প্রবন্ধঃ জন্মশতবর্ষে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও আধুনিকতা - শ্রুতায়ু ভট্টাচার্য


জন্মশতবর্ষে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও আধুনিকতা


শ্রুতায়ু ভট্টাচার্য



জন্মশতবর্ষ শব্দের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে উদযাপনের ধারণা। জন্মমুহূর্তের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকলেও কোনও ব্যক্তির জন্ম থেকে শতবর্ষ অতিক্রম করা আয়ুরেখায় যে বিবিধ স্বীকৃত নির্মাণ সমকালকে প্রভাবিত করে তারই উদযাপন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, জন্মবর্ষের প্রাসঙ্গিকতা একটা সূচক হয়ে ওঠে। সঙ্গীতকর্মী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষও আসলে তাঁর সঙ্গীত জীবনের অবদানকে উদযাপন করার একটা উপলক্ষ্য মাত্র। 

যদি একশ বছর পিছিয়ে ১৯২০ সালের দিকে তাকাই তবে দেখব এক অন্য পৃথিবীকে, অন্য বাংলাকে।  বাংলার সঙ্গীতজগত সে সময় বেশ বর্ণময়। নাগরিক সঙ্গীত আধুনিক কাঠামোলাভ করছে, নাগরিক আধুনিক সঙ্গীতের ধারাটি ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। সঙ্গীতকে ‘নির্মম ভাবে আধুনিক’ করে তোলার উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ আরও অনেকেই। ‘ক্লাসিকিয়ানা’ ও ‘সাবেকিয়ানা’র প্রভাব থেকে আধুনিক সঙ্গীতকে মুক্ত করার সচেতন চেষ্টা চালাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। রাগরাগিণীর দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসে বাংলার আধুনিক সঙ্গীত চেষ্টা করছে স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরির। পাল্লা দিয়ে উঠে আসছে গায়নশৈলী পরিবর্তনের চাহিদাও। তিরিশের দশকে সঙ্গীতজগতে প্রবেশ করা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতের প্রতি অবদান এই আধুনিকতার মূল সুরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই। জন্মশতবর্ষের আলোচনায় সেই প্রসঙ্গ অবধারিত। 



“আমার গানেতে এলে নবরূপে চিরন্তনী,/ বাণীময় নীলিমায় শুনি তব চরণধ্বনি”- বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায় এবং কমল দাশগুপ্তের সুরারোপিত যূথিকা রায়ের গাওয়া ‘তোমার হাসিতে জাগে’ গানের সুরের আদলে প্রথম ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে (অল ইন্ডিয়া রেডিওর তৎকালীন নাম) গাইলেন হেমন্ত, তখন তিনি ক্লাস নাইনের ছাত্র। এরপরে বহু প্রত্যাখানের পরে ১৯৩৭-এ বেরোল প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড, এইচএমভি-র শৈলেশ দত্তগুপ্তের তত্ত্বাবধানে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়কীতে এই সময়ে পঙ্কজকুমার মল্লিকের ছাপ সুস্পষ্ট। সেই সময়ে গায়নশৈলীতে পঙ্কজ মল্লিকই সবচেয়ে আধুনিক এবং জনপ্রিয়ও। তাই নবীন গায়কদের মধ্যে তাঁর প্রভাব ভীষণভাবেই উপস্থিত। 

শুধু গান গাওয়া নয়, প্রথম থেকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর দেওয়াতেও প্রবল আগ্রহ। এই অভ্যাস আরও দানা বেঁধেছিল কাশীতে স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন বিদ্রোহী কবিতায় সুর দিয়ে। এই অভ্যাস একদিকে যেমন তাঁর সুরকার সত্তাকে তৈরি করেছে তেমনই সঙ্গীত সম্বন্ধেও নতুন ভাবনার রসদ জুগিয়েছে। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গান, বিশেষ করে নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যের গান তাঁকে সুরবৈচিত্র্য সম্বন্ধে অনেক ধারণার সন্ধান দিয়েছে। সারা পৃথিবীর সঙ্গীত থেকে রবীন্দ্রনাথের গান কিভাবে রসদ খুঁজে এনে স্বতন্ত্র সঙ্গীতচিন্তাকে বাস্তবায়িত করেছে তা হেমন্তকে অভিভূত করেছে। এই সমস্ত দেখা এবং শ্রবণের অভিজ্ঞতাই হেমন্তকে পথ বাতলে দিয়েছে নিজস্ব আধুনিক গায়কী তৈরির। 



চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশক থেকে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা আধুনিক গানের সুরকারেরা যে বিবিধ রাস্তায় সঙ্গীতকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার সঙ্গে পাল্লা দিতেই প্রয়োজন হচ্ছিল আধুনিক, পরিশীলিত কণ্ঠের। বাংলা গান চলচ্চিত্রে এক নতুন মাত্রা এনে দেওয়ার সঙ্কেত দিচ্ছিল। সঙ্গে পাল্টাচ্ছিল রেকর্ডিং সংক্রান্ত খুঁটিনাটিও। অন্যদিকে সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার ঢেউ লাগছিল গানের কথায়, চলনে, কাঠামোয়। তাই প্রয়োজন হচ্ছিল নতুন অভিব্যক্তিরও। 

