ঠাকুরবাড়ির ব্যবসা ও সমৃদ্ধির ইতিহাস
খালিদ আল হাসান
কথায় আছে ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। আর এই প্রবাদের যথার্থতা প্রমাণ করে গিয়েছেন ঠাকুরবাড়ির পূর্বপুরুষেরা। বিশ্বখ্যাত ঠাকুর পরিবারের প্রতিপত্তি শিখরে গিয়ে ওঠে নানা ধরনের ব্যবসার হাত ধরেই। ঠাকুরবাড়ির বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, ঠাটবাট, জাঁকজমক সবকিছুই ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে দাসত্ব না করে তাদেরকে কাজে লাগিয়ে পরাধীন দেশে স্বাধীনভাবে ব্যবসায় একের পর এক সাফল্য লাভ করেছিলেন ঠাকুরবাড়ির কর্তারা। ভেতো বাঙালির শিল্পোদ্যোগী মনোভাবকে সবলে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দ্বারকানাথ বিলাতে গিয়েছেন৷ তখনকারদিনে সমাজকে উপেক্ষা করে এত বড় সাহসী পদক্ষেপ ভারতবর্ষে আর দেখা যায় কি?
ঠাকুরবাড়ির ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির থেকে আরম্ভ করে বাংলার সেরা পরিবারের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশত বছর আগে, যেখানে অতীতেরও অতীত লুকিয়ে আছে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির আদি পুরুষেরা ছিলেন কুলীন ব্রাহ্মণ। এক সময় বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে বাংলার পূর্বাঞ্চল ব্রাহ্মণশুন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম পুনরায় প্রতিষ্ঠা লাভ করলে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে হর্ষবর্ধনপুত্র জয়ন্ত আদিসুর নাম ধারণ করে গৌড়াধিপতি হন। তিনি বৈদিক সমস্ত আচার পালনে সচেষ্ট হন, এই বৈদিক পূজাপাঠের জন্য তিনি কনৌজ থেকে পঞ্চব্রাহ্মণ নিয়ে এসেছিলেন। এই পঞ্চব্রাহ্মণের একজন হলেন ভট্টনারায়ন। এই ভট্টনারায়নকেই ঠাকুরবাড়ির আদিপুরুষ বলে ধরা হয়। আদিসুর এইসব ব্রাহ্মণদের ভরণপোষণের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেন। সেই অনুযায়ী ভট্টনারায়ন ও তাঁর পাঁচ পুত্র একটি করে গ্রামের অধিকারী হন। সেই গ্রামের নাম ছিল কুশ যার থেকে পরে ভট্টনারায়নের বংশধরদের নাম হয় কুশারি। এই কুশারি থেকেই পরে এসেছে ঠাকুর। ধারণা করা হয় ভট্টনারায়নের পঞ্চম প্রজন্ম জগন্নাথ কুশারি বর্তমানে বাংলাদেশের যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত আলাইপুর মহকুমার পিঠাভোগ নামে গ্রামে বাস করতেন। পরে আমরা ঠাকুরবাড়ির পূর্বপুরুষদের যতটা কুশারি হিসেবে চিনেছি, তার থেকে অনেক বেশি চিনেছি পিরালি ব্রাহ্মণ হিসেবে। সেই ইতিহাসও আসবে৷
আসলে ঠাকুরবাড়ির ব্যবসা বুঝতে গেলে তাদের ইতিহাসটা আমাদের খুব ভালোভাবে জানতে হবে, কারণ ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসেই লুকিয়ে আছে তখনকার সমাজ জীবনের ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার বীজ। ঠাকুরবাড়ির পূর্বপুরুষেরা কুলীন ব্রাহ্মণ হয়েও পরবর্তীকালে কেন একঘরে হলেন পিরালি ব্রাহ্মণ নামে সেটুকু না জানলে এ আখ্যান কখনোই পূর্নতা পায় না। জগন্নাথ কুশারির বিবাহসূত্রেই, এই পিরালি ব্রাহ্মণ নামে হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে একঘরের বলয়ে আটকে পড়েন। জগন্নাথ কুশারির সাথে বিয়ে হয় পীরাল্যা গ্রামের সমাজচ্যুত শুকদেবের মেয়ে রত্মমালার। পীরাল্যা গ্রামের দক্ষিণনাথ রায় চৌধুরীর দুই ছেলে ধর্মত্যাগ করে মুসলিম হয়ে গিয়েছিল, আর অপর দুই পুত্র শুকদেব ও রতিদেব সমাজচ্যুত হয়েই রয়ে গেলেন।
এই পরিবারে বিবাহসূত্রে জগন্নাথ কুশারিও সমাজচ্যুত হয়ে গেলেন। সেই থেকে পিরালি বদনাম বহন করতে হল পরবর্তী সবাইকে এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথকেও। এই কারণেই ধন, মান, জ্ঞান সমস্ত কিছুতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরা কখনোই সমযোগ্যতা সম্পন্ন ঘরে বৈবাহিক সম্পর্ক কখনোই স্থাপন করতে পারেননি, সুদূর যশোরের বদনাম পিছু ধাওয়া করে এসে কলকাতার আবহাওয়াকেও ভারী করে তুলেছিল। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে পারিবারিক বিবাদের কারণে ঠাকুর পরিবারের সপ্তম পুরুষ পঞ্চানন কুশারি পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসেন। এই পঞ্চানন কুশারি ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস প্রসিদ্ধ আদিপুরুষ। ঠাকুরবাড়ির ব্যবসায়িক জগতে প্রবেশও পঞ্চানন কুশারির হাত ধরে। তার কলকাতায় আসার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অর্থান্বেষণ। এই অর্থান্বেষণের পরিকাঠামোটি সুচতুরভাবে তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন, আগেই উল্লেখিত যে ঠাকুরবাড়ির বংশমর্যাদার তেমন কোনও গৌরবগাঁথা নেই। সামাজিকভাবে তারা ছিলেন অবহেলিত। পঞ্চানন ঠাকুর তো পিরালি অখ্যাতি নিয়েই কলকাতায় এলেন এবং ব্যবসায় বেশ উন্নতিও করলেন। কিন্তু তার আগে তার সামাজিক অবস্থানটা আমরা জেনে নিই।
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী দিগম্বরী দেবীর বাড়ি ছিল যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে, দ্বারকানাথের অতুলনীয় বিত্ত বৈভব থাকা সত্ত্বেও তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে বিয়ে করতে হয় যশোরের দক্ষিণডিহির এক অখ্যাত পরিবারের বালিকা সারদা দেবীকে। তাঁর পুত্রদের মধ্যে একমাত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে হয় কলকাতায় তবু তারা ছিলেন ঠাকুর বাড়ির আশ্রিত। কাদম্বরী দেবীর পিতামহ জগমোহন ছিলেন ঠাকুরবাড়ির সন্দেশ পরীক্ষক। তিনি সন্দেশ চেখে মান বলে দিতে পারতেন। জগমোহন এর ছেলে শ্যামলাল ঠাকুরবাড়ির বাজার সদাই এর কাজ করতেন। তার মেয়ের সাথে বিয়ে হয় ঠাকুর বাড়ির অন্যতম সুদর্শন পুরুষ আধুনিকমনা জ্যোতির সাথে। যদিও সত্যেন্দ্রনাথ ভাইয়ের জন্য পছন্দ করে রেখেছিলেন বিলেতফেরত ডাক্তার সূর্যকুমার চক্রবর্তীর মেয়েকে। কিন্তু পরে তা এক প্রকার বাধ্য হয়েই ভেঙে দিতে হল। একে তো পিরালি তার উপর ব্রাহ্ম ঠাকুরবাড়ি তখন সবদিকে থেকে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ভয়ে সূর্যকুমার নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। শেষে কোনওরকমে যাকে পাওয়া গেল তাকে ধরেই জ্যোতির সাথে বিয়ে দেওয়া হল। রবীন্দ্রনাথের বেলায়ও ঠিক একই অবস্থা। বিলেতফেরত, সুদর্শন রবির জন্য মেয়ে পাওয়া রীতিমতো সকলের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল। শেষমেষ সেই যশোর থেকে মেয়ে নিয়ে আসা হল। এভাবেই কলকাতার প্রধান অভিজাত পরিবারের সদস্যদের জীবনসঙ্গী খুঁজতে বারবার পাড়ি দিতে হয়েছে যশোরে। এহেন সামাজিক অবস্থানে থাকা পঞ্চানন ঠাকুর শুধুমাত্র ব্যবসায়ী বুদ্ধি সম্বল করে নিজের পরিবারকে এক উত্তরণের পথে নিয়ে গেছেন, প্রথমেই তিনি কলকাতায় এসে জাহাজওয়ালাদের মাল সরবরাহের কাজে হাত দিলেন। এ থেকে অন্নসংস্থান তো হলই পাশাপাশি ব্যবসায়িক বৃত্তে ঢোকার সুযোগও পাওয়া গেল। অন্যদিকে তিনি বসবাসের জায়গাটিকেও বাছলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে, তিনি বেছে নিলেন গঙ্গার ধারের গোবিন্দপুরকে। জেলে, মালো, কৈবর্ত সব নিচু শ্রেণির লোকেরা সেই এলাকায় থাকতেন। এই নিচু জাতের কাছে ব্রাহ্মণ হিসেবে তিনি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেলেন, সে পিরালি হোক বা যা৷ তিনি সেখানে শিবমন্দির স্থাপন করলেন সেখানকার পুরোহিত হলেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের সাতপুরুষ আগে একসময়ের কুশারিরা ঠাকুর হলেন৷
