পর্ব- এক
সকাল বেলাটা এমনিতেই খুব তাড়াহুড়োর সময়। কোনওমতে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ঠেলে গুঁজে তৈরি করে নাকেমুখে কিছু দিয়েই গাড়িতে গিয়ে উঠা। মাথায় গিজগিজ করতে থাকে সারাদিনের অসংখ্য সব ঘটিতব্য ড্রাফট, মিটিং, ডেডলাইন, নোটশিট আর বিভিন্ন প্রজেক্টস। বেলা দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিসিয়াল টাইম। এরমধ্যে নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত থাকেনা। যমরাজ এলেও তাকে বলতে হবে, প্লিজ একটু ওয়েট করে যান। এটা অফিসিয়াল টাইম শুভব্রতর। তারপর আন-অফিসিয়াল টাইম চলে প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত। হাতের কাজ অনেকটা সেরে তারপর চেম্বার না ছাড়লে পরের দিন আর কোনওভাবে ম্যানেজ করা যাবেনা। সব মিলিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই বিষ্ণুপুর ব্লকে বিডিও হিসেবে জয়েন করার দিনটি থেকে এই তিনমাসে একটা দিন নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়নি ও।
রুমা বউদি এসে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। অফিস বেরোবার সময় তড়িঘড়ি ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসেছে শুভ। দাঁতে টেনে টেনে ডিম পাউরুটি ছিঁড়ে জল দিয়ে গেলে।
“আঃ ওটা কী খাওয়া হচ্ছে! চিবিয়ে খাও না!” রুমা বলে।
“ঊ ঊ ঊ ...টাইম নেই ...” শুভ পাউরুটির মণ্ড গিলতে গিলতে বলে।
“শোন শুভ, প্রতিদিন আমি তোমার এই টাইমের অজুহাত শুনব না কিন্তু। আজ ঊর্মি আসছে। তোমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতেই হবে। এর আগে দু’দিন তুমি মিস করেছো। আজ না এলে আমার মান সম্মান থাকবে না।” রুমা চোখ পাকিয়ে আঙ্গুল তুলে বলে।
“বউদি, তোমাদের যখন এতই পছন্দ তো বিয়েটাই দিয়ে দাও না সরাসরি। আমি তিনদিনের ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে নিচ্ছি, শনি রবি নিয়ে পাঁচদিন হয়ে যাবে। ঝামেলা খতম। রোজ রোজ এই ঝঞ্ঝাট আর ভাল লাগেনা।” শুভ টেবিল থেকে উঠে পড়ে মোজা পড়তে পড়তে বলে।
ভীষণ রেগে যায় রুমা। মুখ ভারী করে বলে, “দেখো সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করো না। বিয়েটা কোনও ইয়ার্কির ব্যাপার নয়। মেয়েটাকে তোমার একবার অন্তত দেখা উচিত। আর সেই বা কেন রাজি হবে এভাবে না দেখে ...”
“সে যখন দু’দিন ফেলিওরের পর আবার তিনদিন তোমার দেওরকে দেখতে আসতে রাজি হয়েছে তখন ছবি দেখেই কাজ চলে যাবে। তাছাড়া আমার ইনফো তো সবই দিয়েছো তুমি। পাত্র আমি খারাপ নই ...” এবার জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলে যায় শুভ।
শুভর দাদা তপোব্রত বাথরুম থেকে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। তার এত তাড়া নেই। মহিলা কলেজের ফিলসফির অধ্যাপক। ধীরেসুস্থে খেয়েদেয়ে পান চিবোতে চিবোতে ক্লাস নিতে যাবে। ক্লাসের সময়ও এক এক দিন একেকরকম। হুড়োহুড়ি ব্যাপারটাই নেই ওর চরিত্রে। ভাই এর ঠিক উলটো। বউ এর গোঁজ মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে, “আবার কী সব যা তা কথা বলে রাগাচ্ছে তোমাকে? তুমি যাও কেন ওর ব্যাপারে কথা বলতে?”
“দেখনা, বলছে দেখাশোনার দরকার নেই, একবারে বিয়েটাই ঠিক করে ফেলতে। ঊর্মি যেন জলে ভেসে এসেছে। যেন ওর একবার ইচ্ছে করে না শুভকে দেখতে ...”
