মুক্তগদ্যঃ টাইফয়েড মেরীর গল্প - জীবক

 

 

স্থান: অয়েস্টার বে, লং আইল্যান্ড।

সময়: গ্রীষ্মকাল, ১৯০৬ সাল।

 

চার্লস হেনরী ওয়ারেন তার গ্রীষ্মকালীন অবসর কাটানোর জন্যে জর্জ থম্পসনের থেকে তার সামার হাউসটি ভাড়া নেন। অয়েস্টার বে ছিলো বিত্তবান, স্বচ্ছল আমেরিকানদের গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জায়গা। মিস্টার হেনরীও সেরকমই একজন। তিনি ছিলেন লিঙ্কন ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। জর্জ থম্পসনের বাড়িটা দেখা মাত্রই ওনার পছন্দ হয়ে যায়। বেশ কিছুটা উঁচুতে, আর সামনেই সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। মিস্টার হেনরী তার পরিবার আর বাড়ির চাকর, রাঁধুনী, মালি কে নিয়ে সেই বাড়িতে এলেন গরমের ছুটি কাটাতে। সব মিলিয়ে ১১ জন। মিস্টার হেনরী, ওনার স্ত্রী, দুই মেয়ে আর চাকর, মালি, রাঁধুনী মিলিয়ে আরো ৭ জন। ২৭ অগস্ট হঠাৎ করেই মিস্টার হেনরীর ছোট মেয়ে অসুস্থ হয়ে পরে, জ্বর, পেট ব্যাথা, তার সাথে বমি। এর কিছুদিন এর মধ্যেই মিসেস ওয়ারেন, তাদের আরেক মেয়ে, আর মালিসহ তিনজন কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়ে টাইফয়েডে। অর্থাৎ ১১ জন সদস্যের মধ্যে ৬ জন টাইফয়েডে আক্রান্ত।

এটা যে সময়ের ঘটনা, তখন টাইফয়েড ছিল খুব বড় একটা সমস্যা। প্রতিবছরই কয়েক হাজার লোক আক্রান্ত হতেন এবং তাদের প্রায় ১০% মারা যেতেন। লোকের ধারণা ছিলো দূষিত জল বা খাবার থেকে রোগটি ছড়ায়। ১৮৭৩ সালে ডঃ উইলিয়াম বাড্ প্রথম বলেন যে একটি বিশেষ বিষাক্ত পদার্থ জলে উপস্থিত থাকলেই টাইফয়েড রোগটি ছড়ায় আর অন্য রোগীর বিষ্ঠা বা মল যদি জলে মেশে তাহলেই এই রোগটি একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। ১৮৮০ সালে প্রথম কার্ল এবার্থ চিহ্নিত করেন Salmonella typhi, টাইফয়েড রোগের জীবাণু। এটাও বলে রাখা ভালো যে ১৯৪৮ পর্যন্ত টাইফয়েডের চিকিৎসার জন্য কোনো অ্যান্টিবায়টিক ছিলো না। টাইফয়েড রোগটা প্রধানত হতো  সমাজের নিচু স্তরের মানুষদের।

এই অবস্থায় জর্জ থম্পসন পড়লেন মহাবিপদে। উনি বুঝতে পেরেছিলেন যে লোকে যদি জানতে পারে যে ওনার বাড়িতে যারা ভাড়া নিয়েছিলেন তাদের টাইফয়েড হয়েছে তাহলে ওই বাড়ি আর কেউ ভাড়া নিতে চাইবে না। উনি একজনকে নিযুক্ত করলেন কোথা থেকে টাইফয়েড ছড়াচ্ছে সেটা খুঁজে বের করার জন্যে। পানীয় জল থেকে শুরু করে বাড়ির  নিকাশি  ব্যবস্থা সবকিছুই পরীক্ষা করা হলো। নাঃ কোথাও কিছু পাওয়া গেলোনা। স্থানীয় একজন মহিলা আসতেন ঝিনুক বিক্রী করতে। তাকেও পরীক্ষা করা হলো। এবারেও কিছু পাওয়া গেলোনা। এইসময় জর্জ থম্পসন খোঁজ পেলেন এক ব্যক্তির  যার নাম জর্জ সোপার। তিনি আগেও বিভিন্ন জায়গায় এরকম কাজ করে বেশ নাম করেছেন।