ঠিক এই রাস্তা ধরেই সামাজিক ও আর্থিক কাঠামোয় বেশ কয়েকধাপ উঠে গেল ঠাকুর পরিবার। কলকাতায় ঠাকুর বংশের পঞ্চানন ঠাকুরের হাত ধরেই প্রথম ঠাকুর বাড়ি গড়ে উঠল। ১৭০৭ সালে রাল্ফ শেলডন কলকাতার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হলে পঞ্চাননের দুই ছেলে জয়রাম ও সন্তোষরাম আমিনের কাজ পায়। আমিনের কাজ পেতে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না কারণ গোবিন্দপুর এলাকায় ততদিনে পঞ্চাননের আধিপত্য বেশ বেড়েছে৷ আর ইংরেজরাও এরকম কাউকেই খুঁজছিল। আমিনের কাজ করার ফলে দুই ভাই জমি সংক্রান্ত ব্যাপারে বেশ দক্ষ হয়ে উঠল ও শেলডন সাহেবের আনুকূল্যে ইংরেজদের উপর মহলেও অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তারা অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন পথ বাতলে দিচ্ছে তাই দুই ভাইয়ের বিষয় সম্পত্তি ও প্রতিপত্তির সূচক তখন ঊর্ধ্বমুখী। ১৭৪১ সালে সুতানটি ও গোবিন্দপুরে জরিপের কাজ শুরু করলে শেলডন সাহেব দুই ভাইকে ডেকে নিলেন, সেই আমিনি কাজের পরই দুই ভাইয়ের জীবনে সম্পদের জোয়ার এল। রবীন্দ্রনাথের উপরের ষষ্ঠপুরুষ জয়রামকে বিশ্লেষণ না করলে তারই উত্তরসূরি দ্বারকানাথের উদ্যোগী ও সাহসী মনোভাবকে সঠিক বোঝা যাবে না। জয়রাম শুধু ইংরেজ অধীনে কর্মচারী রুপেই নিজেকে দেখে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেননি, ব্যবসাতেও মাথা লাগিয়েছেন পাশাপাশি সমানতালে ইংরেজি ও ফার্সি ভাষা শিখেছেন। নিজের কর্মোদ্যোম, ইংরেজি ভাষার পরিপূর্ন চর্চা ও বিশ্বস্ততার মাধ্যমে তিনি অচিরেই ইংরেজ বণিকদের ও প্রশাসনিক মহলের কাছের লোক হয়ে উঠলেন এবং এক সময় অগাধ সম্পত্তির মালিক হলেন এবং কলকাতার অন্যতম প্রধান প্রভাবশালীর তালিকায় নিজের নামও পাকাপোক্ত করলেন। এই জয়রামেরই পুত্র নীলমণি হলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের পিতামহ। জয়রামের দুই স্ত্রী প্রথম স্ত্রী গঙ্গা, ছেলে আনন্দীরাম ও নীলমণি, অপরদিকে দ্বিতীয় স্ত্রী রামধনীর দুই ছেলে দর্পনারায়ন ও গোবিন্দরাম। জয়রামের মৃত্যুর পর শরিকি লড়াই শুরু হয়৷ ঠাকুরবাড়িতে প্রথম মামলা হয়েছিল নীলমণি বনাম দর্পনারায়ন ও গোবিন্দরামের স্ত্রী রামপ্রিয়ার, তিনি অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্না ও সাহসী মহিলা ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সম্পত্তির অধিকার চেয়ে মামলা করেন ১৭৮২ সালে৷ যাই হোক শেষ পর্যন্ত কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাগ বাটোয়ারা হয়। এরপর ১৭৮৪ সালে নীলমণি চলে আসেন জোড়াসাঁকোতে যা সেসময় মেছুয়াবাজার নামে পরিচিত ছিল। সাথে আসেন স্ত্রী ললিতা তিন পুত্র ও কন্যা কমলমণি। নীলমণির ভাই দর্পনারায়ন থেকে যান পাথুরিয়াঘাটার আদি বাড়িতেই যেটি জয়রামের তৈরি করা ছিল। আর সম্পত্তির ভাগ নিয়ে রামপ্রিয়া চলে যান শিবতলায় কেনা একটি বাড়িতে। এভাবেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ভিত্তি রচিত হয়।
এখানে সামনে এগিয়ে যাবার আগে নীলমণি সম্পর্কে বলে নিতে হবে৷ পাথুরিয়াঘাটা থেকে জোড়াসাঁকো এ যাত্রার মাঝে লুকিয়ে আছে অসংখ্য ঘটনা। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার,ওড়িশার দেওয়ানি লাভের পর নীলমণি ঠাকুর লর্ড ক্লাইভের প্ল্যান তদারকি করার ভার পেলেন। এখান থেকেই বোঝা যায় ঠাকুর পরিবারের সাথে ইংরেজদের সম্পর্ক কোন মাত্রায় ছিল। যাই হোক ইংরেজদের বদান্যতায় ততদিনে প্রচুর সম্পত্তি হয়েছে ঠাকুরদের। বাংলার নবাব হেরে যাওয়ায় ঠাকুর বাড়ির ব্যবসাতেও নতুন পালক যুক্ত হয়েছে।
ক্লাইভের প্ল্যান তদারকির কাজ নিয়ে নীলমণি ওড়িশা থেকে চট্টগ্রাম বিস্তীর্ণ এলাকা চষে বেড়াতে লাগলেন। পাথুরিয়াঘাটার সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে গেলেন দাদা দর্পনারায়নকে। মাসে যা উপার্জন করতেন নিজের জন্য কিছু রেখে প্রায় সমস্ত অংশই বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। বহুবছর নির্বাসিত রোজগারের জীবন শেষে যখন দাদার কাছে নীলমনি হিসাব চাইতে আসলেন তখন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মিতব্যয়িতার কোনও পুরষ্কার নয়, পেলেন মাত্র এক লক্ষ টাকা, টাকার কোন হিসাবও দাদা দিলেন না, বললেন এটাই ওর প্রাপ্য। বিবাদ চরমে উঠল, নীলমণি পরিবার নিয়ে এক কাপড়ে পাথুরিয়াঘাটা থেকে বেরিয়ে এলেন। জোড়াসাঁকোয় এসে চালাঘর তুললেন। এই চালাঘরই পরবর্তীতে ঠাকুরবাড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল ও বিশ্বব্যাপী নাম ছড়াল। নীলমণি দেহরক্ষা করলেন ১৭৯৩ সালে। শালগ্রাম শিলার পূজারি ব্রাহ্মণ নীলমণির পুত্র রামলোচন ও অলকাসুন্দরীর দত্তক পুত্র দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথ ছিলেন রামলোচন এর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামমণি ঠাকুরের পুত্র। রামমণি ঠাকুর সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না, শুধু জানা যায় তিনি ব্রিটিশ পুলিশে চাকরি করতেন৷ রামলোচনের পিতা নীলমণি ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব, নিষ্ঠাবান ও ধর্মভীরু কিন্তু রামলোচন ছিলেন তার বিপরীত। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত উদারপন্থী মানুষ। জীবনে তার আড়ম্বরের কোনও কমতি ছিল না। প্রতিদিন বিকালে তাঞ্জাম চেপে হাওয়া খেতে বেরোতেন, ইংরেজ বন্ধুদের সাথে নিয়মিত বাড়িতে আসর বসাতেন। তিনি নিজের ছাঁচে দ্বারকানাথকে তৈরি করলেন। ছোটবেলাতেই দ্বারকানাথকে ইংরেজি, ফার্সি উভয় ভাষাতেই সম্পূর্ণ পারদর্শী করে তোলা হল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, মুক্তমনা, আধুনিক ঠাকুরবাড়ির পুরুষগণ নিজেদের ইংরেজদের ছত্রছায়ায় রেখে নিজের ব্যবসা, সম্পত্তি ক্রমান্ব্যে বাড়িয়ে গিয়েছেন। রামলোচনও সম্পূর্ণভাবে সেই পথ অনুসরণ করেছেন এবং সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন। সাথে সময়ও যেন ঠাকুরবাড়ির সমৃদ্ধির পথে একের পর এক কার্পেট বিছিয়ে দিয়ে গেছে।
এবার আমরা ঢুকব প্রিন্স দ্বারকানাথ এর আলো আঁধারিতে মেশানো সেই ব্যবসায়িক রাজ্যে। আমরা যদি তার জীবনী পর্যালোচনা করি তবে দেখি সর্বত্রই তার ব্যবসায়িক প্রসঙ্গ আড়াল করার সুচারু প্রচেষ্টা। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী বইতে লিখেছেন “সত্যের অনুসন্ধান করে যদি দ্বারকানাথ দোষী হন, তাঁহাকে দোষী বল তাহাতে কারো কোনও আপত্তি হইতে পারে না৷ কিন্তু আজ হইতে বঙ্গবাসী ভাতৃগণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও যে, যে সকল মহাপুরুষ তোমাদের মুখোজ্জ্বল করিয়াছেন, যাহাদের জন্য তোমরা রাজার জাতির নিকট প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছ, স্বদেশ গৌরবান্বিত হইয়াছে; বিনা অনুসন্ধানে, বিনা বিচারে তাহাদের নামে অপবাদ রটাইয়া দুর্নাম ঘোষণা করিয়া নিজেদের উপর কলঙ্ক লেপন করিও না। আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত হইয়ো না।”
এই উদ্ধৃতিগুলো নিশ্চয়ই সকলকে নাড়া দেয়। প্রশ্ন জাগে দ্বারকানাথ সত্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে কোন দোষে দোষী? তার নামে কী অপবাদ রটানো হয়েছিল? কীসের দুর্নামে তিনি জর্জরিত?
দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৭৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পালিত মাতা পিতা রামলোচন ও অলকাসুন্দরী তাকে বড় করেন। দ্বারকা বাড়ির যে পরিবেশে বড় হচ্ছিলেন তার আবহাওয়া তাকে এ হেন বলিষ্ঠ, সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা, নির্ভীক চরিত্র গঠনের অনুকূল ছিল। রামলোচন সম্পর্কে তো জানলাম, এখন অলকাসুন্দরী সম্পর্কে বলতে গেলে তিনি ছিলেন রূপবতী, বুদ্ধিমতী, ধর্মপ্রাণ মহিলা। তিনি শেষ বয়সে অন্তর্জলি যাত্রাতেও যেতে চাননি। এই মনোভাব থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা সংস্কারমুক্ত ছিলেন। এই মানসিকতা থেকেই তিনি দ্বারকানাথকে ছোটবেলা থেকেই সম্পূর্ন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। ইংরেজি, ফারসির পাশাপাশি পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষার সুবাদে দ্বারকানাথ সেকালের অন্যতম প্রধান ব্যরিষ্টার রবার্ট কাটকার ফার্গুসনের কাছ থেকে আইনি শিক্ষায়ও তুখোড় হয়ে ওঠেন। যা পরবর্তীতে তার সাম্রাজ্য গঠনে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ১৮০৭ সালে রামলোচন ঠাকুর মারা গেলে দ্বারকানাথ নিজের পিতা ও বড়কাকা উভয়ের সম্পত্তি লাভ করেন সেই সাথে পান বিহরামপুর ও কটকের জমিদারি, যশোরের তালুক। ১৮১০ সালে ষোলো বছর হবার পর তিনি নিজ হাতে সবকিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরের বছর তার বিয়ে হয় নরেন্দ্রপুরের মেয়ে দিগম্বরী দেবীর সাথে। দ্বারকানাথ কর্মজীবনের শুরু থেকেই সংসার চালিয়ে উদ্দ্বৃত্ত টাকার সঠিক বিনিয়োগ ও উপার্জন বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী ছিলেন। সেই সময় জমানো টাকা নিরাপদে রাখার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তাই তিনি জমানো টাকা চড়া সুদে ধার দিতে লাগলেন এবং এতে তার উপার্জনও মন্দ হতো না। সেই সময় সুদের ব্যবসা বেশ জনপ্রিয় ছিল এমনকি রামমোহন রায় ও রংপুর সেরেস্তায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই কারবারে নেমে পড়েন। শোনা যায় বিদ্যাসাগরের মাও নাকি এপন্থায় কিছু রোজগার করেছিলেন। আসলে এই তেজারতির ব্যবসা ছিল বেশ আরামের ব্যবসা, তার উপর প্রভাবশালী কেউ যদি এ ব্যবসা করে থাকে তাহলে তা বেশ সহজসাধ্যও বটে। কারণ সুদ আসল আদায়ের জন্য বেশি পরিশ্রম করতে হয় না তাকে। দ্বারকানাথের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরবর্তীতে সকলের সামনে দেখা যায় তাতে তিনি রক্তচোষা সুদখোর মহাজনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তখনকার সমাজ জীবনের একজন খলনায়ক হয়ে থাকেন। এটাকে আবার একেবারে ভুল বলেও অবশ্য এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কারণ তার চরিত্রে অর্থলিপ্সা অবশ্যই ছিল। শুধু যে উদ্বৃত্ত টাকা তেজারতির ব্যবসাতেই খাটিয়েছেন তা নয়, যখন কোনও জমিদারি, তালুক নিলামে উঠেছে তা কিনে ফেলতেন। এভাবে নিজের জমিদারিকে বহুলাংশে বিস্তৃত করেছেন, আর এই বিস্তৃতির পেছনে ছিল তার আইন সম্পর্কে পান্ডিত্য এবং তার সাথে তিনি নিজের পূর্নক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছেন।
তবে পরবর্তীতে তো আমরা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং তার লেখনীতেও দ্বারকানাথকে অস্বীকার করার চেষ্টা বারবার দেখি, দেখি তার প্রতি শুধু অবহেলা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই তো পুড়িয়ে ফেলেছিলেন দ্বারকানাথের সমস্ত নথিপত্র। কেন এই নিরলস চেষ্টা প্রমাণ লোপাটের? কোন ইতিহাস বারবার গোপন করতে চেয়েছে ঠাকুর পরিবার?
তাহলে কি ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী গ্রন্থে যে দিক দেখালেন সেটাই সত্যি, রবীন্দ্রনাথ পুড়িয়ে ফেললেন সব প্রমাণ পত্র। সেই পুড়ে যাওয়া দলিলের সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথ পুড়িয়ে ফেলতে চাইছিলেন আত্মমর্যাদার গ্লানি। ক্ষিতীন্দ্রনাথের বইয়ে পাওয়া যায় “এই কুঠির কারবার দ্বারকানাথের জীবনে এক সর্বপ্রধান ঘটনা, কিন্তু দুঃখের বিষয় ইহার সম্বন্ধীয় কাগজপত্র রবীন্দ্রনাথের কর্তৃত্বে ও তাহার আদেশে দগ্ধীভূত হওয়াতে এই কারবার যে কতটা বিস্তৃত ছিল এবং কী রূপে পরিচালিত হইত, তাহার বিবরণ উদ্ধার করিবার আশা আর নাই।” যদি এই নথিপত্র উদ্ধার হত আমরা ঠাকুর বাড়ির কোন কলংকিত ইতিহাস দেখতে পেতাম? এই ইতিহাস কি রবিরশ্মিকেও অন্ধকারে ঢেকে দিত? এই ভয়েই কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজে দাঁড়িয়ে পুড়িয়েছিলেন সব?