তপোব্রত গম্ভীর হয়, “তুমি এত করে সম্বন্ধ করছ আর তোমার দেওর এইসব বাজে কথা বলছে? দরকার নেই ওর জন্য কিছু করে। তোমার যখন এতই ঘটকালির শখ তো আমার জন্যই আরেকটা মেয়ে দেখ। ঊর্মিকেও দেখতে পার। আমার অনেক টাইম আছে। আমি ঠিক দুটো বউ সামলে নিতে পারব।”
রুমা প্রথমে ভাবছিল ওর বর সত্যি সত্যি ওর দিক টেনে কথা বলছে। এবার ঠাট্টাটা বুঝতে পেরে আরও রেগে গিয়ে ধ্যাত বলে ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। আর শুভ হাসতে হাসতে ব্যাগ কাঁধে বাইরে এগোয়। বারান্দার কোলাপসিবল টানার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসে, “বউদিইইই বাআআই… চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি ফিরতেএ এ এ...”।
কথাগুলো শুনতে পেয়ে রুমার মুখে এবার একটু হাসি ফোটে। ও যেদিন থেকে এই বাড়ি এসেছে, একেবারে সরাসরি গিন্নীর পোষ্টটাই পেয়ে গেছে। দু’ভাই এর সংসার, অগোছালো, রমণীবিহীন। এদের ঠিকমত দেখাশোনা করার কেউ নেই। শুভব্রত অবশ্য একথা মানে না যে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। বরং কথায় কথায় বউদিকে রাগাতে বলে ওঠে, “আমরা দুই ভাই আগে কী ভালোই না ছিলাম! এক আত্মা এক প্রাণ। দাদা ভাত নামালে আমি ডাল রাঁধতাম। দাদা ডিমসেদ্ধ করলে আমি খোসা ছাড়াতাম। আর দাদা আলুসেদ্ধ করলে আমি তাতে তেল নুন দিয়ে আচ্ছা করে চটকে মাখতাম। কই কোনদিনও তো খাওয়ার অসুবিধে হয়নি। বরং শর্টকাটে হয়ে যেত সব।” এই সব কথা শুনলে রুমা যত রেগে যায় শুভ তত হেসে হেসে বলে, “এখনই যত ঝঞ্ঝাট হয়েছে। সকালে লুচি আলুর দম খাও, দুপুরে মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল, কাতলা কালিয়া খাও, বিকেলে ফলের ঝুড়ি শেষ কর, রাত্রে গুচ্ছের আনাব সানাব খেতেই হবে। কোনও পার্সোনাল টাইম নেই বাড়ীতে। অফিসের নিত্য দেরি হয়ে যায়।”
এমন ভাবে বলে শুভ যেন দাদার বিয়েটা হয়ে মহা মুশকিল হয়েছে ওর। যেন মাসের পর মাস আলুসেদ্ধ ডিমসেদ্ধ ভাত খেতে পাওয়াটাই পরম আনন্দের ছিল ওর কাছে। এইসব আগডুম-বাগডুম যত বলে, রুমা ততই রেগে ওঠে। সে একটু ছেলেমানুষ টাইপ। তাকে রাগানো সোজা। এটা বিয়ের পর খুব তাড়াতাড়িই দু’ভাই টের পেয়ে গেছে।
খুব বেশি রেগে গেলে রুমা নালিশ করতে যায় বরের কাছে, “তুমি কিছু বলবে না শুভকে? ও আমাকে বউদি বলে মানছে না, যা খুশি তাই বলছে। এবার কিন্তু আমি ভীষণ রেগে যাচ্ছি।”
তপোব্রত বইয়ে মুখ গুঁজে বলে, “কী করছিস কি শুভ? আমি কি তোর জ্বালায় বউ নিয়ে বাড়িছাড়া হব? দেখছিস ভীষণ রেগে যাচ্ছে, তোর আলু ডিমসেদ্ধ এবার বন্ধ কর। এত এত ভাল খাবার পাচ্ছিস, কষ্ট হলেও খেয়ে নে সোনামুখ করে।”
“ওহ… আমার রান্না নিয়ে টিটকিরি হচ্ছে! দু’ভাই সমান শয়তান। খাও তোমরা আলুসেদ্ধ ডিমসেদ্ধ। আর যদি কাল কিছু রান্না করি তোমাদের জন্য!” রুমা রেগে রেগে আবার গিয়ে রান্নাঘরেই ঢোকে। যতই রাগ করুক আর যাই বলুক, বিকেলবেলার জন্য মাছের চপের পুরটা শেষ করে রাখতে ভোলে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এই শেষ। আর কোনদিন কিচ্ছু বানাবে না এই দুই ভাই এর জন্য। তারপর আবার পরদিন সকাল হলেই ভুলে যায় আগের দিনের প্রতিজ্ঞা। আবার মেতে ওঠে নতুন কোনও রেসিপি নিয়ে।