জর্জ সোপার প্রথমেই বাড়ির সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলেন, তাদের পরীক্ষাও করলেন। কিন্তু একজন বেপাত্তা। বাড়ির রাঁধুনী। তাকে  নতুন নিয়োগ করা হয়েছিলো। জর্জ সোপার হিসাব করে দেখলেন, প্রথম যিনি অসুস্থ হন, তার তিন সপ্তাহ আগেই ওই রাঁধুনীকে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু কোথায় সে। বাড়ির অন্য পরিচারিকাদের সাথে কথা বলে জানা গেল তার নাম মেরী ম‍্যালোন। তার ব্যাপারে খুব একটা বেশি কেউই জানে না। কারো সাথেই খুব একটা  মিশতো না সে। সোপার যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন। কিন্তু একটা খটকা লাগছিলো ওনার। সব খাবারই যে তাপমাত্রায় রান্না করা হয়, সব জীবাণু নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে? আরো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, এক রবিবার মেরী আইসক্রিম আর পীচ দিয়ে একটা পদ বানিয়েছিল, যেটা ঠান্ডা পরিবেশন করা হয়। সবাই বেশ পছন্দও করেছিলো।

জর্জ সোপার এরপর যোগাযোগ করলেন সেই সংস্থার সাথে যার মাধ্যমে মেরী ম‍্যালোনকে নিয়োগ করা হয়েছিলো। জানা গেল, মেরীর জন্ম আয়ারল্যান্ডে, সে পনের বছর বয়সে আমেরিকায় আসে, আর খুব ঘন ঘন কাজের জায়গা পরিবর্তন করে।

মেরী ম‍্যালোনের আগের কাজের রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়ে জর্জ সোপারের তো মাথায় হাত। শেষ কয়েক বছরে মেরী যেসব বাড়িতে কাজ করেছে তার মধ্যে সাতটা বাড়িতে কেউ না কেউ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মেরী তারপরেই  সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছে। 

ইতিমধ্যে চারমাস কেটে গেছে।সোপার খোঁজ নিয়ে জানলেন  মেরী এখন কাজ করছে পার্ক অ্যাভেনিউ এর একটা  বাড়িতে। সোপার একদিন খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে উপস্থিত হলেন সেই বাড়িতে। ইতিমধ্যেই সেই বাড়ির একজন কর্মচারী হাসপাতালে ভর্তি টাইফয়েড নিয়ে, আর বাড়ির ছোটমেয়ে প্রায় মরণাপন্ন। কিন্তু কি আশ্চর্য! মেরী তখনও সেই বাড়িতে কাজ করছে, ছেড়ে যায়নি। এখানেই প্রথম মেরীর সাথে সোপারের সাক্ষাৎ হয়। সোপার বেশি অবতারণা না করে মেরী কে বলেন – 

দেখুন, মিস মেরী, আপনি যেসব বাড়িতে কাজ করেছেন তার বেশিরভাগ বাড়িতেই কেউ না কেউ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছেন। আমার মনে হয় আপনার থেকেই ছড়িয়েছে এই রোগ। আমি আপনার রক্ত এবং মল, মূত্র পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

একথার যে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে সোপার  মনে হয় দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। সোপারের প্রস্তাব শোনা মাত্রই একটা কাঁটা চামচ নিয়ে সোপারকে তাড়া করে মেরী। কোনোরকমে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন সোপার সেই যাত্রা। 