ঠাকুরবাড়ির ব্যবসার পরতেপরতে লুকিয়ে আছে গোপনীয়তা, এই গোপনীয়তাকে সরিয়ে যতটুকু আলোকপাত করা যায় আমরা সে চেষ্টা করব। তেজারতি, জমিদারি তো ছিলই সেই সাথে আইনি উপদেষ্ঠা হিসেবেও দ্বারকানাথের রোজগার কম ছিল না। যখনই কোনও মামলা মোকদ্দমা হত তিনি আইনি উপদেষ্ঠা হিসেবেও বেশ ভালো অর্থ উপার্জন করতেন। আমদানি রপ্তানির কারবারও শুরু করেছিলেন ইউরোপীয় বন্ধুদের সাথে। কর্মজীবনে প্রবেশে সাথে সাথে পারিবারিকভাবে ইংরেজদের সাথে সখ্যতার দরুন তার চলার পথ অনেক মসৃণ হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপীয় অর্ডার অনুসারে তিনি রেশম, চিনি, সোডা, নীল রপ্তানি করতেন। ১৮২২ সালে তিনি চব্বিশ পরগনার আবগারি বিভাগে লবণ দপ্তরে কাজ নেন। পরে তিনি আফিম বোর্ডের ডিরেক্টরও হয়েছিলেন। দ্বারকানাথই প্রথম ভারতীয় যিনি এই পদে বসতে পেরেছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উৎপাদন শুরু করেছিলেন। ভারতে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা খননের প্রথম স্থান রানিগঞ্জ আর বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উৎপাদনে প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় হিসেবে দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাম সবসময়ই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৮২০ সালে এখানে প্রথম মেসার্স আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোং কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কিন্তু তারা লাভ করতে পারেনি। পরে ১৮২৮ সালে মেসার্স জেসপ অ্যান্ড কোম্পানি রানিগঞ্জ খনি ও সমূহক্ষেত্র হস্তান্তর করে দ্বারকানাথ ঠাকুরের হাতে। উইলিয়াম কারের সাথে মিলে গড়ে তোলেন ‘কার অ্যান্ড টেগোর কোম্পানি’। দ্বারকানাথ কয়লা ব্যবসায় নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তার হাতে যেন এখানে সোনা ফলেছিল। এই কয়লা ব্যবসায় প্রচুর লাভ হয়েছিল। রানিগঞ্জকে বলা হত ভারতের নিউ ক্যাসেল। দ্বারকানাথের কার টেগোর আর গিলমোর হামফ্রে কোম্পানি হয়ে ওঠে বাংলার কয়লার প্রধান কোম্পানি। ১৮৩৫ সালে দামোদরের তীরে নারাণকুড়ি তে কয়লা খনি বানানো হয়। কুয়ো থেকে যেমন জল তোলা হয় তেমনি একই পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হত কপিকল ব্যবহার করে। একে বলা হয় হলেজ পদ্ধতি। এই খনির পাশেই এই বিশাল ঘরে কপিকল বসানো ছিল। নারাণকুড়িতে ভগ্নদশা নিয়ে আজও সেই হলেজ ঘরটি দেখা যায়। এই ঘরের কিছু দূরেই ছিল বাংলো যেখান থেকে দ্বারকানাথ প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। খনির কাজ দেখাশোনা করতে গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত আসতেন এবং দেবেন্দ্রনাথও কয়েবার এসেছেন। শুধু উত্তোলনই নয় পরিবহণের কথা মাথায় রেখে তিনি সেখানে জেটিও স্থাপন করেছিলেন। প্রায় পনেরশো নৌকা এই জেটিতে থাকত কয়লা পরিবহণের জন্য। বেতনভুক মাঝি ছিল ৯০০ জন। শুধু জলপথই নয় আরও দ্রুততার জন্য দ্বারকানাথ রানিগঞ্জ থেকে কলকাতা পর্যন্ত রেললাইন এর কথাও ভেবেছিলেন। ২০০০ সালে নারাণকুড়ির লোকজন দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাংলোটিকে সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন।
দ্বারকানাথের কারবারি জীবনে অন্যতম প্রধান ঘটনা এই কয়লা খনি স্থাপন। আজ দ্বারকানাথ না থাকলেও এই কয়লা আজও ভারতকে এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকদূর। ঠাকুরবাড়ির অন্যতম প্রধান ব্যবসা ছিল মদের ব্যবসা। এখনকার সময়ের থেকে অনেক বেশি মদ আমদানি হত সে সময়। ভারতবর্ষে যে বৃহৎ কোম্পানিগুলো মদের আমদানিকারক ছিল তার মধ্যে ‘কার টেগোর’ ছিল অন্যতম। দ্বারকানাথ তার অনুগত এক ব্যবসায়িক বিশ্বনাথ লাহাকে দিয়ে খুচরো মদের ব্যবসা করাতেন। তিনি লাহাকে ধর্মতলায় একটি মদের দোকানও খুলে দেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ পারিবারিক সূত্রে জেনেছিলেন দ্বারকানাথ প্রতিদিন রাতে ডিনারের পর এক গ্লাস করে শেরি পান করতেন। এছাড়াও বেলগাছিয়ার ভিলায় নাকি নিয়মিত মদের স্রোত বইত। জনশ্রুতি ছিল দ্বারকানাথ নাকি কলকাতা শহরকে মদের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এই কুৎসা ক্ষিতীন্দ্রনাথ এর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হওয়ায় তিনি বিদ্যাসাগরের কাছে গিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর বলেন, “আমি তাঁকে বিলক্ষণ জানি, এসব নিন্দুকের কথা।” প্রকৃত কথা হল তিনি দেখলেন যে দেশে মদের আমদানি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে তাই তার লভ্যাংশ যাতে ভারতীয়রাও পায় তাই তিনি তাঁর অনুগত বিশ্বনাথ লাহাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তখনকার দিনে বিভিন্ন সংবাদপত্রে দেখা যায় সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তিরা প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত মদের স্রোত বওয়াতেন। কিন্তু দ্বারকানাথের ভোজসভা নিয়েই এত কুৎসা কেন? ধরেই নিলাম ব্যবসায়িক চিন্তা থেকেই তার মদের ব্যবসায় আসা কিন্তু তিনি তো নিয়মিত মদ দেশের মানুষের কাছেই বিক্রি করেছেন। তাই বিদ্যাসাগরের কথায় সহমত পোষণ করা যায় না। দেশের লাভের থেকে তার নিজের লাভের দিকেই নজর বেশি ছিল। তার মদের ব্যবসা এতদূর বিস্তৃত ছিল যে এটা নিয়ে পালাগান ও রচিত হয়েছিল-
“কী মজা আছে রে লাল জলে,
জানে ঠাকুর কোম্পানি।
মদের গুণাগুণ আমরা কী জানি,
জানে কার ঠাকুর কোম্পানি।”
এই মদের উৎপাদন কী ব্যাপক হারে ছিল তা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। ঠাকুর কোম্পানির উৎপাদিত রাম ১৮২১ সালে ২৬০ টন জাহাজ ‘রেজোল্যুশন’-এ ভর্তি করে বুয়েনস আয়ার্সে যায়। লন্ডনে ১৮২৬ সালে কার ঠাকুর কোম্পানির নিজস্ব একটি জাহাজে করে ১৫০ টন মদ নিয়ে যায়। বেলগাছিয়ার ভিলায় নাকি একরাতের পার্টিতে এত মদের স্রোত বইত যা দিয়ে নাকি একটি এলাকা ভাসিয়ে দেয়া যেত।
বেলগাছিয়া নিয়ে পালাগান ছিল এমনঃ
“বেলগাছিয়ার বাগানে হয়
ছুরি কাটা চামচের ঝনঝনি।
খানাপিনার কত মজা,
আমরা কী জানি,
জানেন ঠাকুর কোম্পানি।”