নিজের বিয়ের পরদিন থেকে এই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে রুমাকে। তপোব্রতর বিয়ে করার কোনও প্ল্যানই ছিলনা। দু’ভাই এর জীবন দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। দুম করে রানাঘাটের পিসিমা ডেকে বসল মাথার দিব্যি দিয়ে। ছোটবেলায় বাবা মা একসঙ্গে অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার পর বাবার এই পাতানো বোন অনেকদিন পর্যন্ত দেখে রেখেছিল তাঁর আদরের তপু শুভুকে। সে অনেককাল আগের কথা। শুভব্রতর এতটা ফিলিংস না থাকলেও তপোব্রত মাঝে মাঝেই পিসির খোঁজখবর রেখে এসেছে স্বাবলম্বী হওয়ার পরেও। তবে কালে দিনে সব নিজের সম্পর্কই আলগা হয়ে যায়। এ তো কোনকালে বাবার পাতানো বোন। দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। ওই পালে পার্বণে ফোনেই প্রণাম সারা, এইমাত্র। হঠাৎ সেই পিসি ফোনে হুকুম দিয়ে বসলেন এখুনি তপুকে একবার রানাঘাট যেতে হবে। শুভব্রত শুনে হেসেছিল।
“তুইও চলনা সামনের রবিবার। সকালে গিয়ে বিকেলেই চলে আসব।” তপোব্রত ভাইকে বলেছিল। শুভব্রত তখন বিসিএস পাশ করে গেছে। পুলিশ ভেরিফিকেশনের অপেক্ষায় আছে। সে প্রবল মাথা নেড়ে বলেছিল, “ক্ষেপেছো নাকি দাদা? দেখবে হয়তো সেদিনই ডি আই বি থেকে লোক এল বাড়ীতে”
“দূর… রবিবার ওদের আসতে বয়ে গেছে।”
“না না আমি যাচ্ছি না। তুমি একাই ঘুরে এস।”
যায়নি শুভব্রত। তপোব্রত গেল। কিন্তু সেদিন আর ফিরতে পারল না। সেদিন কেন, পর পর তিনদিন সে ফিরল না। ভাই এর ফোনের উত্তরে বলল, গিয়ে সব বলছি। আসলে যে উদ্দেশ্যে পিসি ডেকেছিল সেটা সম্পূর্ণ সফল। পিসি তাঁর ননদের মেয়েকে তপোব্রতকে দেখানোর জন্য এত তাড়া দিয়ে ডেকে নিয়ে গেল। আর সেই মেয়েকে দেখে চিরকালের উদাসীন মহাদেব তপোব্রতর ধ্যান ভঙ্গ হল পুরোপুরি। বয়সে প্রায় আটবছরের ছোট ছেলেমানুষ স্বভাবের মেয়েটাকে ভাল লেগে গেল তপোব্রতর। একদিন দু’দিন করে তিনদিন পিসির আদর খাওয়ার নাম করে তার সান্নিধ্য উপভোগ করে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছিল ও। রুমা ভাল মেয়ে। যেন তপোব্রতর জন্যই ওর এতদিনের শিবপুজো করা, ভাবটা এরকমই ছিল। এরপরে বিয়ে হতে আর দেরি হয়নি। পিসিকেও ভাইপো মানুষ করার একটা প্রতিদান দিতে পারা গেছে ভেবে তপোব্রত খুশী। আর সবচেয়ে খুশী হয়েছে বোধহয় শুভব্রত। রুমা বয়সে ওর চেয়েও বছর দুই এর ছোট। দাদার বিয়ের তো কোনও আশাই ছিলনা এতদিন। এখন একই সঙ্গে বউদি, বোন আর বন্ধু পেয়ে শুভব্রত বেঁচে গেছে। সারাক্ষণ পেছনে লাগা, খুনশুটি করার এমন সঙ্গী একসাথে মেলা দুর্লভ। সেই দুর্লভ আনন্দটা শুভ দিনেরাতেই পেয়ে থাকে। কিন্তু সার্ভিস জয়েন করার পর তার সময়টা হুট করে অনেকটা কমে গেছে। ইন ফ্যাক্ট শুভব্রতরও ধারণা ছিলনা বিডিও পোষ্টটা এতটাই টাইম ডিমান্ড করতে পারে। তাহলে নির্ঘাত ওর অপশনটা পালটে যেত। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। শুভব্রত তাই মনপ্রাণ দিয়ে নিজেকেই পালটে নিতে চেষ্টা করছে। তারই প্রথম ধাপ হল জীবনের আর সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু ওই চেয়ারটাকেই আঁকড়ে থাকা।