এইভাবে অপমানিত হয়ে জেদ চেপে গেল সোপারের। উনি শুরু করলেন মেরীকে অনুসরণ করা। জানতে পারলেন  যে,  মেরী মাঝে মাঝে থার্ড অ্যাভেনিউতে একটা বাড়িতে যায়। সেখানে একটা লোকের সাথে তার সখ্যতা আছে। নাম ব্রেইহফ; মদ্যপ, সারাদিন কাটায় রাস্তার মোড়ের কাছে একটা সেলুনে। সোপার গিয়ে ভাব জমালেন ব্রেইহফের সাথে। ব্রেইহফকে পটাতে অবশ্য বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। দু চার বোতল মদেই কাজ হয়েছিল। ব্রেইহফের থেকে সোপার জেনে নিলেন মেরী কবে কখন আসবে। আগের বারের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে এবার সোপার সাথে করে নিয়ে এলেন এক বন্ধু  ডঃ হুবলারকে। তার সাথে নিজেও মুখস্থ করে এলেন মেরীকে কী বলবেন।

মেরী তো সিঁড়ির মুখে সোপার আর তার বন্ধুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই রেগে আগুন। সোপার আবার মেরীকে বুঝিয়ে বললেন যা মুখস্ত করে এসেছিলেন।

-দেখুন মিস মেরী, আমি খালি আপনার রক্ত,মল,মূত্র পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আপনার কোনো ক্ষতি আমি  চাই না। আপনি আমাকে এগুলির নমুনা দিলেই আমি চলে যাবো।

-দেখুন মিস্টার, আপনি আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ আনবেন না। আমি টাইফয়েডের ব্যাপারে কিছু জানিনা। আমার জীবনে কোনোদিন ওই রোগ হয়নি। টাইফয়েড তো চারিদিকে কতো লোকেরই হচ্ছে। আপনি মিছিমিছি আমায় দোষারোপ করছেন। বলল মেরী। আসলে মেরী বুঝতে পেরেছিল, একবার যদি ওর নামের সাথে টাইফয়েডের নাম জড়িয়ে যায়  ও  আর কোনোদিনই রাঁধুনির কাজ পাবে না।

সোপার এবারেও কিছু সুবিধা করতে পারলেন না। উনি বাধ্য হয়ে দ্বারস্থ হলেন নিউ ইয়র্ক সিটি স্বাস্থ্য বিভাগের কমিশনার থমাস ডার্লিংটন এবং মেডিক্যাল অফিসার ডঃ হেরমান বিগস এর। সুপারিশ করলেন মেরীকে হেফাজতে নেওয়ার।

এবার দায়িত্ব পড়লো ডঃ জোসেফাইন বেকারের উপর। জন্ম ১৮৭৩, নিউ ইয়র্কের  বেশ ধনী পরিবারে।  ছোটবেলাতেই বাবা এবং দাদাকে হারান টাইফয়েডে। 

একদিন পার্ক অ্যাভেনিউ এর বাড়ির সামনে একটা ঘোড়ায় টানা এম্বুলেন্স এসে থামলো। গাড়ি থেকে নামলেন  ডঃ বেকার আর চারজন পুলিশ। তিনজন পুলিশ গিয়ে ঘিরে দাঁড়ালো বাড়ির তিনদিকে। আর একজনকে সাথে  নিয়ে ডঃ বেকার বেসমেন্টের দরজায় কড়া নাড়লেন। মেরীই দরজা খোলে। বাইরে পুলিশ দেখে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিতে যায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই পুলিশ অফিসার তার একটা পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন, যাতে দরজা বন্ধ না হয়। মেরী দৌড়ে পালায় রান্নাঘরের দিকে। ডঃ বেকার আর পুলিশকর্মীটি মেরীকে তাড়া করে রান্না ঘরে এসে দেখেন মেরী পালিয়েছে। বাকি কর্মচারীরাও কিছু বলছে না মেরী কোথায় গেছে। দুজন মিলে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন রান্নাঘর, কয়লা রাখার জায়গা, কর্মচারীদের থাকার জায়গা। কিন্তু মেরী যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। 