কলকাতার বণিক সমাজ যখনই কোনও আর্থিক সংকটে পড়েছে দ্বারকানাথ এগিয়ে এসেছেন। দ্বারকানাথের অন্যতম সফল আরেকটি উদ্যোগ হলো ব্যাংক ব্যবসা। ১৮০৯ সালে ব্যাংক অফ বেঙ্গল ছিল একটি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান যার অধিকাংশই কাজে লাগানো হত যুদ্ধাভিযানে। ১৮২৪ সালে যখন ম্যাকিন্টস অ্যান্ড কোম্পানির তত্ত্বাবধানে খোলা হয় কমার্শিয়াল ব্যাংক, এর বোর্ড অফ ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর। দ্বারকানাথ বুঝেছিলেন ব্যাংক যদি কেবল কোনও ব্যবসায়িক কোম্পানির সুবিধার্থে হয় তবে তা বাণিজ্যে মদত দিতে পারবে না। ১৮২৮ সালে তিনি রমানাথ ঠাকুরকে নিয়ে খোলেন ইউনিয়ন ব্যাংক। মোট পাঁচশো শেয়ারে বিভক্ত বারো লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে ব্যাংকটি খোলা হল। প্রথম থেকেই এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হল। দ্বারকানাথের জীবনকালেই এই ইউনিয়ন ব্যাংককে কেন্দ্র করে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যের বিশাল বাজার। এছাড়াও দ্বারকানাথ বিমা ব্যবসাও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পালন করেছেন। ১৮২২ সালে দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠা করেন ওরিয়েন্টাল লাইফ ইন্সুরেন্স সোসাইটি। এই ব্যবসায় অংশীদার হিসেবে রাখলেন ফার্গুসন, ক্রাটেন, ম্যাকিন্টস তিনটি কোম্পানিকে। এই সোসাইটির কাজ ছিল সকল কোম্পানির কর্মকর্তাদের জীবন বিমা করা ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেয়া। ১৮৩৪ সালে দ্বারকানাথ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংককে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটি বর্তমানে নটিংহাম ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে আছে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন “বাংলার ব্যবসা বাণিজ্যের ইতিহাসে এটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কলকাতার যে সব নতুন প্রতিষ্ঠান সততায়, অর্থে, বিত্তে ও অভিজ্ঞতায় ইউরোপীয়দের সাথে দেশীয়দের সংযোগ ঘটাবে; আমরাই তাদের মধ্যে প্রথম অবস্থানে থাকব।”
ব্যাংক ও বিমা ব্যবসায় আমরা দ্বারকানাথকে প্রচুর বিনিয়োগ করতে দেখি। এই বিনিয়োগের পরিমাণ নেহাত কম নয়। নুন, নীল, রেশম, কয়লা সব ব্যবসাতেই তিনি টাকা ঢেলেছিলেন, পরিশ্রম করেছেন, লাভ নিয়ে ফিরেছেন। তবে এখানে আরেকটি কথা আছে আরও কোনও ব্যবসার রূপায়ণ কি তিনি করেছিলেন যাতে বিনিয়োগ নেই অথচ লাভ ষোলোআনা!! শোনা যায় ঠাকুর বাড়ির ব্যবসার একটি অন্ধকার দিক হল পতিতা ব্যবসা যা শুরু হয়েছিল রামলোচন ঠাকুরের হাতে। দ্বারকানাথের কলকাতা শহরে ছিল ৪৩টি পতিতালয়। তবে এই তথ্যের সত্যতা কতটুকু তার প্রামাণিক দলিল পাওয়া যায় না। তবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় পতিতা ব্যবসা থাকুক বা না থাকুক সোনাগাছিতে দ্বারকানাথের ৫৪ টি ঘর যেগুলো তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে রামলোচন ঠাকুরের থেকে পেয়েছিলেন। পরে দেবেন্দ্রনাথ এগুলো বিক্রি করে দেন।
দ্বারকানাথের নারী আসক্তি ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই আর এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় জার্মান পরিব্রাজক ও পর্যটক ক্যাপ্টেন লেওপোন্ড ফন ওরলিস এর লেখায়৷ তিনি যখন কলকাতায় আসেন তখন বেলগাছিয়ায় নিমন্ত্রিত হন। ভিলার প্রদর্শনী কক্ষে একটি ভারতীয় অভিজাত মহিলার ছবির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। দ্বারকানাথ তাকে গর্ব করে বলেন মহিলাটির প্রতি তার অনুরাগ সর্বজনবিদিত।
যাই হোক এগুলো এখানে উল্লেখ করার কারন হল পতিতালয়ের ব্যবসা ঠাকুরবাড়ির জন্য অস্বাভাবিক না। রামলোচন ঠাকুর নিজেও কলকাতার একজন বিখ্যাত শিল্প সমঝদার ছিলেন। তিনি প্রায়ই বাইজি বাড়ি যেতেন। দ্বারকানাথ কলকাতা থিয়েটারের একজন ভক্ত ও অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৮৩৫ সালে লসের কারণে চৌরঙ্গি থিয়েটার নিলামে উঠলে দ্বারকানাথ সেটি কিনে নেন। এই থিয়েটারের প্রধান অভিনেত্রী ছিলেন এক ইংরেজ সৈনিকের মেয়ে এথলার লীচ। শোনা যায় দ্বারকানাথ নাকি তাকে প্রলুব্ধ করার জন্য অশোভন পন্থা অবলম্বন করেন।
ঠাকুর বাড়ির প্রধান আয় আসত জমিদারি থেকেই। জমিদারি বলতে পরগনাসমূহ তো ছিলোই সাথে আরও কয়েকটি তালুক, প্রচুর জমিজমাও ছিল। রামলোচন ঠাকুরও একজীবনে আমিনের কাজ করে জলের দরে প্রচুর জমিজমা কিনেছিলেন। দ্বারকানাথও কিছুদিন আমিনের কাজ করেছেন। মূল প্রশ্ন হলো কেমন ছিলেন জমিদার দ্বারকানাথ? ব্লেয়ার বি কিং বলেছেন অন্য আর পাঁচটা জমিদারের মতো তিনি শুধু জমিদারি থেকে আসা আয় নিয়েই সন্তষ্ট থাকেননি, রীতিমতো পরিণত করেছিলেন ব্যবসায়িক মেশিনে। তিনি রায়তি প্রথায় জমিদারি চালাতেন যেখানে দয়ামায়া বলতে কোনও শব্দ ছিল না। এই রায়তি প্রথার দরুন ছোটবড় অসংখ্য কর প্রজাদের ঘাড়ে এসে পড়ত এবং সেই সাথে তাদের জমিতে রায়তের চাহিদামত ফসল উৎপাদন করতে হত। দ্বারকানাথ কখনোই প্রজাদের মা বাপ হতে চাননি। এছাড়া তিনি জমিদারি পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ সদস্যদের নিয়ে কমিটি বানিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে দ্বারকানাথ যদি আগুন হন কমিটি ছিল ঘি। এর উপর ছিল নীলের চাষ। দ্বারকানাথ তার জমিদারিতে প্রজাদের দিয়ে নীলের চাষ করাতেন।
সে সময় এ ব্যবসায় এত অত্যাচার করতে হত যে অনেক সময় দেশীয় লোকজন কোনও নীলকুঠির ম্যানেজার হতে চাইত না। তাই দ্বারকানাথ শাহজাদপুর পরগনা, রংপুরের স্বরূপপুর পরগনা, যশোরের তালুকে ইউরোপীয় ম্যানেজার রেখে নীল চাষ করাতেন। ১৮২৪ সালে বিহরামপুর পরগনার ১১৬ জন রায়ত অভিযোগ করে যে, জমিদার বাঁধ তৈরি করতে না দেওয়ায় বসতবাড়িতে জল ঢুকছে। দ্বারকানাথ দাবি করেন বাঁধ হলে জমি জলমগ্ন হবে এবং নীলের চাষ ব্যাহত হবে। ১৮৩৬ সালে যশোরের রায়তরা আবারও দ্বারকানাথের কর্মচারী নির্যাতন নিয়ে মামলা করেন। পরে দ্বারকানাথ যশোরের ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্ল্যাকমেল করে ঘটনা ধামাচাপা দেন। একটি গ্রাম থেকে যত খাজনা আদায় সম্ভব তার থেকে অনেক বেশি টাকায় দ্বারকানাথ নীলকরদের কাছে জমির ইজারা দিতেন। যেমন শাহজাদপুরের একটি গ্রামকে তিনি হিজবুল কনসার্ন নামে একটি নীল কোম্পানিকে দশ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু গ্রামের খাজনা কোনওভাবেই সাত হাজারের বেশি হওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া খাজনা না দেওয়ার দরুন শাহজাদপুর পরগনার তালুকদার শিবচন্দ্র ভট্টাচার্য ও তার পরিবারকে দ্বারকানাথ ভিটেছাড়া করেন। ১৮২১ সালে শিলাইদহে পদ্মার তীরে স্থাপিত নীলকুঠি প্রজাদের বহু হাহাকারের গল্প শোনায়।
দ্বারকানাথ তার জমিদারিতে নীলের সাথে আখের চাষও শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি চিনি উৎপাদন করতেন এবং ইউরোপে রপ্তানি করতেন। কার টেগোর কোম্পানি চিনি, নীল, রেশম, আফিম, রেশমের থান, আখ থেকে তৈরি রাম, চামড়া, কাঠ, সোডা, চাল রপ্তানি করত। এ সমস্ত কাঁচামাল দ্বারকানাথ সংগ্রহ করতেন জমিদারি থেকে। ১৮৩৩ সালে যখন চার্টার বা সনদের স্থায়িত্বকাল শেষ হয়ে যায় তখন দ্বারকানাথ জঙ্গিপুর, কুমারখালির রেশম কুঠিগুলো কিনে নেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ লিখেছেন, রেশমের চাষ ও গুটি উৎপাদন যারা করত তারা দ্বারকানাথের প্রজা ছিল। চীন দেশ থেকে ভারতবর্ষে প্রথম ওই গুটি রেশমের আমদানি করে কার টেগোর কোম্পানি। ১৮৪২ সালে দ্বারকানাথ প্রথম যেবার বিলেত যান সাথে করে রানির জন্য রেশম ও উপহার হিসেবে নিয়ে যান।
১৮৪২ সালের ১৬ জুন তিনি রানির সাথে প্রথম দেখা করেন। রানি দ্বারকানাথের একটি স্কেচও এঁকেছিলেন। নিচে লেখা ছিল Tagore Zamindar. রানি লিখেছেন, “লেফটেন্যান্ট ফিটজেরাল্ড এক ব্রাহ্মণকে নিয়ে এলেন, তার পরনে ছিল তার জাতীয় পোশাক। তিনি হাতে চুমু খেলেন।” রানির সুনজরে আসার সাথে সাথে লন্ডনের এলিট সোসাইটিতে দ্বারকানাথের অবাধ প্রবেশাধিকার হয়ে গেল। দ্বারকানাথের ব্যবসায় রানির সাহায্যের হাতটি কতটা প্রসারিত ছিল তা বোঝা যায়৷ মহারানি দ্বারকানাথের বংশমর্যাদার প্রতীক অনুমোদন করেন। ১৮৪২ সালে লন্ডন কলেজ অফ আর্মস-এ রেজিষ্ট্রিভুক্ত আছে সেই প্রতীক, নিচে লেখা, ‘WORKS WILL WIN’।