এর মধ্যে আবার রুমা বেশ কিছুদিন থেকে বায়না ধরেছে, এবার দেওরের বিয়ে দেবে। সে মনে করে বড়ো বউদি হিসেবে ওরই দায়িত্ব দেওরের একটা ভালমতো বিয়ে দেওয়া। শুভকে অনেকবার করে জিজ্ঞেসও করেছে তার নিজের কাউকে পছন্দ আছে কিনা। কিন্তু ওরা দু’ভাই চিরকাল শুধু বই মুখে করেই বড়ো হয়েছে। কোন মেয়ের দিকে মন দেওয়ার অবসরই পায়নি অথবা সেটার কোনও প্রয়োজনবোধ করেনি। শুভর ক্ষেত্রে কথাটা আরও বেশি সত্যি। কম্পিটিটিভ এক্স্যামে বসবে ঠিক করার পর থেকে তো ওর জীবনে শুধু একটাই শব্দ ছিল, বি সি এস। পুরোপুরি নারীবর্জিত জীবন যাকে বলে। সব দেখে শুনে এবার শুভর ঘটকালি করার দায়িত্বটা রুমা নিজেই নিয়েছে। তপোব্রতরই এক ছাত্রী ঊর্মির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কোনও এক বিয়েবাড়ীতে। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা, তারপর ফোনে, হোয়াটসআপে, ফেসবুকে বন্ধুত্ব। রুমা সেই ঊর্মিকেই পছন্দ করে রেখেছে দেওরের বউ হিসেবে।
তপোব্রতকে জিজ্ঞেস করে হ্যাঁ বা না কিছুই বোঝা যায়না। রুমা যাই বলুক যাই করুক ওর যেন একটা অপত্যস্নেহ কাজ করে বউ এর ওপর। কিন্তু যখন রুমা সিরিয়াস কোনও কথা বলতে আসে বরের কাছে তখন এতে ওর মন ওঠে না। ও কিছুটা বেশি গুরুত্ব আশা করে এবং প্রায় সময়েই তা পায় না। যেন রুমার সবকথাই হাসিঠাট্টার বিষয়। কিন্তু তাই বলে হাল ছাড়লে তো চলবে না। শুভ বেরিয়ে গেছে। এবার ধীরে সুস্থে ওর দাদা খেতে বসবে। রুমা ভাত বাড়তে বাড়তে ঠিক করে এটাই তপোব্রতকে নিজের দলে টানার সঠিক সময় এবং আজ ও কিছুতেই কোনও কথাতেই রাগ করবে না। বরং ভেবেচিন্তে বেশ বিচক্ষণের মত কথা বলবে। সেই প্রস্তুতি স্বরূপ রান্নাঘর থেকেই মুখটা গম্ভীর করে ফেলে রুমা।
আজ ডিমভরা ট্যাংরার ঝাল করেছে। সঙ্গে আলুপোস্ত। শুভ সকালে তাড়াতাড়ির সময় এসব খায় না। ওর খাবার তাই হটকেসে পুরে দিয়ে দেয় রুমা। কিন্তু ওর দাদার খেতে বসতে বেশ কিছু দেরি হয়। তাই সে আলাদা করে ভারী কোনও ব্রেকফাস্ট না করে গুছিয়ে ভাত খেয়ে নিয়েই কলেজ যায়।
ডাইনিং টেবিলে ভাত জল দিয়ে সামনের চেয়ারে বসে গম্ভীরমুখে রুমা অপেক্ষা করছিল। তপোব্রত এসে বসে। দুটোই ওর প্রিয় পদ। মুখটা একটু উজ্জ্বল হল কি? রুমা আড়চোখে খেয়াল করে। কিন্তু অন্যদিনের মত তড়বড় করে কিছু বলে ওঠে না। আজ ও প্রতিজ্ঞা করেছে সিরিয়াস ভাবে কথা বলবে। শুভর বিয়েতে তপোব্রতর মত করিয়েই ছাড়বে।
কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখা কী যে কঠিন! মনের মত আলুপোস্ত পেয়ে একজন খেয়েই চলেছে। ও যে এতক্ষণ ধরে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে থাকা যে কী কষ্ট তা কি ও জানে? একবার জিজ্ঞেস করবে না রুমা কেন চুপ করে আছে? আশ্চর্য! এবার সত্যি সত্যি রাগ হতে শুরু করে রুমার। কীভাবে শুভর কথাটা পাড়বে বুঝতে পারে না। এদিকে আলুপোস্ত শেষ হয়ে ট্যাংরার বাটিতে হাত পড়েছে। দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে তপোব্রত আয়েশ করে খাচ্ছে। রুমা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। সুগৃহিণীর মত জিজ্ঞেস করে, “আর একটা মাছ দিই?”