সঙ্গীত সম্বন্ধে দূরদর্শী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খুব সচেতন ভাবে সেই আধুনিকতার দাবিকে বুঝতে পেরেছিলেন, চল্লিশের গোড়া থেকেই। এর সঙ্গে ছিল নিজস্ব পরিচিতি তৈরির যুক্তিও। তখন সবে প্লে-ব্যাক করার ডাক পেয়েছেন তিনি। আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’য় হেমন্ত লিখেছেন, 

“এইসময় থেকেই আমি আমার গানের স্টাইল সম্বন্ধে সচেতন হলাম। গোড়াতে পঙ্কজদাকে অনুকরণ করে গান গাইতাম। সেই ছাপটাই আমাকে এতোদিন এগিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আর তো পরের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো চলে না। নিজের পোশাক না হলে চিনবে কী করে লোক? তাই নিজস্ব একটা ভঙ্গির দিকে জোর দিলাম। প্রথমে নজর দিলাম গানের উচ্চারণের দিকে। খুব স্পষ্ট হওয়া চাই, সেই সঙ্গে থাকা চাই মিষ্টত্ব। যা মানুষকে আকৃষ্ট করবে… উচ্চারণটা যেমন সঠিক হওয়া উচিত ঠিক সেইসঙ্গে দেখতে হবে স্বাভাবিকতা না হ্রাস পায়…আর এই করতে করতে নিজের একটা স্টাইল এসে গেল। সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইল, হেমন্ত-কণ্ঠের সূচনা হল তখন থেকে।“

সচেতন ভাবেই তিনি পরিহার করতে শুরু করলেন তাঁর অগ্রজ শিল্পীদের গানে উপস্থিত mannerism-কে। তাঁর কণ্ঠের স্বাতন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে গেল একটা যুগের সূচনাপর্বও- হেমন্ত যুগ, যা থেকে আজও বেরোতে পারেননি সঙ্গীতের শ্রোতারা। তাঁর সঙ্গীতজীবন চল্লিশের দশক থেকে যত সামনের দিকে এগিয়েছে এই হেমন্ত কণ্ঠের আবেদনে মেতে উঠেছে গোটা সঙ্গীতজগত। একই সাথে সুমিষ্ট, মন্দ্র, সুরেলা এবং আবেশ তৈরি করা কণ্ঠ যার যোগ্য শরিক উপযুক্ত উচ্চারণ। এর সঙ্গে রয়েছে পরিমিতি বোধও। দিলীপকুমার রায় একজন সত্যিকারের সঙ্গীতশিল্পীর মধ্যে যে গুণগুলো লক্ষ করেছিলেন, অর্থাৎ, “সহজ সৌষ্ঠবজ্ঞান (sense of proportion) ও সংযমজ্ঞান”-এর উপস্থিতি, সেসবই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে বারবার অনুভূত হয়।  



গান চয়ন সম্বন্ধে বরাবরই ভীষণ সচেতন হেমন্ত। অর্থাৎ, কোন গান তিনি তাঁর অনায়াস ভঙ্গিতে গাইতে পারবেন, আর কোন গানে তিনি সাবলীল নন সেটা গান শুনেই বলতে পারতেন। অথচ সারা সঙ্গীতজীবনে তাঁর গানের সম্ভার প্রবল বৈচিত্র্যে ভরা। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের বহুমুখী বিভিন্ন ধরনের গান তাঁর অনুশীলনের আওতায় থাকাতেই হয়তো সম্ভব হয়েছে নানা দিকে বিচরণ করা। একদিকে সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত একাধিক গণসঙ্গীত ও চেতনার গান রেকর্ড হয়ে বেরিয়েছে তাঁর কণ্ঠে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘ঠিকানা’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতায় সুর দিয়ে গাওয়ানোর জন্য তাঁকেই বেছে নিয়েছেন সলিল চৌধুরী। ‘পথে এবার নামো সাথী’, ‘নৌকা বাওয়ার গান’, ‘গাঁয়ের বধূ’-র মত গানেও হেমন্তের কণ্ঠ আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। এর পাশাপাশি সলিল চৌধুরীর ব্যক্তিগত গভীর জীবনবোধের গানগুলো যেমন ‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘শোনো কোনও একদিন’, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’ প্রভৃতি অনন্য মুন্সিয়ানার সঙ্গে গেয়েছেন হেমন্ত। লক্ষনীয় যে, সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতকাজগুলো (composition) যতটা জায়গা রেখেছে গায়কের জন্য সেটুকুকেই ভরিয়ে তুলেছেন হেমন্ত। সেখানে আবেগের আতিশয্য নেই। অর্থাৎ, একজন আধুনিক শিল্পী তাঁর শিল্পমাধ্যমের মধ্য দিয়ে ইনফরম (স্থূল অর্থে তথ্য নয়) করে থাকেন শিল্পের গ্রহীতার কাছে, ধরে অর্থ বুঝিয়ে দিতে চান না। হেমন্ত ঠিক ততটাই করেছেন এবং সফল ভাবে পৌঁছে গেছেন মানুষের মধ্যে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, জগন্ময় মিত্রের গানে যে বাড়তি দরদ দেওয়ার প্রচেষ্টা অনুভূত হয় তা হেমন্তের গানে একেবারেই অনুপস্থিত, এবং হেমন্ত সচেতন ভাবেই তা করেছেন।            



হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল তা বিষাদসুন্দর। ইংরেজি শব্দ melancholy-র যে ব্যঞ্জনা তা ঝরে পড়ে হেমন্তের বহু গানেই। ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘নীল আকাশের নীচে পৃথিবী’, ‘তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ’, ‘তেরি দুনিয়া মেঁ জিনে সে’ প্রভৃতি গানে তা সহজেই ফুটে ওঠে। আশ্চর্য ভাবে, যাত্রাপথের ক্লান্তিও হেমন্তের কণ্ঠবৈচিত্র্যে ফুটে ওঠে সঙ্গীতের ক্যানভাসে।  মরুতীর্থ হিংলাজ ছবির ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ আর সলিল চৌধুরী সুরারোপিত সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘পাল্কির গান’ এগুলো আলাদা রকমের ক্লান্তির কথা বললেও দুই ক্লান্তিই প্রতিভাত হয় হেমন্তের কণ্ঠে। 

মুম্বইতে সুরকার এবং গায়ক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে একের পর এক হিন্দি গানে নিজের স্টাইলকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। ‘তুম পুকার লো’, ‘না তুম হামে জানো’, ‘ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনি’, ‘এ দিল আব কহিঁ না যা’ প্রভৃতি গান আরবসাগরের পারের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে ব্যারিটোনের ছোঁয়াচ দিয়েছে। কিশোর কুমার যখন গাইছেন ‘উও শাম কুছ আজিব থি’ তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীতযাপনের ট্রেডমার্ক বিষাদ সারা গানের দেহে লেপটে থাকছে। 

লোকসঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে যেসব গান হেমন্ত গেয়েছেন মূলত ছায়াছবির জন্য সেখানে তাঁর নাগরিক পরিশীলিত কণ্ঠে এনে দিয়েছেন বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের ঘরানার ছোঁয়াও। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিণীতা ছবির ‘জাগো রাই কমলিনী’ গানটির কথা। ‘আবার শোনো বন্ধু শোনো প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’ কিংবা ‘সাগর থেকে ফেরা’-র মত কিছু ব্যতিক্রমী গানেও তাঁর গলা সাবলীল। 



বর্ষার আমেজ আছে এমন গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এ হেন কণ্ঠ এক আলাদা মাত্রা এনে দেয়- রবীন্দ্রনাথের গানে হোক কিংবা অন্য গানে। ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’, ‘আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল’, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’, ‘সঘন গহন রাত্রি’ প্রভৃতি গানে তাঁর জলদগম্ভীর অথচ সুমিষ্ট বিষাদবাহী কণ্ঠে বর্ষার চিত্রকল্প ফুটে ওঠে, প্রকৃতির সঙ্গে শ্রোতার নিবিড় যোগ সাধন করে তাঁর কণ্ঠের তুলি। তেমনই ‘তুমি এলে অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এল’, ‘কতদিন পরে এলে’, ‘যখন মনের মেঘ বৃষ্টি ঝরায়’, ‘টাপুরটুপুর বৃষ্টি ঝরে’ প্রভৃতি গানও সিক্ত করে তোলে শ্রোতামনকে। কিন্তু আবেগ কক্ষনও বল্গাহীন নয়। 

হেমন্তের গান শোনা আসলে শিল্পে আধুনিকতার পাঠ নেওয়ার সামিল। যা কিছু বাড়তি সবকিছুকেই শান দিয়ে সুষ্ঠুভাবে পরিবেশন করা। অতিনাটকীয়তা নেই, না আছে দেহের ভঙ্গিতে না আছে স্বরপ্রক্ষেপণে। সাদা হাতাগোটানো শার্ট ও ধুতি পরিহিত আপাত শান্ত ও গম্ভীর ব্যক্তি তাই একশো বছর পার হয়েও সঙ্গীত জগতের আইকন।    

তথ্যসুত্রঃ 

১. আনন্দধারা- হেমন্ত মুখোপাধ্যায় 

২. সংগীতচিন্তা- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


লেখক পরিচিতি



শ্রুতায়ু ভট্টাচার্যর ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। সঙ্গীত, ক্রীড়া সম্বন্ধে উৎসাহী।

No comments:

Post a Comment