দ্বারকানাথের আরও একটি ন্যক্কারজনক ব্যবসা হলো আফিমের ব্যবসা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টার শেষ হয়ে যাবার পরেও তারা যেকরেই হোক আফিমের ব্যবসাকে ধরে রাখতে চাইছিল। ১৮৩০ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক গাঙ্গেয় সমভূমিতে আফিম চাষের জমি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হলে দ্বারকানাথ বাংলার জমি দখল ও ব্যবহার নাম দিয়ে হাইকোর্টে পিটিশন দিয়ে মামলা করেন। স্থানীয় মানুষের সমর্থনে দ্বারকানাথ জিতে যান এবং আফিম ব্যবসার অনুমতি পান। দ্বারকানাথ ব্যক্তিগতভাবে এতটাই স্বার্থান্বেষী ছিলেন যে ব্যবসার খাতিরে তিনি কখনও ইংরেজদের বন্ধু, পদলেহী, আবার তাদের বিরুদ্ধচারণও করেছেন। আফিম চাষের জন্য মামলা জেতার পর পাঁচ হাজার কৃষককে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং এই ব্যবসা দেখাশোনার জন্য একজন ক্লার্ক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়োগ করে একটি পূর্নাঙ্গ ব্যবসায়িক আঙ্গিক তৈরি করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রণীত ‘চীনে মারণ ব্যবসা’ তে দ্বারকা পৌত্র বিশ বছর বয়সে ইংরেজ সরকারের নিন্দা করে লিখেছিলেন যে ইংরেজরা আফিমের হীন ব্যবসাকে কূটনীতি ও ষড়যন্ত্রের সাহায্যে চীনদেশে কায়েম করে। সে সময় হয়ত তিনি জানতেন না তার দাদামশাইয়ের ‘এরিয়েল’ ও ‘মাভিস’ নামে দুটো জাহাজ নিয়মিত এ ব্যবসায় খাটত। দ্বারকানাথ যে মারণফাঁদ পেতেছিলেন তাতে একসময় তার পরিবারই আটকে যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী এই আফিম খেয়েই আত্মহত্যা করে।
দ্বারকানাথ ছিলেন একাধারে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিষয়ী। তিনি স্পষ্ট বুঝেছিলেন সামুদ্রিক জাহাজ যদি হুগলি নদীর মুখ পর্যন্ত ষ্টীমারের সাহায্যে টেনে আনা যায় তাহলে খরচ ও সময় অনেকটাই কমে যায়। সমুদ্র থেকে নদীপথে একটা পালতোলা জাহাজের আসতে সময় লাগত পক্ষকাল আবার সেই জাহাজ থেকে ছোট নৌকায় মাল তোলা হত, এতে শ্রমিকদের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় হত। সবমিলিয়ে ৮-১০ দিন সময় বেরিয়ে যেত। কিন্তু স্টীমার এই মালবাহী জাহাজ টেনে আনত দুদিনের মধ্যে। ম্যাকিন্টস কোম্পানি তাদের ফোর্বস নামক স্টীমার দিয়ে মালবাহী জাহাজ টেনে নদীমুখে আনত। ১৮৩০-৩৩ এর ব্যবসায়িক মন্দার সময় ম্যাকিন্টস কোম্পানির পতন হয়। দ্বারকানাথ নিলামে ফোর্বস কিনে নেন এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীদের এই জাহাজ টানার ব্যবসায় মনোযোগী করে তুলে খুললেন ‘ক্যালকাটা স্টিম ট্যাগ অ্যাসোসিয়েশন’। এই অ্যাসোসিয়েশনে বেশ কয়েকটি জাহাজ টানা স্টীমার ছিল। তার মধ্যে দ্বারকানাথের নিজের ‘দ্বারকানাথ’ নামের স্টীমারও খাটত। ব্লেয়ার বি কিং বলেছেন - ভারতবর্ষে ব্যবসা বাণিজ্যে এই অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা ছিল অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাসোসিয়েশন ছিল অংশীদারদের যৌথ কারবার। অথচ তার সমস্ত কাজ পরিচালনা করত একটি কোম্পানি সেটা ‘কার টেগোর কোম্পানি’। আরও কিছু উদ্যোগ তিনি জাহাজ ব্যবসায় নিয়েছিলেন যেমন ফ্লোটিং ব্রিজ প্রজেক্ট, বেঙ্গল বন্ডেড ওয়ারহাউজ অ্যাসোসিয়েশন, ক্যালাকাটা ডকিং কোম্পানি, বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি, স্টীম ফেরী ব্রিজ কোম্পানি, ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি। ক্যালকাটা স্টিম ট্যাগ অ্যাসোসিয়েশন ছিল জনহিতকর ব্যবসা। শুধুমাত্র এর কারণেই অনেকগুলো ব্যবসা ত্বরান্বিত হয়েছে। তবুও বিতর্ক যেন দ্বারকানাথের পিছু ছাড়েনি। স্টিম ট্যাগ অ্যাসোসিয়েশনের নাম লোকে দিয়েছিল ঠগ অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৩৬ সালে সমাচার দর্পন লিখেছে “আমাদের বাসনা বাবু দ্বারকানাথ এ নাম পরিবর্তন করবেন।”
১৮৩৩ সালে দ্বারকানাথ কতিপয় ইংরেজ বন্ধুদের সাথে বেঙ্গল স্টীম ফান্ড নামে একটি তহবিল গঠন করেন। ১৮৩৫ সালে ৫ জানুয়ারি ইংলিশম্যান কাগজ টাউন হলে একটি সভার রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে প্রস্তাব স্থির হয় ভারতীয় কোনও বন্দর থেকে সুয়েজ অবধি এবং আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কোনও ব্রিটিশ বন্দর অবধি এই ষ্টীমার লাইন স্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সফল না হওয়ার কারন ছিল লন্ডনের বণিক সমাজ।
দ্বারকানাথের কর্মজীবনের অন্তিমলগ্নে দেখা একটি স্বপ্ন হল ভারতে রেল চলাচলের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এই স্বপ্ন সফল সবার আগেই তিনি মারা যান। দ্বারকানাথ এতই দূরদর্শী ছিলেন যে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার সারাজীবনে তৈরি করা বিশাল ব্যবসায়িক সম্রাজ্য, প্রতিপত্তি সম্ভবত তার উত্তরসূরিরা আর ধরে রাখতে পারবে না। তাই ১৮৪০ সালের ২০ শে আগস্ট তিনি একটি ট্রাস্ট ডিড করেন, এই ট্রাস্টের অন্তর্গত ছিল কয়েকটি জমিদারি ও ঠাকুর বাড়ি। তিনি খুব বিচক্ষণতার সাথে তার উত্তরসূরিদের জন্য এমন ব্যবস্থা করে গিয়েছেন যাতে ব্যবসাগুলো পড়ে গেলেও জমিদারিগুলো টিকে থাকে এবং কমপক্ষে তিনপুরুষ খুব ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে। ব্যবসা পড়ে গেলেও যাতে খুব একটা অসুবিধা না হয় এ ব্যবস্থা যদি তিনি না করে যেতেন তাহলে হয়ত পরে তিন ভাইকে সবই হারাতে হত। দ্বারকানাথের কোনও পুত্র তথা তার আর কোন উত্তরসূরিই তার সমকক্ষ হতে পারেনি।
দেবেন্দ্রনাথ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন “আমি কাশী হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখি আমাদের হাউস কার টেগোর কোম্পানি টলমল করিতেছে। হুন্ডি আসিতেছে কিন্তু পরিশোধ করিবার টাকা জুটিতেছে না। এমন করিয়া কতদিন চলে? শেষে ১৮৬৯ সালে কার টেগোর কোম্পানির পতন হইল।” দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরেই নিভে গেল ঠাকুরবাড়ির ব্যবসার প্রদীপ শিখাটি। এই বিপর্যয়ের জন্য দ্বারকানাথকেই দায়ী করা হয়েছে। তিনি ব্যবসায় প্রচুর দেনা করেছিলেন এবং অতি বিলাসবহুল জীবনযাপনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিলেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন “দ্বারকানাথ জীবিত থাকিতে এই নিয়ে কোন প্রশ্নই কখনও ওঠে নাই।”
দেবেন্দ্রনাথ অবশ্য এটাই লিখেছিলেন, “তিনি (দ্বারকানাথ) তাহার দূরদৃষ্টি দিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে আমরা তিনভাইয়ের কেউই তাহার বিশাল কারবার ধরিয়া রাখিতে সমর্থ হইব না। তাই তিনি প্রথমবার বিলাতে যাবার পূর্বেই সব উইল করিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন।”
ইংল্যান্ডে দ্বারকানাথের খরচের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “বিলাতে থাকাকালীন তাহাকে প্রতিমাসে এক লক্ষ করিয়া টাকা পাঠাতে হইত। লোকে তাহাকে প্রিন্স বলিবে না তো কী বলিবে?”