শেষ মুঠো ভাতটা মুখে পুরে এবার এতক্ষণের যত্নে বাঁচিয়ে রাখা মাছের ডিমটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে তপোব্রত বলে,
“আর কখন বলবে?”
“কী?” রুমা চমকায়।
“শুভর বিয়ের কথা বলবে তো? শুরু করে দাও। আর আধঘন্টা। তারপরেই কিন্তু আমি বেরিয়ে যাব।”
হাতও গুনতে জানে নাকি কে জানে! তবে রুমার মনের প্রতিটা ভাব ভঙ্গী ভাবনা যে ধরে ফেলতে পারে একথা বিলক্ষণ। এবার বেসিনের কাছে গিয়ে কুলকুচো করতে করতে তপোব্রত বলে, “একটা সামান্য কথা বলার জন্য এত প্রিপারেশান নিতে হচ্ছে? সেই থেকে হাঁড়ি মুখ করে বসে আছ। তোমার কোন কথাটা আমি শুনি না? বল, বলে ফেলো।”
প্রতিজ্ঞা ভুলে এবার তড়বড় করে ওঠে রুমা, “অতই যখন আমার কথা শোনো তো ভাইকে বোঝাচ্ছ না কেন? মেয়েটা তো খারাপ নয়! তোমারই ছাত্রী ছিল। তুমি তো তাকে কলেজে দেখেছো। বাড়ীর অবস্থা ভাল, দেখতেও ভাল। এম এ বি এড করেছে। এস এস সি পরীক্ষাও দিয়েছে। পাশ করলেই চাকরি ...”
হাত মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পড়া সারা তপোব্রতর। এবার রুমার হাত ধরে খাটে এনে বসায়। নিজেও পাশে বসে।
“শোন, বিয়েটা হল ভবিতব্যের বিষয়। এটা মানো তো?”
হ্যাঁ তা মানে বৈকি রুমা। খুব বেশি করেই মানে। নইলে কোথায় রানাঘাট আর কোথায় টালিগঞ্জ। এই মানুষটাকে জীবনে কোনদিনও ওর পাওয়ার কথা ছিল কি? কিন্তু মুখে সেকথা স্বীকার করে না। গোঁজ হয়ে বলে, “শুধু ভাগ্যের ওপরে ছাড়লে কি ভাগ্যদেবতা এসে বিয়েটা দিয়ে যাবে? মানুষকে চেষ্টা করতে হবে না? তোমার পিসিমা যদি তোমায় না ডেকে পাঠাতেন তাহলে যেতে তুমি রানাঘাট?”
অকাট্য যুক্তি। তপোব্রত অস্বীকার করতে পারেনা মনে মনে। গত পঁচিশ বছরের মধ্যে ও রানাঘাটে যায়নি। সত্যি যদি পিসিমা ডেকে না পাঠাত তাহলে যেতও না। অথচ গেল বলেই এই মেয়েটা এমনভাবে জুড়ে গেল জীবনের সঙ্গে যে আজ আর ভাবাই যায় না যে কোনদিনও ছিল না এই বাড়িতে।
বরকে চুপ করে থাকতে দেখে রুমা খানিকটা উৎসাহ পেয়ে যায়। হাতটা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলে, “ঊর্মিকে একবার দেখুক শুভ। ভাল না লাগলে তো আর আমি জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি না। তুমি ওকে একটা ফোন করো কলেজ থেকে। বলবে যেন অন্তত ছ’টার মধ্যে বাড়ি আসে আজ। আর তুমিও চলে এস। বলনা … আসবে তো?”
