনৈতিকভাবে যেমন দুর্বল, তেমনই আঞ্চলিকভাবে কোণঠাসা। চিরকাল যুদ্ধ এদের বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করেছে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নিরবিচ্ছিন্ন স্ট্রাগল করেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে উঠেছে ডাইনি, জলপড়া, বান মারার মতন মতবাদও। তবে দৈহিক বিপ্লবের মাঝে হুট করে যখন কেউ পৃথক চিন্তাশক্তির পরিচয় দেন, জনগণ তাঁকে বড় বেশী আপন করে নেয়। যেমন আমাদের রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, রামমোহনের মতবাদ সকল বিপ্লবীদের অন্য মাত্রার চিন্তা যোগাতে সাহায্য করেছিল, চেষ্টা করেছিল কুসংস্কার ত্যাগ করে প্রকৃত পরিশ্রমী সত্ত্বা কায়েম করতে। তাঁদের জনপ্রিয়তার কারণ হয়ত তাঁদের মতবাদ কিছুটা মানসিক একঘেয়েমি থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে পেরেছিল বলে। অবশ্য মিস্টার ফ্রয়েড তাকে কি বলবেন, জানিনা। আসলে জ্ঞান ও শিক্ষাকে আমরা আজও অস্বীকার করতে পারি না।
স্কটল্যান্ড দেশটি ছোট, লোকসংখ্যা অতি সামান্য। তাদের যুদ্ধবিদ্যার মাঝে জ্ঞান বিতরণ করার লোকও অনেক কম। তবু অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় ১৭১১ সালে এক মানুষের জন্ম হয়। তাঁর নাম ডেভিড হিউম। এনার ভাইপোর নামও এক, তিনি আবার Royal Society of Edinburgh প্রতিষ্ঠাতাদের একজন।
ডেভিড হিউম হলেন স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি। মৃত্যুর ২৪৩ বছর পরও। আমরা জানিনা আমাদের রবি ঠাকুর তাঁর মৃত্যুর আড়াইশো বছর পর আমাদের মধ্যে কি অবস্থায় থাকবেন!
হিউমের মূর্তি উদ্বোধনের পর তাঁর মতন পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞা পাওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে হিড়িক পড়ে যায়। সবাই মনে করে যে ওনার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলকে প্রতিদিন একবার স্পর্শ করলে তাঁর মতন পাণ্ডিত্য লাভ করা যাবে, (এতেও হয়তো মিডিয়ার কারসাজি আছে)। বিপ্লব শেষ হয়, কিন্তু কুসংস্কার তো বন্ধ করার বিষয় নয়। সেটা যে মনের মধ্যের ভয় থেকে উৎপাদিত হয়। আর ভয় তো এখন একটাই, পিছিয়ে পড়ার ভয়।
প্রতিদিন একজন মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারলে তাঁর অন্তর্বর্তী আত্মা যেমন উন্মোচিত হয় তেমনই বহু মানুষের স্পর্শে হিউমের মূর্তির প্রকৃত ধাতব রঙ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।
সংস্কার বা কুসংস্কার, যাই হোক না কেন। ঐ যে আগেই বললাম, আমরা আজও মানুষের পাণ্ডিত্যকে অবহেলা করতে পারি না।
লেখক পরিচিতি
গত বছর দুদিনের জন্য এডিনবরা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। শহরটা ভাল করে ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি, তবে বাসে করে স্কটল্যান্ডের অন্যত্র একটু ঘুরতে পেরেছিলাম। আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভাল লাগল, আবার যেন পুরোনো শহরটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। পার্লামেন্ট বিল্ডিংটাও মনে পড়ে গেল।
ReplyDelete