দেবেন্দ্রনাথ এর কথা মত যদি ধরা যায় যে কারবারের দেনা ছিল সর্বমোট এক কোটি টাকা, পাওনা ৭০ লক্ষ, অর্থসংস্থান ৩০ লক্ষ। একটি বিস্তৃত চলতি কারবারে এই ঋণ তেমন কিছুই না। সেসময় সব মিলিয়ে ঠাকুরবাড়ির ব্যক্তিগত মোট সম্পত্তি ছিল কয়েক কোটি টাকার। আর দ্বারকানাথের সেসময় কোনও কারবারই লসে বা বন্ধ হয়ে ছিল না। সবগুলোই চলমান ছিল এবং নিয়মিত লাভ আসছিল। দেবেন্দ্রনাথের কথামত ঋণ হিসাব করলে মনে হবে যেন হঠাৎ করেই সব বন্ধ হয়ে গেছে। সে রকম তো কিছুই নয়। এতগুলো চলতি কারবারে তো দেনা পাওনা থাকেই। এটা তো স্বাভাবিক। ঋণ শোধ করতে কষ্ট হতে পারে কিন্তু সব ব্যবসা পড়ে গিয়ে ঋণ শোধ হবে এটা গ্রহণযোগ্য খুব একটা মনে হয় না।
ক্ষিতীন্দ্রনাথ এর লেখায় পাওয়া যায় “কার টেগোর কোম্পানি সহ সমস্ত ব্যবসা পতনের মূল কারণ ছিল একটা বৃহৎ কারবার চালাইতে গেলে যে পরিমাণ দূরদর্শিতা থাকা দরকার তার কোনটাই তাহার তিনপুত্রের কারো ভেতরেই ছিল না।”
দ্বারকানাথ তার পুত্রদের অপারগতার প্রমাণ যে বারবার পেয়েছেন তার প্রমাণ দেবেন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতেই পাওয়া যায় “আমার সকল বিষয় সম্পত্তি নষ্ট হয় নাই এতেই আশ্চর্য বোধ হয়। তুমি তত্ত্ববোধিনী লইয়া পত্রিকায় বাদ বিবাদ করিতে ব্যস্ত। গুরুতর বিষয় রক্ষা ও পরিদর্শন কাজ তুমি প্রিয় আমলাদের হস্তেই ফেলিয়া রাখ। ভারতবর্ষের উত্তাপ আবহাওয়া সহ্য করিবার শক্তি আমার নাই, যদি থাকিত অবিলম্বে লন্ডন ত্যাগ করিয়া তাহা নিজে পর্যবেক্ষণ করিতে যাইতাম।”
দেবেন্দ্রনাথ তার জীবনে সম্পত্তি বলতে শুধু ভুবনডাঙার মাঠে বিশ বিঘা জমি কিনেছিলেন। এটাই তার সারাজীবনে বৃদ্ধি করা সম্পদ। ১৯০৫ সালে দেবেন্দ্রনাথ এর মৃত্যুর সময় ঠাকুর বাড়ির বার্ষিক আর ছিল সবমিলিয়ে ৩,৬৮,৫০৯ টাকা। সরকারকে দেয়া খাজনা ও রাজস্ব বাদে থাকত ২,৩৪,৩১০ টাকা। এই আয়ের উৎসটুকুকে দেবেন্দ্রনাথ সমর্পণ করলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের আমলে ঠাকুরবাড়ির আয়ের উৎস বলতে সেই জমিদারিটুকুই।
রবীন্দ্রযুগে ঠাকুরবাড়ির ব্যবসা, জমিদারি, আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল দেখা যাক। দেবেন্দ্রনাথ মৃত্যুর বহু আগেই সম্পত্তির ভাগ করে যান। তিনি শেষ উইলটি করেন ১৮৯৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। এই উইল অনুযায়ী উড়িষ্যার জমিদারি পান দ্বিজেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথের পুত্র, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ পান শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর তিনটি পরগনা ও ছোট ছোট কয়েকটি তালুক। আর অপর দুই পুত্র সোমেন্দ্রনাথ, বীরেন্দ্রনাথ বায়ুরোগগ্রস্থ হওয়ায় তাদের পরিবারের জন্য মাসিক অর্থ বরাদ্দ করা হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ আপনভোলা, সত্যেন্দ্রনাথ চাকরি নিয়ে বাইরে থাকেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে নিয়মিত জমিদারি দেখতে গেলেও কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেন। তাই সমস্ত কিছু দেখাশোনার ভার রবীন্দ্রনাথ এর উপর এসেই পড়ে।
প্রভাতকুমার মুখার্জি লিখেছেন, “দেবেন্দ্রনাথের বয়স হচ্ছে, সত্যেন্দ্রনাথ বাইরে, দ্বিজেন্দ্রনাথ দার্শনিক, হেমেন্দ্রনাথ গতায়ু, সোমেন্দ্রনাথ বায়ুরোগগ্রস্ত, জ্যোতির সংসারে আর মন নেই, বাকি আছে রবি। তাই দেবেন্দ্রনাথকে রবির উপরের সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে হল। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সালে জমিদারির ভার গ্রহণ করলেন এবং পরবর্তী ৫০ বছর তা দক্ষতার সাথেই সামলালেন। তবে তিনি তার পিতামহের মত জমিদারিকে শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে নেননি। তিনি নোবেল প্রাইজের ১ লাখ বিশ হাজার টাকা জমা রেখেছিলেন পতিসর এগ্রিকালচার ব্যাংকে। তার প্রজারা এখান থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারতেন। ১৮৯৫ সালে শিলাইদহে টেগোর অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্থানীয় চাষিদের ধান, পাট কিনত এই কোম্পানি ও কলকাতায় বিক্রি করত। এর দায়িত্বে ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু ও কোম্পানির ম্যানেজারের দুর্নীতির ফলে প্রচুর টাকা ঋণ করে কোম্পানি বন্ধ করে দিতে হয়। শিলাইদহ সদর কাছারির মুন্সী শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর মতানুসারে জমিদারি ব্যবস্থার আদায়, তহসিল, জরিপ, জমাবন্দী, মামলা, হিসাব, শাসন সংরক্ষণ ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ব্যপারে বিধিবদ্ধ নিয়মাবলি নিয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিন পরগনার আয় ব্যয়ের হিসাব বরাদ্দ করা হত, এসময় কাছারির কর্মচারীদের মাসিক বেতন, পার্বণীর টাকা, যাতায়াতের খরচ, খোরাকির হার সবকিছু রবীন্দ্রনাথ নিজে অনুমোদন করতেন। এছাড়াও পরগনার আয় থেকে স্থাপিত হল দাতব্য চিকিৎসালয়। এখানে তিনজন বেতনভুক্ত ডাক্তারও নিযুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথই ভারতবর্ষে প্রথম যিনি হেলথ কো-অপারেটিভ চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন জমিদারিতে। ১৯১০ সালে জার্মানি থেকে আনান সার ও বীজ। পতিসরে গড়ে তোলেন আদর্শ কৃষিক্ষেত্র।”
রবীন্দ্রনাথই ভারতবর্ষে প্রথম ব্যক্তিদের ভেতর একজন যিনি জার্মানিতে আবিষ্কৃত রাসায়নিক সার আনিয়েছিলেন যা জমির উর্বরতা কয়েকগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। ১৯০৫ সালে তিনি নোবেল পুরষ্কারের অর্থ দিয়ে পতিসর কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। এই ব্যাংক কুড়ি বছর সুনামের সাথেই চলেছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি ছিল ভারতবর্ষে প্রথম কৃষি ব্যাংক।
