রোদ্দুর,
কয়েকটা পাতা নষ্ট করার পর অবশেষে মনে হল বেশি না ভেবে লিখতে শুরু করি৷ আজ এইমুহূর্তে তোমাকে এই চিঠি লিখতে বসার কারণ জানো? একটা পাখি৷ পড়ে হাসবে নিশ্চয়? আচ্ছা তোমার মনে আছে ইছামতীর সেই বিকেল? আর ওই ভাঙ্গা পাঁচিলের ওপর বসা নীলচে বেগুনী রঙের পাখিটাকে? যেটা একভাবে শিস দিয়ে যাচ্ছিল বলে তুমি বলেছিলে, "এরকম একটা পাখি তোমার কাছে রেখে দিও তনু, আমাকে মনে পড়লেই ওকে ডাকতে বলবে৷ আমি ওর ডাক শুনেই বুঝে যাব তুমি কোথায় আছো৷"
আজ ওই পাখিটাই এসে ডাকছে আমার বারান্দায়৷ তাই তো মনে পড়লো তোমায়, তাই তো ভাবলাম এক্ষুণি হয়ত তুমি সাইকেল নিয়ে দাঁড়াবে এসে নীচে কয়েক মিনিট, আর আমি থাকবো দোতলার বারান্দায়, ঠিক আগের মত...
মাঝেমাঝে মনে হয় বর্তমান সময়টা আসলে একটা স্বপ্ন৷ ঘুম ভাঙ্গলেই আবার দেখব আমার সেই ঘর, কালো পালঙ্ক, ওপরের কড়িবরগা থেকে ঘটঘট করে আওয়াজ করে চলা পাখা আর দেওয়ালে থাকা এ্যন্সোনিয়া ঘড়ি, যা জানান দেবে এখন সকাল ছ'টা বাজে আর আমি "উঃ কি বাজে স্বপ্ন!" বলে পাশ ফিরে যেই শুতে যাব রাণীদিদি এসে মুখে জল ছিটিয়ে উঠিয়ে দেবে৷ রাণীদিদি! কতদিন পর মনে পড়লো তাকে, অথচ একসময় সে একদিন না এলে আমি মন খারাপ করে বসে থাকতাম, এমনকি তোমার সাথেও কথা বলতাম না, মনে আছে? তাকে ফেলে দিয়েছিলাম কোন বিস্মৃতির অতলে রোদ্দুর! আজ পাখিটা কি আমার অবচেতনের ঘুম ভাঙ্গাতেই এসেছিল! রাণীদিদিকে শেষ দেখেছি সেইদিনই, ওর বানানো নারকেল তক্তির বয়াম আমাদের এনে দেবে বলে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ তারপর আমার আর কিছু মনে পড়ে না, সব কেমন ধোঁয়াটে লাগে, তোমার লাল পাঞ্জাবীর কোণটুকু ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ে না!
আবার মাঝেমধ্যে তোমার ওপর আমার ভীষণ রাগ হয়, ভীষণ৷ তুমি বলেছিলে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে পড়া তোমার স্বপ্ন৷ এখানে আসার পর যখন দেখলাম মেডিকেল কলেজ থেকে আমার বাড়ি মাত্র কয়েক পা দূরত্বে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম, আর তারপর থেকে যখনই বাইরে বেরোতাম তোমাকে খুঁজতাম, তোমার মত আদলের কাউকে দেখলে দমবন্ধ করে অপেক্ষা করতাম কখন তার মুখটা দেখব৷ তেরো বছর হয়ে গেল! এখনও শুধু আদলই দেখতে পাই, তোমায় নয়৷ তখন ভাবিনি এখন মনে হয় দেখা হলেই বা কি হত? আসলে কি-ই বা হয়েছিল আগেও? কখনও তো মুখ ফুটে 'ভালোবাসি' বলোনি.. জানি সামনে থাকলে এক্ষুণি বলতে, "মুখের কথাই সব তনু? বাকিটা?", ওই 'বাকি'টার জন্যই তো আমিও অসম্পূর্ণ হয়ে থাকলাম, এই এতগুলো বছর পরেও৷ নাহ্ বাইরের সমাজ আমাকে সুগৃহিণী, সদাহাস্যময়ী জননী রূপেই চেনে৷ শুধু নিজের সামনে একা দাঁড়ালে অপূর্ণতাটা বড্ড চোখে পড়ে যায়, নিজেরই..