এই কাঁধে মাথা রাখা আধো গলার বায়নার কাছে অটল থাকবে এমন পুরুষ এই পৃথিবীতে খুঁজলে মাত্র দু’একজনকেই পাওয়া যাবে। তপোব্রত সেরকম নয়। সে বউ এর আহ্লাদী মুখটা ভাল করে চোখে বুকে ভরে নিয়ে একঝুড়ি কথা দিয়ে তবে কলেজমুখো হয়। মনে মনে ভাবে করবে নাহয় ভাইকে একটা ফোন। সত্যিই যদি ওর কোনও বিশেষ পছন্দ না থাকে তাহলে তো এই মেয়েটাকে দেখাই যেতে পারে। আর বিয়ে না করে থাকাটা তো কোনও কাজের কথা নয়। বরং বিয়ে যে একটা কতবড়ো সুমধুর ব্যাপার তা এখন জানে তপোব্রত। রুমা যদি বায়না ধরেই দেওরের বিয়ে দিয়েই ছাড়বে তাহলে তাকে কোনও দোষ দেওয়া যায়না অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জিবরং সেটা ওর গুণ। আজকালকার বেশিরভাগ মেয়েই সাধ করে সংসারে নিজের ভাগীদার আনতে চায়না। সেদিক থেকে এই বায়নাটাকে রুমার বড় গুণ বলেই ধরতে হবে।
তপোব্রত মনস্থির করেই নেয় যে এবার সে নিজেও সিরিয়াসলি ভাইকে বিয়ের কথাটা বলবে।
পুরোপুরি তৈরি হয়ে পায়ে জুতো গলাতে গলাতে রুমার গালটা টিপে দিয়ে বলে, “যাই বল আর তাই বল, এই মুখটা কিন্তু গম্ভীর থাকলে একদম মানায় না। আর এত কষ্ট করতে যেও না।”
এই লোকটা সব বুঝে যায়। চুপ করে থাকলেও সবদিকে ওর নজর। কিছু ওর কাছে লুকোনো যায় না। দরজা বন্ধ করতে করতে ভাবে রুমা। গালে টোল ফেলা ছোট্ট একটা হাসিতে ভরে থাকে ওর মুখ। মানুষটা বয়সে অনেকটা বড়ো হলে কী হবে, আদরটা ভালই করতে জানে। সেইবেলায় পুরুষ সিংহ। ভাগ্যিস রানাঘাটে এসেছিল। নইলে রুমার কী হত! নিজের সৌভাগ্যে আরেকবার নতুন করে খুশী হয়ে এবার শোওয়ার ঘরে মোবাইলটা নিয়ে উপুড় হয়। ঊর্মির নম্বর লাগিয়ে ফোনটা কানে চাপে।
“ঊর্মি? হ্যাঁ শোন, আজ তুই প্লীজ পাঁচটা নাগাদ চলে আয় আমার বাড়ী। না না আজ মিস হবে না। শুভ কথা দিয়ে গিয়েছে, ছ’টার মধ্যে ফিরবেই। আহ… রাগ করিস না প্লিজ...। ওর চাকরিটা তো বুঝবি! সারা ব্লকের সব দায়িত্ব ওর ওপর। তাছাড়া যখন তখন এস ডি ও, এ ডি এম, ডি এম মিটিং ডেকে দিচ্ছেন। চাইলেও ও তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে না ...। আরে বাবা আগে থেকেই এগুলোর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট না করলে পরে কী করবি? তাহলে আসবি কিন্তু। আমি ওয়েট করে থাকব। বাই...”
আজ ঊর্মি একটু হুল বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে কথা বলছিল। সত্যিই তো মেয়েটার রাগ হতেই পারে। আগে দু’দিন শুভ আসব বলে আসতে পারেনি। আজ নিশ্চয়ই সেরকম করবে না! রুমা বেশ খুশীমনে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে ভাবতে থাকে কী কী স্ন্যাক্স তৈরি করবে বিকেলের জন্য।
(চলবে)
……………………
অলঙ্করণঃ- সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
শুরুটা বেশ লাগলো। পরের পর্ব কবে পাবো?
ReplyDelete