দ্বারকানাথ যেমন জমিদারিকে মানি মেকিং এস্টেট করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন ওয়েলফেয়ার এস্টেট। হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথ তাদের পরগনায় যে ব্যবসাগুলো চালু করেছিলেন তা থেকে তিনি নির্দিষ্ট অংকের একটা লাভ পেয়েছেন কিন্তু তাতে শোষণের কোনও জায়গা ছিল না। ঠাকুরবাড়ির প্রত্যেক কর্তাই রামলোচন, দ্বারকানাথ এমনকি দেবেন্দ্রনাথও পিতার মতই জমিদারিকে খাজনা আদায়ের উৎসের বাইরে কিছু ভাবতে পারেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সবকিছুই ঊর্ধ্বে গিয়ে হয়ে উঠেছিলেন প্রজাদের অভিভাবক। জমিদারিতে শোষণ না চালিয়েও সেখানে ব্যবসা করে যে মুনাফা করা যায় তা রবীন্দ্রনাথ কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছেন।
ঠাকুরবাড়ির আরেকটি দিক আলোকপাত না করলে আমাদের এই রচনা সম্পূর্ণ হয় না। তা হলো ঠাকুর বাড়ির আর্থিক সংকট। ঠাকুর বংশের শুরু থেকেই আমরা দেখেছি সকলকে হাতে পায়ে খেটে বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে। পঞ্চানন ঠাকুরের আমল থেকে শুরু করে ঠাকুর বাড়ির ইতিহাস শুধু উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির ইতিহাস। এই শ্রীবৃদ্ধি সম্পূর্ণতা লাভ করে দ্বারকানাথের হাতে। আবার দেবেন্দ্রনাথের সময় থেকে ব্যয় সংকোচের প্রচেষ্টা দেখা যায়। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনযাপন ছিল তখনকার দিনে কিংবদন্তিতুল্য। তার ঋণের বোঝা ঠাকুর বাড়ির বৈভবে যে এত বড় আঘাত হানবে তা হয়ত তিনি ভাবতেও পারেননি। যদিও ঋণের ব্যপারে অধিকাংশ তথ্যই পাওয়া যায় না। তথাপি দ্বারকানাথ হয়ত ভেবেছিলেন তার উত্তরসূরিরা সবকিছু সামলে হয়ত ঘুরে দাঁড়াবে৷
দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরই প্রথম তার ঋণের কথা শোনা যায়। আর এর উপর তার মধ্যমপুত্র গিরীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বিষয়টি অন্ধকারেই থেকে যায়। কারণ গিরীন্দ্রনাথই দ্বারকানাথের ঋণ শোধে অধিকতর ভূমিকা রেখেছিলেন। যাই হোক আমরা দেবেন্দ্রনাথকে দেখি চারিদিক থেকে ব্যয় সংকোচন করতে। দেবেন্দ্রনাথ আহার, বিহার, সংসার সমস্ত কিছুতেই অর্থের সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন। ছেলেদেরও সবসময় সংযমী জীবনযাপনে উৎসাহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, “আমার বিয়ের কোনও গল্প নেই। আমার বিয়ে যাতা করে হয়েছিল।” রবীন্দ্রনাথের বিয়ের খরচ ছিল মাত্র ৩২৮৩ টাকা ৩ পাই। বিয়ের উপহার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীকে দিগম্বরী দেবীর পৌনে ২১ ভরির দুটো হার দেয়া হয়। এত কম আয়োজনে ঠাকুরবাড়ির বিয়ে কখনও হয়নি। রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনাকালীন মাসিক মাসোহারা পেতেন ৩০০ টাকা। এই নিয়েই তাকে চলতে হত। টেগোর অ্যান্ড কোং এর ফলে তাকে অনেক বড় আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। পতিসরে কৃষি ব্যাংক ১৫ বছর বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ব্যাংকটি উঠে যায়। রবীন্দ্রনাথ তার মেয়েদের বিয়েও খুব সাধারণভাবে দিয়েছেন। জামাতাদের বিলেতে ব্যরিস্টারি পড়ার খরচও তাকে নানাভাবে জোগাড় করতে হয়েছে। এই আর্থিক সংকটের কারণে ধীরে ধীরে ঠাকুরবাড়ি থেকে দ্বারকানাথের সমস্ত চিহ্ন সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়। দেবেন্দ্রনাথের বিশাল সংসারের দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্রনাথের কাঁধে। সত্যেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মিলে শুরু করেন ষ্টীমার ব্যবসা। সে ব্যবসাতেও সম্পূর্ণ লস হয়। তাদের গ্যারেন্টার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই ব্যবসার সমস্ত দেনা এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কাঁধে। দ্বিজেন্দ্রনাথ, বীরেন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ সকলের সাংসারিক খরচ সামলানোর দায়িত্ব ছিল রবীন্দ্রনাথেরই। এত কিছু সামলেও জমিদারি নিজের উত্তরসূরিদের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে সামলে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের পরেও জমিদারি চলতে থাকে। কিন্তু নিয়মিত না যাওয়ার কারণে অনেক ঋণ হয়ে যায়। শেষে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে ঠাকুরদের প্রায় ২৫০ বছরের জমিদারির অবসান ঘটে।
রবীন্দ্রনাথের মূল্যবোধ, দ্বারকানাথের অসৎ উপায়ে অর্জিত বৈভবকে মানতে পারে না। তাই হয়ত এই কলুষকে নির্মল করতেই তিনি সব দলিল পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।
দ্বারকানাথের ব্যবসার আলো আধারির জগতে আর সম্পূর্ণ ভাবে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। যা টিকে আছে তা লোকশ্রুতি, সত্য মিথ্যা মিশ্রিত মিথ ও পারিবারিক সদস্যদের মুখে শোনা। তবে দিনশেষে ঠাকুর বাড়ির ব্যবসার কালো আকাশে রবির কিরণ ঢেকে দেয় সব অন্ধকার। তাই তিনি বলেছেন
“যখন রব না আমি
মর্ত্য কায়ায়,
তখন স্বরিতে যদি হয় মন
তবে তুমি এস হেথা নিভৃত ছায়ায়,
যেথা এই চৈত্রের শালবন।”
………………
তথ্যসূত্রঃ
১/দ্বারকানাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী -ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
২/Partner in empire by Blair B king.
৩/ঠাকুরবাড়ির ব্যবসা-সুমনা দাসদত্ত।
৪/মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৫/ডারলিং ডোয়ার্কি-রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়।
৬/Memories of Dwarkanath Tagore by Krishna kripalini.
৭/ঠাকুরবাড়ির গোপনকথা-রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়।
৮/ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল-চিত্রা দেব।
৯/রবিজীবনী-প্রথম খণ্ড -প্রশান্তকুমার পাল।
১০/রবীন্দ্রজীবন কথা-প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
No comments:
Post a Comment