তাই তোমাকে চিঠি লিখতে বসি৷ তোমাকে লেখার সাথে সাথে আমি ঘুরে বেড়াই আমার বাড়ির আশেপাশে, রহমত চাচার মাঠে ওই যে, যেখান থেকে দূরে ধোঁয়া ওঠা রেলগাড়ি দেখা যেত। তারপর দুর্গামন্দির আর তার চাতালে শোয়া ভোলা কুকুরকে পেরিয়ে তোমার বাড়ি৷ শিউলি ফুল পাড়ার ছুতোয় কতবার যে গেছি তোমাদের বাগানে! বিশেষতঃ মহালয়ার ভোরে, এখনও রেডিওয় 'মহিষাসুরমর্দিনী' শুনলে আমার মনে পড়ে যায় তোমার হাতে ধরা একমুঠো শিউলি যা ঢেলে দিয়েছিলে আমার হাতে৷ ব্যস ওইটুকুই! তবুও সেদিনের সেই ভোর, শিউলির গন্ধ, তোমার শান্ত দু'চোখ আর একচিলতে হাসিটা মনে পড়লেই এখনও চোখদুটো অবাধ্য হয়ে জলে ভরে ওঠে৷ যাই হোক, তোমার বাড়ি পেরিয়েই আমাদের এলাকার একমাত্র বালিকা বিদ্যালয়৷ 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের সময় সেই যে বিদ্যালয়ে বোমাবর্ষণ হল ব্যস পড়াশোনাও বন্ধ হল৷ যদিও সুধাকর জেঠুর বাড়ির লাইব্রেরি ছিল আমাদের একফালি মুক্তির আকাশ৷ ওখানেই তো প্রথম পরিচয় আমার রবীন্দ্রনাথের সাথে তারপর বঙ্কিমচন্দ্র, কালিদাস, কবীর এবং জীবনানন্দ! জীবনানন্দ বললেই আমার তোমাকেই মনে আসে আবারও..
জেঠুর পড়ার ঘরের লাল মেঝেতে বসে আমরা সবাই, সামনের টেবিলে ফুলদানিতে একগুচ্ছ গোলাপ রাখা আর তার পাশে বসে তুমি উদাত্ত কন্ঠে আবৃত্তি করছো, "দূরে, কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙে / গ্রামপতনের শব্দ হয় / মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে / দেয়ালে তাদের ছায়া তবু / ক্ষতি, মৃত্যু, ভয় / বিহ্বলতা বলে মনে হয়"...
যেদিন ওনার মৃত্যুসংবাদ শুনেছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল তুমি হয়ত আজ কারুর সাথে কোনও কথাই বলবেনা৷ সময়ের ধাক্কায় এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া একজন মানুষ তো! তাই ট্রামের এক ধাক্কাতেই গুঁড়িয়ে গেলেন চিরতরে! এই ভঙ্গুরত্ব আমাদের থেকে ভালো আর কে বোঝে..
আসলে বদ্ধ ঘরে মানচিত্র, কাগজ নিয়ে কাঁটাতার বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষেরা বুঝতে পারেনা ওই কাঁটাতার কত মানুষের বুকের ওপর গেঁথে গেঁথে বসছে যা সারাজীবনের জন্য ক্ষত সৃষ্টি করে রাখবে, সেখান থেকে সর্বদা রক্ত ঝরবে গোপনে এবং সে ঘা শুকোবেনা কোনওদিন..
আমি মনেই করতে চাই না জানো সেই রক্তাক্ত সময়! চারপাশে পত্রপত্রিকায় অনেক লেখা পড়ি এ বিষয়ে, পুরোটা শেষ করতে পারিনা৷ 'দ্যাশ' কথাটায় একটা আর্তনাদ আছে যা আমাকে অস্থির করে দেয়৷ মনে হয় সেই মুহূর্তে দৌড়ে চলে যাই সব ছেড়ে৷ মনে হয় যেখানটায় দাঁড়িয়ে তুমি বলেছিলে, "চিন্তা করো না, আমি পরের নৌকাতেই উঠে পড়বো, তুমি ওপারে গিয়ে অপেক্ষা করো৷ ঘন্টাখানেকের তো ব্যাপার তনু, যাও তোমার বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছেন৷" ঠিক সেখানটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকি তোমায়৷ সবাইকে ডেকে প্রশ্ন করি তুমি এলে না কেন? এই নদী দিয়ে তো কত নৌকা ভেসে গেল ওপারে, তুমি কোথায় গেলে? তোমার ধর্ম আলাদা বলে কি ওরা তোমাকে আসতে দিলোনা আমার কাছে! কিন্তু নামাজের সময় ছাড়া আর কখনো তো মনেই হয়নি তুমি আলাদা! আচ্ছা তোমার মনে হয়েছিল কখনো? দুর্গাপুজোর সময় গরদের শাড়িতে আমাকে দেখে তুমি বলেছিলে 'মহামায়া', মনে আছে?