ডঃ বেকার হঠাৎ দেখলেন পিছনের বেড়ার গা ঘেঁষে একটা চেয়ার। বরফের মধ্যে একটা পায়ের ছাপ ওই চেয়ার অবধি গিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ডঃ বেকার আর ওই পুলিশকর্মী আশেপাশের বাড়িগুলোয় খোঁজখবর শুরু করলেন। কিন্তু নাঃ; কোথাও নেই মেরী। হতাশ হয়ে যখন সবাই ফিরে যাবেন ভাবছেন এক পুলিশকর্মী হঠাৎ দেখেন যে একটা দরজার ফাঁক দিয়ে ডোরাকাটা একটু কাপড় বেরিয়ে আছে। আর দরজাটার উপরে অনেক ময়লার বস্তা চাপানো যাতে বোঝা না যায়। 

দরজা খুলতেই ভিতরে পাওয়া গেলো মেরীকে। কিন্তু সেও ছাড়বার পাত্রী নয়। অনেক কষ্টে তাকে তোলা হলো এম্বুলেন্সে। এম্বুলেন্সের মধ্যেও সে লড়াই করেছিল পুরো রাস্তা। শেষে এমন অবস্থা হয় যে, ডঃ বেকার  বাকি রাস্তাটা মেরীর  উপর  বসে থাকেন। তাকে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখা হয় উইলার্ড পার্কার হসপিটালের একটি ঘরে। সেখানে মেরীকে পরীক্ষা করে  শরীরে টাইফয়েডের জীবাণু পাওয়া যায়। অর্থাৎ সোপারের অনুমানই ঠিক।

জর্জ সোপার এখানে আসেন মেরীর সাথে দেখা করতে। তিনি মেরীকে বোঝান কিভাবে মেরীর থেকে অন্য লোকেদের  মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে টাইফয়েডের জীবাণু। তিনি মেরীকে বলেন- আমার মনে হয় তোমার পিত্তথলির মধ্যে  জীবাণুগুলি আছে। তুমি যদি অপারেশন করিয়ে তোমার পিত্তথলি বাদ দিয়ে দাও তুমি আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।

আরো অনেকভাবেই সোপার মেরীকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন প্রতিবারই। 

এরপর মেরীকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রিভারসাইড হসপিটালে। সেখানে একটি ছোট বাংলো দেওয়া হয় মেরীকে থাকার জন্য। তাকে খাদ্যসামগ্রী এনে দেওয়া হতো, সে নিজেই রান্না করে নিতো।

প্রায় ২ বছর ১১ মাস পরে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেরীকে ছাড়তে রাজি হয়; শর্ত ছিল – মেরী আর কোনোদিন রাঁধুনীর  কাজ করবে না, আর প্রতি তিনমাস অন্তর হাসপাতালে এসে নিজের পরীক্ষা করিয়ে যাবে।

ছাড়া পাওয়ার পরেই মেরী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। প্রথমে সে কাপড় কাচার কাজ শুরু করে। কিন্তু তাতে রাঁধুনীর কাজের তুলনায় রোজগার বেশ কম। অগত্যা সে যায় সেই দুটি সংস্থার কাছে যারা সমস্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে রাঁধুনী নিয়োগ করতো। কিন্তু তারা মেরীর অবস্থা জানতো। তাই তাকে তাড়িয়ে দেয় দূর দূর করে। মেরী বুঝতে পারলো যে,  সে আর নিজের নামে কাজ পাবে না। তাই বাধ্য হয়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, হোটেলে কাজ শুরু করে ছদ্মনামে। কখনো সে মিসেস ব্রেশহফ, কখনো মেরী ব্রাউন।

এরকমভাবে কেটে গেছে বেশকয়েক বছর। মেরী কোথায় কেউ জানে না। জর্জ সোপারও তখন ব্যস্ত অন্য কাজে। হঠাৎই ওনার কাছে ফোন আসে একটা। ফোন করেছেন স্লোয়ান হসপিটালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিভাগের প্রধান ডঃ এডওয়ার্ড ক্রেগিন। উনি সোপারকে বললেন – আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার আমার হসপিটালে আসুন; খুব জরুরী দরকার। এই বলে ফোন রেখে দিলেন।

জর্জ সোপারও দ্রুত গিয়ে পৌঁছলেন স্লোয়ান হসপিটালে।

ডঃ ক্রেগিন বলেন,

 – মিস্টার সোপার আমার হসপিটালে প্রায় ২০ জন রোগী টাইফয়েডে আক্রান্ত। নতুন একজন রাঁধুনী নিয়োগ করার পরই এই ঘটনা ঘটেছে। আমাদের বাকি কর্মীচারীরা তো রাঁধুনীর নামই দিয়েছে টাইফয়েড মেরী। 

-দেখতে কিরকম এই মহিলাকে?

-উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি, সোনালী চুল, চোখের মনির রং নীল।

-শুনে তো মেরী ম‍্যালোনের মতোই মনে হচ্ছে, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিনা।

-দেখুন তো এই হাতের লেখাটা চিনতে পারেন কিনা? বলে সোপারের হাতে একটা চিঠি দিলেন ডঃ ক্রেগিন।

হাতের লেখা দেখে সোপার একদম নিশ্চিত যে এই মহিলাই মেরী ম‍্যালোন। কিছুদিনের মধ্যেই মেরীকে আবার ধরে আনে স্বাস্থ্য দপ্তর। এই ৮ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে মেরীর। যে মেরী পুলিশের সাথে মারামারি করেছিলো, বেড়া টপকে পালিয়েছিল, সেই মেরী আর নেই। ৪৮ বছরের মেরী অনেক শান্ত। আর সে বুঝেছিলো যে রাঁধুনীর কাজ সে আর পাবেনা। তাকে নর্থ ব্রাদার আইল্যান্ডে হাসপাতালের কাছে একটি থাকার জায়গা দেওয়া হয়। হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে তাকে একটি ছোটখাটো কাজও দেওয়া হয়। ১৯৩২ সালে একদিন মেরীকে তার ঘরে প্যারালাইজড অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। মেরী মারা যায় ১৯৩৮ সালে, জীবনের প্রায় ২৬টি বছর আইসোলেশনে থাকার পর।

অফিসিয়াল হিসেব অনুযায়ী মেরীর থেকে প্রায় ৫৩ জন টাইফয়েডে আক্রান্ত হন ও তিনজন মারা যান। এছাড়া ছদ্মনামে কাজ করার সময় আরো কতো লোকের টাইফয়েড হয়েছিলো তার হিসেব নেই কারো কাছে। মেরীর নিজের কোনোদিন টাইফয়েড হয়েছিলো কিনা এ কথা সে স্বীকার করেনি কোনোদিন। তার পরিবার সম্বন্ধেও বেশি কিছু জানা যায়নি। কাজেই মেরীর শরীরে টাইফয়েডের জীবাণু কিভাবে এলো সে কথাও জানা যায়নি আর কোনোদিন।

পরবর্তীকালে এরকম আরও অনেকের খোঁজ পাওয়া গেছে যারা মেরীর চেয়েও বেশি লোকের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। কিন্তু মেরীই সম্ভবত প্রথম কোনো রোগের কেরিয়ার হিসেবে চিহ্নিত হন; অর্থাৎ যার মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না, কিন্তু তাঁদের মধ্যে ওই রোগের জীবাণু বর্তমান এবং তিনি অন্যকে ওই রোগটি সংক্রমণে সক্ষম। এইভাবেই একজন আইরিশ, খুবই সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা মহিলা চিরপরিচিত হয়ে গেলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে টাইফয়েড মেরী হিসেবে।


তথ্যসূত্র:

  1. Soper GA. The curious career of Typhoid Mary. Bull N Y Acad Med. 1939;15:698–712

  2. Bourdain, A. (2005). Typhoid Mary. Bloomsbury.

  3. Marineli, F., Tsoucalas, G., Karamanou, M., & Androutsos, G. (2013). Mary Mallon (1869-1938) and the history of typhoid fever. Annals of gastroenterology26(2), 132–134.

 

অঙ্কনশিল্পীঃ ডাঃ সায়ন্ন্যা দাশদত্ত

No comments:

Post a Comment