বেশ তখন না হয় এলে না, কিন্তু চিঠি? একটা চিঠিও তো..
ওহ্ আমার ঠিকানাই তো জানতে না তুমি! আমিও তো তোমাকে লিখে পাঠাতে পারিনি কোনওদিন "আমি অপেক্ষা করছি"..
আচ্ছা তুমিও কি চিঠি লিখে আমারই মত ট্রাঙ্কের তলায় লুকিয়ে রেখে দাও? তোমার কি মনে আছে কলাবিনুনী বাঁধা লালডুরে শাড়ির সেই পাড়াবেড়ানি মেয়েটাকে? এখনও আছে ওই দুর্গামন্দির আর রহমত চাচারা? শিউলি গাছটায় ফুল হয় আগের মত? আচ্ছা আমাদের বাড়িটা কি রয়েছে? থাকলে ওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকিয়ে ফেলো বুঝি দোতলায় ভুলবশতঃ?
রোদ্দুর তুমিও কি এখন আমারই মত সংসারী হয়েছ? স্ত্রী-সন্তান, কাজ-কর্তব্যের জালে বন্দী? নাকি লালন ফকির হয়ে ঘুরে বেড়াও রাস্তায় রাস্তায়, যা তোমার স্বপ্ন ছিল?
এই সব প্রশ্ন আর বাকি কথা গুলো ওই পাখিটার মাধ্যমে তোমার কাছে ফেরত পাঠাচ্ছি৷ পাখিটা কখনও আবার ফিরে এলে বুঝবো তোমার উত্তর নিয়ে এসেছে৷ ভালো থেকো৷
ইতি,
তোমার তনু
৮ই মাঘ,১৩৬৬
প্রায় ছেঁড়াছেঁড়া হলদে হয়ে যাওয়া চিঠিটা ধরে কতক্ষণ বসেছিল জানেনা তাথৈ৷ ওর সামনে খোলা আছে চিলেকোঠা থেকে নামানো একটা ট্রাঙ্ক, সেখান থেকেই ও পেয়েছে চিঠিগুলো৷ কিছুটা কৌতূহল আর বাকিটা সময় কাটানোর জন্য ও খুলেছিল এটা৷ ভেতরে সাজানো পুরনো দামী শাড়ি, স্নো-পাউডারের কৌটো, একটা সাদাকালো ছবি, আর এই কয়েকটা হলদে চিঠি৷ ওর রাঙা দিদার ট্রাঙ্ক এটা, যিনি এই তিনবছর হল মারা গেছেন৷ রাঙাদিদার স্মৃতি বলতে ওর মনে পড়ে লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু, গজা এবং সদা হাসিখুশি এক মানুষ৷ সারাজীবন ধরে সেই মানুষটা এভাবে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের কষ্ট! হয়ত রাঙাদাদুকেও জানতে দেয়নি!
২০০১ সালে জন্মানো তাথৈ দেশভাগের যন্ত্রণা কি জানেনা, কোনওদিন আলাদা করে মনেও হয়নি কিছু৷ কিন্তু আজ তার হঠাৎ এত কান্না পাচ্ছে কেন? কেন আচমকাই মনে পড়ছে কানাডায় একসাথে বড় হয়ে ওঠা স্বামীনাথনের মুখ? ভারতে একমাসের জন্য তাথৈ আসবে শুনে ঈষৎ লাজুক মুখে যে বলেছিল, "Isn't one month too long a time?", চোখের জল মুছে ও মোবাইলটার দিকে হাত বাড়ালো তারপর অল্প হেসে কনট্যাক্ট লিস্টে থাকা স্বামীনাথনের নামটা এডিট করে লিখে দিল "রোদ্দুর"..
অলঙ্করণঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশগুপ্ত
লেখক পরিচিতি
২৭ বছর বয়সী শ্রীজা উত্তর কলকাতার শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের প্রাক্তন বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছেন, বর্তমানে চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে লেখালেখি করেন এবং একটি জনপ্রিয় ফুড জয়েন্টের কো-ফাউণ্ডার। বরাবরের ইতিহাসপ্রেমী, ভ্রমণপাগল, বইপোকা শ্রীজার বিশ্বাস শক্তিশালী কলমের জোরে বহু মানুষ তথা সমাজের সার্বিক উত্তরণ করা সম্ভব।
Osadharon.....khhhub valo laglo
ReplyDeleteMon ta bhore gelo golpo ta pore👏👏
ReplyDelete